কবি হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়
কবি হীরক বন্দ্যোপাধ্যায় |
কবি হীরক বন্দ্যোপাধ্যায় আশির দশকের কবি ।কুড়িটির বেশি কাব্যগ্রন্থ । সমস্ত বাণিজ্যিক এবং লিটল ম্যাগে তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে । অর্ধশতাধিক পুরষ্কার পেয়েছেন এই কবি ।কবিতা ছাড়া ছোটগল্পের ও উপন্যাসেরও বই আছে এই জনপ্রিয় সাহিত্যিকের ।
কবি হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশিত হল :
কে, কোথায়, কী জন্যে ?
***
কে কোথায় নেমেছিল ?কে কোথায় উঠেছিল ?
কে কতটা বড়ো, কে কতটা ছোট হতে হতে
পাতালগুহায়...প্রেমে যার পড়া হয়নি
অথবা এক প্রেম থেকে অন্য প্রেমে
ক্ষণিকেই লাফিয়ে লাফিয়ে চলে গেছে অনন্তে
আকাশে অজস্র ডালপালা
হাট থেকে বিকেলে ফিরে আসা ক্রেতা বিক্রেতা
কার গলায় উঠলো মালা
কার গলা থেকে খসে পড়ল
সন্ধ্যায় প্রত্যুষে গোধূলিবেলায়
ওরে বাবা এসব প্রশ্নের উত্তর কি থাকে কোনো কবির কাছে...
বেশ, ঝগড়া থাক বরং চুপি চুপি আমরা
জায়গা বদলাবদলি করি
গ্রীষ্ম গেলে বর্ষা আসবে
বর্ষা গেলে শরৎ মা দুগ্গা আসবেন
লকডাউন উঠবে কি....
মোহভঙ্গ
***
নাক গলাতে গলাতে নাকের আর অস্তিত্ব নেই
ছ্যাতা মুখ পর্যন্ত ভোতা হয়ে গেছে
উচ্চাশা মুখ বন্ধ করেছে
যতক্ষণ পর্যন্ত না মোহভঙ্গ হয়
মোহ মানে মাথার মুকুট সব সময় জ্বল জ্বল করে ধক্ ধক্ করে
মোহ মানে ফিসফিসে গলা শুধু লোভ দেখায়
আর লোভ দেখায়...
বলে আয়,আয়....
আধখানা পর্দার আড়ালে নধর যমুনা যে বয়ে যায়...
তবু ফের গাছে ফুল আসছে বোল আসছে
জলে হামলে পড়ছে ছায়া
ধানের বুকে দুধ আসছে
পদ্ম শালুক বলছে লক্ষ্মী তোমার হাতে বীণা আছে? রাজহাঁস ? নাকি সব ই তোমার বোনের কাছে গচ্ছিত রেখে এসেছো ?
ভয়ংকর অসুখ
***
প্রতিদিন এক খেলা থেকে আরেক খেলায় যেতে
যেতে শিহরিত হতে হয়
তার পর খেলতে খেলতে সারাটা শরীর রক্তাক্ত হয়ে গেলে সমানুপাতিক খুনি হওয়ার পালা শেষ হয়, তখন চাদরে বালিশে রক্ত লেগে থাকে
ভালবাসার নামে কিছু মিথ্যাচার হয়
কিছু অক্ষমতা
অতলান্তিক স্তোত্র ও মন্ত্রপাঠে
মুখরিত হতে থাকে সময়
তখন মনে হয় বিষে নীল হয়ে যাওয়াই বুঝি
প্রকৃত সুন্দর...
দ্যুতিময় অথচ চারপাশে মুখরা শব্দের ওড়াওড়ি
দেখে মনে হয় আজ পৃথিবীর ভয়ংকর অসুখ...
ভাত
***
রাতে রুটির বদলে ভাত-ই আমার পছন্দ
তা যদি জল ছাকা হয়
তাতেও সই
আমি যে ঘর থেকে উঠে এসেছি
সেখানে খিদেই আমাদের তরকারি
মাছ-মাংস দূর অস্ত
মুগ কিংবা মুসুর কিচ্ছু চাই না
শুধু একটু আলু সানা
তার সঙ্গে আজ শুকনো লঙ্কা ভাজা হবে মা
আহা নৈসর্গিক আনন্দ
দেখো আমিও একদিন বিশেষ্য ও সর্বনাম নিয়ে
ঠিক সৌরভ গাঙ্গুলি হয়ে যাবো...
তারণ
***
এখন আমার চারপাশে অজস্র রাজহাঁস
আমি মমি হয়ে শুয়ে আছি পিরামিডের ভেতর
লক্ষ লক্ষ তারা তুমি বিশ্বাস করবে না
ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে হতে
একসময় বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল
সেই থেকে আমার নাম হল তারণ...
পৃথিবীর ওপারে যে বিস্ফোরণটা ঘটলো এই মাত্র তার জন্য আমি দায়ী
হ্যা, আমি... আমাকে ওরা দেখে নেবে বলেছিল
দেখতে দেখতে কখন যে ওরা অন্ধ হয়ে গেছে
আমি বুঝতেই পারিনি...
শুধু বৃষ্টি ও রোদ্দুরকে বলেছি
যাচ্ছ যখন বলো
ওদেরও মঙ্গল যাতে হয়...
কোথা থেকে শুরু করবেন
***
কোথা থেকে শুরু করবেন তা আপনাকেই ঠিক করতে হবে, কিছুটা ধূপছায়া কিছুটা নিয়ন্ত্রণ
অবশ্যই থাকবে ব্যক্তিগত স্মৃতিস্তম্ভের পাশে
হাততালি যদি দিতে হয় আপনাকেই দিতে হবে
কিছুটা অসংবিধানিক হলেও শুরুটা আপনার হাতে শেষটা নয়...
যে যা বলছে বলুক ওদিকে কান দেবেন না
বুদ্ধ কী উপদেশ দেবে ,শংকর মোহাম্মদ প্রোফেট প্রাকৃত না পালিতে
সেসব তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়
কোলগেট স্ক্যাম ,চিটফান্ড কেলেঙ্কারি বা আই পি এল বেটিং.....সমবেত হুল্লোড় করোনা আমফান প্রকৃত সুন্দরের কাছে গিয়ে
সব সপ্তমব্যঞ্জন ,তালপুকুরের থোকা থোকা
কচুরিপানা ,আপনি যা চান তার
শেষ দেখে ছাড়তে হবে ,আপনার মনে হবে
যেভাবে আগায় লিবিডোর নীল
যেভাবে তৃষ্ণার দহন
লেলিহান খিদে
প্রকৃতি কাউকে বিমুখ করে না
শুধু একটু ধৈর্য্য একটু সহিষ্ণুতা আর একটু ঋজুতা বিষাদ পাপবোধ যন্ত্রণা
বজ্রাসন কূটকলা পেরিয়ে দেখবেন আপনার ঝলসে যাওয়া পৃথিবীতে ঠিক বৃষ্টি নামবে
কিন্তু তার ও আগে আপনাকে ঠিক করতে হবে কোথা থেকে শুরু করবেন
আচ্ছা আমি বলছি
মায়ের বাপের বাড়ি থেকে না হয় শুরু করুন...
এইবারটা ...
নতুন সম্পর্ক
***
নতুন সম্পর্ক এলে এগিয়ে যেতে হয়
গানের মানুষ আমরা মোচ্ছবে মোচ্ছবে দিন কাটে দু'চারটা কবিতা লিখে খায়,তাতে কার কি এসে যায় ,বাউল ফকির হয়ে মাঝে মাঝে গৌর
গোসাই আলখাল্লা টুপি খুলে ফেলি
কেউ কেউ আসে ঝড়ের বেগে হীরে মাণিক ফুল
কেউ এসে দাঁড়ায় প্রকাশিত ঝর্ণায়
আসে যায় দ্বিখণ্ডিত
চোখে চোখ গহন রং মাখা
আহা যেন বিভাবরী
বাতাস থমকে যায় মেঘে মেঘে মীরার ভজন
এঘর সেঘর ঘুরে দু'মুঠো সম্পর্ক এসে পড়ে ঝুলিতে,গানের মানুষ আমরা
নতুন নতুন সম্পর্ক এলে ভুলে যেতে হয়
দু'চারটা কবিতা লিখি বলে
এগোতে হয় আরেক সম্পর্কের দিকে....
কথার উপর
***
কথার উপর কথা রাখায় দায়
শব্দ দিয়ে বানায় ঘর-বাড়ি
যেই না দুয়ার আলগা হলো
আজ ভাব কাল আড়ি
আড়ি তবু ইমেল আসে
কাগজ ফুলের পাপড়ি উড়ে ঝড়ে
বোধন শুরু হলেই গান বাজে
পতঙ্গ যে আগুনে পুড়ে মরে
সামনে কত বয়ে যাওয়া নদী
সামনে কত অবাক লাগা চোখ
কেই দেখছে শীতের ঘন রোদ
তুমি বললে সবার ভালো হোক
কিছু কিছু জিনিস ধরা ছোঁয়ার
কিছু কিছু মানুষ আছে খাটি
ইচ্ছে ছিল জ্যান্ত নদী হবো
জন্ম থেকে শুধুই দেখি, মাটি
শোক
***
যে যার মতো নতুন দৃশ্য দেখে
নতুন বাক্যের খোঁজে
মাথা কুটে মরে অমলকিশোর
বিষের সঙ্গে
ও পান করে
কেউ কেউ, এদিকে তখন রহস্যের মহড়ায়
জীর্ণ পাতা খসে পড়ে, কেউ তা বোঝেনা
ঝরে যায়, যেমন যায় দিন রাতের গহনে
নদীর ওপারে কেউ কেউ সুখের সাগরে গিয়ে ভাসে শব্দে স্বপ্নে সত্যে তার নেশা লেগে যায়
যে যায় কমলেকামিনী দর্শন করে ফেরে না কেউ
যে যার মতো বিষ ও অমৃত পান করে
কখনো কখনো আয়নার পারদ মেখে
কেউ কেউ ঘরে ফিরে দেখে
নিষ্প্রদীপ ঘরগুলি ছিন্নমস্তার মতো
মুছিয়ে দিচ্ছে শোক...
মিথ্যে
***
আমি জানি ঐ মুখে এখন আর কোনো মিথ্যে লেগে নেই তবু মানুষের তো কৌতূহলের সীমা পরিসীমা নেই, জাল ফেলে দাঁড়িয়ে থাকে
হাতে নাতে ধরবে বলে কত বন্ধু স্বজন
নির্নিমেষ চেয়ে থাকে তালদিঘীর পারে
কে যেন বলল লোকটা নিরূপদ্রব ছিল
তবে বৃত্তের বাইরে যেতে পারতো না কখনো
কোথা থেকে কথা ভেসে আসে
...মনে রাখবেন দেশটার নাম ভারতবর্ষ
কবির মুখে কোনো মিথ্যে লেগে থাকে না
একথা কেউ জোর গলায় বললো না
এটাই যা আফশোসের ...