কবি জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়
কবি জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন ২৫শে জুলাই ,১৯৫৯ সালে বাঁকুড়ার কুশমুড়ি গ্রামে ।
পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় ও মাতা কুসুমকুমারী দেবী । কবি প্রাণীবিজ্ঞানে সাম্মানিক স্নাতক,শিক্ষাবিজ্ঞান ও বাংলায় স্নাতকোত্তর, বি.এড.।
তিনি গোসাবার শম্ভুনগর,দমদমের কৃষ্ণপুর আদর্শ বিদ্যামন্দির,নদিয়ার নগরউখড়া হাই স্কুলে শিক্ষকতা এবং জুজুড় হাই স্কুলের প্রধানশিক্ষক হিসাবে কর্মজীবন সম্পূর্ণ করেছেন।শিক্ষকতাকে তিনি নিছক পেশা না ভেবে অনেক বেশি কিছু ভাবতে ভালোবাসেন।
স্কুলজীবনেই তার লেখালেখির শুরু। অজস্র কবিতা,গল্প,প্রবন্ধ,আলেখ্য,সমালোচনামূলক লেখা,কয়েকটি নাটক এবং একটি অসম্পূর্ণ উপন্যাস তিনি লিখেছেন । কবির
তাঁর বেশিরভাগ লেখাই দেশ-বিদেশের অজস্র নামি ও অনামি পত্রিকায় প্রকাশিত।
কবির প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ -অভীষ্ট শব্দের উজানে(২০১১),ত্রিভুজ সংক্রান্ত সমীকরণ (২০১৮)এবং অণুগল্প সংকলন -- অণু অম্বুবান (২০১৮)।এছাড়া বেশ কয়েকটি যৌথ সাহিত্য সংকলনে লিখেছেন।
তার সম্পাদিত পত্রিকা : তন্বী (১৮৭৭-৭৮), দোলা (১৯৭৭-৭৯), স্বচ্ছন্দ (১৯৭৮-৮০)।
প্রাপ্ত পুরস্কার ও সম্মাননা : অনামী সংবর্ধনা ও পুরস্কার(২০১০),অণুগল্পের জন্য বর্ধমান জাগরণীর পুরস্কার(২০১১),অণুপত্রীর পুরস্কার(২০১১),সোপান সাহিত্য পুরস্কার(২০১৩),স্পর্শ সম্মাননা(২০১৩),ভোরাই সম্মাননা(২০১৮),আলোর জোয়ার সম্মাননা ও পুরস্কার(২০১৯),বেলদা মহা সাহিত্য আড্ডা(সম্মেলন) -এর সাহিত্য রত্ন সম্মাননা -- ২০১৮,লোককবি এনামুল আলি খান স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার -- ২০১৯,তুলি কলমের আকাশ সম্মাননা -- ২০২০ ইত্যাদি।
কবি জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশ করা হল:
বাইশে শ্রাবণ
***
দ্যাখো অই ঝিলিমিলি পাতাগুলি জলছুঁই স্বপ্ন মেখে তিরতির কাঁপে
সকালের মেঘছায়া আলো বেয়ে ভাবনার কিছু কলি মুখ মেলে শ্রাবণবাতাসে।
ঘুম ভেঙে মৃদু সুরে গেয়েছিলো কয়েকটি পাখি কোন রাগে কে জানে?
মিশেছিল বেদনা কি তাতে প্রিয়জন হারানোর ব্যথা ভাঁজেভাঁজে লেগেছিল কিছু
মায়ারাতে বেজেছিল টান নগণ্য মাত্র দিন বিশেষ গেরুয়া রঙে ছিলো কি মহান?
এদিনের শপথ কিছু থাকে দৃঢ় নয় নরম তুলোর মতো তিরতির বড়োই কোমল
যারা সব ধরে থাকে আসর সাজায় ফুলে ফুল ভোলেনা সময়ের স্রোত খণ্ডকাল
যারা হয় কালের রাখাল তারাই জ্বালিয়ে রেখে দীপশিখা ডাকে আজ সেইদিন এসো
মর্মমূলে টান দিয়ে দ্যাখো,খুলে যাবে স্মৃতির কপাট কবির জন্য নীরব সময়ে ধ্যানে বসো।
মাখনের স্পর্শসুখে চোখ মেলে ফুল শব্দ নয় কিছুটা সময় ছবি নাও তৃতীয় আঁখির ভিতর
চেতনার গভীর থেকে টেনে নাও শুভ্রকলি সুগন্ধজারিত প্রেম মুগ্ধতাবিভোর
কানেকানে কথা নয় খানিক নৈঃশব্দ্য কিছুটা বা অস্ফুট গুঞ্জরন তাঁর কাছে ধার করা
বাণী তাঁর সুরে চেতনার রাখি এসো বাঁধি আমাদের প্রাণে কবিকে আমরা যারা সবেতেই
নির্দ্বিধায় কেবলই জড়িয়ে বেঁচে থাকি।
আমার আকাশ
***
আকাশের কয়েকটি নক্ষত্রকে আর
দেখা যায়না।তারমানে এই নয় যে
আমি আর আকাশ দেখিনা।
কত ফুলে ভরা ওই সীমাহীন মাঠ
দেখতে দেখতে এখনো আমি সেইসব
প্রিয় নক্ষত্রদের খুঁজি।
হেমন্তে ঝরা নীলফুলগুলির জন্য
কুয়াশার সিঁড়ি বাঁধি।
তারপর হিম পড়ে শীত নামে বাগানে
বার্ধক্য জাগে হারানো গাছে ফুল
ফেরে না জানি ভুল স্বপ্নে জাগি রাত।
নক্ষত্রের ছাই টাইগ্রিসের হাঁটুজলে
হারানো মন্ত্র নিয়ে নীচু আমার আকাশ।
সর্পিল
***
তুমিতো বুঝেই গ্যাছো অনিদ্রার সুখ
দু'একটি ত্রিকোণ নিয়ে জ্যোৎস্নাবিলাস
সহস্রার চক্র থেকে ছায়াপথে ছোটা
সোনালি মাটির নিচে নবীন ফারাও
কফিনে কফিনে বাজে প্রাচীন তৈজস
অচেনা ভাষায় কোন সা রে গা মা সাধা
চাঁদ ডাকে এসো,শকুনের শিশু যদি তান ধরে,
ক্লান্ত মায়ের চোখে কেবল আগুন
পেশাদার ঠোঁট আর পায়ের মিলন
তামাটে ধুলোর ঝড়ে ঢেকে যায়.......
সুখ হাসে পাকদণ্ডী পথ ঘাতকের বেশে
তার খঞ্জরে মাখা মধু ও মাখন.........
লীলা
***
আপনি ডানহাত তুললে ততটা আকাশ
জানি আর কারও নয়।
আপনি বাঁহাত বাড়ালে অভাগাদের
চোদ্দপুরুষও ধন্য
লীলা শুধু লীলা সমুদয়।
সৌন্দর্যের বালাই তোলা অনর্থক
বুদ্ধির সূক্ষ্মতা ভাবাও মহাপাপ
যুক্তির কথা ভেবে লাভ কী?
তবু কার বেয়াড়া মন বিপথে ফেরে!
ভয় আছে ওপথে মরণ।
লীলা আর লীলা মোহন খেলা
খেলা ছেড়ে বসে গেলে পথের পাতা।
ভালো ভূত,মন্দ ভূত
***
বন্যা জলের উজান বেয়ে ফাঁদের কাছে যাই
আসলে ফাঁদ জাল টোপ বঁড়শি পলুই খালুই ......
শব্দগুলোয় বেশ যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব তারপর
হঠাৎ কখন শিকারি নিজেই শিকার হয়ে যায়।
হয়তো বাধা টপকানো সম্ভব নয় যদি না একটি
ভালো ভূত কাউকে টানে আর বাঁধ পার হলেই
খানিক জীবনের ঢেউ হাসিমুখ হাওয়া।
কোনো ভালো ভূতের সঙ্গে মন্দ ভূতের ভাব সম্ভব নয়
তারা ঠিক পাশের প্রতিবেশি পাশ শ্যাওড়ায় বাস।
প্রথম জন দ্বিতীয় জনকে খোঁচাতে যায় না অপিচ
দ্বিতীয় জন প্রতিপদে প্রথমের পথ কেটে খুশি।
অন্ধকারে মন্দভূতের মাতন বন্ধ চোখে বাঁচার আশা
ভালো রা কি লুকিয়ে নিল মুখ? কালোর ভেতর আলোর
জেগে ওঠা তার আশাতে ধন্দ নিয়ে জাগি।
অঘ্রান
***
সোনার মতো ধানে নবান্নের ঘ্রাণ
পাখি আর প্রজাপতির চঞ্চল পথে
আমাদের চোখদুটি বাঁধা
শিশিরের শব্দে কুয়াশা জড়ায়
পরপূর্ণ সম্ভার ছেড়ে আমাদের
ধানখেতগুলি রিক্ত মুখ কারুণ্যময়
মধুময় রোদে দুচারটে স্মৃতি বাজে
নদীতীর ছেয়েছে সবুজ
স্থিরজল শালুকের বুড়োবেলা
পিতামহীর ক্লান্তিতে ছেড়েছে সরণি ।
ভুল - ১১
***
তুলোর মতো তুলতুলে ফুল ডাকে
কাশবনে ঝাঁপ দিতেই তারা সাঁ-সাঁ
বাতাস কেটে বললো, থামো থামো
তুমি তো আমাদের প্রেমিক নও .....
আমি এক ভুল মৌমাছি মধু নয়
সারা গায়ে ভাদ্রের সরব আগুন
ব্যর্থ মুখ আদিম মানব হয়ে দাঁড়িয়ে
আমাদের কত শততম পূর্বপুরুষের মতো
কে জানে ? কে জানে !
বিদায়
***
দেখা হবে রাগিণী যাপনে ঝিরিঝিরি বর্ষাবেদনায়
ভাদ্রের বেলা পুড়ে ছাই মুখ ভাসে মেঘের ভেলায়।
তরঙ্গে পুলক লাগে যদি খুশিমুখ ডেকে নেয় গানে
বন জুড়ে পাগল বাতাস মৌমাছি বলে কানে কানে,
যাও কেন? এই ছিলে বেশ পাতা ফুল বাতাসের মতো
মিশেছিলে মন প্রাণ দেহে সময়ের ভাঁজে অবিরত।
তবে তুমি একটু বোসো বড়ো চেনা জলাশয় ছুঁয়ে
ঢেউগুলি বেদনার ভারে ভেঙে যাবে শরীর নুইয়ে।
এরপর যদি যেতে চাও পশ্চিমে দিশা ঠিক করে
যাও তবে বিজয়ীর বেশে জয়ধ্বজা ডানহাতে ধরে।
শিখন
***
ঝড়ের স্বরলিপি শেখার জন্য
মেঘের কাছে যাবেন না
যাবেন সমুদ্রের কাছে
সমুদ্রের বিশাল বুকে তরঙ্গ উদ্দাম
তার কোনো কোনায় খ্যাপা যুবকের
বিরহ-বিক্ষোভের নিম্নচাপ জমে
ডুবুন সেখানে জানুন সেই সরগম
এরপর মেঘের কাছে শিখুন দীপক রাগ
তন্তুর ভাঁজে ভাঁজে লিখে দিন জাল্লিকাট্টু
নয়তো বাদনা পরব উন্মত্ত ষাঁড় বা কাড়ার
আস্ফালনের উচ্চচাপ আঁকুন
ঝড়ের তুলিতে অবশ্যই যন্ত্রণা দগ্ধ রঙে
তা রক্ত হতেই পারে !
মুক্তি
***
অযৌক্তিক উত্থানের গণিত মেলাতে মেলাতে
ছেড়ে যাই মহাশূন্য অফুরন্ত আলস্যের ওমে
ঢেকে নিই যত ব্যর্থ স্বপ্ন জাল্লিকাট্টুর জাল ছিড়ে কি
দৌড়ায় খ্যাপা ষাঁড় সমস্ত কর্ষ ছিঁড়ে টানের বাইরে
ভাসি ওজনহীন মেঘ দানবীয় দূরবিন পর্দায়
খুঁজে নেবো কেবল হাসিখুশি ফুলেদের মুখ কোনো
অত্যাচারী বা অত্যাচারিতের মুখ দেখবো না আর
নিরালম্ব সুখ আকাঙ্ক্ষাহীন প্রেমে অপরিমেয়
কাল ভাসা রূপগ্রন্থিময় পুলকপালক ঢাকা পাখি
হয়তো তুমি বলবে নির্বাসন বিভ্রম বলতেই পারো
আমি জানি মুক্তির অন্য নাম নির্বাণ পরিনির্বাণ।
বেশ তো ভালোই আছি-২
***
বেশ তো ভালোই আছি কাঁটার জ্বালায়
বেশ তো ভালোই আছি দারুণ খরায়
বেশ তো ভালোই আছি স্বজনের মারে
ভালোলাগা ফেরি করি দুয়ারে দুয়ারে।
বেশ তো ভালোই লাগে বিদ্রুপবাণে
বেশ তো ভালোই কাটে দারিদ্রদহনে !
বেশ তো ভুলেই থাকি ভুলসুর গানে
ভালো আছি আমি জানি,কজনই বা জানে ?
আমি আর আমাদের ক্ষয়ে আসা বৃত্তে
ঝোল টানা কোল পানে দ্বিধাহীন চিত্তে।
সেরা কাজ বুঝে নিয়ে ঘোলাজলে ঝম্প
সেরা যারা তারা দেয় অকাতরে লম্ফ !
বেশ তো ভালোই আছি মনে মনে জানি
যদিও অযোগ্য বলে হয় কানাকানি !