কবি সোনালী মিত্র
কবি সোনালী মিত্র |
কবি সোনালী মিত্র জন্মগ্রহণ করেন ১৯৮৬ সালের ১৮ ই নভেম্বর নবদ্বীপ নদীয়ায়। এম এ পাশ করার পর কিছুকাল স্কুল শিক্ষকতায় নিযুক্ত থাকলেও বর্তমানে দিল্লিবাসী । লেখালিখি শুরু সেই স্কুল পত্রিকা থেকেই । বর্তমানে বহু পত্রিকায় লিখে চলা। সাহিত্য মূলক পত্রিকা 'মায়াজম' এর হোতা তিনিই। প্রিন্ট এবং ওয়েব দুটি ভার্সনেই প্রকাশ হয়ে থাকে পত্রিকাটি । 'স্পর্ধাকাল' তার একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ।
কবি সোনালী মিত্রের একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশ হল :
বিজ্ঞাপনের তুমি
***
বিজ্ঞাপনে প্রথম দেখেছিলাম তোমায়
হলুদ আলোয় প্রেমচাতক খিদে মসৃণ হয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিল
রোমহীন বুকের হোডিং ঘেঁষে
কৌপিন জেদী মিশাইল যুদ্ধরত উন্মাদনায়
পুরুষাকারকে উজাগর করে ছড়িয়ে দিচ্ছিলে চূড়ান্ত
আভিজাত্য নাকি অহঙ্কার !
দুরাত ঘুমাতে পারিনি আমিও,আকাশের উপর দাঁড়িয়ে
তোমার আকাশ ছুঁতে চাওয়া ভঙ্গিমা দুডানা মেলে দিয়ে
এত কামনীয় তুমি ! এত ঐশ্বর্য কোথায় রাখ পুরুষ !
যেন গ্রিক কারুকলা,যেন বিশ্বকর্মা শ্রেষ্ঠ সৃষ্ট এগিয়ে আসছে
ঝুম চাষের নেশায়
শীতকালীন গমবোনা রোদ্দুরে এস প্রেমিক হয়ে উঠি
তোমার ড্রয়ার জাঙ্গিয়া রঙিন বিজ্ঞাপনে
যদি ধরে নিতে পারি বাস্তববর্জীত তুমি...
অনুশাসন
***
গোঙানিটা শুনতে পেলেই বুঝতে পারি,
বাবা এবার ছিটকিনি তুলে বাথরুমে বোনকে শাস্তি দিচ্ছেন।
তখন মা রান্নাঘরে পেঁয়াজ কাটায় অনাবশ্যক ব্যস্ত হয়ে পড়েন ।
অনাহুত এক ভয়ে জোরে জোরে আমি মানচিত্রে,
দেশের নাম মুখস্থ করতে থাকি। যতটা সম্ভব জোরে।
অদ্ভুত ভাবে আমি ও শাস্তির মধ্যে এক বটগাছ তফাৎ থাকতো।
শাস্তি পাওয়ার পরে,
বোনের রক্তচাপ কমে যেতো, রক্তগতির মধ্যে ভুগতো
রোগা শরীরে। হাঁটতে পারতো না ঠিক মতো। ভয়ঙ্কর এক জ্বরে রাতেরবেলা বোন কিসব বিকার বকতো।
দু'বছর হল বাবা মারা গেছেন।
বোনটা পাড়ার বখাটে ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়ে বেঁচেছে।
নাকি মরেছে কে জানে !
সামান্য ভ্রান্তিতে আমিও শাস্তি দিই বাথরুমে ছিটকিনি তুলে।
মায়ের গোঙানির শব্দ ধবধবে সাদাফ্লোরে চাপ
চাপ দাগ হয়ে জমে থাকে।
ক্লাসরুম
***
জ্যোৎস্না দিদিমণির বয়স বাড়ে না।
ব্ল্যাকবোর্ডে জলের সমীকরণ এঁকে কি অবলীলায়
ভেঙে দিতে থাকেন অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেনের মহাজাগতিক সঙ্গম।
তামাম গোঁফের রেখায় তখন ছেলেদের টিফিন বেলার খিদে
পার্থিব সংকেত ভুলে দিদিমণি গুছিয়ে নেন তার পিনকরা
আঁচলের টুকরো অসুখ।
ছেলেরা মুগ্ধ চোখে দেখে নীল শাড়ির আড়াল থেকে চোরাগোপ্তা নাভিসমুদ্রের গর্জন
ওরা জানে, চক্ষুসুখের জ্যোৎস্না গড়িয়ে যাবে তাদের
সন্ধ্যাকালীন ভৌতবিজ্ঞানের দিকে।
ঘন্টা পড়া বাকি। ছেলেরা একে একে পড়া বলবে ভবিষ্যৎ হতে চেয়ে ।
দিদিমণির রিং টোনে "ভালবেসে সখী নিভৃত যতনে" বাজতে থাকবে অনায়াস।
ক্লাসে সবাই জানে জ্যোৎস্না দিদিমণির ছাদ ফাটিয়ে একটা বটগাছ উঠে গেছে
দাম্পত্য বিচ্ছেদের আকাশ ছুঁয়ে
যার বয়সের হিসাব রাখে না স্কুলের জারুল গাছ।
মণিকা আন্টি–বয়ঃসন্ধির ফুল
***
সামনেওয়ালি খিড়কি,
ঘুমদুপুরের বাড়িঘর, ঘুমের পরীরা ঘুমিয়ে থাকে।
পাশের বাড়ির ছেলেটার চোখে তাক করা থাকে দূরবীন, গোলাপী নেশার দিকে ।
ঝাঁঝাঁ দুপুরের রোদ ভেঙে চোখে এসে বসেন খাজুরাহো সুন্দরী
শরীরে তার শিলাচিত্র চৌষট্টিকলা শৃঙ্গার।
নতুন গজানো গোঁফের রেখায় ঘামের বিন্দু
পিপাসার দেবী ঘাম চাটেন, চেটে বুঝতে চান
পুরুষঘাটে কোথায় থাকে এত খুনখারাপি !
দূরবীন দুপুরের খোলা জানলায় খেলা করে,
মনিকা আন্টির মেয়েলি সাবানের বুদবুদ উড়ে যায়
পিঙ্ক টাওয়েলের বার্বিডল, দেবদাসী স্তনের স্থিতাবস্থায় এসে প্রজাপতি দোল খায়
খসে পড়ে নাভিসুতো, মেয়েলি আস্তরণ...
ফিনফিনে পর্দাগুলো হাওয়ায় নাচে।
ভারি হয়ে ওঠে পুরুষদ্বীপ।
দরদর ঘাম গলে,ছেলেটির হাত ভরে যায় গলে পড়া রোদ্দুরে,
উঁকিটুকি খেলায় জনলারার ফর্দারা নিষিদ্ধ খিদেয় ভোগে।
মনিকা আন্টির খোলা নাভিতে অপূর্ব জলমন্থনে -
ছেলেটি, কিশোর থেকে যুবকের দিকে দৌড়য়...
ক্যানভাস
***
পুটুস, আকাশ দেখে
আমি পুটসের বন্যসোহাগ দেখি
শ্যামলা গড়নে ভাঁজ-পড়া কোমরে অসংলগ্ন কাপড় খুঁজি
বুনোশূকরের মাংসের পোড়া ধোঁয়া,মহুয়ার যুবতীপূর্ণিমায়
পুটুস মাদিবাঘ হয়ে ওঠে, হিংস্র দাঁতে ছিঁড়ে খায় হাড়-মাংস
এইসব দেখি আর লুকোনো শিকারিদের মতো
ক্যানভাসে টুকে রাখি হরিণের বিশ্বাসী দৃষ্টি
পুটুসের মাটিবুকে নিটোল ডুমুরের-ফল আছে ,
আমি পুটুসের আদিমজঙ্গলের ঘাসপালা দেখি , চিবোই
চিবোনোর ফলসরূপ রস থেকে তৈরি হয় রং
রসের মহিমায় আমার ক্যানভাসে জেগে ওঠে এক প্রত্ননারী
জ্যোৎস্নাবনে সে এক অদ্বিতীয়া জ্যোৎস্না , সামান্য নখের আঁচড়ে
ভেঙে যায় সে
এগজিবেশন সৌন্দর্যের সমস্ত সার্চলাইটটুকু কেড়ে নেয় পুটুসমণি
আমি দর্শকের মুগ্ধতা ও নিলামের দর ধরে থাকি
কালো রং থেকে আমার পুটুসরানি কর্পোরেট সভ্যতার দিকে
হাঁটতে থাকে
পুটুসকে নিলামে তুলি শিল্পের প্রয়োজনে
পুটুসের কলে জল নেই , বিড়িপাতা পড়ে আছে দাওয়ায়
বসন্ত-অভিধান
***
হে নিষাদ পুরুষ, আমাদের প্রেম নিয়ে লেখা হোক বসন্ত-অভিধান
যে পথ ধরে তুমুল চুম্বনগুলো ছুটে গেছে বিগত শতাব্দীর দিকে
তাদের কি নামে ডাকবে ?–বাউলের কন্ঠীবদল?
টুকটাক ঝগড়া, মান-অভিমান অহেতুক মেঘবৃষ্টির বজ্র উত্তাপ
পরিচয় পাক একটা-
তুমি বললে ওরা হোক প্রথম কদম ফুল অথবা বৈষ্ণবীর রসকলি !
আমার যেমন স্বভাব, হিলহিলে সাপিনীর মতো শরীরটাকে
৯০ডিগ্রী বেঁকিয়ে তুমুল প্রতিবাদে বললাম,কিছুতেই না ওরা
হবে ঔপন্যাসিক ঝড়।
অসমাপ্ত সঙ্গমগুলোর কিছু একটা ব্যবস্থা করা যাক!কি নাম
রাখলে ওদের ! কপিঞ্জল ! তা বেশ...তা বেশ
সম্পর্কের ভাঙা পাড়ে উত্সাহী বিলাপের সুতীব্র হুতাশন !
বরং সম্মানিত নাম দেওয়া যাক একটা-অন্ধ ভিখারীর আলোব্যথা !
এই নাও পৃথিবীর দিকে হেলে পড়া স্মৃতিদের নাম রাখলাম পোড়ামাটির বাঁশি।
বিচ্ছেদের ইতিবাসর ঠিক করা ছিলো তো সে কবেই
যেবার তুমি অক্ষিণী নক্ষত্রের বৃষ্টিভেজা বুকের নাম রেখেছিলে কবিতাসম্বন্ধীয়
আমি অবশ্য ধুতরার সর্বনাশ নামে আমাদের প্রিয়বিচ্ছেদকে ডেকে থাকি
প্রেম প্রকৃত অর্থেই চন্ডাল !
নির্লিপ্ত হাতে বাঁশের চিঙ্গারি উস্কে দিয়ে চিতার লেলিহান
সম্পর্ক গিলে খায় হবিষ্যির ক্ষুধায়
কথা রেখো সখা,শ্মশানের সমীপে অস্থি বয়ে যাওয়া নদীটির
নাম রেখো সোনালী এক বিস্মৃত অধ্যায়।
এস মিলিয়ে নিই যাবতীয় হিসেব বিষাদের জলযান
আফিমশোক বন্দর স্পর্শ করার আগে ?
ছবিওয়ালা
***
এই যে ম্যাডাম, আর একটু ঠোঁট খুলে হাসুন।
উত্তাল ঢেউকে বাঁ পাশে রেখে,স্যারের বুকে আলতো করে মাথা রাখুন।
বাহ বেশ হয়েছে...
আমার চশমার হাই পাওয়ার দেখে চমকে যাবেন না।
বিশ্বাস রাখুন, এ পেশায় পঁয়ত্রিশ বছরের নোনাবালি জমে।
আর, আর একটা ছবি,ম্যাডাম।
দানবের মতো তেড়ে আসা সমুদ্রকে অগ্রাহ্য করুন।
যে ভাবে এপ্রিলের কড়া বালুতট তুখোড় সূর্য তুড়িয়ে সুখমুহৃর্ত বুকে ঝুলিয়ে
ঘুরি আমরা ছবিওয়ালা ।ঠিক সেই ভাবেই , ভয় পাবেন না প্লিজ।
মোমের শরীর থেকে গলে পড়া সোনা নিয়ে এইবার স্যারের গলাটা
জড়িয়ে ধরে টুপ করে উঠে পড়ুন তার কোলে।
আর হ্যাঁ চোখটা একদম রাখবেন স্যারের চোখে।
দেড়শো টাকায় তিনটে, এ তল্লাটে কেউ দেবে না জানবেন।
ঝকঝকে এনড্রয়েড পকেটে ভরে রাখুন, ক্যামেরায় আমার মেগাপিক্সেল
কম হতে পারে তবে ফ্রেমে ঝুলিয়ে ঘরের দেওয়ালকে আন্তরিক সমৃদ্ধি
দিতে সক্ষম এ ছবিরা। ঢেউয়ের উপর চড়ে ঢেউ ছোঁয়ার নেশায় উজাগর
হোক মধুচন্দ্রিমা যাপন।
ঠিক চিনেছি জানেন,আপনাদের পিতা-মাতাও এসেছিলেন,
তাদেরও মাতা-পিতা সুদূর অতীতে।
আমরা খুব আশাবাদী বিধুরস্বপ্ন ছুঁয়ে আপনাদের সন্তানেরাও
আসবেন ঠিক একদিন।
আপনাদের এই সুখের মুহূর্ত ধরে দিতে পারলেই,
ঘরে আমার বাপ মরা নাতনীটার গরম ভাতের সুখ কিনে নেওয়া
যাবে লবন ও ঘামজলে।
মুদ্রারাক্ষস
***
পুরনো পয়সা জমিয়ে নিজেকে রাজা সাজাবার
বাবার এক অদ্ভুত নেশা ছিল ।
সেইসব ধাতুর কয়েনের মধ্যে থেকে দুপুর গভীর হলে
বেরিয়ে আসতো সমুদ্র গুপ্তের সারঙ্গীর অলৌকিক রোশনি ,
পাল-সেনদের রক্তমাখা তরবারির সদর্প উল্লাস, অশোকের ধর্মস্ত্রোক।
বাবার শিরায় ছলকে উঠতো মৃত-জমিদারির ক্ষুধার্ত লোলুপ বাঘ
আমরা ভয়ে সিটিয়ে যেতাম মায়ের কোলে ।
বাবা বিপিএল কার্ডে চাল-গমের হিসেবের থলে নিয়ে ঢুকে
যেতেন পুরনো কয়েনের ভিতর ,উন্মাদগ্রস্থ নেশায়
একদিন রাজা হবেন বলে ।
আমরা বাবার বুকের মধ্যে শুনতে পেতাম ধাতব চিৎকার,
আফিম ক্ষেতের মধ্যে অসফল মানুষের নঞ্চর্থক সুরের গোঙানি ।
মায়ের শাক তোলার প্রবল নেশা ছিল
ভূতে পাওয়া মানুষের মতো ছুটে যেতেন খালেবিলে ।
বড় হয়ে বুঝেছিলাম , অভাবী মায়েরা আসলে জ্যান্তভূত , সন্তানের
পেট ভরাতে কোনও অবলম্বন পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়তেন তার ওপরে ।
আমারও নেশা আছে সম্পর্ক গিলে খাওয়ার ।
অন্ধকারের মধ্যে খুন করে নিজের আত্মমুখ খাই ,
আর খেতে খেতে দেখি আমার শরীর থেকে মুছে যাচ্ছে ব্যক্তিগত চিত্র
বাবার দীর্ঘছায়া ঘন হচ্ছে আমার মুখের ওপরে ...
ঘরের লক্ষ্মী
***
চুমুতে লক্ষ্মী জন্মান না
জগৎমোহিনী দেবী এই সত্য শিখেছে চুমু বিলিয়ে ..
খরিদ্দার অতিথি লিঙ্গনারায়ণ। সাপটে জড়িয়ে
যতবার ছেড়েছে ঘনশ্বাস , যতবার কেঁপেছে ক্ষুধার্ত নারায়ণ
মনে -মনে বলেছেন , চুমু হারাম , চুমু বীর্যবন্ত নয় !
কামতাপুরীর জগৎমোহিনী লিঙ্গনারায়ণকে বসান তার বুকে
দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখেন পোস্টকার্ডঈশ্বর ,
মহালক্ষ্মীকে বসান গণিত ও সংখ্যাতত্ত্ব নামক চালে
লিঙ্গনারায়ণ যেটুকু ছড়িয়ে যান খুদকুঁড়ো
তাই নিয়ে ট্রেন ধরে , কোথায় বাঁচে বিদূরের সংসার ।
শরীর ধুয়ে কোজাগরী পাতেন কড়ি আর ধান ছড়ায়
সব চুমুতে ঈশ্বর থাকে না, লক্ষ্মী জন্মান না , যদিও লক্ষ্মী বাঁচে
তার লক্ষ্মী ক্লাস নাইনে পড়ে , বেণীবেঁধে সাইকেল
চালিয়ে স্কুলে যায় ৫ কিলোমিটার দূরে...
আবিষ্কার
***
এক সময় গাভীনীর প্রসব দেখার কৌতুহল ছিলো খুউব । আমরা লুকিয়ে গোয়াল ঘরের পিছনে দাঁড়ালেই মা নীল আঁধারে ঢেকে দিতেন কাঙ্খিত সেসব দৃশ্য। তখন আবিষ্কারের নেশাটা ছিলো প্রবল, পিঠে নেমে আসা বেদম প্রহারের চেয়েও। তখন দুলে দুলে কলম্বাসের আবিষ্কার মুখস্থ করি। সদ্য জন্মানো বাছুরের চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখার উচ্ছ্বাস মোহিত করে রাখতো আমাদের চারবেলা।
দেখতাম বড়দিকে খানিকটা মায়ের মতো মুখ করে ঘুরতে । ইচ্ছে থাকলেও খেলতে যেতো না,গাছে চড়ে পেয়ারা খেতো না । মা বলতেন,সেয়ানা মেয়েদের ওসব করতে নেই। তখনো অবশ্য "সেয়ানা মেয়ে" আমার অনাবিষ্কৃত অধ্যায়। আমি টের পেতাম গাভীনীর চোখের সৌন্দর্য আমার মায়ের চোখ,বড় দিদির চোখ ছুঁয়ে নেমে আসছে আমার চোখে। সে ঝড়ের রাতে মাকে আতঙ্কিত হতে দেখলাম। লন্ঠনের মৃদু আলো ছড়িয়ে গেলো গোয়াল ঘরে। হঠাৎ আলোয় আরো বেশি অন্ধকারে ডুবে গেলো চরাচর। অদ্ভুত এক দৃশ্য নাকি কল্প ! আমার ছোট্ট নরম চোখে ভয়ার্ত অনুরণন। গাভীনী তীক্ষ্ণ আর্তনাদ। মা এবং গাভীনীর অসহায় দুটিমুখ । পিছনের পা দুটো পেঁচিয়ে ধরে বিশালাকায় এক দাঁড়াস গাভীনীর স্তনের বোঁটায় জিভ লাগিয়ে শুয়ে।
মা ধীরে ধীরে বুঝিয়েছিলেন দুধেজনিত আকাল।বুঝিয়েছিলেন আত্মরক্ষার জন্য প্রতিরোধের জরুরি বিজ্ঞাপন । রুগ্ন গাভীনীর পাশে পড়ে থাকে আমাদের বিলাপ।গাভীনীর টানা টানা চোখ ঠিক মায়ের চোখ,ঠিক দিদির চোখ। ভাবতাম ,আশ্চর্য ওদের শিংএর ধার কোথায় ! দাদা বলতো বড় অবলা জীব। খুঁটি এবং দড়ির মধ্যে দীর্ঘ হতে থাকেন মা এবং বড় দিদি। ঘুমের মধ্যে বাড়ন্ত সেই দৃশ্য বিশাল সর্প হাঁ-মুখ। উঠে আসছে পায়ের পাতায়, হাঁটুর উপর, বুকের দিকে ...যেন নড়ে উঠছে আমার গলায় বাঁধা সুদৃশ্য দড়ি ও ঘন্টার শব্দ,টং টং টং টং টং টং ...
মরণফগ
***
প্রত্যেকটা পুরুষ চোখ আসলে এক একটা
আটলান্টিক মহাসাগরীয় মরণফগ
পুরুষের বুকের মধ্যে নারী 'মায়া সভ্যতা'র মিথ
তার তুরুপের অঙ্গ আসলে কাদাজলের জোঁক
যখন নরমবল উঁচিয়ে থাকে উপোষী 'কালুরায় ' দেবতার দিকে
তখন নরমবল আসলে থলথলে মাটির জেলি কুমোরের হাতে
আসলে , পুরুষের কাঁধে নয় , উরুতে জন্ম নেয় নারী
পুরুষের চওড়া উন্মুক্ত বুক হাসিমারা অভয়ারণ্য
নাভিকুণ্ড প্রেমের উষ্ণপ্রস্রবণ
নারীকে ওম দাও , চোখে সে অন্নপূর্ণা চোখে সে লক্ষ্মী
নারী তখন চিনের প্রাচীর , তখন
প্রত্যেকটা পুং আসলেই গ্রীক সূর্যদেবতা
একালের পুংলিঙ্গকে 'হোক কলরবের ' মত লাগে
প্রতিটি শিডিউল আসলে গঞ্জিকা অন্ধকার
'জাগতে রহ' নেপালি চৌকিদারের মত সময়টুকু জেগে থাকে
মানুষের জন্মের জন্য যতটুকু পুরুষের জাগা দরকার ...
রবিনহুড বুক বিছিয়ে দাও পুরুষ , নইলে ওয়াই কীট নিয়ে
বেদে তাঁবুতে খেলে যেতে যাবে যেকোন মদনকুমার
সমকামী
***
নিতার দুধফর্সা গালে কালো তিল নদীজোয়ার
এই ভাসান কেউ দেয়নি , ভেসে যাওয়া ভেলা দেয়নি পুরুষমারীচ
গায়ের বুদবুদ গন্ধ অফিসটাইমের লেজার খাতা পর্যন্ত ছুঁয়ে।
ওয়াশরুমে সাবান ও জলের প্রবণতায় ভিজে সপসপ অন্তর্বাসে
কাঁঠালরস এর অন্তর্যামী মুছে যাচ্ছে বিতর্কিত
রাত গভীর হলে হাত ঠোঁট দীর্ঘ জিব্রাগ্রীবা মুখ তুলে ঘাসের দিকে
নিতার চুলের মত নিষ্ঠুর আকাঙ্ক্ষা ,
নিতার বুক পাহাড়ে সৃষ্টিছাড়া কঙ্কাল
নিতার চুমুতে ঈশ্বর জন্মান আর মৃতসন্তান বীজ কষ্টহীন গর্ভাশয়ে
ধর্ম আর বিধর্মীর মত ঈশ্বর হন্তারক যারা উৎসাহী ,
যারা সমাজের চোখে ধুলোবালি পায়ে পায়ে ঘোরে
এবার বিজ্ঞাপন পাবেন আনন্দবাজারে , চলে এসো নিতা
নাম-রুমেলা আহমেদ , নিবাস-মেটিয়াবুরুজ।
'অ্যাসিড'
***
আমার এগারোতম প্রেমিকের চোখে সালফিউরিক অ্যাসিড দেখেছিলাম। স্মিতহাস্যে সে আমার দশ নম্বর উলম্ব কাঁটাটা তুলতে তুলতে আলতো করে পায়ের পাতায় ছুঁয়ে দিয়ে বলেছিল, - এত ওজন নিয়ে ঘোরা ফেরা করো না হে...... তলিয়ে যাবে অতলে। অহংকারে আমার ভরে ওঠা ডাল পালা । আবেগ আর ওজন কি সমকেন্দ্রিক ? কেন্দ্রবিন্দুটা কি কোন আধারকে কেন্দ্র করে, এক বিশেষ ভর নাকি ভার ! আবেগের রসায়নকে বহুবার টেস্টটিউবে ফেলে কাটাছেঁড়া করে দেখেছি নিটফল বিগজিরো।
ইলেভেনের ফিজিক্স খাতায় আশুতোষ স্যারের নাম লিখতাম ,মনে মনে জুড়ে দিতাম নিজস্ব ভালো লাগার কিছু সোনালী ডানা। আইনস্টাইনের মত মুখ করে ব্ল্যাকবোর্ডে চক ঘষে যখন দ্রবণ আর দ্রাবকের টানাপোড়েন বোঝাতেন ,আমি হাঁ করে চেয়ে থাকতাম তার ঢেউ খেলানো চুলের স্ট্যাটিস্টিকের দিকে ,শার্ট ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাওয়া মার্বেল গুলির দিকে। মনে হত ভর ও ভারের বিশ্লেষণ বুঝি গুলিয়ে যাচ্ছে কিছু সংখ্যাতত্ত্বের বায়ুচাপের ওঠানামার মত বিন্দু বিন্দু ঘামে।
মায়ের নিকানো উঠান থেকে খালপাড়ের কুরচি গাছ পর্যন্ত উড়ে যাচ্ছে ভৌত বিজ্ঞানের পাতা ,উড়ে যাচ্ছে অনিশ্চিত দ্রবণ-দ্রাবক। আমার আগামী প্রেমিক তুমি কি বুঝতে পারছ বিস্ফোরণ আমার শিরায়- উপশিরায়।ভালবাসতে হলে আরো আরো সালফিউরিক করে তোল একান্ত সমীকরণ সময়। আমাদের উত্তাপের নাম দেব 'অ্যাসিড' বিস্ফোরণ। আর একবার বুনসন বার্নার বুকে নিয়ে এস রীতিমত ভৌতবিজ্ঞান হয়ে উঠি।
দুধেভাতে ঈশ্বরী
***
ভাতের গন্ধের মতো সুখ
অসুখের দিনে কখনো সখনো রোদ পোহাতে আসে।
বিছানা ভেজান ঘরের পা ভাঙা ঈশ্বর ,অসহায় অ-সহায়
লক্ষ্মীঘটে তখন ধানের জোয়ারে... ভাটা।
পাখিবৌ ঢেকি পার দেয়।পাড়ায় পাড়ায়।
রোগাটে সূর্য কখন গিলে খেয়েছে তাপ এবং উত্তাপ!
পিঠে পুলি আব্দারে সন্ধ্যে দীর্ঘ হলে
কোলের রাজপুত্তুরের ঝুমঝুমি বিপন্ন শব্দে বাজে
পাখিবৌ ডানা ঝাপটিয়ে এসে বসে, আসলে সংসার অথৈ সরোবর ।
শরীরী মেঠো শ্রম পেলে প্রকৃত ঈশ্বরী উঠনে নেমে আসেন
ভাঙা জোয়াল পিঠে বয়ে বীজ ছড়ায় তার
চাষযোগ্য জমিন। দুধ-ভাত হতে চেয়ে কখন যেন
মাটি মাটিঘর মন্দির হয়ে যায়।
নেই কাব্য
***
না দানে , না ধ্যানে আমি কোথাও নেই ।
না রক্তদানে , না বন্যাত্রানে । না দয়ায় , না দাক্ষিণ্যে ।
আমি ঠিক যেন কোন ভূমিকাতেই নেই
না গরিষ্ঠ নায়কে না জ্ঞান বিতরণে
না পুজো প্যান্ডের ডালের হাতায় না সংসারের ছ্যাঁচড়া চাকায়
না মঞ্চের কেন্দ্রে না না , মঞ্চের পিছনে ।
লোকে আতেল বলে , অধঃপতনে সিদ্ধ বলে ।
কবিতা পাঠের শেষে হাততালি দিতে ভুলে যাই বলে
ইদানিং মহাকবিরা ডাকে না আর ,
কেরোসিনের লাইন দেখে আগুন আগুন চিৎকার করি বলে
রেশনকার্ড থেকে নাম বাদ গেছে আমার ।
প্রতিদিন দরজা বন্ধ ঘরে আত্মহত্যামূলক শব্দ দিয়ে
শরীরে পিন ফুটিয়ে প্রত্যক্ষ করি রক্ত ও শিরার ভালোবাসার গভীরতা
মৃত্যুর অভিনয়ের নাম জীবন - দু'বার খাতায় লিখে কাটি
আমি জন্মে নেই , মৃত্যুতেও নেই । শোকে বা আনন্দে
শ্বাসে নেই , দীর্ঘশ্বাসে নেই , গাঁয়ে নেই শহরে
রাস্তায় হেঁটে যাই , বাচ্চারা পাথর ছোঁড়ে
আমি পাগলে নেই , প্রলাপেও নেই । তবু লোকে পাগল বলে ...
ভাল লেখা ৷ ভাল লেগেছে ৷ - অমিতরূপ চক্রবর্তী ৷
উত্তরমুছুনধন্যবাদ দাদা
মুছুন