কবি শাঁওলি দে
কবি শাঁওলি দে |
কবি শাঁওলি দে'র একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশ করা হল :
ঈশ্বর
***
ঈশ্বরকে কোনদিন প্রেমিক ভাবিনি আমি
বরাবরই ঈশ্বরের সামনে হাত জোড় করি
তেমন করেই প্রেমিককেও ঈশ্বর ভাবা হল না আমার
আজন্ম তাকে হাত পাততেই দেখেছি
প্রেমিক ও ঈশ্বরের এই চির দ্বন্দ্বে
নিজেই নিজের ঈশ্বর হয়ে উঠি
ইতিহাস
***
বেড়াজাল ভেঙে ঢুকে পড়ছে
কিছুটা বিষাদ
রক্তাক্ত ইতিহাস সাক্ষী দেবে তার
ছায়া ছায়া মেঘ আর জীবাশ্ম যত
চিহ্ন রেখে যাওয়া এ ধূলিপথ
সবই কি হারায় ?
কিছু ইতিহাস বই'এর পাতায়
কিছু বা হৃদয় খুঁড়ে বের হয়
অকস্মাৎ।
আমার আমি
***
তার চেয়ে বরং জল আঁকি, আকাশের বুকে। নি:স্তব্ধতাকে করে দি খান খান। টুকরোকে সাজাই আমির মত।
দেখো, এই তো মিলেছে পথের সাথে পথ
এই তো নদী তার পেয়েছে গতি পথ
এই তো আবার দলছুট ভালবাসা
এই তো তোকে খুঁজে যাওয়া অবিরত।
তার চেয়ে বরং এ এক অন্য খেলা হোক
ভালবাসাটাসা মিটে যাক ধূলিস্যাত
ধুলোকে সাজাই আমার আমির মত।
ছাই -বাগান
***
সুন্দরের ভেতর জ্বলতে থাকা
দাউ দাউ দাবানল
পুড়তে পুড়তে কখন ছাই হয়
দূরতম নক্ষত্র কি তার খবর পায় ?
দু'পাশে, সামনে যতদূর চোখ যায়
সবুজ আর সবুজ
ধূ ধূ পথ শুধু এগিয়ে যাওয়ার
নীল আশ্রয় বরাবর।
তবু ছাই ওড়ে, ফুলগুলো ঝরে পড়ে
বন্ধ বাগানের কোলে ঢলে পড়ে
শৈশব থেকে বার্ধক্য,
মৃত লাশের গন্ধে ঢেকে যায়
অবসর যাপনের পানীয় স্বাদ।
চারিদিকে এ এক অদ্ভুত আঁধার
কথারা বদলে গিয়ে শুধুই হাহাকার
নীল সবুজের রঙবাহারে
কান পাতলেই শুনি,
'দু'টি পাতা একটি পাতার বিনিময়ে
একমুঠো চাল দাও,
জীবন ফুটিয়ে খাই . . . '
ভাঙনের কবিতা
***
১.
কিছুটা সময় ভেঙে
গড়িয়ে নিই ভালোবাসা
মুঠো মুঠো গুঁড়ো রঙ
জমতে জমতে প্রবল জলোচ্ছ্বাস
পাড় ভাঙে, ভাঙে সম্পর্ক
গোধূলির বুক চিরে
সামান্য লাল আজও পশ্চিমে।
২.
বনসাই স্বপ্নের ভিড়ে
জঞ্জাল বাড়ে
ধূলো মাখা শহর বদলায় রঙ
চেনা মানুষের মুখ মুখোশ
একাকার।
৩.
স্বপ্ন দেখব বলে এই জেগে থাকা
অসহায় রাত্রি যাপন।
নৈঃশব্দের জানালায় আজও
দাঁড়িয়ে থাকা অর্ধেক চাঁদ
কোন এক ভাঙনের গল্প শোনায়।
ফেরা
***
১.
একটু একটু করে রাতের গা খুবলে
বেরিয়ে পড়ছে রক্তাক্ত স্বপ্ন।
ছাতিম গন্ধ আজ আর নেশা ধরায় না।
তোকে প্রথমেই ঠিক চিনেছিলাম . . .
ছায়াপথে লেগে থাকা নক্ষত্রের সারিতে
দিশা খুঁজে নিই নিশ্চুপে।
তোর বাঁধতেই ঘর বেঁধেছিলাম
নীল আকাশের নীচে
২.
শরীর শরীরের গন্ধ চেনে।
মনকে জানার কোন ঠিকানা নেই
অন্ধকারে হাতড়ানো কিছু দিশেহারা হাত
সারাদিন শুধু খুঁজেই ফেরে।
তোর চুম্বনের দাগ আজও জীবন্ত
পাতাঝরা বিকেলের গায়ে পুরোনো প্রেম
উঁকি মারে এখনো . . .
রাত জেগে সেই রাতের অপেক্ষা করি
উষ্ণতা
***
যতটা পথ হাঁটলে ছোঁয়া যায় দিগন্ত
যতটা হাত বাড়ালে দূরত্ব কমে তোর-আমার
ঠিক ততখানিই চেয়েছি আমি।
কুয়াশা সরিয়ে রেখেছি যত্নে
জড়িয়ে ধরেছি ওম ঘুমের মত আষ্টেপৃষ্ঠে।
তবু এত শীতলতা !
ঘুম ভাঙবে না বলেই কি এত ব্যকুলতা. . .
বারবার তোকে ছুঁয়েই বাড়াতে চাই
মৃত সম্পর্কের উষ্ণতা।
রাত
***
১.
অন্ধকারকে তুমি রাত নাম দিলে
আমি দিলাম ইশারা,
তুমি ইঙ্গিত বুঝলে না
আমি অন্ধকারকেই জড়িয়ে নিলাম।
২.
শহর জুড়ে রাত নেমে এল
দিগন্তে শুধু এক টুকরো লাল
আমি সিঁদুরের রঙ খুঁজলাম
তুমি ছড়িয়ে দিলে অবিশ্বাস
৩.
মুহূর্তই সব কথা বলে দেয়-
জোনাকি যেমন শোনায় রাতের গল্প
তারা খসে পড়তে কত সেকেন্ড লাগে বলো ?
আশ্রম
***
ইঁট, সিমেন্ট আর পাথর
কয়েকটা ঘর, একটা বাড়ি।
চার দেওয়ালের মধ্যে অবসরের আনাগোনা...
আশ্রয় বলা যায় ?
সময়ের গা থেকে ছিটকে যাওয়া অবহেলা
আশ্রমে জায়গা নেয়।
দিম্মি
***
দিম্মি চলে যাওয়ার পর আমি
ওইরকম বয়সী সকলের মধ্যেই
ওঁর ছায়া খুঁজি...
বাসে জায়গা না পেলে বসতে দিই,
হাত ধরে পার করে দিই রাস্তা !
রাতে শোওয়ার আগে দেওয়ালে সাজানো ধূসর ছবিটার দিকে রোজ তাকাই একবার
আশির্বাদ চাই মনে মনে -
তখন থেকে যখন আমার সাত ক্লাস
শুধু এই তো সেদিন ওঁর মৃত্যুর দিনে
ধূপকাঠি জ্বালাতে গিয়ে দেখি ফটোটা নেই হঠাৎ !
খালি ফ্রেমটা পড়ে আছে অহেতুক।
দৌড়ে যাই পাশের বৃদ্ধাশ্রমে-
সারি সারি দিম্মি দাঁড়িয়ে সেখানে
আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলছে -
একজন ঘর ছাড়াকেও কি ঘর দিতে পারি না আমি ?