কবি আনারুল হক
কবি আনারুল হক |
আনারুল হক, পিতা রুহুল আমিন মোল্লা, প্রক্তন সমর কর্মী, মাতা-মোহরা বিবি গৃহবধূ।
জন্ম-১৭ই আগস্ট ১৯৮১, নিবাস-গোবিন্দপুর, থানা-স্বরূপনগর, জেলা উত্তর ২৪ পরগনা। শিক্ষা-স্নাতকোত্তর, শিক্ষান্তে সরকারী চাকুরী, পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তর, নিজস্ব পত্রিকা-"আলোর সন্ধানে" প্রথম কবিতা"বিড়াল" (বর্তিকা পত্রিকা, বালকী হাই স্কুল) প্রথম কাব্য গ্রন্থ "স্বপ্নলীনা" ২০১৯, দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ- "জলছবি" ২০২০ প্রথম গল্প সংকলন-"নীল চোখ ও নীলা" ২০১৯ ।
কবি আনারুল হকের কয়েকটি কবিতা প্রকাশ করা হল :
মৃতের মিছিল
***
বাবা আমার অসুস্থ, কয়েকদিন ধরে অসুধ না খেয়ে
বুকের ব্যথাটা বেড়েছে, আমি প্রায় দৌঁড়ে হিরু ডাক্তারকে
ডাকতে গেলাম । রাস্তার বাঁক ঘুরতেই দেখি
প্রচণ্ড মিছিল, যেন বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়েছে তারা
হাতে করতাল, ঢোল খোল নিয়ে এক নারকীয় উন্মাদে
বিজয় মিছিল ।
না ওটা বিজয় মিছিল নয়, নারায়ন বাবু
নাকি শহিদ হয়েছেন শাসক দলের বুলেটে ।
মিছিলের মুখ থেকে লাশটা নড়ে
উঠে বলল, আমার কানে বড্ড লাগছে আর পিঠের
ব্যথা সহ্য করতে পাচ্ছিনে ।
আমি বেমালুম জ্ঞান হারালাম, এখন মৃত মানুষ কথাবলে !
কোন্ কুহকে পড়লাম । কালো পতাকা আর রাজনীতির দাদাদের
পাশ কাটিয়ে যেতেই বুঝলাম, এটা কুহক নয়, যন্ত্রণা পিড়ীত বৃদ্ধের
আত্ম চিৎকার ।
নারয়ান বাবু মানে আমার মাস্টারমশাই শহীদ হলেন ?
কৌতূহলী হয়ে উঠলাম, গেলাম তাঁর বাড়ি ।
জ্যাঠাইমার রোদনে বুঝলাম কেন নিয়ে গেল লাশটা ।
আর শহীদের রহস্য ।
বুকে তাঁরও অসহ্য যন্ত্রণা ছিল, হঠাৎ রক্ত ক্ষরণে মৃত্য হলো,
নিয়ে গেলো হায়েনার দল, বুঝালো জ্যাঠাইমাকে, অনেক টাকা দেবে তারা,
এম.এল. এ করবে তাঁকে ।
আমার সম্বিৎ ফিরতেই হরু ডাক্তারকে উচ্চ স্বরে
ডাকলাম, জানিনা আমার অর্ধমৃত বাবাকে কারা আবার
শহীদের খাতায় জীবন্ত তুলে নিয়ে যায় ।
মুখ ঢেকে যায় অট্টালিকায়
***
আলোর রোশনায়, ঝাঁ চকচকে প্রাসাদ
তবু অবিনাশ বাবু ঘোর অন্ধকারে যেন ধ্যাতা ইঁদুরের মত ম্রিয়মাণ
ঘুম হয়নি তার অথবা ঘুম আসেনা আর ।
পাড়ায় পাড়ায় ভোজ উৎসব
যারা বানাত, তাদের মুখ ঢেকে ফেলে অট্টালিকা
সব যেন সভ্যতার শিখরে----
তারা ব্যাস্ত, যেমন হঠাৎ বৃষ্টিতে কুলায়ে পাখি ফেরে ।
তাই গ্রামে আর নবান্ন হয়না, পিঠে পুলির হাট হয়না,
গরুর গাড়ির ক্যাচক্যাচ শব্দ হয়না, বসন্তে আর কোকিল
ডাকেনা, বারান্দায় তাসের আসর আর হুঁকো হাতে গরির উল্লাকে দেখা যায়না
অট্টালিকার আলো চকচকে
হ'লেও তাতে মুখ দেখা যায় না, বিবেক থাকলেও তা বিস্ফারিত হয়না
গরির উল্লা এখনও গরিব আর অবিনাশ বাবুর
অট্টালিকায় মুখঢেকে যায় তার ।
দ্বীপ হতে বিচ্ছিন্ন নাবিক আমি
***
দ্বীপ হতে বিচ্ছিন্ন নাবিক আমি;
দুকুল প্লাবিত উত্তাল ঢেউ এর
মতো তোমার উদ্ধত যৌবন।
অনেক ফুলের মধু সংগ্রহকারী ভ্রমর তুমি।
তোমার চকিত চাহনিতে ভেসে যায় কত দ্বীপ--
কোনো এক নির্জনে থ্যাতা ইঁদুরের মতো আমাকে
বিচ্ছিন্ন করেছিলে উষ্ণ মরুর মতো।
তুমিতো কোনো এক নারী, তুমি অসীমা
তোমার মৈথুন লিপ্সায় আমি দিশেহারা,
ঠিক যেন কোনো দ্বীপ হতে বিচ্ছিন্ন নাবিক আমি।
আধুনিক সভ্যতার ছাপ তোমার চোখে
শ্রাবণ-নদীর মতো পাড় ভাঙে আমাকে।
পারো যদি আর একবার আমাকে স্বীকার করো--
আমি এখন দ্বীপ হতে বিচ্ছিন্ন কোনো এক নাবিক।।
জীবন্ত লাশ
***
ওরা খায়নি কিছু, ওদের অনশন রোজ
ওরা চায়না কিছু, একটু ভাত নুন
ওরা চালহীন ঘরে পূর্ণিমারচাঁদ দেখে
ওরা পলিটিক্স এর পণ্য, ঝরায় রোজ খুন ।
না খেয়ে কুকুর মরে না, মরেনা কোনো জন্তু
রোজ ছেলেটা অসুখে ভোগে আজ তারা ক্লান্ত
শহরের ফুটপাতে নগ্ন যে মেয়েটি, যদিও বইছে শ্বাস
চামড়া জড়ানো হাড় দেখে মনে হয় জীবন্ত লাশ ।
মা ব'লে আরো একবার
***
শহরের এক কোণে
এক বৃদ্ধা, হাতে লাঠি কাঁধে ব্যাগ
অজানা এক চাহনিতে বুড়ি নিরব নিথর।
হাতটা বাড়ালাম সাহায্যের, নেতিবাচক ভঙ্গিতে আমাকে ফেরালো।
কি হয়েছে ? জিজ্ঞেস করতেই বৃদ্ধা যেনো বারুদের মতো ফেটে পড়লো,
চারদিকে যেনো বজ্রনিনাদে তুমুল ঝড় আরম্ভ হলো, আমি শিঁউরে উঠলাম।
আমি আরও শিঁউরে উঠলাম;
যখন বুড়ি তার তলপেট আমাকে আলগা ক'রে দেখালো।
----বুড়িমা একি!
----পূর্ণিমা আমি, চাঁদের মতো মুখ আর কাচের মতো ছিল আমার গা,
কোন ‘অপরাধরে' আমার পেটে এদাগ?
আমার পয়োধর ঝুলে আজ নাভিমূলে
আমার মুখ জালিকা নদী এখন;
কোন্ পাপে সন্তায়দ্বয় আমাকে ফেলে গেলো অন্ধগলিতে ?
কোন পাপে ? বলো কোন পাপে ?
আমি কেঁদে বুড়িকে ‘মা' ব'লে ডাকতেই
বুড়ি ব’লে ওঠে, আরো একবার ‘মা' ব'লে ডাক শুনতে চাই,
মা ব'লে আরো একবার…