1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

দেবদীপ রায়



                        ক্যারিব
                          —দেবদীপ রায়


(১)

গাড়ি এখনো পৌঁছালো না।কাল রাত্রি থেকে বারবার ড্রাইভারকে বলা ছিল ভোর পাঁচটার মধ্যে যেন হাজির হন হোটেলের গেটে।নীল ও মেঘ ভোর পোনে পাঁচটা থেকে হোটেলের রিসেপশনে বসে আছে।ওদের সঙ্গে আছে দুজনের দুটো লাগেজ ব্যাগ,আর ছোট একটা ব্যাগ যার মধ্যে দু-তিনটে বিস্কুটের প্যাকেট,জলের বোতল,আর নীলের কেনা পাহাড়ি চকলেটের প্যাকেট।আর মেঘের কাছে ওর ডিএসএলআর-এর ব্যাগ।ওই ঠান্ডা সকালে খামোখা এইভাবে বসে থাকার কোনো মানে নেই।হোটেলের ম্যানেজারকে ফোন করে নীল জানতে চাইল,গাড়ি কেন আসছে না ? উনি বললেন,সে নাকি ফোন করে জেনেছে এইমাত্র,গাড়ি কাল রাত থেকে ল্যান্ড স্লাইডিঙে ফেসে গিয়েছিল,তাই এখন একটু লেট হচ্ছে।মেঘের অলসতা একটু বেশি।তার মধ্যে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা!নীলের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল-"ভাই,আমি তাহলে একটু লেপের মধ্যে গিয়ে বসছি।এই ঠান্ডার মধ্যে কী থাকা যায় এইভাবে !"
নীলের এইসব একদম পোষায় না।কোথাও ঘুড়তে গিয়ে বিছায়ায় অবস্থানটা ওর গা জ্বালিয়ে দেয়।মেঘের কথায় প্রচন্ড একটা ধমক দিয়ে উঠে বলল-"ধুর!তার চেয়ে আউটার ব্যালকনিটাই গিয়ে একটু বসা যাক।আমি আর এক কাপ করে কফি আর টোস্ট বলে দিচ্ছি।আধা ঘন্টার বেশি দেড়ি হবে বলে মনে হয় না।"
মেঘ আর নীলের বন্ধুত্ব সেই ছোটবেলাকার।দুজনই এত কাছের,যে মজা করে গালিগালাজ,মারপিট করলেও,কেউই খুব একটা কথা অমান্য করতে পারে না।অগত্যা মেঘ আর নীল ব্যালকনীতে গিয়ে বসল।এই ফুরসতে একটু ব্যালকনির ভিউ নিয়ে বলে রাখি,কখন গাড়ি চলে আসে তার ঠিক নেই।ব্যালকনি থেকে বাইরে তাকালে বিস্তৃত পাহাড়,একের পর এক ধাপ বেয়ে উঠে গেছে,তার মাঝে ছোট ছোট বাড়ি- যেন দেশলাইয়ের বাক্স,ও আশেপাশে বড়ো বড়ো গাছ।পাহাড়ের পদতলে কিছু চায়ের বাগান।এখন সূর্য খানিক উঠেছে।তাই দুর্দান্ত লাগছে সামনের পাহাড়টা।তবুও মেঘ আকাশে ছেয়ে আছে।সামনের মেঘপুঞ্জ এই ব্যালকনির খুব কাছে বলেই বোধ হচ্ছে।ব্যালকনিটা সুসজ্জিত।নানা রঙের ফুল দিয়ে সাজানো।দেওয়ালে কিছু এবস্ট্রাকট ছবি আঁকা রয়েছে।কারুকার্যে স্প্যানিস ও ফ্রেঞ্চ স্টাইল আরপ করা।তার সঙ্গে রয়েছে চোখ ধাঁধানো আলো।এক কথায়,খুব নীরস না হলে,এখানে এসে বসলে হোটেল রুমে যেতে খুব একটা ইচ্ছে করবে না।
বেয়ারা এক কাপ ধূমায়িত কফি,ও লিকার চা নিয়ে এলো।মেঘ চায়ের সাথে সিগারেট জ্বালালো।নীল এক মনে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে।এমন সময় মেঘ একটু হেসে বলল-"কী মন কেমন করছে? এই সময় Diamond and rust শুনতে মন্দ লাগবে না কি বলিস?"
নীলের মুখে লজ্জা।তবে গানটা যে মন্দ হবে না, তা সে জানালো।অতয়েব,মেঘের ফোনে শুরু হল সেই বিখ্যাত প্রেমের আকুতির গান।
নীলরা যে টেবিলে বসে ছিল,তার পাশেই একজন বিদেশী ভদ্রলোক বসেছিলেন,সেটা তারা এতক্ষণ সচেতন ভাবে লক্ষ্যই করেনি।একটা পেন,ডাইরি ও একটা সিগারের প্যাকেট নিয়ে উনি মাথা নিচু করে বসে আছে।ভদ্রলোকের নাম এডগার স্ত্রাকা।সে সুদর্শন,ব্রাউন ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রেখেছেন,বয়স পঞ্চাশ উর্ধ্ব।এতক্ষণ তিনি বেশ মন দিয়ে ডাইরিতে মুখ গুঁজেছিলেন।ঠিক যখনই গানটা চলতে শুরু করল,মাথাটা উঠিয়ে নীল আর মেঘকে দেখে একটু হেসে জিজ্ঞেস করলেন-"you people like Joan Baez?"
নীলের নতুন মানুষের সাথে পরিচয়ের হুজুগ  চিরকালের।তাই পুরো একমনা থেকে চমকে উঠে,তার দিকে হেসে বলেন-"yes,we do.By the way,what country are you from?"
-"venezuela.You like baez,because of Dylan,or her soprano voice with three octave vocal range?"
নীল একটু হেসে নিয়ে বলল-
-"Have you listened to the songs of "Gulf winds"?"
-"yes,a great album.why?"
-"Then what let you perceive Baez,as Dylan's Girlfriend,or maybe his company while in various musical tours?"
ভদ্রলোক হেসে উঠলেন।তিনি বুঝেছেন,শুধুই সাধারণ শ্রোতা নন এই তরুণ যুবকটি। মিউজিক শোনার প্রতি একটা প্যাশন আছে  তার।বললেন – "I Don't like Baez much.But,It's interesting in conversation with you.So,two friends are on a Hilly tour,right?I miss those bachelor days."
নীল একটু থেমে জিজ্ঞেস করল-"So,why you in the extreme east,for a tour plan,or any projects?"
-"A project,indeed."
ভদ্রলোকের কথায় একটা বাঁধা ছিল।মুখটা যেন কেমন কুঁচকে গেল।কি যেন একটা লুকোতে চাইল সে।নীল সেটা বুঝতে পেরে,আর কোনো কথা বলল না।
ভদ্রলোক এবার ডাইরিটা বন্ধ করে,জিজ্ঞেস করল – "So,today,where are you planning to move?"
-"Actually,we arrived two days earlier in darjeeling,now it's time to explore Lava."
কথাটা শোনা মাত্রই ভদ্রলোকের চোখে একটা আলাদা ছন্দ খেলা করতে লাগল।পিট সোজা করে বসলেন উনি।
মেঘ একলা বসে বোর হচ্ছে।সে অচেনা লোকের সাথে হঠাৎ করে বন্ধুত্ত্ব করে উঠতে পারে না।তাই,এতক্ষণ সে হেডফোন কানে দিয়ে গান শুনছিল।এখন আর থাকতে না পেরে,উঠে দাঁড়িয়ে বলল-"ভাই,আমি দেখছি ড্রাইভার কতদূর।"
নীলের সম্মতিসূচক হাসি। মেঘের অন্তর্ধান। 



(২)

এখন সকাল ৮টা বেজে ১০ মিনিট।মেঘ বারে বারে ড্রাইভারকে ফোন করে জেনেছে,এখনো দু-ঘন্টা সময় লাগবে তার পৌঁছোতে।রাস্তায় প্রচন্ড বৃষ্টির জন্য গাড়ি স্পিড তুলতে পারছে না।এমনিতেও তাদের একটু দেরি করেই বেরোনো ভালো হবে,কারন কালিম্পং এর রাস্তায় কাল রাত্রে ধস্ নেমে গেছিল।পুরো রাত জুড়ে সরানো হয়েছে পাথরের চাঁই।এখন আসতে আসতে রাস্তা খুলেছে।কিন্তু জ্যাম এখনো স্বাভাবিক নয়।একটু পর বেরোলেই রাস্তা ফাকা হবে।
এদিকে নীল ও ভদ্রলোকের অনেক গল্প এগিয়েছে।তাদের কথার মধ্যে উঠে এসেছে স্পেনের কাছ থেকে ভেনেজুয়েলার স্বাধীনতা,"গ্রান কলম্বিয়া" তৈরীর ইতিহাস,সাইমন বলিভিয়ার বিল্পব,লাতিন আমেরিকার উদ্ধার,ওখানকার ভাষা,সংস্কৃতি,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইত্যাদি।স্প্যানিশের  গান,নাচ,চিত্রশিল্পের বিভিন্ন রূপ নিয়ে তারা কথা বলেছে।সব মিলিয়ে একটা টানা আলোচনা চলল।তার মধ্যে কিছু তর্যাও হয়ে গেছে।মোটমাট বেশ বন্ধুত্ত্ব জমে উঠেছে।
ভদ্রলোক স্প্যানিশ লোকগান বাজনা চর্চা করছে অনেকদিন হল।এটা জেনে নীলের গান শোনার দাবিতে একটা লোকগান অর্থাৎ ফ্ল্যামেনকো স্টাইলে একটা গান গেয়ে ফেললেন টেবিল বাজিয়ে।অসাধারণ লেগেছে নীলের।কিন্তু কোথাও যেন একটা দুর্বল ব্যাপার আছে ভদ্রলোকের শরীরে।দেখে মনে হচ্ছে অসুস্থ।ভদ্রলোক একটু চুপ করে বসলেন।গান গেয়ে যেন একটু হাঁপিয়েই গেছেন।
নীল থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন,উনার শরীর ঠিক আছে কিনা।
উত্তরে বললেন- "Actually,I came here to meet an assignment by Venezuelan broadcast ministry.But I fell seriously Ill,for last 4 days,Suffering from diarrhoea."
নীল কিছুটা সহানুভূতি জানাল।ভদ্রলোক  আগেই জানিয়েছেন,দুদিন পরেই তার ফিরে যাওয়ার ফ্লাইট।এই প্রজেক্টটা তার জীবনের একটা অভূতপূর্ব কাজ হতে চলেছিল।তাই সেই আশাভঙ্গের কারনে খুব চিন্তিত হয়ে পরেছে।তাহলে কি তার কাজ অধরা রয়ে যাবে এখানে এসে,হঠাৎ খটকা লাগল নীলের।
নীল একটু নতস্বরে জিজ্ঞেস করল- "May I know about your assignment?And,will you return without even doing it?"
ভদ্রলোক প্রথমে খুব সংক্ষেপে একটা কিছু বললেন উনার কাজের ব্যাপারে।কিন্তু নীল কিছু না বুঝে,তাকে প্রশ্ন ছুড়তে শুরু করে।অবশেষে আর কোনো দ্বিধা না করে,উনি ব্যাপারটা একদম খুলেই বললেন।
নীল সমস্ত শুনে বসে রইল চেয়ারে চুপচাপ হেলান দিয়ে।খুব চিন্তিত হয়ে পরেছে সে।স্ত্রাকাও খুব চিন্তামগ্ন হয়ে পাহাড়ের দিকে চোখ ঠিকরে তাকিয়ে রইল।






(৩)

এখন সকাল ১১.৩০।রাস্তার পাশে একটা কাঠের দোকান।যেখানে একজন নেপালী ভদ্রলোক চা,ম্যাগি,ব্রেড টোস্ট জাতীয় ব্রেকফাস্ট বানান।নীল আর মেঘ ওখানে ব্রেকফাস্ট সেরে এখন বসে আছে পাহাড়ের লাগোয়া একটা ছোট্ট ভিউপয়েন্টে।ওদের গাড়ি এখানে হল্ট করেছে।ড্রাইভার ভদ্রলোক একটু খেয়ে নিচ্ছেন।এই দোকানের পাশেই পাহাড়ের তল।অতয়েব ওখানে বসে অসাধারণ একটা দৃশ্য দেখা যায়।
কাল রাতে যেহেতু অনেক খানি বৃষ্টি হয়েছে,তাই এদিকটা খুব ঠান্ডা।পাহাড়ের গায়ে মেঘ।চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেছে।কুয়াশার জন্য সামান্য দূরের জিনিসই দেখা যাচ্ছে না।নীলরা গায়ে দু-টো করে সোয়েটার চাপিয়েছে।হাত জিন্সের ভেতরে ঢুকিয়ে,গল্প করছে।
গাড়ি যতক্ষন না ছাড়ে,ততক্ষণে নীল আর মেঘের সঙ্গে একটু পরিচয় করা যাক।মেঘ ও নীল শিলিগুড়িতে ছোটবেলাটা কাটায়।স্কুলে থেকেই ওরা খুব ভালো বন্ধু।একসাথে ক্লাস টুয়েলভ অবধি পড়ে,নীল চলে যায় কলকাতা পড়াশোনার জন্য-এখন ব্যাঙ্গালোরে চাকরী করে।অন্যদিকে মেঘ কেমেস্ট্রিতে ওনার্স করে মাস্টার্স শেষ করেছে-এখন একটা নামি ব্যাঙ্কে চাকরী করে কোলকাতায়।দু-জন দু-জায়গায় থাকলেও বন্ধুত্ত্ব একটুও ভাঙেনি।এ ওর জীবনের সমস্তটা জানে।প্রতি বছর ওরা একটা ট্যুর করে।চাকরীর পাশাপাশি,মেঘ অসাধারণ ছবি তোলে।আর নীলের শখ লেখালেখির। দুজনই স্কুল লাইফ থেকে এই প্যাশনটা নিয়ে আছে।তাই ওদের মধ্যে যে মিলটা আছে,সেটা শুধু সঙ্গ দেওয়ার বন্ধুত্ত্ব নয়,তার চেয়ে অনেকটাই বেশি।এই বছরের তালিকায় ছিল দার্জিলিং,লাভা ও লোলেগাঁও।
ড্রাইভার গাড়িতে গিয়ে বসলেন।মেঘও ডিএসএলআরটা ব্যাগে ঢুকিয়ে উঠে পড়ল।গাড়ি রওনা দিল লাভার দিকে।এখান থেকে দুঘন্টার রাস্তা।গাড়ি সোনাদা হয়ে লাভায় যাবে।
পাহাড়ের গায়ের গাছগুলো দুর্দান্ত সবুজ ও সতেজ।বিগত কিছুদিন ধরে দাপিয়ে বৃষ্টি হয়েছে পাহাড় জুড়ে।তাই,রাস্তায় বহু জায়গায় গাছ পরে আছে।সরকারি দপ্তরের রাস্তা তৈরির কাজ বন্ধ হয়েছে।
পাহাড়ি স্কুলগুলো এখন বোধহয় ছুটি হয়েছে।ছোট ছেলেমেয়েরা পাহাড়ের রাস্তা দিয়ে হেঁটে নামছে।ওরা যেহেতু প্রকৃতির আদরে মানুষ,তাই ওদের চোখে একটা দারুণ সারল্য আছে।নীল সেটা চোখ ভরে দেখে।



(৪)

এক ঘন্টা হল লাভা পৌঁছেছে ওরা।লাভা মনাস্টেরি,ও ফরেস্ট বাঙলো ছাড়া তেমন কিছু লাভায় নেই।ওগুলো টুকটাক ঘুড়ে এসে,এখানে এক বাঙালি হোটেলে লাঞ্চ সেড়ে,এবার রিশপ যাওয়ার পালা।এখানেও এখন ধুম ঠান্ডা।ওরা দুজনই ব্যাগ থেকে জ্যাকেট বের করে গায়ে দিয়েছে।টুপি,মাফলার সব দিয়ে জুবুথুবু অবস্থা।এখান থেকে রিশপ যাওয়ার পালা;৪ কিলোমিটারের পথ। তবে রাস্তা দুর্গম।একটা আলাদা এডভেঞ্চার। 
ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে ফিক্সড্ রেটে গাড়ি নিয়ে রওনা হল ওরা।রিশপ হল পাহাড়ের চূড়ায় একটা ছোট্ট গ্রাম।যেখানে খুব জোড় ছ'শ সাত'শ লোক থাকে।তেমন সুযোগ সুবিধা নেই।বাজার ঘাট করতে মানুষদের লাভায় আসতে হয়।আর কোনোরকম কেনাকাটা, ওষুধ, বা দরকারি আসবাবের জন্য কালিম্পং, বা সোনাদা।ওখানে বেশ কিছু হোটেল,গেস্ট হাউস ও হলিডে হোমস আছে।আর এই নিয়েই গ্রামের লোকেরা রোজগার করে।
গাড়ি কিছুটা এগিয়েই একটা ছোট রাস্তা নিল।সে রাস্তা পাহাড়ের পাথর ভেঙে তৈরি।রাস্তা ও গাড়ির প্রস্থ প্রায় সমান।রাস্তার এদিক ওদিক উঁচুনিচু।তাই গাড়ি চললে কখনও কখনও  একটা চাকা নেমে যাচ্ছে। চালকের যথেষ্ট দক্ষতা লাগে এমন রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাতে।ফোর হুইল ড্রাইভ ছাড়া এ রাস্তায় ওঠা সম্ভব না।
এখন বৃষ্টির সময়,তাই লাভা,রিশপ জুড়ে জোঁক ভর্তি।হাঁটা চলা খুব সাবধানে করতে হয়।গাড়ি দুলতে দুলতে এগিয়ে চলল।নীল ও মেঘ খুব ভয়ে ভয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে যাচ্ছে সমানে।ড্রাইভার ভাইয়ের মুখে নিশ্চিন্তির হাসি ও প্রচুর গল্প।রাস্তার পাশেই খাই।গাড়ি কোনো ভাবে ব্যালেন্স হারালেই বিপদ।এ এক লোমহর্ষক ব্যাপার।এমন সফর আগে করেছে বলে নীলের মনে পরে না।গাড়ি প্রায় ৪৫ মিনিট নিল চার কিলোমেটার নিয়ে আসতে।গাড়ি যেখানে নামাল তার ঠিক সামনেই আমাদের গেস্ট হাউস-"মেঘমল্লার গেস্ট হাউস",সাইনবোর্ডে লেখা,হিন্দি ও ইংরাজীতে।এক নেপালী কাকু,কাকিমা ও তাদের ছেলে মিলে এই গেস্ট হাউস চালান।তারা আমাদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন।উনাদের ছেলে আমাদের লাগেজ ব্যাগগুলো দুহাতে নিয়ে পথ দেখালেন।




(৫)

ভেনেজুয়েলা পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো খনিজ তেলের ভান্ডার।১৯৬০-এর পর থেকে পিডিভিএসএ( PDVSA) নামে একটা রাষ্ট্রায়ত্ত কম্পানি দেশের তেল নিয়ে ব্যবসা শুরু করে।পৃথিবীর বহু দেশে তারা তেল রপ্তানি করতে থাকে। আর তার ফলে দেশ অর্থনৈতিক ভাবে অনেকটা উন্নতি করে।ভেনেজুয়েলার পাশাপাশি সৌদি আরব, ইরান,ইরাক,ইত্যাদি দেশও তেল রপ্তানি করে থাকে সারা বিশ্বে।ফলে এখন তারা যদি তেলের দাম,ও রপ্তানির নীতি একসূত্রে না বাঁধে,তাহলে স্বাভাবিকভাবেই শুরু হবে বিবাদ,ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শুরু হবে গোলমাল।ফলে পাঁচ দেশ মিলে তৈরী হল ওপেক(OPEC); ইরাক,ইরান,ভেনেজুয়েলা,কুয়েত ও সৌদি আরব।কিন্তু এই সংগঠন তৈরী হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই শুরু নিয়ম ভঙ্গ।ফলে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন দাম।অতয়েব, ক্ষতিগ্রস্ত হল ভেনেজুয়েলার মতো সৎ দেশ।ভেঙে পড়ল অর্থনীতি।ভেনেজুয়েলা শুধুমাত্র তেল রপ্তানির ওপরেই নির্ভরশীল।অন্যকোন পন্থা যথা,কৃষি,উৎপাদনের ওপর কোনো নজর দেয়নি সরকার।ফলে,দেশের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে পরল।
১৯৯৯ সালে রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহন করলেন হিউগো চাভেজ।আর ঠিক তারপরেই,তেলের দাম উঠল।তেল রপ্তানি নিয়ে অন্য দেশের সাথে বিবাদ মিটলো। এবং ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক অবস্থা আবার স্বচ্ছল হল।দেশে তখন রমরমা ব্যবসা। অনেক মানুষের চাকরি হল।ফলে দেশে গরীব লোকের সংখ্যা কমে গেল।অন্যান্য ছোট দলগুলোর সাথে মিলে চাভেজ পিএসইউভি(PSUV-সমাজবাদি দল) তৈরি করে ১৯০৭ সালে।ফলে দেশের মানুষের দুঃখ দুর্দশা অনেকটা কমতে থাকে।
২০১১ সাল থেকে ফের শুরু হয় অর্থনীতির অধঃপতন,তেলের মার্কেট পরে যায় ভেনেজুয়েলার।২০১৩ সালে চাভেজের মৃত্যু হলে,নিকোলাস মাদুরো এলেন ক্ষমতা।কিন্তু দেশের অবস্থা আরও নামতে শুরু করেছে। জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া।ফলে ডাকাতি,খুন,ধর্ষণ,হেনস্থা দিনদিন বেড়ে চলল।কারাকাস এখন দুনিয়ার সবচেয়ে সাঙ্ঘাতিক শহরের মধ্যে একটা।মানুষ খুব ভয়ে ভয়ে থাকে।মানুষ দুবেলা খাবার পায় না।অনাহারে থাকে।ওখানে থাকাই একপ্রকার দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে।সমাজতাত্ত্বিকদের হিসেবে,প্রায় তিরিশ লক্ষ লোক দেশ ছাড়া হয়েছে।বেশির ভাগ কলমম্বিয়ায় আস্তানা গেড়েছে।বাকিরা নানান জায়গায় পাড়ি দেয়।তেমনই,ক্যারিব উপজাতিরাও চলে যায় এই দেশ ছেড়ে।
ক্যারিব হল ক্যারিবিয়ার দ্বীপগুলোর  আদিবাসী।এরা থাকত তৃনিদাদ,টোবাগো,গ্রেনেডাইন্স ও সেন্ট ভিনসেন্ট,ডোমিনিকা,ইত্যাদি দ্বীপে।পরে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সাথে সংঘর্ষে ঠিক হয় তারা শুধু সেন্ট ভিনসেন্ট ও গ্রেনেডাইন্স,ও ডোমিনিকায় থাকবে।এরা পিদজিন ভাষায় কথা বলে।শিকার,খাওয়া দাওয়া,গান বাজনা নিয়ে এরা জীবন অতিবাহিত করে।গান বাজনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য রূপ হল পুন্টা।তারা ওই ধাঁচেই গান বাজনা করে।এদের জনসংখ্যার কিছু অংশ ছড়িয়ে আছে পুরো দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ জুড়ে।এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপগুলোর খুব কাছাকাছি হওয়ায় বেশ কিছু পরিবার ভেনেজুয়েলায় বসবাস করত।যারা শহরের আশেপাশে থাকতো তারা অনেকটা সাধারণ মানুষের মত করে জীবন যাপন করা আরম্ভ করেছিল।কিন্তু ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক অবস্থা যখন রসাতলে,যখন মানুষ কোথায় গিয়ে বাস করবে,কোথায় গিয়ে দুবেলা খাবার জোটাবে এই নিয়ে চিন্তিত, তখন এই দেশের ক্যারিব জনগষ্ঠি পড়ল বিপাকে।কেউ গেল দ্বীপগুলোয়,কেউ বা কিউবা,কেউ বা স্পেন,মেক্সিকোয়,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে,আবার কেউ কেউ আর্জেন্টিনা, চিলি,উরুগুয়ে। তারই মধ্যে চোদ্দোটি পরিবার কোনো দিশা না পেয়ে,নতুন পরিচয় হওয়া নিকারাগুয়ার কিছু চেনা মানুষের সাথে পাড়ি দেয় ভারতবর্ষে;কালিম্পঙের লাগোয়া রিশপ গ্রামে। দেশে তাদের অর্থের কোনো দাম না থাকলেও অন্য দেশে বলিভিয়া কারেন্সি ভাঙিয়ে কিছু জোগাড় করেছে।আর ২০১৩ সালেই ডুয়ার্সের পাহাড়ের এক ছোট্ট গ্রাম রিশপে চোদ্দোটি কারিব পরিবার,ও ছয়টি নিকারাগুয়ার পরিবার থাকতে শুরু করে।কিছুটা হিন্দি,ও খানিকটা নেপালি ভাষা তারা আয়ত্ত করেছে।টুরিস্টদের জন্য মোটমাট ভালোই আছে তারা।



(৬)

এডগার স্ত্রাকা ভেনেজুয়েলার বাসিন্দা।স্প্যানিশ বংশধর,কিন্তু জন্ম ভেনেজুয়েলায়।এখন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক,ও সমাজ বিজ্ঞানী।তার ইদানীং রিসার্চের বিষয় - ক্যারিবীয়ান দ্বীপগুলোর অর্থনীতি। সেইজন্যেই তার বহু জায়গায় গিয়ে সার্ভে করার প্রয়োজন পরেছে।ফলে,ক্যারিবীয়ার দ্বীপ থেকে শুরু করে,ইউরোপ,উত্তর আমেরিকা,ও এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়েছে।এখন এসে পৌঁছেছে ভারতবর্ষে। চেন্নাই,মুম্বায় ঘুড়ে এখন দার্জিলিং।দার্জিলিং থেকে যাওয়ার কথা ছিল রিশপ,যেখানে ক্যারিব জাতি,ও নিকারাগুয়ার দ্বীপের কিছু মানুষ বসবাস করেন গত পাঁচ বছর ধরে।ভারত সরকারের দূতাবাসের অনুমতি নিয়ে স্ত্রাকা এসেছে এখানে।উনাদের সাথে কথাবার্তা,ও কিছু তথ্য নেওয়ার জন্য সে রিশপে দুদিন থাকবে।কিন্তু ঘোর বিপাকে পরেছে সে।দার্জিলিঙের গোল্ডেন অর্কিড হোটেলে একবেলা কাটানোর পরই খুব জ্বর,সঙ্গে ডাইরিয়া।ডাক্তারকে দেখানো হয়েছে।ডাক্তার ভাবগতিক দেখে দু-তিনদিন হোটেলেই বিশ্রাম নিতে বলেছেন।এদিকে তার প্লান বানচাল হবে রিশপ যাওয়ার।দুদিন দিন বাদেই বাগডোগরা থেকে কলকাতা হয়ে নিউ ইয়র্কের ফ্লাইট।ফলে তার মন খুব খারাপ ছিল।একমনা হয়ে বসে থাকত হোটেলের ব্যালকনি ভিউয়ে।সেখানেই দেখা হয়ে যায় নীল ও মেঘের সাথে।
নীল চিরকালই একটু একঘেয়েমি থেকে বাইরে বেরিয়ে স্টেপ নিতে ভালোবাসে।কোনো চ্যালেঞ্জিং কিছু এলেই ঝাপিয়ে পরতে ভালোবাসে।লেখাটা তার ধাতে আছে।ইন্টারোগেশন খুব একটা খারাপ করবে বলেও মনে হয়না।এদিকে মেঘ দুর্দান্ত ছবি তোলে।অতয়েব এরকম একটা প্রোজেক্ট পেলে লাফিয়ে ওঠার কথা।ছবি আর সমস্ত ইন্টারোগেশনের একটা ইংরাজিতে লেখা নথি যদি প্রস্তুত করতে পারে,তবে ভদ্রলোকের খুবই সাহায্য হবে-তার এতদূরে আসাটা সার্থক হবে।
নীল স্ত্রাকার সমস্ত কথা শুনে,চেয়ারে ঠেস দিয়ে কিছুক্ষন বসে বললেন-"If you don't mind,we can devote our two day vacation for your project. We may cancel our lava tour,and make it to rishyop then."
ভদ্রলোক একটা স্বচ্ছল হাসি হেসে উঠলেন।আবার হঠাৎ হাসিটা চাপিয়ে ভাবল,ওদের ভ্যাকেশনটা কোনোভাবে বানচাল হবে কীনা।তাদের কোনো অসুবিধা হবে কিনা জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক।নীল স্ত্রাকার সমস্ত দুশ্চিন্তা মিটিয়ে জানালেন তারা আজই কিছুক্ষনের মধ্যেই রিশপের জন্য রওনা দেবে।স্ত্রাকা তার তৈরী করা বিভিন্ন কাগজ,নথিপত্র ও জিজ্ঞাসাবাদের পরিকল্পনার একটা নক্সা নীলকে দিল।নীল পুরোটা পড়ে বুঝে নিল কি করে তারা কাজটা সম্পন্ন করবে।মেঘও চ্যালেঞ্জিং এই বিষয়টা পেয়ে একটু ফুরফুরে মেজাজেই আছে।সে স্ত্রাকার সাথে কিছু তথ্য বিষয়ক আলোচনা সেড়ে নিল।এখন তারা যথেষ্ট সুনিশ্চিত,তারা পারবে; একটু চিন্তিত যদিও,তাই মেঘ ও নীল টেবিলের বিপরীতে বসে শান্ত বসে পুরো ব্যাপারটাকে মাথার মধ্যে গুছিয়ে নিচ্ছে।এদিকে স্ত্রাকা ফোন করে হোটেলে জানিয়ে দিল,সে আসছে না;তার বদলে অন্য দুজন যাবে।নাম বৃত্তান্ত সব জানিয়ে দিল।নীলরাও তাদের লাভার হোটেলে থাকাটা বাতিল করলেন ফোন করে।
কিছুক্ষণের মধ্যে ড্রাইভার এলেন।তাকে নতুন পরিকল্পনা জানিয়ে দেওয়া হল।
 মেঘঘন আকাশ।ছিটেফোঁটা বৃষ্টি।গাড়ি পাকদণ্ডী বেয়ে বেয়ে উঠতে আরম্ভ করল।



(৭)
গতকাল রাতে ২ ডিগ্রি অবধি টেম্পারেচার নেমেছিল।গেস্ট হাউসে যারা ছিলেন,সবাই ঠান্ডায় কেঁপে গেছিল।টেন্টের পাশেই বনফায়ারের ব্যবস্থা ছিল,মাঝেমধ্যেই কফি,চিকেন পকোড়া,ও বিদেশী এলকোহলের ব্যবস্থা ছিল।নীল সহসা খায় না,কিন্তু ওই ঠান্ডায় দুই ঘোঁট মেরে দিয়েছে।মেঘের সেরকম কোনো বাঁধা নেই,ও বেশ আমেজ করেই কাটিয়েছে।রাত্রিতে ডিনারে রুটি ও মাংস-যার কোনো তুলনা নাই।এই নেপালী পরিবার যেভাবে আপ্যায়ন করছে টুরিস্টদের,তা উপভোগ না করলে বোঝা মুস্কিল।
সকাল এখন ৫.৩০টা।আকাশে ঘন মেঘ,সূর্য এখনো ওঠে নি।গেস্ট হাউসের মালিক সব টেন্টেই টোকা মেরে ডেকে দিয়ে থাকেন,ওই পাহাড় থেকে সূর্যদয়,বা সকালের আকাশ দেখার জন্য।ওরা দুজনেই দাঁড়িয়েছে সূর্য দেখবে বলে।সকালের ওই অসাধারণ পরিবেশ মেঘ যতটা পারছে ক্যামেরা বন্দি করার চেষ্টা করছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলো এই গ্রামেরই এক বাগানের চা-পাতার দারূণ চা।ক্ষাণিক পরেই,আকাশ নীল হল,মেঘ সরে গেল,মিষ্টি চোখ ধাঁধানো রোদ এল।সামনের পাহাড় শ্রেনী এখন যে রূপ নিয়েছে,সেটা লিখে প্রকাশ করা যায় না।চোখই একমাত্র গ্রহনে যোগ্য।তারা যদি স্ত্রাকার কথায় এই পাহাড়ে না আসত,তবে এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য তারা দেখতে পেত না।
সকাল আটটা মতো বেজে গেছে।ওরা বেরিয়ে পরবে ব্রেকফাস্ট সেড়েই।ক্যারিব উপজাতিরা যেখানে থাকে,সেটা এখান থেকে প্রায় দু-কিলোমিটার।ওখানে হেঁটে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।নীল মনে মনে একটু প্রস্তুতি নিচ্ছে,কী করে স্ত্রাকার যথার্থ উপকারে আসা যায়।মেঘও খুব এক্সাইটেড। 
এখন সকাল ৯.৩০টা।ওরা একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পরল দূর ক্যারিবিয়ান সাগরের মানুষের সাথে পরিচয় করতে।একটা আলাদা আমেজ,ও অনুভূতি।ওরা রাস্তায় মানুষদের জিজ্ঞাসা করতে করতে প্রায় ১ ঘন্টা পর পৌঁছালো একটা জায়গায়,যেখানে রাস্তার পাশে দুটো উলঙ্গ বাচ্চাকে দেখে,ও তাদের মুখাকৃতি দেখে ওরা বুঝে নিল,এই সেই কালিনাগো (ক্যারিবদের আদি নাম) মানুষদের আস্তানা।সেই রাস্থা দিয়েই,পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে গেছে একটা সরু গলি।ওখানেই ওদের গ্রাম।ওই পথ অনুসরণ করে নামতে লাগল ওরা।কিছুদূর গিয়ে দেখা গেল,ছোট ছোট বেশ কিছু কুঁড়ে ঘর।ঘরের আশপাশে বেড়া দিয়ে সবজি,ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে।কুঁড়ে ঘরগুলোর মধ্যে বেশ খানিকটা করে জায়গা রাখা।সেখানেও নানা গাছ লাগিয়ে বাগান মতো বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে ।বড়ো গাছগুলোর মাঝে হ্যামক ঝোলানো।এই দোলনা জাতীয় হ্যামক জিনিসটা ওদের দেশের আবিস্কার,যেটা আমরা এখন নানা সমুদ্রের বিচে দেখতে পাই।একটু দূরে দুটো জায়গায় বড়ো পাথর দিয়ে উনুন বানানো হয়েছে।কিছু মেয়েমানুষ একে ওপরের সাথে বসে আছে-কথা বলছে।ওদের আসতে দেখে সবাই একটু অবাক হল।কেউ তো এদের ওখানে আসে না লোকাল নেপালী মানুষেরা ছাড়া।ওরা পাঁচ বছর থাকার ফলে এখন বেশ ভালো হিন্দি ও কিছুটা নেপালী বলতে পারে।একজন মেয়ে সামনের একটা ঘরে ঢুকে একজন যুবককে ডেকে নিয়ে এল।সে এসে জিজ্ঞেস করল,তাদের আসার কারণ। মেঘ পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল।তারা জানাল এই খবর তারা পেয়েছে বেশ কিছুদিন হল।এখানকার লোকাল গাড়ির সিন্ডিকেটরা লোকাল থানা থেকে জেনে তাদেরকে বলেছে,যে তাদের দেশ থেকে একজন ভদ্রলোক আসছেন,তাদের সাথে কিছু কথা বলতে ও জানতে।সেই ভদ্রলোকের বদলে এরা কেন এসছে,সেটা তারা খুলেই বললেন।বেশ কিছুক্ষণ পরিচয় পর্ব চলল।ইতিমধ্যে ওরা দুজনে দুটো চেয়ার পেয়েছে বসার।ঘর থেকে কাটা ফল,ও এক কাপ চা দেওয়া হয়েছে।ওদের বাড়িগুলো থেকে আসতে আসতে লোক জোড় হওয়া শুরু হল।গোটা পাঁচেক লোক,আর প্রায় ৯জন মতো ভদ্রমহিলা বসেছেন তাদের সামনে এসে।কিছুজন কাঠের মোড়ার উপর বসল।পাশে কিছু নাবালিকা,ও কিছু শিশু দাঁড়িয়ে নিস্পলক চেয়ে আছে ওদের দুজনের দিকে।
নীল ধিরেধিরে আসল জিজ্ঞাসায় ঢুকলো,হাতে পেন,পেপার।মেঘ ক্যামেরা বের করে ট্রাইপডের উপর ফোকাস ঠিক করল।এরপর নীলের কাগজ ও মেঘের ক্যামেরা যা গ্রহন করল,তা সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করা হল-
বহু যুগ আগে,যার সময়কাল অনুমানযোগ্য মাত্র (চতুর্থ হিম যুগ),এশিয়া মহাদেশ থেকে কিছু প্রাগৈতিহাসিক উপজাতি শিকারের খোঁজে হিমায়িত বেরিং স্ট্রেট হয়ে ক্যানাডা-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে মেক্সিকো পেরিয়ে ইস্থামাস অফ পানামা দিয়ে প্রবেশ করে দক্ষিণ আমেরিকায়।ওখানে তারা বসবাস করতে আরম্ভ করে।তাদের উত্তরসূরীরা দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর দিকে যাওয়া শুরু করে-ব্রাজিল হয়ে,গুয়েনা,সুরিনেম বা ভেনেজুয়েলা পেরিয়ে তারা পাড়ি দেয় ক্যারিবিয়ার দ্বীপ গুলোর উদ্দেশ্যে।তারা বসত জমায় তৃনিদাদে, টোবাগোয়,মার্টিনিক,ডোমিনিকায়,সেন্ট ভিনসেণ্ট ও গ্রেনেডাইন্স,সেন্ট লুসিয়া হয়ে আরও কিছু দ্বীপ অতিক্রম করে জামাইকা ও কিউবা অবধি।এই সমস্ত দ্বীপ গুলোয় তাদের শ্রেনী শত্রু হিসেবে ছিল আরাওয়াক উপজাতি।যাদের সাথে প্রতিনিয়ত বিবাদ,ঠান্ডা কলহ লেগেয় থাকত।কে কোথায় নিজেদের ডেরা কাটবে এই নিয়ে তাদের পরিকল্পনা সবসময়ের।এরা মূলত জলের ধারে,অর্থাৎ সমুদ্রের ধারে বসবাস স্থাপন করত,কারণ তাদের মূল খাদ্য ছিল মাছ,আর দ্বিতীয়ত, জলের ধারে থাকলে আগত শত্রুপক্ষকে অনুধাবন করা যায় সহজে।
ব্রিটিশরা এদের ওপর রাজ চালায় কিছুকাল,তারপর অনেক আন্দোলন, বিদ্রহের পরে সেন্ট ভিনসেন্ট ও গ্রেনেডাইন্স,ও ডোমিনিকায় তারা বসবাস শুরু করে।এই বিদ্রহে ক্যারিবদের পাশে ছিল ফ্রান্স ও মার্টিনিকের বাসিন্দারা।এখন বিশুদ্ধ ক্যারিব উপজাতি খুঁজে পাওয়া মুস্কিল।বেশীরভাগই আফ্রিকান ট্রাইবদের সাথে বংশবিস্তার করে নাম হয়েছে গ্যারিফুনা উপজাতি।কেউ কেউ আবার আরাওয়াকদের সাথেও বংশবিস্তার করে ফেলেছে।যদিও এদের সংখ্যা এখন কমে এসেছে আগের তুলনায়।প্রকৃতির প্রতিকূলতায়,শত্রুদের সাথে যুদ্ধে এদের সংখ্যা অনেকটা হ্রাস পেয়েছে।
এদের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক, অর্থাৎ ছেলে সন্তানদের খুব ছোট থেকেই যুদ্ধবিদ্যা,শিকার করা শেখানো হয়।এদের সমাজে সন্তান জন্ম নিলে তাদের খুব ছোট থেকেই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যুদ্ধের শিক্ষারম্ভ করা হয়।আর কিছু ছেলেকে পুরোহিত বা প্রিস্টের ভূমিকা নিতে হয়।যদিও সে ভার গ্রহনের অনেক নিয়ম নাস্তি আছে।পুরুষদের বহুবিবাহ এখানে ন্যায় সংযত।আর মহিলাদের ক্ষেত্রে তা হলে মৃত্যুদন্ডের কম কিছু ধার্য হয় না।পুরুষরা বিবাহের পরে একটা কুঁড়ে ঘর পায়।সেখানেই তার বউ থাকে।আর পুরুষরা থাকে আলাদা জায়গায়,যা তাদের যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজন।
এদের যুদ্ধদলের নেতাকে বলা হয় উবুটু,যিনি সিদ্ধান্ত নেন কখন তারা কার ওপর যুদ্ধ পরিকল্পনা করবে।এই উবুটু নির্বাচন করে সমাজের বয়স্ক লোকেরা।ক্ষমতা,যুদ্ধের পটুতা ও শৈলী দেখে নির্ধারণ করা হয় কে হবে গ্রামের সর্দার।এই দলে থেকে কেউ যদি দলের বিপরীতে ষড়যন্ত্র চালায়,তাহলে তার মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত।অনেক ঐতিহাসিকদের মতে,তারা মানুষের মাংসও খেত।এই কথা যখন শুনছে,নীলদের মনে পরে যাচ্ছে রবিনসন ক্রুসোর উপন্যাসের ফ্রাইডের কথা,সমুদ্র উপকূলে ওদের তান্ডবের কথা।
অন্যদিকে মহিলারা শিশুপালন, ঘরের সমস্ত কাজ,হস্তশিল্পের নানা দিক নিয়ে কাজ,এবং বার্টার সামগ্রী তৈরীতে ব্যস্ত থাকে।নিজেদের স্বাধীনতা বলে কিছু নেই মহিলাদের।
তারা গান বাজনা,বিভিন্ন ধরনের নাচ নিজেরাই আয়ত্ত করেছে।বাঁশ কেটে বাঁশি,ও আরও নানা বাদ্যযন্ত্র নিজেরাই তৈরী করে গান বাজনা করে থাকে এরা।ওদের গান বাজনার স্টাইল এখন পৃথিবীর বহু জায়গায় খ্যাত।ল্যাটিনো সিনেমায় তাদের শিল্প কীর্তি বহুসময় প্রদর্শিত হয়েছে।
এভাবেই তারা ক্যারিবিয়ার দ্বীপগুলোয় শান্তিতে এখনও বসবাস করে থাকে।কিন্তু একদল ক্যারিব এখনও দক্ষিণ আমেরিকার দেশ গুলোয় থেকে গেছে।তেমনই কিছু সংখ্যক রয়ে গেছে ভেনেজুয়েলার আগুন জ্বলা পরিস্থিতিতে।দেশের খাবার অনটন, খুনখারাপি,ছিনতাই ও নানা দুর্বৃত্ত কার্যকলাপ  এখন আসল হয়ে দেখা দেওয়ায়,বহু মানুষ স্বেচ্ছায় দেশছাড়া হয়েছে।ফলে এদেশের ক্যারিবরাও চলে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে।যে ক্যারিবরা এখন দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোয় থাকে,তারাও এখন শহুরে আদপ কায়দায় অভ্যস্ত।এটা জেনেও যে শহুরে আদপকায়দা এখনো সেখানে প্রবেশ করেনি,বহু সংখ্যক ক্যারিব ক্যারিবিয়ান দ্বীপ গুলোয় চলে গেছে।শান্তির আশায় তারা চলে গেছে নিজেদের মানুষের সাথে থাকবার জন্য।আর কিছু ক্যারিব চলে গেছেন দক্ষিন আমেরিকার অন্য দেশ গুলিতে।কিন্তু এখন সব দেশেরই ফরেন পলিসি খুব নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে।ফলে যেকোনো দেশে চাইলেই চলে যাওয়া যায় না।তাই ভেনেজুয়েলার এই চোদ্দোটি পরিবার পরে বিপাকে।এরা জন্ম থেকেই ভেনেজুয়েলার শহরে মানুষ।কেও কেও চাকরীও করেছে এতকাল,অর্থাৎ স্বচ্ছল জীবন কাটিয়েছে।ফলে তাদের জীবন ওই সমুদ্র উপকূলে,মাছ ও নানাবিধ চাষ করে কাটানো একটু কঠিন হয়ে পরবে।তারা চেষ্টা করে ইউরোপের বা উত্তর আফ্রেকিয়ার কোথাও গিয়ে বসবাস করার কিন্তু সুযোগ হয়নি।ভেনেজুয়ালায় বসবাসরত ছয়টি নিকারাগুয়ার পরিবার ঠিক করে তারা ভারতবর্ষের পূর্বে একটা পাহাড়ি গ্রামে তথা টুরিস্ট স্পটে জীবন কাটাবে।এদের সাথে ভারতের দার্জিলিঙে থাকা এক পরিবারের যোগাযোগ ছিল।তাদেরই পরামর্শে এবং তাদেরই জমিতে থাকবার সুযোগ পেয়ে তারা চলে আসার সিদ্ধান্ত নেই ভারতে।
এই খোঁজ পায় ভেনজুয়েলার পরিবার গুলোর একজন।এবং তারাও যোগাযোগ করে,একসঙ্গে চলে আসে ভারতের রিশপ গ্রামে।
এরা এসেই এখানের হোটেলগুলোর সাথে যোগাযোগ করে,নানা কাজে লাগবার চেষ্টা করে।আর ছেলেরা ড্রাইভার হয়ে যায় টুরিস্টদের ভ্রমনস্থলে নিয়ে যাওয়ার কাজে।মাঝেমধ্যে টুরিস্টদের বায়না পেলে ওদের দেশীয় ধাঁচে নেচে,গেয়ে ওরা গেস্ট হাউসগুলোয় অর্থ উপার্জন করে।এখন ওরা ভালো আছে।
নীল ও মেঘ একমনে এদের সমস্ত গল্প শুনে,ও অনেক প্রশ্ন করে যতটা পেরেছে তথ্য জোগাড় করেছে।এরা অতিথিদের খুব আপ্যায়ন করতে জানে।নীল ও মেঘকে তারা দুপুরে খাইয়েছে।এদের রীতি অনুযায়ী সবাই একসাথে খেতে বসলে প্রথমে একটা গান ওরা নিজেদের ধরনে গাইবে।তারপর খাওয়াদাওয়া।শুধু তাই নয়, তাদের হাতের তৈরী কিছু কাঠের জিনিস উপহার হিসাবে ওদের দিয়েছে।এক চরম ভালোবাসা ও ভালোলাগার আদানপ্রদান হয়ে গেল ওদের মধ্যে।একটা উপকথার দেশে ভেসে চলে গেছিল ওরা সবাই।
এরই মধ্যে একজন ছেলে ওদের ওই পাড়ায় এগিয়ে আসতে দেখা গেল।সে গেস্ট হাউস থেকে এসেছে,ওদের এতো দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে।সময় শেষের দিকে।ওরা আর দেরি না করে তাদের এত সাহায্য,এত তথ্য,এত আদর আপ্যায়নের জন্য ধন্যবাদ ও প্রণাম জ্ঞাপন করে তারা ফিরে এলো মেঘমল্লারে।
দুপুরে ক্ষানিক বিশ্রাম নিয়ে,পাহাড়ের একটা ধারে মেঘ ও নীল।তারা একে ওপরের দিকে তাকিয়ে শুধু ভেবে যায়,কি উপহার তারা পেল ভেনেজুয়েলার এই ভদ্রলোকের থেকে।অনেক ট্যুর তারা করেছে এর আগে।তবে,এটা চিরকাল মনে থেকে যাবে।এ এক নতুন শিক্ষা-এই কিছু সময়ের মধ্যে তাদের সঙ্গে যেন কেমন পরিবারের মতো হয়ে গেছিল।বড্ড মন কেমন করে ওঠে ওদের।পাহাড়ের ধারের রেলিঙের ওপর দুই হাতের ভর দিয়ে ওদের মন চলে যায় ওই কুঁড়ে ঘরে।নীলের দুচোখের কোণে জল।



(৮)

ডুয়ার্স হয়ে গাড়ি শিলিগুড়ির দিকে।আর মাত্র দুঘন্টার পথ।স্ত্রাকা আজ সকালেই পৌঁছে গেছে বাগডোগরা বিমানবন্দরে।আজ বিকেল ৫.২০তে কলকাতার ফ্লাইট;পাঁচ ঘন্টা মতো হল্ট দিয়ে কলকাতা থেকে রাত ১১টায় নিউইয়র্কের ফ্লাইট।ভদ্রলোকের ইন্ডিয়ার কাজকর্ম শেষ।অপেক্ষা করছে নীলদের জন্য।ওদের থেকে কাগজ,ভিডিও সব নিয়ে সে ফিরে যাবে নিজের কর্মস্থলে।
ঠিক দুপুরের দিকে ওরা পৌঁছল বাগডোগরা।স্ত্রাকার সাথে করমর্দন সেড়ে সমস্ত বিষয় নিয়ে তারা আলোচনা করল।তাদের দেখা,জানা সবটা খুলে বলল।নীল উনাকে বিশেষ ধন্যবাদ জানাল তাদেরকে এইরকম একটা অসাধারণ কাজের অংশ করে নেওয়ার জন্য।
নীল ব্যাগ থেকে নথিগুলো বের করে দিল।মেঘ ক্যামেরা থেকে স্ত্রাকার ল্যাপটপে সমস্ত ছবি ও ভিডিও ট্রান্সফার করে দিল।স্ত্রাকা ওদের কাজ দেখে আপ্লুত।তার মুখ দার্জিলিঙে থাকা কালিন যতটা করুণ ছিল,এখন ততটাই আনন্দের।কী করে সে এদের ধন্যবাদ জানাবে,এই ভাষাই যেন সে খুঁজে পাচ্ছে না।কতকালের আত্মীয় বলে বোধ হচ্ছে ওদেরকে।
ওরা সবাই মিলে গিয়ে একটা রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ সারল।সময় হয়ে এসছে-স্ত্রাকা এবার ফ্লাইটের চেকিংএ চলে যাবে।তার হঠাৎ কী মনে হল,নিজের লাগেজ ব্যাগটা খুলে ফেললেন।সেখান থেকে একটা অদ্ভুত ধরনের বাঁশি নীলকে,ও একটা পাথর ও কাঠের তৈরি ব্রেসলেট মেঘকে উপহার দেয়।সে জানাল,এগুলো সে পেয়েছে তৃনিদাদে ক্যারিব ট্রাইবদের কাছ থেকে।ওদের হাতের তৈরি এই জিনিসগুলো।ভারতে আসার পূর্বে যখন সে ক্যারিবিয়ার দ্বীপগুলিতে গেছিল নিজের কাজে,তখন এই উপহারগুলো সে পেয়েছে ওদের থেকে।
এমনটা ঘটতে গেলে ভাগ্য প্রয়োজন।কত ভালোবাসা যেন মিশে গেল ওদের মধ্যে।নীলের মনে পরে গেল রিশপের ওই মানুষগুলোর কথা যাদের সাথে সে একবেলা কাটিয়েছিল।কতটা নিজের বলে মনে হচ্ছে ওদের।বরাবর নীলের আবেগ একটু বেশি।স্ত্রাকাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে সে।
বাইরের আকাশে থমকে আছে মেঘ।থমথমে হয়ে গেছে ওদের মন।স্ত্রাকা যেন কত কালের বন্ধু।মেঘের গর্জনের সাথে মিশে গেল স্ত্রাকার চলে যাওয়ার শব্দ।


Joydeb Biswas

Poet Joydeb Biswas studied Bengali literature. In 2015, at the age of 22, he published 'Sahitya Chetona' magazine. Currently two editions of the magazine are published. One is the online version and the other is the printed version. He is the founder and editor of the two editions. facebook twitter youtube instagram whatsapp

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন