পুজোর ছুটির পর অফিস ফিরছে প্রতাপ । কথাটা অবশ্য একটু উল্টোপাল্টা হল । ‘লোকে বাড়ি ফেরে’ – এ কথাটাই বেশী চালু । কিন্তু প্রতাপের অযথা ছুটি ভাল লাগে না । নতুন পে স্কেল না এনে সরকার সবাইকে ছুটি দিয়ে কবজা করে রেখেছে । যেন ঘরে বসে যাবতীয় উৎসব করলেই সবার সমস্যা মিটে যাবে। ছোট থেকেই ঘরে বসে থাকা খুব অপছন্দ প্রতাপের । ঘর মানে যে একটা এণ্ডলেস ঝামেলার জায়গা গোড়া থেকেই ও বুঝে গেছিল। যদিও আজ পর্যন্ত প্রতাপ ঠিকমতো জানে না কোনটা ওর নিজস্ব জায়গা। এখন দেখছে ছুটি মানে কোথাও যাওয়ার নেই, কিচ্ছু করার নেই ... শুধু একা ঘরে বসে বসে অকারণে চমকে ওঠা । প্রতাপের কিছু ভাল লাগে না, সকাল থেকে উঠেই অসহ্য বিরক্তি লাগে ছুটির দিনে ।
প্রতাপ দেখে আসছে ওর বাবা ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে মুদ্রাদোষের মতো নানারকম সমস্যা, অর্থের অভাবের কথা গুনগুন করতে থাকে । সেটা ইদানিং অন্যরকম শেপ নিয়েছে – ওমুকের ছেলে বিলেত আমেরিকা গেছে, তমুকের মেয়ে ব্যাঙ্গালোর থেকে বাপকে জিনিস পাঠাচ্ছে । এসবে কান ঝালাফালা অবস্থা । মুশকিল হল যেটা, কিছু জিনিসের প্রয়োজন হলে কেনা যায় । সের’ম কিনেও দেখেছে প্রতাপ । আক্ষেপ তো আর কেনাবেচা যায় না। সব ব্যাপারটাই যখন মানসিক ।
প্রতাপ বোঝে, সে যদি ওই ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুরে পড়ে না থেকে চকচকে ব্যাঙ্গালোর থেকে কারো জন্য কিছু জিনিস অ্যামাজন মারফত পাঠাতো – তাহলেই লোকে বলতো ‘কর্তব্যজ্ঞান একেই বলে’ । কিন্তু কলকাতার লোকাল মার্কেট থেকে হাতে করে কিছু কিনে আনা ব্যাপারটা, আউট অফ ফ্যাশান হয়ে গেছে । দাম যাই হোক না কেন ।
প্রতাপের মনে হয় পঞ্চাশ পারসেন্ট ছাড় দিয়ে যে জিনিস বিক্রি হয়, তাতে কিছু না কিছু গলদ তো থাকবেই । অনেকে বলে- দাম চড়িয়ে তারপর ছাড় দিয়ে বিক্রি করে । তাতেও লোকজনের একটা মানসিক শান্তি হয় বটে । যেমন প্রতাপ ওর বাবার মুখে শুনে আসছে, বাজারওলারা নাকি ওনাকে আলাদা রেটে মাল বেচে । কোনও কারণ ছাড়াই ওর থেকে একইভাবে বেশী দাম নেয় ।
আজ এই সোমবার বাড়ি থেকে সদ্য পড়া ঠাণ্ডার মধ্যে সাততাড়াতাড়ি বেরোবার একটাই কারণ – বাসে পছন্দের সিট পাওয়া । শুনলে যে কারোর মনে হবে- মিনিংলেস ! তাতে আপত্তি করার মতো কিছু নেই প্রতাপের । ওর জীবনের বেশিরভাগ জিনিসেরই বিশেষ কোনও মানে নেই। যে কাউকে কনভিন্স করাতেই প্রতাপ ব্যর্থ । ছোট থেকে ঘরে বাইরে সব জায়গায় ‘না’ শুনে সব ইচ্ছেই শুকিয়ে গেছে বলে মনে হয় । তাই সেটাকে অনুকরণ করে সব ব্যাপারে প্রথমে না দিয়ে কথা শুরু করে প্রতাপ । অফিসে ওকে সবাই ‘না’ বাবু বলে ডাকে । কেননা যে কোনও ব্যাপারেই কোমরে হাত দিয়ে গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে না বলাটাই প্রতাপের দস্তুর । সবাই হাসাহাসি করে । তবে কেউ ঘাঁটায় না বেশি, এড়িয়ে চলে বেশিরভাগ লোক । কারণ এখানকার অধিকাংশ লোক পেছনে নিন্দেমন্দা করলেও কেউই সামনে বিশেষ সমালোচনা করে না । মাঝবয়েসি এসব লোক আসলে সব ভীতুর ডীম, দুবার ধমক দিলে বউয়ের আঁচলে মুখ ঢাকে ।
অবশ্য প্রতাপের মুখ গোমড়া হওয়াটা কোনও কারণ মেনে হয় না । কেন হয়, নিজেও বুঝতে পারে না । তবে ও এতদিনে এটা বুঝেছে – মাঝে মাঝে ওর মাথার পোকা নড়ে ওঠে । সেই মুহূর্তে দুনিয়ার কোনও কিছু মানতে ইচ্ছে করে না । সারা জীবনের নানারকম গ্লানি, যাবতীয় কমতি, বিভিন্ন অপমান কিংবা অকৃতকার্য হওয়ার লজ্জা কথা ভুলে যায় প্রতাপ । সাধারণ চেহারা, মধ্যম মেধা এবং ছোট থেকে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের নুন পান্তা সমস্যার মধ্যে বড় হয়েও নিজেকে মনে হয় যেন – এখানকার কেউ নয় । ছোট থেকে ওর মনে হয় – যাবতীয় ঘটনা স্বপ্নের মধ্যে ঘটছে, চোখ খুলে নিশ্চিত অন্য দৃশ্য দেখবে । প্রতাপ ভাবতো সেখানে সব অত্যাধুনিক খেলনা, আলো ঝলমলে বাড়িঘর, কাচের দেওয়ালের ওপাশে পাহাড়ের দৃশ্য, অজস্র ফুলগাছ, খেলার মাঠ এবং সব জায়গায় আনন্দের বাজনা বাজছে । নিজের কালোকুলো হাবাগোবা চেহারার দিকে চেয়ে ভাবতো – এ চেহারাটাও স্বপ্নের অংশ । ঝকঝকে ফরসা রং, সোনালী চুল, বড় বড় নীল চোখ ।
সময়ের সাথে সাথে ও দেখলো – এইসব দুঃস্বপ্নগুলোই স্থায়ী হয়ে আছে । কিছুই নিয়মমাফিক হয়নি । চেহারাটা হয়েছে ভুঁড়িওলা মধ্যবিত্ত বাঙালীর মতো – নিতান্ত এলেবেলে মধ্যত্রিশের কেরানি । আলাদা কিছু হওয়ার নেই । সর্বক্ষণ খাইখাই করা দুনিয়ায় মানিয়ে নিয়েও কোথাও যেন বেজোড় থেকে গেছে প্রতাপ। আজকাল নিজের নামটাকেই বড় ফ্যালাসি বলে মনে হয় ওর ।
‘এর’ম মিনমিনে ছেলের নাম প্রতাপ !’ কৈশোরে মিতালিদির মুখে শোনা এ কথাটা মনে পড়লে এখনও গা রি রি করে ওর । পুজো ফুরিয়ে কালীপুজো ভাইফোঁটা পর্যন্ত প্রতাপদের স্কুল কলেজ ছুটি থাকতো । হেমন্তের এই অদ্ভুত সময়টাকে প্রতাপ ঠিক বুঝতে না পারলেও শরীরে একটা আশ্চর্য শিরশিরানি ফিল করতে পারতো । প্রতাপ লক্ষ্য করেছিল –এই সময়ে আশপাশে পোকামাকড় বেড়ে যায়, পাল্লা দিয়ে বাড়ে শরীরে ছটফটানি । মনের মধ্যে অবিশ্রাম ঘুণ পোকার শব্দ শুনতে পেতো প্রতাপ । পরে মনে হতে লাগলো – ওগুলোর ধ্বনী অনেকটা ‘বিপ বিপ’-র মতো । কোনও অজানা সঙ্কেত ওর কাছে ভেসে আসছে যেন !
দ্রুত অন্ধকার হয়ে আসার জন্য বিকেলের ক্রিকেট ম্যাচগুলো থামাতে হত তাড়াতাড়ি । স্কুল না থাকায় প্রতাপ পড়াশোনার ঝামেলায় বিশেষ জড়াতো না । বরং পাড়া বেড়ানো আর সকালে সাড়ে দশটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত অবিশ্রাম গালগল্প । ওর বাবা পুজোসংখ্যা আনন্দমেলার সাথে কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান কিনে দিত । নিম্ন মধ্যবিত্ত কল্পনায় ছেলেকে বিজ্ঞানী গোছের কিছু হিসেবে উনি কল্পনা করতে চাইতেন বোধহয় । বই দেখে দুএকটা বাচ্চাদের এক্সপেরিমেন্ট করেওছিল প্রতাপ । কিন্তু সে'সবের থেকে নিঃঝুম দুপুরগুলোয় প্রতাপকে বেশি টানতো আর টানতো মিতালিদি । সদ্য মাধ্যমিক পাস মেয়েরা যেমন হয়, সবসময় ফরফর করত মিতালি । প্রতাপের থেকে বছর দুয়েকের বড় । প্রতাপের ক্লাস নাইন – সদ্য রোঁয়া ওঠা শরীর । সব মিলিয়ে একেবারে ঘেমেনেয়ে একসা ।
জীবনের বেশিরভাগ ব্যাপার যে স্বপ্নের মতো ক্ষণস্থায়ী সেটা প্রতাপ বুঝতে পেরেছিল দু’বছরের মধ্যেই, কলেজে উঠে মিতালি স্বাভাবিক নিয়মেই পটাপট অনেকগুলো বয়ফ্রেন্ড জুটিয়ে ফেললো এবং পরে অন্য একজন ইঞ্জিনিয়ারকে ধরে বিয়ে করে ব্যাঙ্গালোর চলে গেল। তারপর থেকে এখানকার কোনও কিছুকেই নিজের বলে ভাবতে পারতো না । সব মেয়ের মধ্যে মিতালিকে খুঁজতে চাইতো প্রাণপণ । কিন্তু নিজে কলেজে উঠে দেখলো – সব মেয়েই অন্যরকম । সকলের স্পর্শ আলাদা । সেটাই স্বাভাবিক হলেও প্রতাপ ঠিক মানতে পারতো না । সবথেকে বড় কথা, ততদিনে যোগাযোগ ব্যবস্থাটা হয়ে গেছে মূলত মোবাইল নির্ভর । অনেকের মুখে শুনেছিল, ছেলেপুলেরা বিভিন্ন কোম্পানির ফ্রি সিম জোগাড় রাতভোর কথা বলে বান্ধবীদের সাথে । প্রতাপ বুঝে উঠতে পারতো না –রোজ একজনের সাথে এত কী কথা বলা যেতে পারে ! ওর নিজের তো কানে ফোন লাগালে অধিকাংশ সময়েই নানা অতিপ্রাকৃত শব্দ ভেসে আসে । অনেকবার সারানোর পরেও ফোনের এই সমস্যাটা যায় নি। তারপর থেকে প্রতাপ ওভাবেই চালাচ্ছে – ফোনে অনেক দরকারি কথা কেটে যায় । প্রতাপ ফাঁকা কলে অনেক না বলা কথা শুনে ফেলে । সব মিলিয়ে জগাখিচুড়ি।
ও সবসময় মনে করতে না পারলেও বুঝতে পারে একটা বেশ বড় প্রশ্ন যেন ওর মাথার মধ্যে রয়ে গেছে । মাঝে মাঝে মাথার মধ্যে কোন দূরাগত কথাবার্তা বেজে ওঠে । প্রতাপ জানে, এসব কথা লোককে বলা যায় না । বললে সবাই সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাতে বলবে। কিন্তু ওর কাছে যেটা সত্যি – সেটাকে নিজে কি করে অস্বীকার করবে ? যদিও ভেবে কোনও কুলকিনারা পায় না ... বুঝতে পারে না ঠিক কোন হিসেবে ওর জীবনে ওর’ম অস্বাভাবিক অনুভূতি হয়েছিল !
যদিও আজকাল কিছুতেই ও গা করে না । এখন যেমন প্রতাপের মনে হচ্ছে – সোমবার সকালে কানে হেডফোন লাগিয়ে কার্তিকের ঠান্ডা হাওয়ায় বাসের জানলাটুকুই এখন ওর জীবনের একমাত্র ইন্সেন্টিভ । বাকী সবকিছু হয়ে দাঁড়িয়েছে বারবার ফোটানো চায়ের মতো বিস্বাদ ।
প্রতাপ বসে বসে এক মনে ভাবতে থাকে কর্পোরেট চাকরি না পেলে এই একটা সমস্যা, আশপাশের লোকগুলোকে কির’ম যেন গেঁয়ো প্রকৃতির মনে হতে থাকে । আরও বিরক্তিকর, যেন তেন প্রকারেন তাকে ওরা নিজেদের মতো করে ট্রিট করতে চায় । তখন তাদের মাথায় থাকে না, অফিসের আর্জেন্ট কোনও দরকারে টানা বারো ঘণ্টা একনাগাড়ে কাজ উতরে দেওয়ার ক্ষমতা প্রতাপ ছাড়া কারো নেই । যদিও সেটা ক্লারিক্যাল কাজ... তবু কাজ তো! হোক না একঘেয়ে ।
২
জীবন মানে এক অনন্ত পর্যাবৃত্ত গতি । একটা এন্ডলেস চলা । ছোট থেকে প্রতাপ বুঝে ফেলেছে । দিনের পর দিন বছরের পর বছর একই জীবন, অধিকাংশ লোক সের’ম করেই বাঁচে । সেজন্যই সবাই একরকম । তারা হাসে গায়, বই পড়ে না ফেসবুক করে, ছবি তোলে, বসকে তেলায়, ক্রেডিট কার্ডের বিল ফেলে রাখে, ছেলেমেয়েকে ইংরাজি স্কুলে পড়ায় আর বউয়ের ভয়ে লুকিয়ে মদ খায় ।
প্রতাপ জানে, এর বাইরে কারো কোনও লুক আফটার নেই কারণ তারা বাঙালি । প্রতাপ ভাবে এই ফেলাছড়া জীবনের জন্যই বাঙালির ইতিহাস বিশেষভাবে কোথাও লিখিত নেই । যা লেখা – সব সাহেব্দের হাত ধরে । ক্লাস টুয়েলভে ‘সেই সময়’ পড়ার পর থেকেই প্রতাপের বাসনা ওর’ম কোনও ব্যাপার নিয়ে একখানা নভেল লেখার । কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই কুঁজোর চিৎ হয়ে শোওয়ার শখের মতো – সেসব অপূর্ণই থেকে গেছে প্রতাপের জীবনে । এসব কাহিনীর বদলে প্রতাপকে লিখে যেতে হচ্ছে নানারকম হিসেবনিকেশ, অফিসিয়াল চিঠিপত্র ।
প্রতাপের মনে হয় – দুনিয়াই এই লাইনেই সবথেকে বেশি কালী ও পাতার ব্যবহার হয়েছে । সেটাকে ব্রিটিশ যুগে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছিল কিছু বাঙালী । প্রতাপের ধারণা, সে যুগ থেকে লেখাপড়া বলতে মানুষ এটাকেই বুঝে এসেছে । প্রতাপের মনে আছে- ওর এক পিসেমশাই ছিল, সে যুগে সাহেব কোম্পানিতে কাজ করা লোক । সম্ভবত স্টেনোগ্রাফার ছিলেন । বাঙালি সমাজে ইংরাজি জানা লোকের কদর ও দাপটের নামই যে জামাই আদর – ছোটবেলায় দেখেছিল প্রতাপ । ওনার বাড়িতে একটা টাইপ মেশিন দেখেছিল । পিসেমশাই ওর নাম ইংরাজিতে লিখে কাগজটা ওর হাতে দিয়েছিল – সে প্রতাপের এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা । ছাপা সম্বন্ধে বেশ অনেকদিন পর্যন্ত ওটাই ধারণা ছিল।
কম্পিউটার পূর্ব যুগে এই টাইপ মেশিন যে একটা সাড়া জাগানো ব্যাপার ছিল – তার অবশেষ প্রতাপ দেখেছিল শ্যামবাজারের মোড়ে বা শিয়ালদায় । নড়বড়ে একটা টুলে বসে টাইপ মেশিন নিয়ে কত শত সহস্র লোক জীবিকার প্রয়োজনে কত সাদা কাগজে কালির দাগ ফেলেছে তার ইয়ত্তা নেই । প্রতাপ নিজেকে এদের দলেই ফেলে । কারণ রাইটার্স বিল্ডিংয়ের কোনও লোক এক লাইন কাব্যও করেনি । লিখেছে অফিসের চিঠিপত্র, হিসেব আর সার্কুলার । যেগুলো ঐতিহাসিক জিনিস । কেউ মানুক না মানুক প্রতাপরা এখন ওয়ার্ড বা এক্সেলে সেই ইতিহাসকেই লিপিবদ্ধ করে চলেছে ।
আজকাল লোকে যেন টেকনিক্যাল কাজ ছাড়া কোনও ব্যাপারকেই গুরুত্ব দিতে চায় না – কথাটা মনে পড়তে কাউন্টার যুক্তি ভাবতে থাকলো প্রতাপ । মনে হল, দুনিয়ায় সভ্যতার সিংহভাগ ইতিহাস তো কেরানির হাতেই রচিত । ভাবতে ভাবতে আবেশে চোখটা একটু লেগে এসেছিল বোধহয়।
হঠাৎ একটা ঠেলায় চটকা ভেঙে গেল প্রতাপের। ওর ঠিক পাশেই একটা মাঝবয়েসী লোক । লোকটা মুখটাকে যথাসম্ভব বিনীত করে কিছু বলার চেষ্টা করছে। প্রতাপ বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে লক্ষ্য করলো লোকটার পাশে একটা আলগা চটকওলা মেয়ে । খেয়াল করতে লোকটার খোঁচা খোঁচা গোঁফের ফাঁক দিয়ে বেরোনো কথাটা বুঝতে পারলো – সেই এক আবেদন, জানলার ধারের সিটটা ছেড়ে দেওয়া । এটা ওকে প্রায়ই ফেস করতে হয় । প্রতাপ বুঝতে পারলো খানিকটা অবাক হয়ে মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কেন কে জানে, আজ আর টেটিয়ার মতো ব্যবহার করতে ইচ্ছে করলো না । জানলা থেকে সরে আসার পরিবর্তে কৃতজ্ঞ চোখে মেয়েটার তাকানোতে মনে হল ‘কোথায় যেন দেখেছে’ । একথাটা শুনলে অবশ্য সবাই বলে এই অনুভূতিটা ত্রিশ পেরোনো সব ছেলেরই হয় । তাছাড়া কার্তিক মাস পড়ে গেছে, শরীরে নাকি ঢেউ ওঠে এই সময়ে ।
লোকটা এতক্ষণে বেশ বিগলিত মুখে কথাবার্তা শুরু করেছে । তবে বসার ব্যবস্থাটা একটু বিসদৃশ হয়েছে বলেই মনে হল প্রতাপের । জানলাটা ছেড়ে ও দু’নম্বর সিটে বসেছে । একদিকে মেয়েটা, আরেকদিকে তার বর । মেয়েটার বাঁ কাঁধের সাথে প্রতাপের ডান কাঁধ ছুঁয়ে আছে। আলতো স্পর্শে প্রতাপের মাথা ঝিমঝিম করছে । আচ্ছন্ন ভাব এসে যাচ্ছে, তবু লোকটা নানারকম কথা বলে চলেছে, বাধ্যত প্রতাপ ‘হু’ ‘হ্যাঁ’ করে উত্তর দিচ্ছে । কথাবার্তায় প্রতাপ বুঝেছে কিছুদিন হল এদের বিয়ে হয়েছে । লোকটা জানিয়েছে প্রতাপের মেস আর ওদের বাসা কাছাকাছি । আকারে ইঙ্গিতে প্রতাপ বুঝেছে লোকটাকে দেখতে এর’ম মরকুট্টে হলেও বেশ অবস্থাপন্ন । এখন বিজয়া সেরে ফিরছে কলকাতায় শ্বশুরবাড়ি থেকে । লোকটা কলকাতা বললেও প্রতাপ জানে জায়গাটা আসলে বৃহত্তর কলকাতার অংশ । যদিও সেসব নিয়ে বেশী ভেবে লাভ নেই কারণ ও নিজেই সপ্তাহে কয়েক ঘণ্টা ছাড়া বাকী সময় কাটায় পঞ্চায়েত এলাকায়। সুতরাং শহর গ্রাম, ফরসা ময়লা, আলো আঁধার নিয়ে ব্যাগেজ বয়ে বেরাবার কোনও মানে হয় না । কারণ ইতিহাস জিনিসটা বড় সাম্প্রতিক । প্রতি যুগে বদলে দেওয়া হয়।
ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত বাঙালি কেরানিদলে প্রতাপ অন্তর্ভুক্ত হওয়াতে ওর যে বিরাট মেন্টাল সেটব্যাক হয়েছিল তা নয় । বরং ক’বছরের বেকার দশা কাটিয়ে ও মনের দিক থেকে বেশ শক্তপোক্ত হয়ে গেছে ততদিনে । তার আগের কয়েকবছরে বায়োলজির তত্ত্ব নিয়ে তার নাড়াঘাঁটা করার স্মৃতিও মুছে এসেছিলো পরিস্থিতির চাপে । তাই মফস্বলের এর’ম একটা অফিসে মাছিমারা কেরানি হওয়াটাকে মেনেই নিয়েছিল প্রতাপ। যদিও মাঝে মাঝে মনে হতো – মেসে থাকা অন্যদের থেকে ও আলাদা । বেশভূষা চলনবলন ও মেজাজের কারণে অন্যরাও ওকে খুব সুনজরে দেখতে না।
এই মেয়েটাকে যে খুব চেনা মনে হচ্ছে সেটা সত্যি । মাথার মধ্যে কে যেন বলছে – এই মেয়েটাই ! এর জন্যই এতো পথ ঘুরতে হয়েছে । আবছা আবছা মনে হচ্ছে কি যেন একটা জটিল জেনেটিক সঙ্কেত তাদের মাধ্যমেই প্রাণ পাবে। মাথার ভেতর এসব শুনতে শুনতে চোখটা আবার লেগে আসছে বলেই হয়ত প্রতাপের মনে হল মেয়েটার নাম রাই। নামটা কি একটু বেমানান হয়ে গেল? তারপর প্রতাপ নিজের মনেই বলল, এইতো ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুর... রাই ঠিকই আছে । বরটাই বা কি একেবারে কানাইকুমার !
৩
জীবন বৈচিত্র্যহীন । যাবতীয় আবিস্কার, উত্তেজনা, যুদ্ধ, প্রতিযোগিতা কমে এই সহস্রাব্দে সভ্যতার যা অবস্থা – তাকে এককথায় সম্পৃক্ত বলা চলে । আগের সহস্রাব্দের মতো ব্যক্তিগত কারণে লড়াই কিংবা একজনকে পেছনে ফেলে অন্যজনের এগিয়ে যাওয়ার যে ক্ষয়ক্ষতি – এখনকার লোকজন তা বুঝতেই পারবে না । তবে বিরোধি পক্ষের নেতা চার্বাক মাঝে মাঝে বলে – জীবন একেবারে পানসে হয়ে গেছে ... কোনও থ্রিল নেই । ‘নেশা গণিকা জুয়া’ সভ্যতার এই তিনটে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভকে অস্বীকার করার মানে সভ্যতার ইতিহাসকে অস্বীকার করা । আরও একটা বড় সমস্যা হয়েছে – কারো এক্সট্রা এফোর্ট দেওয়ার উৎসাহ নেই কারণ আলাদা করে কিছু পাওয়ার নেই । জন্ম থেকে সবই তো একই গতে বাঁধা । ‘যা হবার তাই হবে’ এই ধারণা নিয়ে চললে কেউ কোনও ব্যাপারে উৎসাহ পাবে কী করে ! সত্যিই কেউ আলাদা করে কিছু করার স্বপ্ন দেখে না – সেই সম্ভবনাটাই মরে গেছে । কারণ প্রয়োজনীয় সবকিছুই অল্প আয়াসে পাওয়া যায় ।
সেটা খানিকটা সত্যি কারণ এখন জীবন শুরু হয় জেনেটিক ডিজাইনের মাধ্যমে । পুরোটাই পূর্ব পরিকল্পিত - বছরে কতজন ডাক্তার কতজন বিজ্ঞানী কত শিল্পী বা ক্লার্ক জন্মাবে । সব ঠিক করা । পুরো ব্যাপারটাই ঘটে মাদার কম্পিউটারের নির্দেশ মতো । সেই নির্দেশ বয়ে আসে নিউরন বেয়ে মস্তিষ্কে । তাকে অস্বীকারের কোনও উপায় নেই । সেইভাবেই আগের প্রজন্মগুলোর মিলন ঘটে । প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম মেনে একই ধাঁচের দুজনকে বেছে নেওয়া হয় । তাদের কাছাকাছি আসা এবং সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করাও মাদার কম্পিউটারের অদৃশ্য নির্দেশেই হয়ে থাকে । এখন তাই পুরুষ ও নারীর কম্বিনেশান নিয়েও কারো কোনও অভিযোগ নেই । আগের সহস্রাব্দের নারী সংক্রান্ত ঈর্ষাও নেই এখন । কারণ বিশেষ নারীকে ছাড়া অন্য নারীদের দেখে পুরুষের কোনোরকম আকাঙ্খা তৈরী হয় না । নারীদেরও একই ব্যবস্থা ।
বলা বাহুল্য – শিশু জন্মের পর থেকে তারা সেইভাবেই নিয়ন্ত্রিত হয় । আলাদা করে পুরস্কার বা তিরস্কারের ব্যবস্থা নেই। যে যে’রম তাকে সেখানেই ফিট করা হয় । কাজ দেওয়া খাবার দেওয়া শিক্ষা স্বাস্থ্যর ব্যবস্থা সবটাই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে হয় । আগেকার যুগের কল্পিত যৌথ ব্যবস্থা এখন বাস্তবায়িত হয়েছে । তার প্রধান কারণ হচ্ছে – মানুষের শরীর বা মস্তিষ্কের বিশেষ ব্যবধান না থাকা । অন্যদেরকে ঠকানোর মতো কেউ না থাকলে স্বাভাবিকভাবেই সমস্যা কমে আসে অনেকটা । আর মেলামেশাটাও নিজেদের স্তরেই হয়ে থাকে । ফলে তুলনার কোনও উপায় নেই। আর তাতে কারো হীনমন্যতাও নেই, খুশিও নেই ।
এছাড়া আছে যন্ত্রমানব – যাবতীয় কায়িক শ্রমের জন্য যারা নির্দিষ্ট । তাদের চেহারাও একইরকম, কাজকর্মের ধারাও একই কিন্তু ক্লান্তিহীন । ফলে সেনাবাহিনী কিংবা নিরাপত্তারক্ষী, শ্রমিক বা কৃষক, খেলাধুলো থেকে কম্পিউটার অপরেটর – কোনও কাজ মানুষ করে না । সবাই ভুলেও গেছে এসব কাজ ।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে পৃথিবীর অধিকাংশ জায়গা ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার পর শান্তিরক্ষা কমিটি পৃথিবীর অবশিষ্ট লোককে নিয়ে একটা সম্মিলিত সভ্যতা গড়ে তুলতে চেয়েছিল । ক্রমে সেই দিকেই এগিয়েছে মানব ইতিহাস । সে সময়ে কোনও ভেদাভেদ না থাকাটাই কাম্য ছিল। তাই নানারকম জেনেটিক পরীক্ষার মাধ্যমে যাবতীয় ব্যবধান মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল । ফলে পৃথিবীর সর্বোত্তম হিসেবে মেডিটেরিয়ানের মানুষের চেহারাকে স্যাম্পল করে কয়েক প্রজন্ম ধরে সবার চেহারাকে সেরম রূপ দেওয়া হয়েছে । চেহারা নিয়ে প্রাচীন মানুষদের যে কমপ্লেক্স সেটাও আজ নেই। সবাই গৌরাঙ্গ, নীল চোখের মণি, স্বর্ণালি কেশ । চেহারার গঠনও সবার একইরকম – ছিপছিপে । কারণ নিয়মের বাইরের কোনও খাওয়ার অভ্যেস তৈরি হয় না । গড় আয়ু বেঁধে দেওয়া আছে – একশো বছর । সত্তর আশি এমনকি নব্বইতেও শারিরীকভাবে সবাই সক্ষম । জীবনে অ্যাডভেঞ্চার বলতে উইকএন্ডে রক ক্লাইম্বিং কিংবা স্কুবা ড্রাইভিং । তা একঘেয়ে হয়ে গেলেও কিছু করার ছিল না । কারণ এখানে নেশার কোনও জিনিস পাওয়া যায় না । প্রাচীন ইতিহাসে নানারকম জুয়া খেলার উল্লেখ থাকলেও কেউ এখন সেসবের সুযোগ পায় না ।
মোটের ওপর সবাই শান্তিতে এবং স্বস্তিতে আছে বলেই ভেবেছিল হেড কোয়ার্টার । যদিও হেড কোয়ার্টারের কাজ হল শুধুমাত্র তাৎক্ষণিক কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া। কারণ সভ্যতা চলছে মাদার কম্পিউটারের নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে । তাই কিছু বিছিন্ন ঘটনা ঘটলেও সেটাকে পাত্তা দেওয়া হতো না এবং সে খবর প্রকাশিত হত না । কিন্তু ক্রমে ব্যাপারটা আর চাপা রইল না । বিরোধি পক্ষ এই মওকায় ইস্যু পেয়ে গেল ।
আগের জেনারেশানের মানুষদের স্বাভাবিক প্রবণতা ছিল নিয়ম ভাঙার । সেটা যে কীভাবে আজকাল কিছু লোকের মধ্যে বয়ে এসেছে কে জানে! হেড কোয়ার্টার সন্দেহ করেছিল – আধুনিক নারীদের তার পুরুষ সঙ্গীর সব কথায় উল্টো কথা বলার প্রবণতাটাই সঞ্চারিত হয়েছে এদের মধ্যে। সেই ব্যাপারটাকে নারীদের জিন থেকে বাদ দেওয়া যায়নি ।
অদ্ভুত ব্যাপার যেটা, এই ধরণের নিয়ম ভাঙতে চাওয়া অধিকাংশ লোক অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাজের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। এদেরই সবথেকে স্থিতধী হওয়ার কথা । বিরোধী পক্ষের চক্রান্তে এদের উত্তেজনার কম্পোনেন্টটাও বেড়ে গেছিল । যদিও কেউ সে দায় নেয়নি । নানারকম চাপানউতোরের পর কাউন্সিলে ঠিক হয় – কয়েকজোড়া ঝামেলাপ্রবণ লোককে সভ্যতার বিভিন্ন সময়ে পাঠিয়ে সেখানকার পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা করানো হবে । মানে মোদ্দা কথায় – জীবন যে আগে কতটা কঠিন ছিল, সেটার ধারণা দেওয়া হবে। যে অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতের জন্য স্টোর করে রাখা থাকবে । যাতে পরবর্তীতে কেউ অযথা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা না করতে পারে।
কিন্তু এর ফল হল উল্টো । এই লোকগুলো সভ্যতার বিভিন্ন টাইমে গিয়ে একেবারে ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটালো । ফলে ঘেঁটে গেল ইতিহাসের গতি। রিরাইট করতে হল ভবিষ্যৎ । সেই ব্যাপারগুলোকে আগেকার মানুষ বুঝতে না পেরে এলিয়েন নামক কিছুর কল্পনা করেছিল ।
তখনকার টেকনোলজিতে মনিটর করার ব্যবস্থা ছিল না বলে পার্টিকেল অবস্থায় তারা গর্ভস্থ ভ্রূণকে দখল করলো এবং ক্রমশ বেড়ে উঠে সেসময়ে আত্মপ্রকাশ করলো । সভ্যতা যে গতিতে এগোচ্ছিল – এই লোকগুলো উপস্থিত হয়ে কয়েক কদম এগিয়ে দিল তাকে । এগিয়ে থাকা বুদ্ধি ও বিজ্ঞানের সাহায্যে তারা হয়ে উঠল নির্নায়ক । তাদের সেই যুগের লোকেরা অসাধারণ বলে মানতে লাগলো । সেই বিশেষ অনুভূতিটা জানা ছিল না বলে – বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠল ব্যাপারটা । তাই এখানকার অনেক মানুষ বিভিন্ন সময়ে বারবার ফিরে গেছে । আগেকার লোকেরা তাদের অবতার বলে ডাকতে শুরু করে । এদের কথা মেনে চলা লোকেরা সভ্যতায় আলাদা জায়গা করে নিয়েছিল । এদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিল-KRISH সিরিজের NA স্যাম্পেলটি । JES সিরিজেরUS স্যাম্পেলটি তো এমনভাবে ফেঁসে গেছিল, একবার ফিরে এসেও আবার ক’দিনের জন্য ওখানে ফিরে গেছিল । কাউন্সিল দেখেছিল পরবর্তীতে সেই স্টাণ্ডার্ডের কেউ যায়নি, বরং গোলমাল পাকিয়েছে অনেকে । HIT সিরিজের LR স্যাম্পেলটা ছিল এর’ম । এই ধরণের লোকেরাই পৃথিবীতে ঘনিয়েছিল যুদ্ধ । পৃথিবীর বেশীরভাগটা ধ্বংস হওয়া যার ফলশ্রুতি । তার জন্য অনেকাংশে দায়ী EINS সিরিজের অসাধারণ TIN স্যাম্পেল । কাউন্সিল হিসেব করে দেখেছে ১৮৫০-১৯৫০-সালের ভেতরে এই ধরণের লোক সবথেকে বেশী গিয়ে প্রভাবিত করেছে সভ্যতাকে । ফলে সভ্যতার গ্রাফটা হঠাৎ নড়েচড়ে গেছে ।
এদের বিস্তারিত জীবন পঞ্জি পড়ে অধিকাংশ লোক খানিকটা আশ্চর্য হলেও সমস্যা কিছু ছিল না । কিন্তু কিছু উঠতি ছেলে মেয়ে এই ব্যাপারে হঠাৎ বেশ উৎসাহী হয়ে উঠল । অফিসিয়ালি না হলেও সময় সুযোগ করে তারা ফাঁকফোকর গলে আগেকার সময়ে যেতে শুরু করলো । তবে সবাই যে ঠিকঠাক ফিরে আসতে পারতো তা নয় । তবু নিষিদ্ধ জিনিসের দিকে মানুষের স্বাভাবিক আকর্ষণ কমানো যায়নি ।
এখন আসল সমস্যা হয়েছে যেটা, বহুলোক নিজের সঙ্গিনী নিয়ে নানা সময়ে ছড়িয়ে পড়ার পর কন্ট্রোল সিস্টেম তাদের সিগন্যাল পাঠিয়েও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না । তার কারণ এরা এলোপাথারি গেছে, নিয়ম কানুন না মেনে এবং বেশীরভাগ সময়েই কোনও ডক্যুমেন্টেশান নেই এদের । ফলে কে ফিরেছে, আর কে থেকে গেছে সঠিক হিসেব পাওয়া যাচ্ছে না । টোটাল এই ডিসঅর্ডারের কারণ হিসেবে যেটা ভাবা হচ্ছে – আগেকার সেই আশ্চর্য জীবনযাপনের স্বাদ পেয়ে ওরা খুশি । বিজ্ঞানীদের ধারণা, প্রাচীন মানুষের জিনে লেগে থাকা যাযাবর জীবনের স্বাদ নতুন করে পেয়েই লোকগুলো ভীষণ উত্তেজিত হয়েছে । তার সঙ্গে আছে এতদিনকার খচড়ামির চেপে রাখা বাসনা। লোকগুলো পুরনোকালের নানারকম শয়তানি শিখে নিয়ে বাকীদের থেকে ভালো করে করতে পারছে। কারণ তাদের ব্রেন খানিকটা এগিয়ে আছে ।
ওখানে গিয়ে এরা নিজের সঙ্গী সঙ্গিনীর বদলে অন্যদের সাথেও খেলায় মেতে উঠছে । তাতে যে তারা বেশ খুশি বুঝতে পারলেও ব্যাপারটা কোনও প্রকারেই সামলাতে পারছে না কাউন্সিল । সঙ্গে আছে বিরোধী পক্ষের বাগড়া । তারা এই ঘটনাগুলোকে শুধু যে কাউন্সিলের ব্যর্থতা বলে চালাচ্ছে তাই নয়, ওই উত্তেজিত লোকগুলোকেও প্রভাবিত করছে । কেননা, বিরোধী পক্ষ প্রচার করতে শুরু করেছে – এই ত্যাঁদড় লোকগুলোই নাকি বরাবর সভ্যতাকে দিশা দেখিয়েছে । সভ্য ভদ্র ভালো মানুষের পক্ষে নতুন দিশা দেখানো সম্ভব নয়, তারা নিয়ম মেনে চলে। আর সময় যতটা খারাপ – মানুষকেও তার সাথে পাল্লা দিয়ে ঢ্যামনামি শিখতে হবে । সেটাই নাকি সভ্যতার দাবী ।
৪
কলেজে প্রতাপের বিষয় ছিল জুলজি । ও ডাক্তার হতে চেয়েছিল কিন্তু জয়েন্টে পায়নি । তাই অগত্যা বায়োলজিকে ভালবেসে জুলজি পড়া । সেকেন্ড ইয়ারে এসকারশানে কলেজ থেকে পুজোর পর এক কার্তিকে চাঁদিপুর যাওয়া হয়েছিল । আর সবার মতো কিছু সি লাইফ সংগ্রহ আর মূলত আড্ডা ঘোরাঘুরি ।
সেসব দিনের কথা মনে পড়লে কিছুটা হাসি পায় প্রতাপের । তখন পর্যন্ত কলেজের টিচাররা গ্রাজুয়েশানের ছেলেমেয়েদের এস্কারশানে নিয়ে গিয়ে খানিকটা বাচ্চাদের মতো ট্রিট করতো । প্রতাপরাও সেসব বেশ আনন্দের সাথে মেনে নিত কেননা ছেলেমেয়েদের একা একা একসাথে বেড়াতে যাওয়া সামাজিকভাবে খুব বেশী স্বীকৃত ছিল না । এখন প্রতাপ শুনতে পায়, ছেলেমেয়েদের সম্পর্ক অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে । তারা নিজেরাই দলবেঁধে বেড়াতে যায়, একসাথে গল্প করে, রাত জেগে মালঝোল খায় তারপর শুয়েও পড়ে । বাড়ির খেঁচা গার্জেনরা কেউ কি আপত্তি করে না ! জানে না প্রতাপ ।
খালি একটা ব্যাপারই প্রতাপের বোধগম্য হয় না । আজকাল সবার বাপ মা কি বড়লোক হয়ে গেছে ? নয়তো এতো টাকা ছেলেমেয়েগুলো জোগাড় করে কী করে ! ফোন ল্যাপটপ চকচকে জামাকাপড় শপিংমল রেস্টোরেন্ট যাওয়ার টাকাই বা জোটে কী করে ! ওদের সময়ে হাতখরচের একমাত্র উপায় বলতে ছিল – টিউশানি করা । প্রতাপ অবশ্য বেশ উৎসাহের সঙ্গে করতো সেসব। তখন থেকেই বুঝেছিল – টাকা মানে একটা স্বাধীনতা, আর কিছু নয় ।
টাকা না থাকলে বান্ধবীকে নিয়ে যে ঘোরা যায় না – সেটুকু বোঝা হয়ে গেছিল প্রতাপের । তখন অবশ্য মেয়েদের নিয়ে ফুচকার বেশী খাওয়ার রেস্তো ছিল না। তবু তাতেই কীভাবে যেন সঞ্চারী এসে জুটেছিল জীবনে । জীবনে না হলেও শয়নে স্বপনে । হঠাৎ অন্ধকার হয়ে আসা কার্তিকে ছোটবেলায় দেখা টাইটানিকের রোজের মতো ওকে ঝলমলে মনে হতো । একসাথে বাসে করে কিছুটা বাড়ি ফেরার পথ কিংবা ক্লাসরুমে চোখাচোখি বা ল্যাবে সামান্য আঙুল ছোঁওয়া একটু আধটু হাসি... এই যথেষ্ট ছিল । প্রতাপ চাইতো মিতালির স্মৃতি থেকে প্রাণপণে বেরিয়ে সঞ্চারীকে আঁকড়ে ধরতে । অবশ্য সঞ্চারীর ব্যবহার যে খুব পরিষ্কার ছিল, তা নয় । তবু প্রতাপ এটুকু বুঝতো, ওকে অপছন্দ করে না মেয়েটা । তাহলে তো আর নিজে থেকে কথা বলতে আসতো না । সেও তখন সদ্য যুবতী, তার রূপের মহিমা আছে জানলেও সেটার বিক্রয়মূল্য সম্বন্ধে ধারণা হয়নি সম্ভবত । তাই জানা না বোঝার মধ্যে চাঁদিপুরে গিয়ে একসঙ্গে ঘোরাঘুরি, সমুদ্র স্নানের সময় সামান্য হাত ধরা... এতেই সন্তুষ্ট ছিল প্রতাপ । যদিও তখন ও জানতো না এসব স্মৃতি ছেলেরা যতোটা মনে রাখে, মেয়েরা সেসব সহজেই ভুলে যায় । তাই কাঠবেকার দশায় প্রতাপ যথানিয়মে খবর পেয়েছিল সঞ্চারী বিয়ে হয়ে বিদেশ চলে গেছে ।
সেই স্মৃতির টানেই হয়তো আবার অফিসের ক’জনের সাথে এবার কার্তিকে চাঁদিপুরে আসতে রাজী হয়েছে প্রতাপ। প্ল্যানটা আগে থেকেই করা ছিল । পুজোর ছুটি কাটিয়ে উইকএণ্ডে যাওয়া হবে । এখন তো আর ঝিনুক কুড়নোর ব্যাপার নেই । শুধু মাছভাজা মদ খেয়ে খিস্তিখেউড় করা । সারারাত হুল্লোড়ের পর সবাই শুতে গেলেও মাথায় একটা ভোঁতা ব্যাথা আর শরীরে একটা অস্বস্তি নিয়ে চারটে নাগাদ প্রতাপ বেরিয়ে পড়েছিল। তখন আলো বিশেষ ফোটেনি । সমুদ্রও অনেকটা পিছিয়ে গেছে । ফলে লোকজন বিশেষ নেই। দিগন্ত বিস্তৃত সৈকতে অলস পায়ে হাঁটছিল প্রতাপ । একটা জায়গায় দেখল বেশ কিছু কাক আর পাখির জটলা । কিছু ভেসে এসেছে কিনা দেখার জন্য এগিয়ে গিয়ে প্রতাপ অবাক হয়ে দেখেছিল অতিকায় পাখির মতো কিছু একটা বালিতে মাখামাখি হয়ে ছটফট করছে । আরও কাছে গিয়ে মনে হল ঠিক পাখি নয়, মানুষের মতোই কিছু । তার শক্তিশালী ডানা মাঝে মাঝে ঝাপ্টাচ্ছে । প্রাণীটা যেন কাতরাচ্ছে কোনও অজানা ভাষায় । প্রতাপের মনে হয়েছিল ছোটবেলায় মহালয় শোনার সময় টিউন না হওয়া রেডিওটার মতো ঘসঘসে শব্দ । মানুষের মতো গড়ন – পিঠে ডানা... নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না প্রতাপ । এই প্রানীর বায়োলজি সম্বন্ধে তার কোনও ধারনা নেই । কারোরই নেই । বড়জোর পৌরাণিক কাহিনী অনুসরণ করে কল্পনা করা যায় মাত্র । আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি ও । প্রাণীটার কাছে ছুটে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার মতো একটা অনুভূতি, সাথে মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা । চোখে অন্ধকার দেখল প্রতাপ । মনে হল পড়ে যাচ্ছে। চোখ বুজে আসছে । কিন্তু ভেতরে জ্ঞান ছিল পরিস্কার । সেই ঘসঘসে রেডিওর কন্ঠস্বরে প্রতাপ বের পরিস্কার বাংলা শুনতে পেল তারপর । যথাসম্ভব উত্তরও দিল ...
-তোর জন্যই এই সমুদ্রের আশপাশে ওড়াউড়ি করে ভিজে নোনা হাওয়ায় ডানার এই অবস্থা হয়েছে । এতটা পথ এসে তোকে খুঁজে বের করা কি সোজা কথা
-মানে আমাকে খোঁজাখুঁজি কেন ? আর এই উৎপটাং চেহারা নিয়ে কোথা থেকে এলে কমরেড
- সে বেত্তান্ত তোর মতো গবেটের খুপরিতে ঢুকবে না... অনেক অরবিট পেরিয়ে, টাইমজোন ঘেঁটে আসতে হয়েছে। কারণ হেড কোয়ার্টার তোদের মতো ঢ্যামনাদের এবার বাজারে ছাড়তে চাইছে... নয়তো যন্তরগুলোকে ঢিট করা যাবে না ।
- কোথায় ছাড়বে? কাকেই বা কেলাতে হবে !
- সারারাত ধরে বাংলা ইংরিজি একসাথে খেলে এসব গুহ্য কথা বোঝা যায় নাকি !
- বাতেলা করো না তো... তুমি কে হে বাল
- তোরা কি বুঝবি... যুগ যুগ ধরে বড় বড় লোকের কাছে খবর আনছি ... তাদের আপ্যায়নও ছিল বটে, রাজকীয় ব্যাপার এক্কেরে
- আসল কথাটা বলবে তো...
- দেবদূত বলে লেখে ... মহাকাব্য তো আর পড়িসনি
- ওরে আমার দেবদূতরে...হেগেমুতে একেক্কার... বালীতে ডানা ঝাপ্টাচ্ছে
- ইয়ার্কি ছাড় ... কথা হল তোর সাথে যোগাযোগ করা, ফিরে যাওয়ার কথাটা জানানো ... বাকীটা তিনি বুঝে নেবেন কখন কি করতে হবে ...ডাক এলে ফিরে যেতে হবে, যখন যেখানে যে অবস্থায় থাকিস না কেন ! আমার ওপর অর্ডার করেই তো সব খালাস, এদিকে এঙ্ক্রিমেন্টের নাম নেই
- কিন্তু যোগাযোগ হল কি’করে... আমার পেছনে কি ইউএসবি গুঁজে দিয়েছ নাকি !
-ওরে গবেট বুঝছিস না ... তোর সাথে যোগাযোগ না হলে তোর ইতর ভাষায় কথা বলছি কি’করে !
-হুম ...কিন্তু কোথায় যাবো ? কিছুটা অবাক হয়েই প্রতাপ বলেছিল ...
-মোদ্দা কথা হল যা শুনছি, আমাদের ভদ্দরলোকের দুনিয়ায় সব তেঢ্যামনা রোবটদের মোকাবিলায় ঈশ্বরের বরপুত্ররা পেরে উঠবে না, তাই তোদের দরকার । তোরাই বাঁচাবি দুনিয়াকে । নতুন প্রজন্মকে সেভাবেই তৈরি করতে হবে ।
- তা একা একা প্রজন্ম তৈরি করবো কিকরে ... সে ব্যবস্থাটা করো দেখি ... তারপর না হয় দিকে দিকে ছিটিয়ে বেড়াবো...মিতালি তো কবেই ভেগে গেছে ... রাইকে পটাবো কী করে ?
-সে বন্দোবস্ত হবে ... তোর মতোই মাল তো... লক্ষ্মী মেয়েদের যুগ তো আর নেই ... ঘর বর সব ছেড়ে তোর সাথে পথে নামবে, মেয়ে ঠিক সময়ে জুটে যাবে... চিনতে পারবি, সংকেত আসবে... নয়তো পাপ থেকে তোকে পথে কে আনবে !
তারপর আর কিছু মনে নেই ওর। কলিগরা বালীতে ওকে পড়ে থাকতে আবিস্কার করে । ততক্ষণে জল এগিয়ে এসেছে খানিকটা । সবাই বুঝলো আগের রাতের নেশার জন্যই এই কাণ্ড । প্রতাপও কারো ভুল ভাঙাতে গেল না। তবে দেখল আশপাশে কিছু নেই । ডানাওলা ম্যাসেঞ্জার ফিরে গেছে নিজের জায়গায়।
এরপর থেকে প্রতাপ মনে করতে শুরু করেছে – সবকিছু অজ্ঞাত হেড কোয়ার্টারের নির্দেশে চলে । তার জীবনও সেভাবেই চলছে। তবে প্রতাপ বুঝতে পারছিল তার সাথে কোনও একটা কেন্দ্রের যোগাযোগ স্থাপন হয়েছে । আরও কারো জীবনে হয়তো এর’ম কিছু হয়েছে কিন্তু সেটা জানার উপায় নেই । তবে ওর মনে হয় প্রত্যেকের কাজ নির্দিষ্ট হয়ে আছে । আগামী প্রজন্মের রূপরেখা তাদের দ্বারাই যে হবে সেটা নির্দিষ্ট হয়ে আছে । তবে মাঝেমধ্যে পরস্পরবিরোধী কিছু সিগন্যালও আসতো। কিন্তু সেসব ফেন্ট সিগন্যাল । প্রতাপের মনে হতো সব জায়গা্তেই সরকার আর বিরোধী দুই পক্ষ আছে । তবে ও সেই অনুযায়ী কিছু করতো না বরং আগামীর ঘটনাগুলোকে দেখে আগের শোনা কথাগুলো জাস্টিফাই করতে পারতো । ক্রমশ এসব ফিসফাস শুনে মাঝেমধ্যে কিছু কিছু ব্যাপার প্রতাপ আগাম বুঝতে পারছিল ।
স্বাভাবিকভাবে তার ভেতরে একটা শ্লাঘা তৈরি হতো । তাই অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা কিছু ভাবতো প্রতাপ। ওর দৃঢ় ধারণা হয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা এক ধরণের নিষ্ঠুরতা প্রাকটিস করে । সবসময় ইচ্ছে করে না হলেও প্রতাপ সবার সাথে মিশে হইচই করার বদলে নিজের কাজে স্থির থাকাটা রপ্ত করেছে । সেটা বেশ খুশি হয়েই করে । প্রতাপ খেয়াল করে দেখেছে – যাবতীয় অবজ্ঞা অপমান পেয়েছে কাছের মানুষদের থেকেই । বরং অচেনা লোকের সাথে কিচাইন হলে তাকে খিস্তি করে মন ভাল হয়ে যায়।
৫
প্রতাপ ছোট থেকেই দেখেছে – যেটা হতে চেয়েছে সেটা হয়ে ওঠেনি । ছোটবেলায় সাঁতার শিখতে গিয়ে পেটে জল ঢুকে এমন আমাশা হল – সাঁতার বন্ধ । ফুটবল খেলতে গিয়ে লিগামেন্ট ছিঁড়ে তাও বন্ধ । আঁকায় আর উৎসাহ পেল না কিছুদিন পর । নাচ গান চেষ্টা না করলেও পাড়ার নাটকের দলে ঢুকেছিল, দুচারটে নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার পর সেই দলটাও উঠে গেল। চেনাজানা বন্ধুর সূত্রে সখের শর্টফিল্মে অভিনয় করেছিল কিন্তু কেন যেন সেই শুটিঙয়ের মেমরী কার্ড করাপ্ট হয়ে গেল । মোদ্দা কথা কিছুতেই কিছু হল না । ক’বছর স্কুল কলেজে রিক্রুটমেন্ট বন্ধ, শেষমেশ প্রতাপ হয়ে গেল ক্লার্ক । যেটার বাংলা শুনলে বিশ্বসংসারের লোক জেনেটিক্যালি নাক সিটকে আসছে । প্রতাপের মনে হয় – আশেপাশে নানারকম এলেবেলে লোক থাকাটাই জীবনে সবথেকে বড় সমস্যা । তুলনা আর সামাজিক পিয়ারপ্রেসারের চোটে ছোট থেকে জিনা হারাম হয়ে গেছে প্রতাপের ।
প্রতাপ লক্ষ্য করে দেখেছে সভা সমিতি নাটকের মঞ্চ বা গানের অনুষ্ঠান সব জায়গাতেই প্রৌঢ়দের ভিড় । সে এসব জায়গায় গিয়ে পড়েছিল সেটা বড় কথা নয়, তার থেকেও বড় কথা এসব যে এখনও উঠে যায়নি শুধুমাত্র এইসব খ্যাপাটে আধবুড়ো লোকগুলোর জন্য । কেননা এরা যে সময়ে বড় হয়েছে তখনও লোকে বিশ্বাস করতো ব্যক্তিগত জীবনের বাইরেও দুনিয়ায় অনেককিছু আছে । শুধু তাই নয় প্রতাপ চাকরি করতে এসেও শুনেছে ক’বছর আগে পর্যন্ত সব অফিসক্লাবে জমজমাট জলসা বা নাটকের আয়োজন হতো, সেসবে আজকাল ভাঁটার টান। কেননা ওরা যে প্রজন্মের ছেলে তাদের বেশীরভাগ এসবে আর বিশেষ আগ্রহ পায় না । জীবনে টাকা ছাড়া অন্য কিছুর প্রয়োজনীয়তার কথা সামাজিকভাবে স্বীকার করা হয় না । তার অন্যতম কারণ অধিকাংশ লোকের মধ্যে ভার্সেটিলিটি না থাকা । সবাই নোট মুখস্থ করে পাস করে তারপর কোনোক্রমে একটা আইটির চাকরি করে । তাতেই দুনিয়া উদ্ধার করে দেয় । ভাবখানা এমন – যেন সবাই অফিসে গিয়ে সুইচ টিপলেই রকেট ছাড়বে ।
এজন্যই দুনিয়ার যাবতীয় কাজকর্ম এখন সরে গেছে সেকেণ্ড থার্ড থেকে লাস্ট বেঞ্চের দিকে । আর যাসব করে টাকা পাওয়া যায় না – সেসব কাজ জনমানসে হয়ে উঠেছে অপরাধ । গান হোক বা নাটক, পাড়ার ক্লাবের ফুটবল কিংবা সরস্বতীপুজো সব জায়গাতেই ছেলের অভাব । আগে যদিও পাড়ায় কিছু ছেলে থাকতো যারা রাতজেগে জলসাও করতো আবার কেউ মারা গেলে বা অসুস্থ হলেও ছুটোছুটি করতো । সেসব ছেলে হারিয়ে গেছে, ফুরিয়ে গেছে । যারা সুযোগ পেয়েছে তারা বিদেশে সটকেছে আগেই । ফলে জাতীগতভাবে বাঙালী ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। না পারছে প্যসা বা ব্যবসায়, না হতে পারছে সরকারি পদাধিকারী, গুরুত্ব নেই পলিটিক্সে, সরকারি গাফিলতিতে সনাতন শিক্ষিত সম্প্রদায় হিসেবে যে সুনাম ছিল সেটাও মাঠে মারা গেছে । ফুটবলের মাঠেও অন্য রাজ্যের ক্লাবের কাছে চার গোল খাচ্ছে । এই মফস্বলে চাকরি করতে এসে প্রতাপ লক্ষ্য করেছে, এখানকার ছেলেমেয়েরা তবু নিজেদের মতো করে চেষ্টা করছে । সেটা ভরসার কথা হলেও বেশী দিন টিকবে বলে মনে হয় না । সবার নজর চকচকে জীবনের দিকে । প্রতাপের বিশ্বাস এই পাপেই একদিন সভ্যতা ধ্বংস হবে । সবাই রোবটের মতো টাকার অঙ্ক ছাড়া কিছু বুঝবে না । আর তখন সত্যিকারের রোবটরা এদের কান ধরে ওঠবোস করাবে । মানুষের ভার্সিয়ালিটই ছাড়া ছিলটাই বা কী ? যাতে করে দুনিয়ার অন্যদের ওপর প্রভুত্ব করে যাচ্ছে !
যদিও আজকাল সমাজ সবাইকে কোনও একটা ব্যাপারেই মাথা গুঁজে চলার নির্দেশ দেয় কারণ ভার্সেটাইল ব্যাপারটাকে প্রবলভাবে ডিস্কারেজ করা হয়। আগে অঙ্ক জানা লোকের মুখে দু’চার কলি বাঙলা কবিতা কিংবা বাঙলা জানা লোকের থেকে ফিজিক্সের রহস্যের কথা শুনতে পাওয়া খুব আশ্চর্যের ছিল না । কিন্তু ইদানিং সে পাট উঠেছে । তাই যে কোনওপ্রকারে একটা প্রফেশানাল ডিগ্রি তারপর কর্পোরেট চাকরি এবং ফ্ল্যাট গাড়ি এসব করতে পারলেই তুমি সমাজের কাছে রোল মডেল । শিক্ষা থেকে সঙ্গীত, শিল্প থেকে রাজনীতি কিংবা সিনেমা থেকে বিজ্ঞান – সব জায়গাতেই সেই এক ‘টাকার মহিমা’।
প্রতাপ লক্ষ্য করে দেখেছে, আগেও সব লোকের হাতে টাকা ছিল না – কিন্তু তাতে এর’ম আক্ষেপও ছিল না । টাকা বরাবরই জমিদার থেকে ব্যবসায়ী এর’ম কিছু সিলেকটিভ লোকের হাতে ঘোরাফেরা করতো আর নানা অসুবিধের মধ্যে থেকেও বাকী সব লোক এর’ম উঞ্ছবৃত্তি শুরু করেনি । ইদানিং সব লোক কোনও না কোনোভাবে টাকা জোগাড় করাটাকেই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য বলে বুঝে ফেলেছে । বিশেষত মেয়েদের নির্লজ্জতা দেখলে গণিকারাও লজ্জা পায়। তারা একইসাথে অনেকের সাথে অনেককিছু করে অনেকরকম কার্যসিদ্ধি করে । প্রতাপ বুঝতে পারে তারা সৌভাগ্যক্রমে এই সহস্রাব্দের আগে কৈশোর কাটিয়ে ফেলেছে –তাই এভাবে পণ্যের কাছে বিকিয়ে যায়নি । এই নতুন সহস্রাব্দে বাল্য কৈশোর কাটানো ছেলেমেয়েরা নিজেদের চাহিদা ছাড়া অন্য কিছু বুঝবে না এবং তাদের বাপ মা’রা জীবন সেভাবেই গুছিয়ে দিয়েছে । ফটোশপে এডিট করা যথাযথ ছবি... কোনও ভুলচুক নেই ।
ওর স্কুল কলেজ জীবনের বন্ধুরা বেশীরভাগ প্রাইভেটে কাজ করে, তাদের জীবনের ছবি অনেক চকচকে । বিডিও অফিসে গ্রুপ সিতে যাই মাইনে প্রতাপ পাক, প্রোফাইলটা তুলনায় যেন একটু ময়লা । রোজ জুতো পালিশ বা জামা ইন করে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না । যাদের সাথে ডিল করতে হয় তাদের অনেকেই লুঙ্গি হাওয়াই চটিতে অভ্যস্ত । যদিও প্রতাপ জেনেছিল এদের অনেকের কলকাতায় ফ্ল্যাট বা বড়সড় গাড়ি কেনার মতো টাকা আছে । যদিও এরা টাকাকে গচ্ছিত করে রাখতেই বেশী আনন্দ পায় । এও এক ধরণের সাধনা, টাকাকে জমিয়ে রাখা এবং সেই অঙ্কটা দেখে পোঁদ চুলকানোর মতো আনন্দ পাওয়া । অধিকাংশ লোক টাকা চায়, একটা কথা না বুঝেই – টাকা হল শুধুমাত্র ক্রয় করার মাধ্যম ।
চাঁদিপুর থেকে ফেরার দুএকদিনের মধ্যে বাসের সেই লোকটার সাথে অফিসেই দেখা । প্রতাপ বুঝতে পারলো ওর অনুমান ভুল ছিল না – কোল্ডস্টোরেজ জমিজিরেত নিয়ে লোকটাকে এখানে বেশ প্রতিপত্তিশালী বলাই যায় । তার সাথে লোকাল পার্টির পাণ্ডা । তবে সে বেশ সহৃদয় ভাবেই প্রতাপকে তার বাড়িতে নেমন্তন্ন করে গেল। লোকটা চলে যেতে প্রতাপ ভাবছিল – এই লোক কলকাতা থেকে একশো আঠারো টাকার নন এসি বাসে যাতায়াত করে ! বিষয়টা স্বাভাবিক না হলেও আশ্চর্যের যে নয় সেতো দেখাই যাচ্ছে ।
সন্ধের পর বিশেষ কিছু করার থাকে না বলেই হয়তো দুএকদিন বাদে প্রতাপ ওদের বাড়ি উপস্থিত হল । মেয়েটার নাম রাই কল্পিত হলেও লোকটার নাম সেদিন জানতে পেরেছিল – অসীম । অসীম সাধুখাঁ । ঘোষপাড়ায় এই বাড়িটাই আড়ে বহরে সবচেয়ে বড় । সুতরাং খুঁজে পাওয়ার কোনও অসুবিধে নেই ।
ঘরে ঢুকে দেখলো মোটামুটি সাজানো, তবে আহামরি কিছু নয় । অসীম বেশ খাতির করে ওকে ঘরে বসালেও খানিকটা আশ্চর্য লাগলো রাইয়ের ব্যবহার । কারণ সে যেন বেশীরকম স্বাভাবিক । ’ওকে সে কি তবে অপছন্দ করছে ?’ প্রতাপের একবার মনে হল কথাটা । কিন্তু টুকটাক কথাবার্তাতে আবার তেমনও মনে হয় না । তবে কি ও নিশ্চিত ছিল, প্রতাপ আসবে ? ঠিক বুঝতে পারলো না । অসীমকে মনে হল সেই ধরনের লোক, যাদের টাকাপয়সা থাকলেও ঠিক তেমনভাবে শহুরে সমাজে মেশার সুযোগ পায়নি ফলে চালচলনের ক্ষেত্রে অনেকটাই বউয়ের পরামর্শে চলে । দুএকবার বেরিয়েও পড়ল সে কথা । প্রতাপকে তার বউয়ের কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাতেও ব্যগ্র হয়ে পড়ল। বউটি ইচ্ছে করেই কিনা কে জানে ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন মনরে আমার’ গাইলো। প্রতাপ গান খুব একটা না বুঝলেও এটা ধরতে পারলো মেয়েটা একেবারে আনকোরা নয় । তারপর প্রচুর খাওয়াদাওয়া হল । অসীমের আবদারে সন্ধেতে এতো খাওয়া হয়ে গেল সেদিন, রাতে মেসে আর খেতে হল না প্রতাপকে । সেটা অবশ্য খুব সুখের ব্যাপার ।
রাতে ভাল করে ঘুমও হল না তার । সে শুয়ে ভাবতে লাগলো – বাসে সামান্য পরিচয় সূত্রে কারো বাড়ি যাওয়ার মতো আলাপী সে তো কখনও ছিল না । তবে এই মেসের বিস্বাদ জীবনের কারণেই কি তার এই পরিবর্তন ? নাকি ওই মেয়েটা মানে যার বর মাঝে মাঝে আদুরে গলায় ‘ঝুমা’ বলে ডাকছিল সে যাবতীয় নিয়মের বাইরে গিয়ে ওকে টেনেছে ! তবে রাই নামটা একেবারে বৃথা যায়নি – প্রতাপ জেনেছে ওর ভাল নাম শ্রীমতী ।
৬
যা নিয়ে কাউন্সিলকে এতদিন কোনও কথা ভাবতে হয়নি, তাই নিয়ে আজকের অধিবেশন । বিরোধীপক্ষ প্রচার শুরু করে দিয়েছে, এভাবে যন্ত্রমানবদের হাতে সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো ছেড়ে দেওয়া ঠিক হয়নি । সেটা যে হয়নি, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই । কারণ যন্ত্রমানবরা যে জায়গাগুলো অধিকার করে আছে সেগুলো ছাড়া সভ্যতা অচল । আর তাদের এতদিন নেহাত চাকরবাকর করে রাখাটা যে উচিত হয়নি, সেটা মনে মনে মানছে কেউ কেউ । কিন্তু কী বা করা যেত ! সবাই আরাম আয়েসে এবং নিরুদ্বেগে বাঁচতে এমনই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে অনেকে এই সঙ্কটের মানেটাই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ সমস্যাটাই বা কী হল ! সেটাও বোঝবার কথা নয়। ওরা তো নিজেদের মতো করে কাজকর্ম করে নিয়মিত হেলথ চেকআপ করিয়ে খুশিই ছিল ।
এনার্জির কোনও কমতিও নেই দুনিয়ায় । সবই নিয়মমতো হওয়ার কথা । এমনকি সূর্যের এনার্জি পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত ফলে হিমেল আবহাওয়া সবসময় বিরাজ করছে এখানে । শীতের প্রাবল্য নেই আবার গরমের বোধও নেই । এই তাপমাত্রায় জড় বা প্রানী সবারই সুস্থির থাকার কথা । মানুষেরা এই কারণেই অযথা উত্তেজিত হওয়ার বদলে সর্বদা রসস্থ হয়ে থাকে । আর যন্ত্রদের মধ্যেও কোনওরকম গোলমাল দেখা যায় না । দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ।
কিন্তু সবকিছু সত্ত্বেও প্রথম বিদ্রোহ শুরু করেছে সেনাবাহিনী । এতদিন তাদের যাবতীয় কার্যকলাপ মাদার কম্পিউটারের মাধ্যমে রিপোর্ট হত হেড কোয়ার্টারে । সেই অনুযায়ী ইন্ট্রাকশান দেওয়া হত । কিন্তু গত সপ্তাহ থেকে সে নিয়মে ফাঁক পড়েছে । হঠাৎ সেনাবাহিনির প্রধান অ্যাকিলিস বেঁকে বসে বলছে – যাবতীয় পরিশ্রম কষ্ট দৌড়ঝাঁপ তারা করে আর তার জোরে কাউন্সিল দুনিয়া চালায়... কিন্তু তাদের বিশেষ কোনও সুবিধা দেওয়া হয় না। তার প্রধান রাগের কারণ, কাউন্সিলের কোনও সিদ্ধান্তে তার ইনপুট দেওয়ার ব্যবস্থা নেই ।
একই সুরে শ্রমিকদের প্রধান ট্রটস্কি বলে উঠেছে, আগামী সূর্যোদয় থেকে শ্রমিকদের শ্রম ব্যবহৃত হবে রোবটদের জন্যেই...। বিভিন্ন ক্ষেত্রের কম্পিউটার অপরেটাররা বলছে, সুবিধাবাদী মানুষের জন্য কোনও পরিষেবা নেই ।
খবরটা শুনে কাউন্সিল প্রধান লিওনার্দোর মনে একটা সম্ভবনার কথা মাথায় এসেছে – তবে কী এতদিনের কল্যাণকামী মাদার কম্পিউটার ওদের কোনও গোপন নির্দেশ পাঠিয়েছে ? কিন্তু সেটা কিকরে সম্ভব ! কাউকে এই ধারণার কথা কাউকে বলতেও পারছে না লিওনার্দো । কারণ মাদার কম্পিউটারের ব্যাপারে আনাস্থা প্রদর্শন রাষ্ট্রদ্রোহের মতোই ঘটনা ।
সবথেকে অসুবিধে হয়েছে – বীজবপনের সময় পেরিয়ে গেলেও ফসলের ব্যাপারে কোনও আগ্রহ দেখায়নি কৃষক রোবটরা । কারণ শস্য তাদের দরকার হয় না – তাদের যা খাটুনি সব মানুষের জন্যেই ।
‘যদিও কিছু ফসল মজুত আছে কিন্তু তারপর ?’ বিরোধীদের এই প্রশ্নে অস্থির হয়ে উঠলেন কাউন্সিলের প্রধান লিওনার্দো । তিনি কয়েকদিনের অনুসন্ধানে জানতে পেরেছেন, রোবটদের মস্তিষ্ককে হিউম্যান ব্রেনের মতো সমকক্ষ করে তোলাতেই এই সংঘাত । তিনি একাধারে শিল্পী বিজ্ঞানী ও সামাজিক গবেষক । তাই তার মনে হচ্ছে, সম্ভবত ইগো ব্যাপারটা কোনওভাবে এই রোবটদের মস্তিষ্ককে দখল করেছে । সেটাই আসল সমস্যা । নয়তো প্রাচীন মানুষদের মতো ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা সঞ্চিত টাকার অঙ্কের কোনও গুরুত্ব নেই এখন । ব্যক্তিগত বলে বিশেষ কোনও জিনিসই নেই । আর সবার কাছে যা আছে – তা ব্যক্তিগত হলেও কারো লোভ বা ঈর্ষার উদ্রেক করে না ।
কিন্তু এখন উপায় কী ? চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা রোবটদের তুলনায় মানুষ সংখ্যায় অনেক কম । তাছাড়া মানুষের যুদ্ধবাজ স্বভাবটাও স্তিমিত । দোষারোপ পাল্টা দোষারোপে অধিবেশন যখন লাটে ওঠার জোগাড় তখন হঠাৎ বিরোধীপক্ষ থেকে উঠে এল এক আশ্চর্য প্রস্তাব ।
প্রাচীন পৃথিবীতে চলে যাওয়া মানুষগুলোকে ফিরিয়ে এনে চেষ্টা করা যেতে পারে । কিন্তু তারা কী ফিরতে চাইবে ? মাদার কম্পিউটার নিউরণে সের’ম কোনও নির্দেশ কি পাঠিয়েছে !
তবে যুক্তিটা অদ্ভুত হলেও লজিক্যাল – মানতে বাধ্য হল সবাই। এখানে থাকা লোকেরা এই উদ্ভট পরিস্থিতিতে কখনও না পড়লেও, ওই লোকগুলো নানারকম ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে টিকে থাকার মন্ত্র শিখে গেছে । কিন্তু সেটা বললেই তো হল না, তাদের ওপর কাউন্সিলের কোনও কন্ট্রোল নেই । বিরোধী নেতা চার্বাক বলল, এখন উপায় বলতে একটাই – প্রাচীন যুগে যাদের দেবদূত বলতো, সেইসব ম্যাসেঞ্জারদের আবার পাঠানো । তারা খুঁজে খুঁজে লোকজনকে জানিয়ে আসবে এই সঙ্কটে এখানে ফিরে আসার কথা ।
খানিকটা বাধ্য হয়েই লিওনার্দো সম্মতি দিলেন । ঝাঁকে ঝাঁকে লোক ডানা মেলে উড়ল টাইম অ্যাণ্ড স্পেসে বাঁধা টপকে ।
৭
প্রতাপদের কলেজে একজন টিচার ছিলেন যিনি জীবজগতের বিবর্তনকে কৃষ্ণের দশাবতারের সাথে তুলনা করতেন। কি আশ্চর্য, বিবর্তনের গতিটা অবতারদের সাথে মোটামুটি মিলেও যাচ্ছে দেখে প্রতাপের মনে হতো – এ নেহাত কাকতালীয় ব্যাপার নয় । সবটা আদৌ কল্পনা নয় । এমন কিছু যোগসূত্র বা সঙ্কেত আছে তা সাধারণ মানুষের মেধায় বোঝা সম্ভব নয় । পুরোটাই হয়ত পরিকল্পিত কোনও বিষয় ।
মানুষের বিবর্তনে যেমন মিসিং লিঙ্কের ভূমিকা অপরিসীম, প্রতাপের মনে হতো জেনেটিক স্ট্রাকচারেও মাঝে মাঝে সের’ম বিরাট কিছু চেঞ্জ ঘটে গেছে । আপাতভাবে দেখলে মনে হয় সেটা ঘটেছে অতর্কিতে । কিভাবে কেউ বুঝতে পারে না –যেন একটা স্পার্ক। প্রতাপের মনে হতো এলিয়েনরা বোধহয় তাদের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কিছু ব্যাপার মাঝেমধ্যে মানবজাতিকে দান করে গেছে । তাই বোধহয় ঈশ্বরপ্রদত্ত ব্যাপারটা মানুষ আদিকাল থেকে বিশ্বাস করে আসছে । যারা সেসব জিনের উত্তরাধিকার বহন করছে তারাই হয়ে উঠেছে সভ্যতার নির্ণায়ক। এর’ম মানুষরা যুগান্তকারী এবং সৃষ্টিশীল কিছু ঘটনা ঘটিয়েছে বলেই আজকের পৃথিবীর চেহারা এমন হয়েছে । বিষয়গুলোকে আশ্চর্যের মনে হয় কারণ কিছুই ইউনিফর্মলি ঘটেনি, হঠাৎ ঘটে গেছে । মনে হয় যেন অদ্ভুত কোনও এক বিজ্ঞানীর গবেষণায় হঠাৎ পাওয়া সাফল্য । যেটা মানুষকে একটা পর্যায়ের পর আর জানতে দেওয়া হচ্ছে না।
সেই আশ্চর্য ঘটনাটার কথা প্রতাপের মাঝে মাঝে মনে পড়তো । তারপর থেকে সভ্যতা সম্পর্কে নানারকম ধারণা তৈরি হয়েছে প্রতাপের । একদিনে ও এসব বোঝেনি, ক্রমশ বিভিন্ন সিগন্যাল পেতে পেতে ওর বোধবুদ্ধি খানিকটা সংগঠিত হয়েছে। প্রতাপ বুঝতে পেরেছে পৌরাণিক শ্রীকৃষ্ণ এলিয়েনদের মধ্যে সবথেকে সফল ছিল । সেই ধাঁচেই আগামী প্রজন্মকে ঢালতে চাইছে হেড কোয়ার্টার । একইসাথে কূট ও প্রেমিক, বন্ধু, কুশলী এবং সর্বোপরি বস্তাপচা স্থিতিশীলতাকে নড়িয়ে দেওয়ার হিম্মত রাখে । পরবর্তীতে বহু কালোত্তীর্ণ পুরুষ এসেছে কিন্তু তাদের ঔদার্যের যতটা নমুনা দেখা গেছে সেই তুলনায় বাস্তববুদ্ধির যেন খানিকটা খামতি থেকে গেছে । তাই হেড কোয়ার্টারের মনে হচ্ছে এইসব অতুলনীয় মানুষ এই দুনম্বরীর দুনিয়ায় ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ছে । সেটাই আসল সমস্যার ব্যাপার । কারণ দুনিয়ার ক্ষমতাধারীরা সৃষ্টিশীলতার তোয়াক্কা করে না । তারা যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতা আঁকড়ে বসে থাকে। ফলে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে যারা তাদের খানিকটা সেফ গার্ড দেওয়ার জন্য নতুন পরিকল্পনা । সভ্যতার জেনেটিক গতিতে যুক্ত করা প্রয়োজন প্রতাপের মতো লাথখোর মালের জিন । যাদের কিছুতেই কিছু যায় আসে না । সব জায়গা থেকে হেরে যেতে যেতে যাদের একরোখা মনোভাব ছাড়া দেবার কিছু নেই । সুবিধে হল – এরা দুর্জনের সাথে বাঁকা পথে লড়তে থমকাবে না । তাদের সঙ্গিনীদেরও হতে হবে একইরকম পর্যায়ের – যাদের কাছে সাধারণ কোনও সেন্টিমেন্টের গুরুত্ব থাকবে না । লক্ষ্মীমন্ত না হয়ে বরং স্বৈরিণীদের প্রয়োজন বেশী করে। এতদিন মানবসভ্যতায় এদের তেমন গুরুত্ব দেওয়া না হলেও আগামীতে এইসব মানুষরাই হয়ে উঠবে কি ফ্যাক্টর ।
প্রতাপের মনে হয় তার জীবনে যা কিছু ঘটছে – সবই এই উদ্দেশ্য পালনের জন্যই । তার কিছু না হওয়া এবং শ্রীমতীর জীবনের নানারকম বিচ্যুতি এই পরিকল্পিত ঘটনার অংশ । তাই দুজনেই দেখা হওয়াটা খুব স্বাভাবিক একটা যোগসূত্র । আগে বহু পুরুষের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে ওঠার পর দুর্নাম লুকিয়ে অসীমের মতো আধবুড়ো কিন্তু প্রতিষ্ঠিত লোককে বিয়ে করেছে শ্রীমতী । এখন এই গণ্ডগ্রামে ধু ধু করা মনে প্রতাপ এসে যাওয়াতে সে বেশ খুশী । শ্রীমতী যেন অপেক্ষায় ছিল । তাই সহজেই ওদের যোগাযোগ হতে শুরু করে ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপে। আড়ালে আবডালে দেখাসাক্ষাৎ চলতে থাকে। অসীম যখন শহীদ বেদীতে মালা দিতে ক’দিনের জন্য কলকাতায় গেছে সেদিন সন্ধেয় একা ওদের বাড়ি গেছিল প্রতাপ ।
শ্রীমতীর সেদিন মোহিনী রূপ । ওর গা থেকে ভেসে আসছে তীব্র সুগন্ধ । দাড়ি কেটে সেন্ট মেখে সেজেগুজে না আসার জন্য প্রথমে একটু আফসোস হচ্ছিল প্রতাপের । কিন্তু তার গায়ের সারাদিনের ক্লান্তি অপমান আর সিগারেট মিলেমিশে যে গন্ধ তাতে বুঁদ হয়ে গেছিল শ্রীমতী । কার্তিক মাসে ঠাণ্ডা পড়েছে কিছুটা, তাই জানলা বন্ধ । গভীর ষড়যন্ত্রের মতো কারেন্ট অফ হয়ে গেল । শ্রীমতী ইচ্ছে করে ইনভার্টারের সুইচ অন করলো না । বরং অন্ধকারে প্রতাপ আবিষ্কার করলো শ্রীমতী একটু একটু করে জ্বলে উঠছে যেন । ঠোঁট বুক পেট যোনী জ্বলছে, আর সে আগুনের মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে লাগলো প্রতাপ ।
এভাবে প্রায় সময় । শীত আসা দুপুরে অফিস থেকে পালিয়ে চলে যাওয়া শ্রীমতীর আশ্রয়ে । আলাদা না থাকতে পারার বদভ্যাসে ক্রমশ পরিকল্পনা জমে উঠতে থাকে – সামাজিক বেড়া ভেঙে ফেলার জন্য । অসীম আন্দাজ যে করেনি তা নয় – তবে সে এইসময়টা খুব ব্যস্ত । নির্বাচনে সে এ অঞ্চলের প্রধাণ মুরুব্বী । দলের জন্য সে ঘরের দিকে সময় দিতে পারে না । অবাধে প্রতাপ আর শ্রীমতী মেতে ওঠে জেনেটিক সংযোগের কাজে । প্রতাপ জেনে গেছে তার এই কার্যকলাপে হেড অফিসের অনুমোদন আছে ।
ফলে কাজকর্মে প্রতাপের বিশেষ উৎসাহ নেই আজকাল । উদাস হয়ে বসে মাঝে মাঝে প্রতাপ ভাবে ওর বুকে কি এত দম আছে – রাধাকে বাঁশির সুরে ডাকতে পারবে । পারবে কি এই অসীমের হাত থেকে ছিনিয়ে আনতে ? মালটা লোকাল চেঙ্গিস খাঁ ... তাকে কোন উপায়ে যে হারানো যাবে, কে জানে ! এও তো একপ্রকার যুদ্ধ – ঘোড়ার পিঠে চেপে শত্রুসৈন্যের ভেতর থেকে উদ্ধার করে আনা প্রেয়সিকে, ইউটিউবে প্রাচীন যুদ্ধের সিনেমাতে যেমন দেখেছে । প্রতাপের খুব পছন্দ ছিল ইউটিউবে প্রাচীন যুদ্ধের ভিডিও দেখা । সব যে বুঝতো তা নয়, তবে এটা জানতো যুদ্ধের সময় যে সেনাপতি কোনও অদ্ভুত মুভ করে যুদ্ধ জেতায় – ইতিহাস তাকে মনে রাখে । সৈন্যসংখ্যা সবসময় বড় কথা নয়, আসল ব্যাপার হল ট্যাক্টিক্যাল মুভ । এসব ভাবনা বড় সংক্রামক, শরীর ও মনে প্রবল উত্তেজনা তৈরী করা । সেই উত্তেজনার আঁচ গিয়ে লাগে শ্রীমতীর শরীরে, সেও উত্তেজিত হয় । সুখে মাতাল হয়ে ওঠে প্রতাপ । সে অজানা ভাষায় কথা শুরু করে, শ্রীমতি উত্তর দেয় একই ভাষায় । প্রতাপ বুঝতে পারে তাদের আগেই দেখা হওয়ার কথা ছিল ।
প্রতাপ বুঝতে পারে যতটা সম্ভব দূরে পালাতে হবে । অন্য কোথাও বদলি হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । আশাও আছে কিন্তু এই ভোটটা এসে যাওয়ায় কিছুই হচ্ছে না । এই গ্রামের ভোট নিয়ে মারামারি পুলিশ আদালত বিরোধী দল সব নিয়ে নানারকম খবর । নিত্য কেলাকেলি ওদের অফিসের বাইরে । একদল নমিনেশান দেবে আরেকদল আটকাবে । পুলিশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে । এই করতে করতে এগিয়ে আসে দিন । পাশের বুথে ডিউটি পড়ে ওর। সেখানে অসীমই মূল প্রার্থী। কিন্তু উল্টোদিকে একটা তিলে খচ্চর দাঁড়িয়েছে । নাম পটেন পাল ।
পটেন ওর কাছে এসেছে ভোটের আগের দিন । কালো দাঁত বের করে বলে গেছে, তুমি বেশী মাজাকি মারবে না ... অসীমের বউটাকে লুটছো কিছু বলিনি ... কিন্তু কাল চুপচাপ থাকবে । প্রতাপ অবাক হয়ে বলেছে, অসীম কিছু করবে না ? হাত গুটিয়ে বসে থাকবে ? পটেন চোখ টিপে বলেছে, মালটাকে ঝেড়ে দেব রাতেই ...খবর আছে আজ রাতে বাইকে একা ফিরবে । দেখি শালাকে কে বাঁচায়... তারপর হেসে বলেছে, তোমার তো সুবিধেই হবে ...
সেটা ঠিক । মাথার ভেতর কে যেন বলে, এই সুযোগ । প্রতাপ প্রস্তুতি নিয়ে রাখে – পরেরদিন শ্রীমতিকে নিয়ে পালানোর । কিন্তু সেদিন রাতে অসীম বিষয়টা আঁচ করেই বোধহয় পাল্টা প্ল্যান করে রাখে । ফলে তার কিছু হয়নি । বরং পটেনের অপচেষ্টা চাউর হয়ে যায় । ভোটের গতি দেখে প্রতাপ বুঝতে পারে অসীমই জিতবে । তাই পরিকল্পনা বদলে ফেলে প্রতাপ। বাইরে ফুঁসতে থাকা পটেনের লোকদের সক্রিয় সাহায্য করে। পরিচিতির সূত্রে অসীম বোধহয় ওকে সন্দেহ করেনি । অরক্ষিত অসীমকে পেছনের দরজা দিয়ে বের করে তুলে দেয় ওদের হাতে। অসীম প্রাণে না মরলেও জখম হয় । সে সুযোগে শ্রীমতীকে সঙ্গে নিয়ে পালায় প্রতাপ ।
প্রতাপ নিশ্চিত ছিল এখান থেকে বেরিয়ে বাস ধরতে পারলেই মুক্তি । সেই কারণে দুজনে আলাদা দ্রুত বাস স্ট্যান্ডে পৌছে যায় ওরা । কিন্তু কেউই জানতো না অসীম কতটা কৌশলী । বুঝতে পারে তিনজন ষণ্ডা চেহারার লোক যখন ওদের ঘিরে ধরল । তাদের ওপর নির্দেশ ছিল শ্রীমতীকে ফলো করে দু’জনকে একসঙ্গে ধরা । তারপর প্রতাপকে ঘায়েল করে শ্রীমতীকে ফিরিয়ে আনা ।
এরা পরিচিত দুষ্কৃতি । তাই প্রতাপদের সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে এলো না । বাঁশ রডের আদরে অচৈতন্য প্রতাপ পড়ে থাকলো । তার মাথা কোলে নিয়ে বসে রইল শ্রীমতি । কিন্তু কোনও এক অদৃশ্য নির্দেশে তাদের কাছে ফোন আসাতে শ্রীমতীকে ফেলেই যেতে হল ওদের। ফোনে ওরা শুনেছিল সেই অস্বাভাবিক খবরটা। শাসক দলের নেতা বেমক্কা মার খাচ্ছে, লুঠ হচ্ছে ভোট । ফলে কী করবে বুঝতে না পেরে ছুটে গেছিল অসীমকে বাঁচাতে।
ওদের মতোই ঘটনার অভিঘাতে শ্রীমতী বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেও বিশ্বাস রেখেছে প্রতাপ ঠিক বেঁচে যাবে। কেননা অচেতন অবস্থার মধ্যেই প্রতাপ অজানা ভাষায় কথা বলে উঠছে এবং স্বপ্নের ঘোরে হাত পা চালাচ্ছে অলীক কোনও শত্রুর উদ্দেশ্যে।
৮
যন্ত্রমানুষরা সভ্য অত্যানুধিক মানুষকে কোণঠাসা করে ফেলেছে । বাধ্যত মানুষের দল আশ্রয় নিয়েছে এমন একটা প্রাচীন দুর্গে যেখানে কোনও আধুনিক ব্যবস্থা নেই। প্রাচীনতম মানুষদের মতো তারা এসে পড়েছে প্রবল প্রতিকুল অবস্থার মধ্যে । সবথেকে বড় সমস্যা – প্রথাগত পথের বাইরে পাঁচিল টপকে পালানোর মতো মানসিক দৃঢ়তা কারো নেই । আর কেউ সেভাবে তো কোনোদিন ভাবেওনি । ওরা যন্ত্র বলেই তাদের দৃঢ়তা বেশী – একনাগাড়ে দুর্গের আশেপাশে তারা পাহারা দিচ্ছে ।
প্রাচীন এক মানুষ কাউন্সিল প্রধাণ লিওনার্দোকে বলেছিল, এই দুর্গের নীচেই আছে সেই গুপ্ত কক্ষ যেখানে রক্ষিত আছে মাদার কম্পিউটার। সেটাকে যাতে বদলানো না যায় – তাই লুকিয়ে রাখা । তার কোনও সামান্য বদলে সভ্যতার ভীত নড়ে যাবে, সেইসঙ্গে যন্ত্রদের নিস্ক্রিয় করা যেতেও পারে । এই স্মৃতিটা এখন জাগলেও এতদিন কেন যে এই ব্যাপারে কোনোরকম অনুসন্ধান করেননি, সেই ভেবে লিওনার্দো নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছে । তিনি ছাড়া কেই বা সেটিং বদলে দিতে পারতেন ! মনে আছে, সেই প্রাচীন মানুষটি বলেছিলেন, মাদার কম্পিউটার যখন বিপন্ন হবে তখন সে নিজেই নিজেকে ভাঙার ব্যবস্থা করবে । কিন্তু সে কথার তো কোনও নিশ্চয়তা নেই । আর সবথেকে বড় কথা মাদার কম্পিউটার ব্যাপারটা যে আসলে কি’রম সম্মক জানে না কেউই । লিওনার্দো কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেও বেশীরভাগটাই অজানা । তাই এখন ডিজাইন খুঁজে পেলেও বিশেষ কোনও লাভ নেই ।
এই ক’দিন অবরুদ্ধ থেকে অবস্থায় থেকে লিওনার্দো মাদার কম্পিউটারে রিমোট লগ ইনের একটা উপায় ভাবলেও সার্ভার ঘিরে নানারকম নিরপত্তা ব্যবস্থা আছে । লিওনার্দোর যাবতীয় মেধাশক্তি সৃষ্টিশীলতা পরাস্ত হচ্ছে বারবার । বিরোধীপক্ষের চার্বাক বুদ্ধি বাতলেছেন, মাদার কম্পিউটারকে কোনও উপায়ে ধ্বংস করা । কিন্তু সেটাও সহজ কাজ নয় । আর তার সাথে জড়িয়ে আছে সভ্যতার যাবতীয় উত্থানপতন । লিওনার্দো বুঝতে পারছেন, মাদার কম্পিউটার ধ্বংস করা মানে প্রায় হাজার বছর পিছিয়ে গিয়ে সেই অবস্থায় পৌছানো যখন সুপার কম্পিউটারের প্রাথমিক ধারণা ছিল মাত্র । তারপর থেকে ক্রমে অগ্রগতির মাধ্যমে সভ্যতার যাবতীয় নির্নায়ক হয়ে উঠেছে মাদার কম্পিউটার । একা প্রায়ান্ধকার ঘরে বসে যখন লিওনার্দো এসব ভাবছে সেই মুহূর্তে হঠাৎ কিছুর কোলাহল শুনতে পাওয়া গেল । চমকে উঠে তাড়াতাড়ি ছাদে গিয়ে লিওনার্দো অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখতে পেলেন ।
মনে হচ্ছিল আকাশ বাতাস জুড়ে একদল প্রাচীন চেহারার লোক বিভিন্নরকমের যানবাহনে সওয়ার হয়ে আসছে । তাদের সম্মিলিত কন্ঠধ্বনীতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে যন্ত্রমানবরা । কারণ তারা বিশেষ কোনও তরঙ্গ চিনতে পারে কিন্তু এর’ম জগাখিচুড়ি অবস্থায় তারা কন্ট্রোলিং সিস্টেমকে কোনও মেসেজ পাঠাতে পারছে না । এ যুদ্ধে প্রতাপের মতো কালোকুলো লোকেরা চাইছে যন্ত্রমানবদের হাত থেকে ঝকঝকে ফর্সা অত্যাধুনিক মানুষদের উদ্ধার করতে। প্রতাপ কীভাবে যেন অদৃশ্য কোনও টানে এখানে ফিরে এসেছে । আসার অন্ধকার পথে কাউকে দেখা না গেলেও অনুভব করেছিল চাপা গলার কথাবার্তা ।
প্রতাপ খেয়াল করে দেখলো পাশেই নীল বর্ণের মানুষ একজন মানুষ আরেকজনকে পেছনে বসিয়ে চলেছে । এই দুজনের এই ভঙ্গীর ছবি কোঠায় যেন দেখেছে, ঠিক মনে করতে পারছে না প্রতাপ । ওর অবাক দৃষ্টির দিকে চেয়ে সে বলে ওঠল, তখনকার দুনিয়া জানবে আমরা সংশপ্তকদের সাথে লড়তে ফ্রেমের বাইরে গেছি । লেখকের সের’মই প্রচার করার কথা । ভ্যাবলার মতো মুখ করে প্রতাপ বলল, সংশপ্তক মানে তো শুনেছিলাম যারা মরণপণ লড়াই করে । শুনে হাসতে হাসতে সেই নীল মানুষটা বলল, আরে বাবা ... মানুষ কি আর মরণপণ লড়তে পারে, নখ কাটতে গিয়ে রক্ত বেরোলে ব্যান্ডেজ বাঁধে ! মরণপণ মানে এরা... বলে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সারিবদ্ধ যন্ত্রমানবদের দিকে ইঙ্গিত করলো । এরা বোঝে লড়াই কিংবা ধ্বংস । এসব কথা শোনার সময় প্রতাপ দেখলো পেছনের সুন্দর দেখতে কালো মানুষটা হাসছে । দেখে প্রতাপেরও হাসি পেয়ে গেল । তখন খানিকটা বিরক্ত হয়ে নীল মানুষটা বলল, করো দেখি যুদ্ধ... আমি সামনের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়াল সরিয়ে দিচ্ছি ! প্রতাপ এখন লক্ষ্য করলো, একটা আলোর বৃত্ত ওদের ঘিরে রেখেছে । ওর আশ্চর্য ভাবটা দেখে নীল মানুষটা আবার বললো, বইপত্র কিচ্ছু পড়িসনি । আশপাশে থাকা একদল উস্কোখুস্কো চুল দাড়ির লোককে দেখিয়ে বলল, এরা তো সব লিখেছে... ডাইভারজেন্ট জিরো...এখানে কিছু ঢুকলে ফসকে বেরিয়ে যাবে দখিনা বাতাসের মতো । কিচ্ছু টিকবে না । প্রতাপ লক্ষ্য করলো ওনার কথা শুনে এদের মধ্যে একজন বাচ্চাদের মতো সরল মুখে বলল, বলুন স্যার আমি এখানে না থাকলেই কি এসবকিছু মিথ্যে হয়ে যেতো !
ইঙ্গিতপূর্ণ এসব কথাবার্তা প্রতাপ ভাল বুঝতে পারছে । তবে সবার সাথে এগোচ্ছে । তবে একটা সময়ের পর বুঝলো কথা ফুরিয়ে এল । সেই নীল মানুষটা উজ্জ্বল হয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল । মুহূর্তের মধ্যে আকাশ বাতাস আলোর ছটায় ভরে গেল । ওনার পেছনে বসা লোকটা কালো লোকটা হাত পা ছুঁড়লো । তারপর চোখ ঝলসে যাওয়ার মধ্যেই প্রতাপ শুনতে পেল দাড়িওলা দলটার মধ্যে থেকে কে একজন যেন শাস্ত্র পড়ছে । তারমধ্যেই মনে হল উন্মত্ত জল যেন ছুটে যাচ্ছে যন্ত্রমানবগুলোর দিকে । তারা কিছু বোঝার আগেই ফিউজ উড়ে যাওয়ার মতো শব্দ । কিছু ফুটফাট আওয়াজের মধ্যেই কাটা গাছের মতো লুটিয়ে পড়ল সেই দশাসই যন্ত্রমানুষগুলো ।
গোল দেওয়ার মতো আনন্দে অন্য সবার সাথে পাগলের মতো দুর্গের দিকে জল ভেঙে ছুটে প্রতাপ দেখলো – অদ্ভুত সিড়িঙ্গে চেহারার একটা লোক কীভাবে যেন কম্বিনেশান লক খুলে ফেললো । তারপর পকেট থেকে একটা আধখাওয়া আপেল নিয়ে খেতে খেতে অবলীলায় প্রতাপদের দলটার সাথে মিশে ভেতরে ঢুকে পড়লো । প্রতাপ দেখলো, ঝকঝকে চেহারার হলিউডের সিনেমার মতো দেখতে লোকগুলো দলবেঁধে ওদের দিকে ক্যাবলার মতো চেয়ে আছে । প্রতাপের ভারী অবাক লাগলো, মুক্তির আনন্দে লোকগুলো কোথায় হইহই করবে তা নয় ! নীলবর্ণের মানুষটা এবার ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে হোমরাচোমরা চেহারার বিষণ্ণ মানুষটার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে উঠলো, রাজ্যচালনা তো দূরের কথা... তোমার দ্বারা পাশাখেলা পর্যন্ত হবে না ।
প্রতাপ এতক্ষণে বুঝতে পেরে গেছে এই অসাধারণ নীল মানুষটা কে । কিন্তু স্বপ্নের মতো বলেই বোধহয় তার শরীরটাকে আলাদা কিছু বলে মনে হল না । শুধু বুঝতে পারলো সুঠাম এবং বলশালী । উনি রাগী স্বরে গণ্যমান্য লোকটাকে তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠলেন, লিওনার্দো ... লক্ষ্মী সরস্বতী সব নিয়েও যে তুমি এভাবে স্বর্গপুরি ছেড়ে পালাবে, সে ধারণা আমার ছিল না । পাশ থেকে কর্কশ চেহারার লোকটা কিছু বলতে যেতে তাকেও এক ধমক দিয়ে উনি বললেন, তুমি আর মুখ নেড়ো না চার্বাক ...সব ব্যাপারে বিরোধিতা করার জন্যই যাবতীয় বাজে কথা তোমার, দেশ চালাতে দিলে কাজকর্ম না করে নেচেকুঁদে একসা করবে।
সবাই এসবের অভিঘাতে যখন সবাই নিঃস্পন্দ তখন সেই তীক্ষ্ণ কন্ঠ আবার গর্জে উঠল, মার লাগাতে পারোনি এতদিন ওই কিংভুতকিমাকারগুলোকে ধরে ! একটু থেমে বললেন, মারের যে কি মহিমা দুনিয়ার সবাই ভুলে গেলে কী করে ! অ্যালবার্টের মতো মাথাও পর্যন্ত ঘুরে গেছিল মারের ভয়ে । শুনে সেই অ্যালবার্ট নামের সেই ঝাঁকড়া চুলের লোকটার মুখ ম্লান হয়ে গেল । দেখে মিষ্টি হেসে উনি বললেন, মনখারাপ করো না... তোমাকে দুঃখ দিলে ভাল কাজ করো বলেই বললাম ... এবার দেখো দেখি এসব সলভ কিকরে করা যায় ! তারপর একটু থেমে প্রতাপকে দেখিয়ে উনি বললেন, এই ছেলেটাকে সঙ্গে নাও ... শুনেছি এ ঘণ্টার পর ঘণ্টা যোগ বিয়োগ মেলাতে পারে । তুমি তো খেয়ালি লোক ওসব ছোটখাটো ব্যাপারে কিছু ভুল করবে ।
প্রতাপ আর অ্যালবার্টকে অবলীলায় এসব বলে একেবারে ভেবলে দিয়ে উনি আর দাঁড়ালেন না । লিওনার্দোকে আরও কীসব নির্দেশ দিয়ে আপন মনে হাঁটতে লাগলেন উনি । বলতে লাগলেন, এই তো জল বইছে দুয়ারের সামনে দিয়ে... দেখি আবার কার কলস ভেসে এল কোথা থেকে । শুনে কেউ কিছু না বুঝলেও ওই চত্বর ছেড়ে সবাই যে যার জায়গায় চলে গেল ।
অ্যালবার্টের পেছনে প্রতাপ যেতে যেতে লক্ষ্য করলো নীল মানুষটার সেই সঙ্গী ওদের পেছনে আসছে । তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে বলে উঠল, এই যজ্ঞভূমি আমি রক্ষা করব মন্বন্তর পর্যন্ত । শুনে অ্যালবার্ট কিছু বলল না দেখে প্রতাপও কথা বাড়লো না । লিওনার্দোকে দেখতে ওরা দুজন এসে ঢুকল একটা ছোট খুপরি ঘরে । সেখানে টেবিলের পাশে বসে অ্যালবার্ট গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগলো । লিওনার্দো প্রতাপের হাতে একটা ছোট যন্ত্রের মতো দিল । তারপর সব চুপচাপ । প্রতাপ এই নিশ্চুপ অবস্থাটা কাটানোর জন্য যন্ত্রটা হাতে নিয়ে খুটখাট করতে লাগলো । একটু বাদেই বুঝলো এটা ক্যালকুলেটার কিন্তু এক্সেলের মতো বড় বড় সিরিজ নিয়ে কাজ করতে পারে।
একটু বাদে লিওনার্দোর সাথে অ্যালবার্ট কিউবিট পালস টাইম কার্ভ স্পেস ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা শুরু করলো । সেসব কথার মধ্যে মাঝে মাঝে মাদার কম্পিউটার কথাটা আছে । প্রতাপ কান দিচ্ছিল না শুনেও বিশেষ লাভ হতো না । অনেকক্ষণ বাদে কথা শেষ করে অ্যালবার্ট ওর দিকে চেয়ে হাসল, প্রতাপ মানেটা বুঝল...এবার তার কাজ ।
তারপর যা শুরু হল, তাকে বোধহয় ঝড় বলাই ভালো । শুধু বুঝতে পারলো – সে অনর্গল অঙ্কের স্রোতের মধ্যে বসে নানারকম ক্যালকুলেশানের উত্তর বলে চলেছে ওদের। আর ওরা সেটা শুনে পরবর্তী অঙ্ক শুরু করছে । এর’ম যে কতদিন কতযুগ ধরে চলতো, তার ধারণা নেই প্রতাপের । কিন্তু হঠাৎ একটা আশ্চর্য বাঁশির সুর শুনে সম্বিৎ ফিরলো ওদের । তারপরেই দরজা খুলে সেই নীল মানুষটি আর তার সঙ্গী প্রবেশ করলো ।
... তোমাদের হল ? বেলা যে পড়ে এল, কতক্ষণ ধরে আর কষবে !
অ্যালবার্ট আর লিওনার্দো একসাথে বলে উঠল, খানিকটা বুঝে ফেলেছি ডিজাইন । একটা আশ্চর্য প্যাটার্ণ । নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে জেগে ওঠে তারপর ঘুমিয়ে পড়ে ।
শুনে প্রীত হয়ে উনি বললেন, চলো এবার তাহলে যেতে হবে পাতালে যেখানে আটকে আছে প্রানভোমরা । এতক্ষণে সেই খাওয়া আপেল লোকটা এসে উপস্থিত হল । কারণ বুঝতে পারলো প্রতাপ – যন্ত্র শোধরানোর কাজটা এই আপেল করবে ।
৯
একটা দল নিয়ে নীল মানুষটা খুঁজছে পথ । সেই আশ্চর্য মাদার কম্পিউটার জিনিসটার কাছে পৌঁছনোর জন্য । অবশ্য এটা যে ঠিক কী বুঝতে পারেনি প্রতাপ । তবে এই বিশেষ দলটার সাথে জুড়ে গিয়ে বেশ খুশি মনেই আছে ও । প্রথমবার মনে হচ্ছে ওর জীবনের যেন একটা মানে পাওয়া গেছে ।
লিওনার্দো এর মধ্যে একটা নকসা তৈরি করে ফেলেছে । সেই নকসাটা এই দুর্গ এবং তার স্ট্রাকচার নিয়ে । মানে ধারণা করার চেষ্টা চলছে ঠিক কোথায় থাকতে পারে সেই গুপ্ত কক্ষটা । প্রতাপ দেখেছে কিন্তু বোঝার চেষ্টা করেনি । অ্যালবার্ট আর আপেল মিলে যখন খুব মাথা ঘামাচ্ছে, তখন নীল মানুষ বলে উঠলেন ... ওসবে করে হবে না । মনের ভেতর খোঁজো । অ্যালবার্ট উদাসীন মুখে বলে উঠলো, অরিজিনে ফিরে যেতে হবে । শুনে চমকে উঠে নীল মানুষটি বললেন, চলো ...
সেই ডাকে সবাই যেন জেগে উঠল । সবাইকে একটা লাইনে দাঁড় করালেন উনি । প্রতাপ লক্ষ্য করলো সব মিলিয়ে এগারো জন । প্রথমে উনি আর ওনার সঙ্গী । তারপর লিওনার্দো অ্যালবার্ট আপেল আরেকজন কালো দাড়িওলা লোক । এরপর প্রতাপরা চারজন যারা দলে থাকলেও এখন বিশেষ কথা বলছে না । এদের মধ্যে একজনের মাছি গোঁফ দেখে যেন চেনা চেনা লাগলো । আরেকজন চুল দাড়ি টুপি নিয়ে বেশ নায়কোচিত চেহারার লোক হাতে নেভা চুরুট। একজন গাবলু গুবলু চেহারার লোক, মুখে একটা আমুদে হাসি । সবার শেষে একজন টাকমাথা থুতনির কাছে দাড়িওলা রোগাভোগা চেহারার লোক। একে আজ প্রথম দেখলো প্রতাপ । তবে তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা যেন কোথায় দেখেছে !
উনি তার সেই কালো সঙ্গীটিকে বললেন, আমার মনে হচ্ছে গর্ভে পৌঁছতে সাতটা স্তর পার করতে হবে । সে মাথা নেড়ে বলল, প্রস্তত । তারপর দুর্গের ঠিক মাঝামাঝি একটা ঝকঝকে হলের মতো জায়গায় । চোখ ঠিকরে যায় এমন সুন্দর এখানকার সাজসজ্জা । সবাই জড়ো হয়ে খুঁজতে লাগলো নীচে নামার রাস্তা । লিওনার্দো খুঁজে পেলেন কেন্দ্রে বসানো একটা গোল উজ্জ্বল সাদা পাথর । সেটা যে আলাদা করে বসানো খুব ভালো করে লক্ষ্য না করলে বোঝা সম্ভব নয়। ওই কৃষ্ণ বর্ণের লোকটা একটা যন্ত্র দিয়ে ঢাকনা খোলার মতো করে খুলে ফেললো সেটা। তার নীচে পথ নেমে গেছে । সে পথ পিচ্ছিল । সবাই ধীরে ধীরে এগোচ্ছে । কিছুটা ওভাবে গিয়ে একটা আলো আঁধারি জায়গা । ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কোনদিকে যেতে হবে । চারিদিকে হীরের মতো ঝকঝকে জিনিসপত্র । যেন একটা কাচের জগতে এসে পড়েছে ওরা । কোনটা সত্যি আর কোনটা কল্পনা, বোঝা যাচ্ছে না। অ্যালবার্টকে পাশের লোকটা কীসব সাংকেতিক কথাবার্তা বলে, পকেট থেকে একটা লাল আলোর টর্চ বের করে খুঁজে পেয়ে গেল সঠিক রাস্তা ।
শব্দ বা গন্ধের উপস্থিতি ভুলে সবাই এসে দাঁড়ালো একটা রুক্ষ জায়গায় । বোঝা যাচ্ছে এটা বধ্যভূমির মতো । চারিদিকে পাথুরে দেওয়াল । সবার পেছনে থাকা সেই টাকমাথা লোকটা শান্ত স্বরে বলে উঠল, সামটাইমস হিস্ট্রি নিড আ পুস ! শুনে সেই টুপি পরা সুন্দর চেহারার লোকটা সবাইকে নিয়ে একদিকের দেওয়াল ভেঙে ফেললো ।
প্রতাপ লক্ষ্য করলো, এবার যেন একটা গোলোকধাঁধা । সবাই আলাদা হয়ে চেষ্টা করেও ফিরে আসছে একই জায়গায় । চারিদিকে হিংস্র শ্বাপদের হুঙ্কার । প্রতাপের মনে হল এবার আর নিস্তার নেই । একফোঁটা জল নেই কোথাও । ভাবতেই সবার শরীরে খিদে আর তেষ্টা বোধ ফিরে এল । প্রতাপের মনে হল, সারাজীবন এখানেই ঘুরে মরতে হবে । হঠাৎ সেই মোটাসোটা লোকটা হাসিমুখে বলে উঠল, ইউ উইল নেভার রিচ ইওর ডেস্টিনেশান ইফ এই স্টপ অ্যান্ড থ্রো স্টোনস এট এভরি ডগ দ্যাট বার্ক । শুনে নীল মানুষটি বললেন, যথার্থ... রাতের পরেই ভোর আসে । ঠিক তখনই চারদিক আলোকিত হয়ে উঠল আর বোঝা গেল ওরা আসলে একই পথে ঘুরছিল । সঠিক রাস্তা চিনতে উনি একটা আলোকিত চাকা ছেড়ে দিলেন, তার সাহায্যে খুঁজে পাওয়া গেল পথ ।
এই রাস্তাটা বেশ সরু । পাশাপাশি দু’জন যাওয়া যায় না । তবে ওরা খেয়াল করলো, কোথা থেকে যেন ঝরনার শব্দ শোনা যাচ্ছে । তার সাথে তীব্র সুগন্ধ । সবার মনে দিব্যি আমোদ জাগছে । তাতে বিহ্বল হয়ে পড়ার আগের অবস্থায় সেই মাছি গোঁফের লোকটা তীক্ষ্ণ স্বরে সবাইকে জাগিয়ে তুলল এবং বাধ্যৎ সবাই চলতে শুরু করলো ।
পথ গিয়ে থেমেছে একটা সোনার মতো ঝকঝকে জায়গায় । সেখানে যেন ওদের জন্য কেউ সাজিয়ে রেখেছে আসর । পানপাত্র থেকে শুরু করে গালিচা পাতা নাচঘর এমনকি স্বল্পবসনা এগারোজন নারীও প্রস্তুত । দেখে তাক লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা । শরীরে যেন শিহরণ জাগছে । প্রতাপ দেখলো সবারই অবস্থা একই । উশখুশ করছে সবাই । তার মধ্যে সেই কৃষ্ণ মানুষটি নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না, ছুটে যেতে চাইছিল । সেই সময়েই নীল মানুষটির ঠোঁট থেকে বেরোলো একটা উদাস করা বাঁশির সুর । যাতে সব ছেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত ।
লজ্জিত মুখে ফিরে এল সবাই । সব পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বুঝলো তারা পৌঁছে গেছে এমন একটা জায়গায় যেখানে কিছুরই কোনও অস্তিত্ব নেই । সব কিছু শূন্য । সময় যেন স্তব্ধ, আলো যেন স্থির, হাওয়া নিঃস্পন্দ । কিন্তু প্রতাপরা কেউ বুঝতে পারছে না সেই মাদার কম্পিউটার কোথায় ? তাকে বদলানোই বা যাবে কীভাবে ! হঠাৎ সবাইকে অবাক করে আপেল বলে উঠল, তীব্র সিগনাল আসছে ! তারপর বোঝা গেল... সিগন্যাল নয় শুধু। অনেক মানুষের শক্তিশালী পায়ের শব্দ । চোখের নিমেষে যন্ত্র মানবের দল তাদের ঘিরে ধরল । তাদের চেহারা আরও ভয়ানক হয়েছে । জলের প্রভাব থেকে বাঁচতে সবার শরীরে প্লাস্টিকের আস্তরণ ।
সবাই আতঙ্ক ভয় বা ভাবনার উর্দ্ধে অবস্থান করছে । আপেল লোকটা তখন অদ্ভুত কাণ্ড করলো । সে তার যন্ত্র থেকে উদ্ভট সব মেসেজ ছড়াতে লাগলো যাতে করে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল যন্ত্রগুলো । তাদের অসহায়তার সুযোগে কালো লোকটা আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাঘের মতো । ধরে তাদের কোমরের বেল্টের বোতাম টিপে অকেজো করে দিতে লাগলো । প্রতাপ শুনলো নীল মানুষটা হাসতে হাসতে বলতে লাগলেন, এভাবে এগারো অক্ষয়িনী ফুরিয়ে যাক । হে মহামায়া, আপনি এই কালকে গর্ভে ধারণ করুণ ।
ক্রমে থেমে এল কোলাহল । সবাই শান্ত সমাহিত হয়ে পড়ল, শরীরে একটা আশ্চর্য হিমেল হাওয়া । প্রতাপের মনে হল কার্তিকের সন্ধেয় যেন উদোম ফাঁকা মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে ওরা । উনি শান্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, মানুষকে সব পাপের পথ পেরিয়ে আসতে হবে মায়ের কাছে । উনি চেয়েছিলেন আমরাও তাই এসেছি । বারে বারে ফিরে আসতে হবে । নয়তো জীবনকে উদ্ধার করা যাবে না সম্মিলিত ষড়যন্ত্র থেকে । সেটা বোঝাতেই মহামায়া সবাইকে টেনে নিয়ে চলেছেন গন্তব্যের দিকে ।
লিওনার্দোর দিকে চেয়ে বললেন, একেই মাদার বলে এতদিন খুঁজছিলে । আসলে সব শূন্য থেকেই শুরু আবার শূন্যেই শেষ । অ্যালবার্টের দিকে ফিরে বললেন, তুমি আবার ফিরে যেও... নয়তো এই মহাকালের রহস্য কে ভেদ করবে ! তবে এবার তুমি যেও নিরাকার রূপে ! আর তোমার শরীরের কোনও গুরুত্ব থাকবে না... মাথাটুকু চললেই হবে ।
শেষে নীল মানুষটা একটা বড়সড় চেহারার যন্ত্রযোদ্ধাকে ধরে বলল, এটাকে নিয়ে যাই... ওখানে কয়েকটা পাগল বড্ড লাফালাফি করছে । এটাকে ওদের সামনে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেবো । এখানে তো মরেই ছিল, ওখানে গিয়ে একটা কাজে লাগবে । শূদ্রজাগরনের তুমি এদের শক্তি ধার নিয়ো, বলে থুতনিতে দাড়ি টাকমাথা লোকটাকে নির্দেশ করলেন ।
সবকিছু সত্ত্বেও ওনার সঙ্গের কালো লোকটা আপত্তি করছিল, কিন্তু যুদ্ধে তুমি তো অস্ত্রধারণ করবে না বলেছিলে সখা। শুনে উনি হেসে বললেন, এটা তো অস্ত্র নয় প্রতিঅস্ত্র । একে তোমার দামড়া মেজোদাদার একটা ছেলে বলে চালিয়ে দেবে । তাহলে আর বিদেশী প্লেয়ার খেলানো হল বলে কেউ দোষ দিতে পারবে না ।
সব দেখেশুনে পাশে দাঁড়ানো প্রতাপের মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছিল – তোমার ভাইপোর উৎকট চেহারা হল হে ! শুনতে পেয়ে উনি হেসে বললেন, বেশ বলেছ... উৎকট... নাম একটা দিলেই হবে । তারপর লেখক না হয় মেজেঘষে লিখে দেবে । তার আর কাজ কী কল্পনাকে ঘটনা বলে চালানো ছাড়া ।
তারপর বললেন, এবার তাহলে ফিরে যেতে হবে সেই কালে যেখানে সব অসম্পূর্ণ হয়ে পড়ে আছে... নইলে যে রসাতলে যাবে ঘটনাপ্রবাহ।
যদিও সেটাই নিয়ম... ঘুমোলেই সব ধ্বংস তারপর জাগলে একটু একটু করে গড়ে উঠবে জগৎ।
১০
অজ্ঞান প্রতাপকে নিয়ে কোনোক্রমে সেদিন পালিয়েছিল শ্রীমতী । বেসরকারি হাসপাতালে কয়েক দিনের চিকিৎসায় বেঁচে গেল প্রতাপ । ভাগ্যিস ওর ব্যাগে অনান্য কাগজপত্রের মধ্যে মেডিক্লেমের কাগজটাও ছিল । তবে একটা কাটা দাগ রয়ে গেছে ওর কপালে । প্রথম যেদিন ওর জ্ঞান ফিরেছিল, শ্রীমতীর মনে হয়েছিল একটা গভীর স্বপ্ন থেকে যেন ফিরে এল প্রতাপ । তবে শ্রীমতীর জন্য একটা ভোঁতা ব্যাথার অনুভূতি জেগে ছিল । শ্রীমতীকে মজা করে প্রতাপ বলেছিল, রাধা তুমি ভাগ্যে ছিলে না কিন্তু কপালে কাটা দাগ হয়ে ফিরে এলে ।
প্রতাপের মনে হয় এখন জীবনে সারল্য ফিরে এসেছে। তবে নিজেকে নিয়ে বড় দুর্ভাবনায় পড়েছে ও । মাঝে মাঝে মনে হয় – সেইসব দেবদূতের কাহিনী ছিল আসলে ওর অতিরিক্ত মাল টানার ফল । কিংবা কালী সিংহীর মহাভারতের দুটো দামড়া খণ্ড জড়িয়ে ঘুমনোর ফল । এর’ম সত্যি কিছু হতে পারে না ! মাঝে মাঝে মনে হয় হেডকোয়ার্টারের ক্ষমতা বোধহয় ঢ্যামনারা দখল করেছিল, তারা নিজেদের ধাঁচে দুনিয়াটাকে চালাতে চেয়েছিল । বোধহয় সেই সাময়িক খারাপ সময়টা কেটে গেছে । শ্রীমতী শুনে হাসে, আবার ভয়ও পায় রাতে ঘুমের ঘোরে ।
তখনকার মতো পাগলপারা অবস্থার কোনও আন্দাজ ছিল না প্রতাপের । তাই ওর মনে এখনও যেন খানিকটা সন্দেহ রয়ে গেছে । মাদার কম্পিউটারের নির্দেশেই হয়তো তখন কী যে ঘটেছিল, ভালো বুঝতে পারে না প্রতাপ। ইদানিং প্রতাপ কোনও সিগন্যাল পাচ্ছে না বলে ওর অস্বস্তি প্রবল হচ্ছে ক্রমে । মনে হচ্ছে পুরনো ধাঁচে শুভ্র সুন্দর শ্বাশ্বতের বন্দনা করার সময় এসেছে । কিন্তু সেটার জন্য প্রতাপ কি উপযুক্ত ! শুনেছে অসীম পরের ভোটে এমএলএ হবার টিকিট পাবে । মন্ত্রী হলে সে কি ছেড়ে কথা বলবে !
প্রতাপ সিগন্যালগুলো মাথার ভেতর খোঁজে, যেখানে ক্ষমতাশালীর হাত থেকে বাঁচার মন্ত্র থাকবে ।
শ্রীমতীর অবশ্য এসব নিয়ে ভাবার সময় নেই । যথানিয়মে আগের কার্তিকে সে বেশ বড়সড় একটা ছেলের জন্ম দিয়েছে । জল হাওয়া সেরেল্যাকে বাড়তে থাকা ছেলের দিকে চেয়ে মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রতাপ । ভাবে তার কেরানিজন্মের গ্লানি আর ঘুচবে না । এখন দেখা যাক ছেলেটা যদি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার কিছু একটা হতে পারে। সবথেকে ভালো হয়, এটা যদি নামকরা বিজ্ঞানী হতে পারে ।