1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

রীনা তালুকদার


                         ভাষা বেঁচে থাকে চর্চায়
                                  —রীনা তালুকদার




মানুষ বাক্ যন্ত্রের সাহায্যে মনের ভাব বুঝানোর জন্য যে ধ্বনি উচ্চারণ করে বা প্রকাশ করে তাকে ভাষা বলে। বাক্ যন্ত্র দ্বারাই ধ্বনির সৃষ্টি। বাক্ যন্ত্র হচ্ছে গলনালী, মুখবিবর, কণ্ঠ, জিহবা, তালু, দন্ত্য ও নাসিকা ইত্যাদিকে বাক্ যন্ত্র বা বাক্ প্রত্যঙ্গ বলে। ভাষার দুটি রূপ একটি মৌখিক অন্যটি লেখ্য বা লৈখিক রূপ। লেখ্যরূপ দু’প্রকার সাধু ও চলিত ভাষা। যে ভাষা তৎসম শব্দবহুল সর্বনাম ও ক্রিয়াপদ অপেক্ষকৃত দীর্ঘ গুরুগম্ভীর ও কৃত্রিম তাকে সাধু ভাষা বলে; ভাগীরথীর তীরের মানুষের মৌখিক ভাষাই চলিত ভাষা।  অবশ্য এরই আঞ্চলিক ভাষাও রয়েছে। ভাষার স্তর হচ্ছে প্রথমে বাংলাভাষা তার থেকে লেখ্য ও মৌখিক তারপর লেখ্য ভাষা সাধু ভাষা এবং মৌখিক চলিত ও আঞ্চলিক কথ্য ভাষা হিসাবে প্রচলিত। সম্পূর্ণ বাক্যই ভাষার উপকরণ বা প্রাণ। সাধু ভাষা বিকশিত হয় সংস্কেত শব্দের মিশ্রণে। উইলিয়াম কেরী, রাজা রামমোহন রায়, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, অক্ষয়কুমার দত্ত, ও রাম রাম বসু সহ অনেকের হাতে। তারপর বঙ্কিম চন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের এবং সর্বশেষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যবহারিক ভাবে মৌলিকত্ব ঠিক রেখে গতিময় করে তোলেন। অন্যদিকে চলতি বা চলিত ভাষাকে ১৮৫৮ সালের দিকে প্যারীচাঁদ মিত্র টেনে তোলার চেষ্টা করেছেন তার ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গদ্য রীতিতে সৃষ্টি করে। ১৯১৪ সালে প্রমথ চৌধুরী চলতি রীতিকে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম শুরু করলে সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চলতি ভাষাকে গ্রহণ করলে আর পিছনে তাকাতে হয়নি। চলতি ভাষা বহুল ব্যবহারিক রূপ পরিগ্রহ করে। তবে সাধু ও চলিত ভাষার পার্থক্য খুব একটা বেশী নয়। সাধু ভাষা সর্বনাম পদ আর চলিত ভাষা ক্রিয়ারূপে ব্যবহৃত হয়। সাধু ভাষার কতিপয় শব্দ হচ্ছে : যাইব, খাইব, ধরিব, করিব, চলিব, মারিব ইত্যাদি। চলিত ভাষায় এই শব্দরূপ হচ্ছে : যাবো, খাবো, ধরবো, করবো, চলবো, মারবো ইত্যাদি।

মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। আদি মানুষেরা যখন বিচ্ছিন্নভাবে পর্বতের গুহায় বাস করতো তখন মনের ভাব প্রকাশ করার কোনো মাধ্যম ছিলোনা। যদিও পৃথক বসবাসের জন্য খুব একটা মনের ভাব প্রকাশের প্রয়োজন ছিলোনা। কিন্তু যখন কৃষিকাজ শুরু হলো তখন মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করার প্রয়োজন দেখা দিল। মানুষ তখন আপদে বিপদে, হাসি আনন্দে জন্তু জানোয়ারের ভাষায় বিভিন্ন ভঙ্গিতে মনের ভাব প্রকাশ করার চেষ্টা করলো। তারপর তারা জিহবার সাহার্যে মনের ভাব প্রকাশের চেষ্টা করলো। প্রত্যেক গোষ্ঠীতে নিজস্ব ভাষা ভঙ্গি চালু হয়ে গেলো। ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গ ভঙ্গি ও শব্দের সাহায্যে বহু ভাষার সৃষ্টি হয়। প্রত্যেক জাতির নিজস্ব ভাষা আছে যা মাতৃভাষা রূপে পরিচিত। পৃথিবীর সবদেশেই আঞ্চলিক বা উপভাষা আছে। বাঙালি শঙ্কর জাতি। বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাভাষা। ষোড়শ শতাব্দী হতে বাংলা ভাষাকে অনেকেই গৌড়ভাষা বলে অভিহিত করেন। সেই কারণে রাজা রামমোহন রায় ১৮২৬ সালে ইংরেজী লেখা বাংলা ব্যাকরণকে স্কুল বুক সোসাইটির জন্য ১৮৩৩ সালে বাংলায় অনুবাদ করে ব্যাকরণ বইয়ের নামকরণ করেন ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’। এটিই বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম বাংলা ব্যাকরণ বই। বাংলা ভাষার রচিত প্রথম ব্যাকরণের নাম নাথিনিয়েল ব্রাশি হ্যালহেড রচিত এ গ্রামার অফ দি বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ। সাধারণত রাঢ়, বরেন্দ্র, কামরূপ, বগড়ী, বঙ্গ, চট্রল এই অঞ্চল গুলোকে একত্রে বাঙলা বলা হতো। এসব অঞ্চলের ভাষা এক হলেও কিছুটা উপভাষায় বিভক্তি ছিল বলে পরবর্তীতে বাঙলাকে বাংলা এবং ভাষাকে বাংলাভাষা নামকরণ করা হয়। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ গৌড়ী প্রাকৃতের পরে গৌড় অপভ্রংশ হতে ৬৫০ বা সপ্তম শতাব্দীতে বাংলা ভাষার উৎপত্তি বলে মত দিয়েছেন। অপভ্রংশ হচ্ছে ভারতীয় আর্য ভাষার একটি স্তরের নাম। অনেকেই বলেছেন দশম শতাব্দীতে বাংলা ভাষার উৎপত্তি। বাংলা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের শততম শাখার একটি ভাষা। পৃথিবীতে বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত প্রায় ৪৫০০ হাজার ভাষা প্রচলিত আছে। এমন অনেক ভাষা আছে বহু পুরনো ; ঐ সকল ভাষার মানুষদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই সে ভাষার বিলুপ্তি ঘটছে। সে হিসাবে প্রতিনিয়ত পৃথিবীতে হতে অনেক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। পাপুয়ানিউগিনিতে ৮১৭ টি ভাষা রয়েছে যা বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী ভাষার দেশ। বর্তমানে বিশ্বে বাংলা ভাষার স্থান ৪র্থ স্থানে। বাংলা লিপির উদ্ভব হয় খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে সম্রাট অশোকের সময়ে ব্রাহ্মী এবং ব্রাহ্মী লিপির কুটিল রূপ হতে বাংলা লিপির উদ্ভব হয়। ১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দের গোড়ার দিকে প্রথম লিসবন শহরে বাংলা ভাষা রোমাণ হরফে মুদ্রণ যন্ত্রের ছোঁয়া পায়। রোমাণ হরফে রচিত তিনটি বইয়ের দোম আন্তোনিয়ো বাংলা গদ্যের ন্যায় রচনা করেন ব্রাহ্মণ-রোমাণ ক্যাথলিক সংবাদ এবং পর্তুগিজ পার্দ্রী মনোএল দ্যা আসসুম্পসাঁউ রচনা করেন কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ অন্যটি ভোকাবুলিরও ইদিওমা বেনগল্লাই-পোরতুগিজ। তারপর ১৭৪৩ এর পরে ইউরোপীয়রা বাংলা গদ্যকে বিভিন্ন ভাবে শাসন করার চেষ্টা করে। কিন্তু পর্তুগিজদের এদেশে আগমনের সাথে সাথে কত গুলো বিদেশী শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ করলে বাংলাকে নবতর রূপ পায়। বাংলা ভাষায় প্রধানত ফারসি ও ইংরেজী ভাষার শব্দের সাথে তুর্কি, আরবি, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ ও ফরাসি শব্দ প্রবেশ করে বাংলা ভাষাকে গতিময় করেছে। বিশেষ করে তেরো থেকে আঠারো শতকে বঙ্গদেশে মুসলমান শাসকগণ বাঙলাদেশ শাসন করে। এই সময়ে প্রায় আড়াই হাজারের মতো ফারসি আরবি ও তুর্কী শব্দ প্রবেশ করেছে। তুর্কি শব্দ প্রায় ৪০টি, ১১০টি পর্তুগিজ শব্দ, কতিপয় ওলন্দাজ ও ফরাসি শব্দ ছাড়া বেশীর ভাগই ইংরেজী শব্দ ঢুকেছে। বাংলা মূল শব্দ ৪৭০টি। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের মুদ্রাযন্ত্র শ্রীরামপুর মিশন প্রেস স্থাপিত হবার পর বাংলা অক্ষর স্থায়ীরূপ গ্রহন করে; এরপর আর কোনো মৌলিক পরিবর্তন দেখা যায় না। তবে ভাষায় ধ্বনি পরিবর্তনশীল। ভাষায় ধ্বনি পরিবর্তিত না হলে ভাষার মৃত্যু অনিবার্য। আর অতিপরিবর্তনে ভাষা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারায়। পৃথিবীতে হতে প্রতিনিয়তই ভাষার মৃত্যু ঘটছে। ভাষায় ধ্বনি পরিবর্তন হয় মানুষের উচ্চারণের অসাবধানতাবশত: উচ্চারণের সহজীকরণ ও দ্রুততার জন্যই ভাষার পরিবর্তন ঘটছে। ভাষার পরিবর্তনের বিষয়ে ১৮৭০ সালে বিশ্ব ধ্বনি বিজ্ঞানীরা একমত হয়েছেন যে ভাষায় ধ্বনি পরিবর্তনের বিষয়টি একটি নিয়মিত ব্যাপার। বাংলা ব্যাকরণ প্রথম ইংরেজী ভাষায় রচনা করলেন ইংরেজ নাথানিয়েল ব্রাশ হালহেড। আবার ইংরেজী ভাষার প্রথম অভিধান রচয়িতা ড. স্যামুয়েল জনসন।

বাংলা ভাষার সর্বত্রই শুদ্ধ ব্যবহার করতে হবে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গীতাঞ্জলি গীতিকাব্যে নোবেল অর্জনের মধ্য দিয়ে এবং ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলন ও ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ বাংলা ভাষাকে বিশ্ববাসীর কাছে ব্যাপক পরিচয় করে দিয়েছেন। প্যারিসে ইউনেস্কার সাধারণ পরিষদের সম্মেলনে ১৭ নভেম্বর, ১৯৯৯ সালে ২১-শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তজার্তিক মাতৃভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিলে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সভায়ও সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ফলে জাতিসংঘ ভুক্ত সকল সদস্য দেশ ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালন করে। জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দান করার দাবী উঠেছে। ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ লগ্নের সেই ঐতিহাসিক ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণকে জাতিসংঘ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা দাপ্তরিক দলিল হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি বাংলা ভাষার জন্য গৌরবের। এছাড়াও দাবী উঠেছে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের সকল দেশের প্রধান ভাষার সাথে বাংলা ভাষাকেও দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা। এ জন্য সকলকে একযোগে চেষ্টা করতে হবে। যে কোনো ভাষা বেঁচে থাকে মানুষের চর্চার মাধ্যমে। যে ভাষা যত বেশী চর্চা হবে সে ভাষার আয়ু ততো বেশী বৃদ্ধি পায়। যে ভাষার সাহিত্য সংস্কৃতি যত বেশী ছড়িয়ে যাবে সে ভাষা ততো বেশী সমৃদ্ধ হয়। আর তাই বাংলা ভাষাকে আরো বেশী করে ছড়িয়ে দিতে হবে কবিতা, গানে, সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমে।

                             কবি ও প্রাবন্ধিক






সহায়ক গ্রন্থাবলী:

১।  সংসদ বাঙ্গালা অভিধান-সংকলক- শৈলেন্দ্র বিশ্বাস,  ডঃ শশি ভূষণ দাশগুপ্ত ও শ্রীদীনেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য
২।  বাংলা একাডেমী বাংলা বানান-অভিধান- সংকলন ও সম্পাদনা - জামিল চৌধুরী 
৩।  বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত-ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
৪।  বাঙ্গালা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত-ডঃ অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায়
৫।  সাহিত্য-সন্দর্শন-শ্রীশচন্দ্র দাশ
৬।  কবিতা কথা - জীবননান্দদাশ
৭। কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী - হুমায়ুন আজাদ
৮।  ভাষা ও বাংলা সাহিত্য জিজ্ঞাসা - অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর
৯।  বাংলাছন্দের রূপরেখা- মাহবুবুল আলম
১০।   বাংলা কবিতার ছন্দ - মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান
১১।  কবিতার ক্লাস - নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
১২।  অকারণ ব্যাকরণ - স্বরোচিষ সরকার (শোভা প্রকাশ)
১৩।  আবৃত্তি নির্মিতি - মাহিদুল ইসলাম
১৪।  আবৃত্তি মঞ্জরি - ফয়জুল্লাহ সাঈদ

১৫। আবৃত্তি প্রসঙ্গ অনুষঙ্গ - নাসিম আহমেদ (কাকলীপ্রকাশনী)

Joydeb Biswas

Poet Joydeb Biswas studied Bengali literature. In 2015, at the age of 22, he published 'Sahitya Chetona' magazine. Currently two editions of the magazine are published. One is the online version and the other is the printed version. He is the founder and editor of the two editions. facebook twitter youtube instagram whatsapp

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন