অভিষেক
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪–১৮৭৩) : জন্ম অধুনা বাংলাদেশের যশোহর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে। বাল্যবয়সেই কলকাতায় এসে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তার সহপাঠী ছিলেন ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক প্রমুখ। গ্রিক, ল্যাটিন, সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন।
প্রথম জীবনে ইংরেজি ভাষায় দুটি প্রন্থ রচনা করলেও পরবর্তী পর্যায়ে কবি মধুসুদন “মেঘনাদবধ কাব্য” “তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য” “বীরাঙ্গনা কাব্য” ব্রজাঙ্গনা কাব্য” চতুর্দশপদী কবিতা” রচনার মধ্যে দিয়ে বাংলা কাব্য-কবিতার ইতিহাসে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন।
“রত্রাবলী”, “শরমিহা” পদ্মাবতী”, কৃয়ুকুমারী’ প্রভৃতি নাটক এবং “একেই কি বলে সভ্যতা” ও “বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ নামক দুটি প্রহসন তার অনবদ্য সৃষ্টি। “পদ্মাবতী” নাটকে তিনি প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। “অভিষেক” শীর্ষক কাব্যংশটি কবির “মেঘনাদবধ কাব্য, -এর প্রথম সর্গ থেকে নেওয়া।
বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নোত্তর
১. ‘কৌশিক-ধ্বজ’ শব্দের অর্থ-
ক. সাদা পতাকা
খ. হলুদ পতাকা
গ. সবুজ পতাকা
ঘ. রেশমি পতাকা
২. “দেখ অস্তাচলগামী দিননাথ এবে’ – “দিননাথ’ হলেন-
ক. ইন্দ্রদেব
খ. বরুণদেব
গ. সূর্যদেব
ঘ. চন্দ্রদেব
৩. “যথাবিধ লয়ে গসোদক।” গঙ্গোদক’ শব্দের অর্থ-
ক. যমুনানদীর জল
খ. পদ্মানদীর জল
গ. গঙ্গাজল
ঘ. সোদাবরীর জল
৪. “রুষিবেন দেব অগ্নি।” অগ্নিদেব রুষ্ট হবেন। যদি
ক. সেনাপতি হিসেবে তাকে বরণ করার আগেই ইন্দ্রজিৎ যুদ্ধে নেমে পড়ে
খ. অসময়ে ইন্দ্রজিৎ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করে
গ. রামচন্দ্রকে ভয় পেয়ে বারণ যুদ্ধে যান, আর মেঘনাদ নিশ্চেষ্ট থাকেন।
ঘ. ইন্দ্রজিৎ নিকুম্ভিলা যজ্ঞ সম্পূর্ণ না করে যুদ্ধে যায়।
৫. “হায় দেহ তার, দেখ, সিন্ধু-তীরে ভূপতিত,’ – এখানে কার কথা বলা হয়েছে?
। ক. বীরবাহু
খ. কপূরদল
গ. তুরাঙ্গম
ঘ. কুম্ভকর্ণ
৬. “ছিড়িলা কুসুমদাম রোষে মহাবলী’ – কাকে ‘মহাবলী’ বলে সম্বােধন করা
ক. মেঘনাদকে
খ. রাবণকে
গ. লক্ষ্মণকে
ঘ. অঙ্গদকে
৭. “ঘুচাব এ অপবাদ, বধি –।” [শূন্যস্থান পূরণ করো ]
ক. বানরকুলে
খ. রিপুকুলে
গ. রাক্ষসকুলে
ঘ. অসুরকুলে
৮. ‘অভিষেক’ কবিতাটি মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘মেঘনাদ বধ কাব্য-র কোন্ সর্গ থেকে পাঠাংশে সংযোজিত হয়েছে?
ক. প্রথম সর্গ
খ. তৃতীয় সর্গ
গ. চতুর্থ সর্গ
ঘ. পঞ্চম সর্গ
৯. মেঘনাদবধ কাব্যের প্রথম সর্গের নাম-
ক. প্রেতপুরী
খ. অভিষেক
গ. অস্ত্রলাভ
ঘ. লক্ষ্মণবধ
১০. ‘কিরীটী’ যাঁর নাম তিনি হলেন—
ক. যুধীষ্ঠির
খ. ইন্দ্রজিৎ
গ. অর্জুন
ঘ. রামচন্দ্র
১১. ‘মাতঙ্গ’ কথার অর্থ-
ক. রাক্ষস
খ. ঘোড়া
গ. পতঙ্গ
ঘ. হাতি
১২. মেঘবাহন কে?
ক. ইন্দ্র
খ. ইন্দ্রজিৎ
গ. মেঘনাদ
ঘ. রাবণ
১৩. ‘অভিষেক করিলা কুমারে।’ – কার অভিষেকের কথা বলা হয়েছে?
ক. রামের
খ. ইন্দ্রজিতের
গ. অর্জুনের
ঘ. অঙ্গাদের
১৪. “আগে পূজ ইষ্টদেবে’ – কোথায় ইষ্টদেবের পুজোর কথা বলা হয়েছে?
ক. দেবমন্দিরে
খ. যুদ্ধক্ষেত্রে
গ. নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে
ঘ. পর্বত শিখরে
অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্নোত্তর
১. “তারে ডরাও আপনি, রাজেন্দ্র ?’ – এই পঙক্তিটিতে কাকে ভয় পাওয়ার কথা বক্তা বলেছেন?
উত্তর: মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘অভিষেক’ পদ্যাংশ থেকে গৃহীত উদ্ধৃতাংশ রাঘব শ্রীরামচন্দ্রকে ভয় পাওয়ার কথা বক্তা বলতে চেয়েছেন।
২. রথীন্দ্রভ’-কথাটির অর্থ কী?
উত্তর: ‘রথীন্দ্রভ’ কথাটির অর্থ শ্রেষ্ঠ রথী। যিনি ঋষভ বা বৃষ সদৃশ শক্তি বা বলের অধিকারী। মহাপরাক্রমশালী ইন্দ্রজিৎকে রবীন্দ্রভ বলা হয়েছে।
৩. “হাসিবে মেঘবাহন” – ‘মেঘবাহন কে?
উত্তর: মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘অভিষেক’ পদ্যাংশে ‘মেঘবাহন’ হলেন যিনি মেঘকে বাহন করে ঘুরে বেড়ান অর্থাৎ ‘মেঘবাহন’ হলেন দেবরাজ ইন্দ্র।
৪. ‘অভিষেক’ কী?
উত্তর: মধুসুদন দত্ত রচিত ‘অভিষেক’ পদ্যাংশে ‘অভিষেক’ কথাটির অর্থ হল রাজসিংহাসনে আরোহণকালীন স্নানাদি অনুষ্ঠান। পাঠ্য পদ্যাংশে রাবণরাজ পুত্র মেঘনাদকে সেনাপতি পদে অভিষিক্ত করবার উদ্যোগের প্রসঙ্গে ‘অভিষেক’ শব্দটি প্রযুক্ত হয়েছে।
৫. ‘অভিষেক’ কাব্যাংশটি কোন্ কাব্যগ্রন্থ থেকে গৃহীত?
উত্তর: ‘অভিষেক’ কাব্যাংশটি মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘মেঘনাধবধ কাব্য’ কাব্যগ্রন্থ থেকে গৃহীত।
৬. “মহাশোকী রাক্ষসাধিপতি”-রাক্ষসাধিপতি কে?
উত্তর: রাক্ষসাধিপতি হলেন লঙ্কার রাজা রাবণ।
৭. “সিন্ধু-তীরে/ভূপতিত’ – এখানে কীসের কথা বলা হয়েছে?
উত্তর: মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘অভিষেক’ পদ্যাংশ থেকে গৃহীত প্রশ্নোপ্ত উদ্ধৃতাংশে সিন্ধুতীরে কুম্ভকর্ণের দেহ ভূপতিত থাকার কথা বলা হয়েছে।
সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্নোত্তর
১. “জিজ্ঞাসিল মহাবাহু বিস্ময় মানিয়া’ – মহাবাহু কে, কার কাছে তিনি কী জিজ্ঞাসা করেছিলেন?
উত্তর: মহাবাহু : মেঘনাদবধ কাব্যের প্রথম স্বর্গ অভিষেক নামাঙ্কিত কাব্যাংশে মহাবাহু হলেন মেঘনাদ অর্থাৎ ইন্দ্রজিৎ মহাবাহুর জিজ্ঞাসা : ছদ্মবেশধারী লক্ষ্মীর কাছে ইন্দ্রজিৎ লঙ্কার কুশল সংবাদ জিজ্ঞাসা করেছিলেন। প্রমােদ উদ্যানে হঠাৎ জননী স্থানীয়া ধাত্রীর আগমন অপ্রত্যাশিত। তাই ইন্দ্রজিৎ তার কাছে লঙ্কার সংবাদ জানতে চান। ইন্দ্রজিৎকে ছদ্মবেশধারী দেবী জানান বীরবাহ নিহত হয়েছেন ও রাবণ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই দুটি সংবাদ শুনে মহাবিস্ময়ে ইন্দ্রজিৎ প্রশ্ন করেন—কে হত্যা করল বীরবাহুকে? কারণ তিনি নিজেই রামচন্দ্রসহ শত্রুদলকে সংহার করেছেন।
২. “কে কবে শুনেছে পুত্র ভাসে শিলা জলে”। – এমন উপমা দেওয়ার কারণ লেখাে।
উত্তর: উপমার কারণ : অভিষেক কবিতার রাক্ষসরাজ রাবণ এমন উপমা প্রয়োগ করেছেন। রামচন্দ্রের পুনরায় বেঁচে ওঠা সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে এমন প্রশ্ন করেছেন। রাবণ পুত্র ইন্দ্রজিৎ রামচন্দ্রকে দুবার যুদ্ধে পরাজিত করেছেন। দুটি ক্ষেত্রেই রামচন্দ্রের মৃত্যু নিশ্চিত ছিল। কিন্তু বাস্তবে বিপরীত ঘটনা ঘটে। রামচন্দ্র দুবারই পুনঃজীবন লাভ করে। রাবণ নিজের জীবন অভিজ্ঞতা থেকে জানাচ্ছেন। শিলা বা পাথরের যেমন জলে ভাসা কঠিন, তেমনই কোনো মানুষ মরে গিয়ে তার বাঁচা কঠিন। আসলে রাম মায়াবী মানব। তাই এটা সম্ভবপর হয়েছে। এমনটাই মনে করে ইন্দ্রজিৎ।
৩. “নিকুম্ভিলা যজ্ঞ সাঙ্গ কর’ – নিকুম্ভিলা যজ্ঞ কেন করা হত?
উত্তর: নিকুম্ভিলা যজ্ঞ করার কারণ : নিকুম্ভিলা লঙ্কার কুলদেবী। রাবণের বিশ্বাস ইন্দ্রজিৎ আরাধ্য অগ্নিদেবতার পূজা সঠিকভাবে সুসম্পন্ন করলে তার সিদ্ধিলাভ নিশ্চিত। রামচন্দ্রকে পরাজিত করবার ক্ষমতা অর্জন করতে পারবেন। স্বর্ণলঙ্কার দেবী নিকুম্ভিলা অতিশয় গুপ্ত জায়গায় থাকেন। এখানে ইন্দ্রজিৎ যুদ্ধ যাত্রার পূর্বে পূজা। অর্চনার মাধ্যমে কুলদেবীকে তুষ্ট করতে আসেন।
অভিষেক কবিতার রচনাধর্মী প্রশ্ন উত্তর
১. অভিষেক কবিতা অবলম্বনে ইন্দ্রজিৎ চরিত্রের পরিচয় দাও।
ভূমিকা : বাল্মীকি বা কৃত্তিবাসের মতো ইন্দ্রজিৎকে দেখেননি মধুসূদন। ইন্দ্রজিৎ কবির মানসপুত্র। কবি এই চরিত্র সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছেন তার মধ্যে দুটি বক্তব্য এই চরিত্রের গুরুত্বকে চিনিয়ে দেয়।
দুর্জন সাহস : প্রমােদ উদ্যানে ধাত্রী প্রভাসার ছদ্মবেশে রাজলক্ষ্মীর মুখে মহাবলী বীরবাহুর মৃত্যু সংবাদ শুনে তিনি অবাক হন। তৎক্ষণাৎ যুদ্ধে যাওয়ার সংকল্প গ্রহণ করেন। গভীর সাহসের সঙ্গে রামচন্দ্রকে হত্যা করার কথা ভাবেন।
অগাধ পত্নীপ্রেম : প্রমীলার সঙ্গে ইন্দ্রজিতের দাম্পত্য সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর। প্রমীলা ইন্দ্রজিতকে ছাড়তে না চাইলে ইন্দ্রজিৎ প্রমীলাকে বলেছে তার দৃঢ় বন্ধন থেকে ছিন্ন করার ক্ষমতা কারোর নেই।
সরল পিতৃভক্তি ও কর্তব্য বোধ : ইন্দ্রজিৎ শুধুমাত্র পিতার প্রতি ভালোবাসা দেখাননি, তার কর্তব্য সম্পর্কে সে সজাগ তাই পিতাকে বলেছে পুত্র বেঁচে থাকতে পিতার যুদ্ধ করতে যাওয়া কলঙ্কের কথা।
দেশের প্রতি ভালোবাসা : মধুসূদন দত্তের ইন্দ্রজিৎ লঙ্কাকে গভীরভাবে ভালোবাসেন। তাই লঙ্কার দুর্দিনে লঙ্কাকে মুক্ত করার সংকল্প সে গ্রহণ করেছে।
আত্মবিশ্বাস : ইন্দ্রজিৎ চরিত্রের সব থেকে বড়ো বৈশিষ্ট্য তার আত্মবিশ্বাস। তাই ছদ্মবেশী লক্ষ্মীর কাছে লঙ্কার সর্বনাশ শুনে সে বলেছে সমূলে শত্রুকে বিনাশ করবে।
মূল্যায়ন : মধুসূদনের কাছে ইন্দ্রজিৎ ছিলেন প্রিয়। তাই তার বীরত্ব ও বংশ মর্যাদাকে কৃতিত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। ইন্দ্রজিৎকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চরিত্র হিসাবে গড়ে তুলেছেন তিনি।
২. অভিষেক কবিতায় প্রমীলার চরিত্রটি উল্লেখ করো।
ভূমিকা : সীতা চরিত্র পরিকল্পনায় মধুসূদন দত্ত আদি কবি বাল্মীকিকে অনুসরণ করেছে কিন্তু প্রমীলা চরিত্র নির্মাণে কবি পাশ্চাত্য নারীকে তুলে ধরেছেন। সীতা যেমন বাল্মীকির মানস দুহিতা। প্রমীলা তেমন মধু কবির মানস প্রতিমা।
অসামান্য চরিত্র : নারী সম্পর্কিত চরিত্রগুলিকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষাপটে নির্মাণ করেছেন। প্রমীলার মতো বীরাঙ্গনা চরিত্র শক্তি ও সুন্দরতার সমন্বয়। তাই এই চরিত্রটি অসামান্য।
সুযোগ্য পত্নী : প্রমীলা ইন্দ্রজিতের সুযোগ্য পত্নী । ইন্দ্রজয়ী ইন্দ্রজিৎকে তিনি জয় করেছেন প্রেমের পবিত্র পরশে। ইন্দ্রজিৎ তাই বলেছেন, প্রমীলা তাকে শক্ত ভাবে ধরে রেখেছেন।
বিরহীনি নায়িকা : সাময়িক পতি বিরোহ প্রমীলার পক্ষে অসহনীয় অভিষেক নামাঙ্কিত এই কবিতায় দেখা যায়। প্রমীলার বিপুল শুন্যতা বোধ। স্বামী যুদ্ধে যেতে চাইলে প্রমীলা অস্থির হয়ে ওেঠ।
পতিপ্রেমে মুগ্ধা : নারী যে স্বামীকে গভীরভাবে ভালোবাসে তার প্রমাণ হল প্রমীলা। তাই ইন্দ্রজিতের মতো শক্তিশালী বীরকে তিনি প্রেমের আবেশে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
দাম্পত্য প্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত : প্রমােদ কাননে ইন্দ্রজিৎ প্রমীলার হাস্য উজ্জ্বলময় দাম্পত্য প্রেমের যে ছবি আমাদের মধ্যে ভেসে ওেঠ তাতে প্রমাণিত হয় তারা দাম্পত্য প্রেমের এক সুখী দম্পতি।
মূল্যায়ন : অভিষেক কবিতার সামান্য পরিসরে প্রমীলা চরিত্রটি অসামান্য। স্বামীর প্রতি ভালোবাসা ও চিরন্তনতায় প্রমীলা অসাধারণ।