মিসম্যাচ
প্রিয়দর্শিনী চ্যাটার্জি
সারারাত বিছানায় শুয়ে ছটফট করলো গৌরব। ভোরবেলায় ট্রেন।আর কয়েক ঘন্টা।মফস্বলে জীবনের আঠেরো বছর কাটিয়েছে ও।২৪ পরগণার এই ছোট্ট শহরটার বাইরে বেড়াতেও যাওয়া হয়নি কখনো। ছোটবেলায় দু'একবার সোদপুরে পিসির বাড়ি গেছে।এইটুকুই।আসলে গৌরবদের মস্ত বড় পাড়া শহরে।গোটা একটা পাড়া ওদের সারনেমে।ওদের জ্ঞাতিগোষ্ঠী।স্টেশনে নেমে চৌধুরীপাড়া বললেই যে কেউ রাস্তা বলে দেবে। এখানেই বয়েজ হাই স্কুল থেকে পড়াশোনা,একগাদা বন্ধু,একসঙ্গে সাইকেল চালিয়ে টিউশন যাওয়া,ইংরেজি টিউশনের রাইমাকে আড়চোখে দেখা আর তৎক্ষণাৎ বন্ধুদের কাছে ধরা পড়ে লেগপুলিং,রবিবারের ক্রিকেট,ছুটির বিকেলে নাংলায় অভি আর জয়ের সঙ্গে সূর্যাস্ত দেখতে যাওয়া,সেখানেই প্রথম সিগারেটে টান - জীবনটা দিব্যি কাটছিলো। সত্যি বলতে হাবড়া ছেড়ে বাইরে বেড়াতে যাওয়ার তাগিদও কখনো অনুভব করেনি ও।এখানেই ওর প্রাণটা ছিলো।সবচেয়ে সুখে,শান্তিতে ছিলো।
হায়ার সেকেন্ডারির পর লোকাল কলেজেই জেনারেল স্ট্রিমে পড়তে চেয়েছিল গৌরব।দশ বছর পরে কী করবে সেই নিয়ে এখন থেকে পরিকল্পনা, ছকে ছকে জীবনের প্রতিটা অধ্যায় মেলানোর চেষ্টা, এত ধান্দার জীবন ওর পছন্দ ছিল না।বাড়ির প্রেশারেই মাধ্যমিকের পর সায়েন্স নিতে বাধ্য হয়।যদিও নিয়েছে এই পর্যন্তই।ওর উৎসাহ ক্রিকেট,পলিটিক্স, জেনারেল নলেজ বাড়ানো।অঙ্ক, ফিজিক্স বইটা দেখলেই ভয় করতো ওর।টেনে বায়োলজিটা ভালো লাগতো,কিন্তু ওর এন আই টিতে পড়া জেঠতুতো দাদা ওকে বায়োলজি বাদ দিয়ে কম্পিউটার সায়েন্স নিতে বলে।বাড়ির ধারা বজায় রেখে টেকনিক্যাল লাইনেই এগোতে হবে ওকে, অন্য কিছু পড়ে সময় নষ্ট করার দরকার নেই।অঙ্ক টিউশনের দিন নাংলায় গিয়ে সূর্যাস্ত দেখাই সে বেটার মনে করতো।মাঝেসাঝে যেত ক্লাস টুয়েলভে।শুধুমাত্র হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার তাগিদে।
বাড়ির সবাই দাদার স্যারের ব্যাচেই ভর্তি করেছিলো টিউশানে।সপ্তাহে একদিন এক্সট্রা জয়েন্টের স্পেশাল ক্লাস হতো।স্যারও শেষের দিকে বুঝে গিয়ে বাড়িতে ফোন করে বলেন, "ওকে বাঁধবেন না বৌদি।যা চায় করতে দিন না।মাসের শেষে টাকাটা না পড়িয়ে নিতে আমার খারাপ লাগে।এই মাসে আমি ওদের বারোটা ক্লাস করিয়েছি,আপনার ছেলে তিনদিন এসেছে ঠিক।এভাবে হয় বলুন?"
গৌরবের মা সব জানতো।কিন্তু বুঝেও বুঝতে চাইতো না।ইচ্ছা করতো,তার ছেলেও চৌধুরীবাড়ির বাকি ছেলেদের মতো বড় চাকরি করবে,মা বাবাকে দূর দেশ দেখিয়ে আনবে।একটাই ছেলে ওদের,গৌরবের বাবার ছোটো একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি। বাকি ভাইদের তুলনায় গৌরবের বাবা অর্থনৈতিকভাবে বেশ দূর্বল।বাবা জানে,অপাত্রে দান করছে।কিন্তু ওর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারে না,গ্রাম থেকে বিশ বছর আগে বিয়ে করে আনা সরল মেয়েটা আজ ঘোর সংসারী,তার আশা ভাঙতে মন চায় না।
কেলেঙ্কারি ঘটেছিলো উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার দুমাস আগে। জে ই ই মেইন্সের ফর্ম আউট হয়েছে বন্ধুদের থেকে শুনেছে।পাঁচশো টাকা লাগবে।গৌরব কিছুদিন গড়িমসি করে কয়েকদিন পরে মায়ের কাছে টাকা চাইতেই মা দিয়ে দিয়েছে জোগাড় করে।টাকা নিয়ে ক্যাফেতে গিয়ে শুনলো ফর্ম ফিলাপ করার ডেট পার হয়ে গেছে আগের দিনই।ফেরার পথে পাঁচশো টাকা দিয়ে অভি আর জয়কে ডেকে চলে গেলো হাবড়ায় নতুন হওয়া রাজুদার বিরিয়ানির দোকানে।এমনিতেই দোকানে বিক্রি খুব বেশি ছিলো না।ছোটো দোকান। রাজুদাকে শুদ্ধ বিরিয়ানি খাইয়ে সব টাকা শেষ করে ফিরলো।বাড়িতে ঢুকতেই বুঝলো গন্ডগোল।বাবার দৃষ্টি বদলে গেছে।মা জড়সড় হয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে।গৌরবকে কীভাবে বাঁচানো যায় মা তাই ভাবছে।বাঁচাতে পারেনি সেদিন মা।অফিস থেকে ফেরার পথে ক্যাফেতে বাবা খোঁজ নিয়ে ফিরেছিলো সবটা,জয়ের এক বন্ধু বলে দিয়েছিলো টাকাগুলো দিয়ে সে কী করেছে।
জে ই ই মেইন্সে ওদের গ্রুপের সবারই র্যাংক এলো মোবাইল ফোনের নম্বরের মতো বড়।এই একটা ব্যাপারে মানুষ ছোটো সংখ্যা চায়।র্যাংক যত ছোটো সংখ্যার হবে ভবিষ্যতের ব্যাংক ব্যালেন্স হবে তত বড় সংখ্যার। রেসিপ্রোকাল অর্ডারে সিস্টেম। জয়ের ক্ষেত্রে অবশ্য তা হয়নি।জয় সিনসিয়ার,খুব ভালো রেজাল্ট না হলেও কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে।কিন্তু ওর রেজাল্ট পছন্দ হয়নি।এক বছর আবার প্রিপারেশন নিতে চাই জয়।এটাই শেষ সুযোগ।এরপর লেট হলে কোম্পানিতে প্লেসমেন্ট হয়না ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। তাই ও খুব ভালোভাবে কাজে লাগাতে চায় বছরটা।সিদ্ধান্ত নেয় কলকাতায় কোচিং নেবে,বড় কোনো কোচিং সেন্টারে।কিন্তু সাথে কাউকে চায় যে ওর সাথে থাকতে পারবে নতুন অচেনা শহরটাতে।গৌরবের বাড়িতেই গেল জয়।গৌরব শুনেই আঁতকে উঠেছে।আবার ম্যাথ,ফিজিক্স? কিন্তু ততক্ষণে জয় তার কাজ সেরে ফেলেছে।গৌরবের মায়ের মনে আবার আশা ঢুকিয়ে দিয়েছে গৌরব ইঞ্জিনিয়ার হলে বড় চাকরি পাবে,দেশ বিদেশ ঘুরবে।
গৌরব মনে মনে ভাবলো,জয় তো জানতো ওর এই পড়াগুলো কোনোদিনও ভালো লাগেনা।তাও কেন নতুন করে বাড়িতে বলতে গেল?মাকে না বলার ক্ষমতা গৌরবের বাবার মতো গৌরবেরও নেই।মা কষ্ট পেলে মনে হয় জীবনটাই মিথ্যে।শেষ পর্যন্ত না করতে পারেনি গৌরব,মনে অনেকটা লুকানো দুঃখ নিয়ে সে চলে যাবে কাল সকালে কলকাতায়।পরাধীনতার দুঃখ।জয়ের সাথে একই পেইং গেস্টে ও কলকাতায় থাকবে এরপর।
দশটা পনেরোতে ইনস্টিটিউটে ক্লাস শুরু।আটটার পর ওরা ওদের পিজিতে পৌঁছেছে।গৌরব ঘরটা গোছগাছ করছিলো। জয় বইপত্র বের করে ওর স্টাডি টেবিল গোছাতে লাগলো । সাড়ে দশটা বেজে গেলো ঢুকতে।প্রায় ছ'ফুট উচ্চতা,গায়ের রং ধবধবে ফরসা,পাতলা চেহারা,গলায় শ্রীকৃষ্ণের কাঠের মালা, ব্লু শার্ট-প্যান্ট ও মুখে মাইক্রোফোন সেট করা- স্যার ক্লাসরুমে ঢুকে গিয়েছেন আগেই।প্রায় একশো ছেলেমেয়ে এক ক্লাসে,সত্যিই মাছের বাজারের মতো লাগছে জয়ের।সে মুখ কাঁচুমাচু করে আছে।অন্যদিকে গৌরবের বেশ ফূর্তি।দরজায় দাঁড়িয়ে স্যারের দিকে না দেখেই ও ঢুকে পড়তে যাচ্ছিলো, জয় ওকে একটা চিমটি কাটলো।
"স্যার,আসবো?" জয় বললো।
পিছনে ফিরে তাকালেন স্যার।চশমার ওপার থেকে দুটো চোখ ওদের আপাদমস্তক ওদের পরীক্ষা করে বললো,
" হোয়াই আর ইউ সো লেট? ইটস টেন থার্টি এ.এম রাইট নাউ।"
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল জয়।স্যার ননবেঙ্গলি।ওর আবার বাংলা ছাড়া কাজ চালাবার মতোও অন্য ভাষা আসেনা। ভড়কে যায়।গৌরব পাশ থেকে বললো,"সরি স্যার, কাল সে কভি নেহি হোগা।আজ বহত দূর সে আ রহা হু।"
স্যার বললেন,"গো অ্যান্ড টেক ইওর সিট।"
ক্লাসে বেঞ্চগুলো প্রায় ভর্তি।ঢুকে যাওয়ার পরে জয় আর গৌরবের দিকে দেখলো না,একটা ফাঁকা সিট পেয়ে বসে পড়লো একটু পিছনের দিকে।গৌরবের কোনো অভিযোগ নেই, ও সেকেন্ড বেঞ্চে একটু ঠেসাঠেসি করে একটা জায়গা করে নিলো।একটা রো ছেলেদের,অন্যটা মেয়েদের।এই স্যার নিজের ইন্ট্রোডাকশন দিচ্ছিলেন, ইনস্টিটিউটের এই নর্থ ক্যালকাটা ব্রাঞ্চের ফিজিক্সের হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট।স্যারের বহু ছাত্রছাত্রী এই সেন্টার থেকেই পড়ে আই আই টি,এন আই টিতে চান্স পেয়েছে।আগামী এক বছরে কীভাবে ফিজিক্স পড়তে হবে, স্ট্র্যাটেজি ডিসকাস করলেন স্যার প্রথম দিনের ক্লাসে।এরপর মিনিট পনেরোর ব্রেক।তারপর ম্যাথ।ব্রেকে গৌরব ঘরের মধ্যে হাঁটছিলো একটু,বাইরে বেরিয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে এসে বসলো।পাশের মেয়েদের রো থেকে একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল,"হাই,আমি সুদীপ্তা,তোর বাড়ি কোথায়?"
গৌরব প্রথমটা বুঝতে পারেনি,আশেপাশে একবার দেখে নিয়ে বললো,"আমি?" ঢোক গিলে তারপর আবার বললো, "হাবড়া,উত্তর ২৪পরগণা।তোর বাড়ি?"
চশমা পরা মেয়েটা হেসে চোখ পিটপিট করতে করতে জবাব দিলো,"বর্ধমান।"
"অনেক দূর থেকে এসেছিস তো, কোথায় থাকছিস? একা এখানে?"
"হ্যাঁ,পিজি ভাড়া নিয়ে আছি। এখনও সেরকম কারোর সঙ্গে পরিচয় হয়নি।তোর ফোন নম্বরটা দেওয়া যাবে?ক্লাসের ব্যাপারে কোনো দরকার হলে কন্ট্যাক্ট করা যেত।"
ছোটো থেকে নিজেকে বিশাল হিরো ভাবলেও এই ব্যাপারে গৌরব ভীষণ লাজুক, আড় চোখে পড়ার ব্যাচে রাইমার দিকে শুধু দেখেছে গত দু'বছর,ওর দৌড় এই অবধিই বরাবর।লজ্জায় লাল হয়ে সুদীপ্তাকে ফোন নম্বর বললো গৌরব। সুদীপ্তা খাতায় নোট করে নিলো।
বাকি ক্লাসদুটোও ভালোই কাটলো। কেমিস্ট্রির আর.বি.আর স্যার বেশ মজার মানুষ।সমস্যা এখানে একটাই,বাঙালি স্যারদেরও ইনস্ট্রাকশন দেওয়া হিন্দি বা ইংলিশেই কথা বলতে হবে।বাংলা মিডিয়ামরা কিছুটা অস্বস্তিতে পড়লো।গৌরবের কোনো ব্যাপার না, ও সবার তালে তাল মিলিয়ে ফূর্তিতে এমনভাবে "তাইতো,তাইতো" বলতে লাগলো,রেগে গিয়ে একটা ছেলে ওকে হালকা একটা ঘুঁষি মারলো।
বয়েজ পিজি।ফিরে গিয়েই সন্ধ্যেয় প্রায় সবাই হইহল্লা শুরু করলো।গৌরব সেদিনই নিজের মনের মতো দু'চারজন পেয়ে গেল আর রাস্তায় নিয়ে বেরিয়ে গেল।কাছেই সুভাষ সরোবর।একটা বেঞ্চে বসে আড্ডা দিতে শুরু করলো ওরা।পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে,নিজের জাতভাই টাইপ লোক এরা অনায়াসে চিনে যায়,বেশি আলাপচারিতা হওয়ার আগেই বন্ধুত্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছায়।ভাব এমন,বহুদিনের চেনাই তো।এখানে থাকাকালীন ক্রিকেটের কী ব্যবস্থা হবে আলোচনা করছে,এমন সময় হোয়াটসঅ্যাপে টুং করে নোটিফিকেশনের আওয়াজ।বাকিরা ফোনে উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করলো বলে গৌরব ফোনটা খুললো না।অপ্রস্তুত বোধ করে ও।বন্ধুরা না জেনেবুঝেই লেগপুল করবে। ক্লাসেও হয়তো কিছু বলে বসবে,লজ্জার সীমা থাকবে না নতুন জায়গায় এসে।
পিজিতে ফিরে গিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ চেক করলো গৌরব।যা ভেবেছিলো তাই। আননোন নম্বর থেকে মেসেজ।
"হাই, সুদীপ্তা বলছি।নম্বরটা সেভ করে রাখিস।"
তারপর সবকিছু খুব ভালোই কাটতে শুরু করে।জয় প্রথম রাতেই সিনসিয়ার একটি ছেলে খুঁজে তার ঘরে শিফট করেছে,জীবন নাম।কোচিংয়েও ও যায় গৌরবের সাথে,কিন্তু গিয়ে আলাদা বসে,টপারদের আলাদা গ্রুপ হয়ে গেছে।গৌরব একাই বসে,বন্ধু সেরকম হয়নি সুদীপ্তা ছাড়া।তবে ক্লাসের সব হুজুগে গৌরব এগিয়ে আসে।পুরো ক্লাসটাই যেন ওর টীম।স্যারদের জন্মদিন সেলিব্রেশন থেকে শুরু করে টিচার্স ডে-সবকিছু পালন হচ্ছে গৌরবের উদ্যোগে।সন্ধ্যেয় পিজিতে ফিরে প্রায়দিনই নিজেদের ছোট্ট পিকনিক,বক্সে গান চালিয়ে সারারাত নাচ,পিজির কেয়ার টেকার কৃপাদার সাথে ফাজলামি - কলকাতা শহরটাকেও গৌরব যেন হলুদ - কালো গণ্ডির বাইরে বার করে এনে রামধনু রঙে রঙিন করে দিচ্ছে অনবরত।
কৃপাদার কেচ্ছা আছে।পিজির রান্নাঘর সামলানো মাসির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় ধরা পড়েছে ছেলেদের কাছে বহুবার।কৃপাদার ডোন্ট কেয়ার ভাব।ছেলেরা মস্করা করলে সে যেন আরো উৎসাহ পায়।বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কটা নিয়ে তার যেন কিছুটা দম্ভও আছে।তার পরিবার বীরভূমে,সেখানে দশ বছরের বাচ্চা মেয়ে,বউ থাকে।বহু বছর ধরেই এই পিজির ছেলেরা কৃপাদার কাজকর্মের সাথে নাকি পরিচিত,এটাই খুব সম্ভবত এই পিজির সবচেয়ে হট টপিক ছেলেদের কাছে।তাই কেউ কোনোদিন বাঁধা দেয়নি।দিয়ে লাভ নেই।
কোচিংয়ে প্রথম মক টেস্টের দিন সুদীপ্তা আর গৌরব একসঙ্গে গেল পরীক্ষা দিতে।নিখাদ একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে ওদের, ও মেয়ে বলে যে জড়তা ছিলো গৌরবের মধ্যে, সুদীপ্তার ব্যবহারেই তা কেটে গেছে এখন।ওদের বন্ধুত্বের মূল সূত্র হিসেবে সুদীপ্তা বলেছিলো,"পড়াশোনায় আমরা দুজনেই বেশ পিছিয়ে,আমার মনে হয়। ইমপ্রুভ করার চেষ্টা করবো একসাথে।" ওরা এখন একে ওপরের সাথে সব কথা শেয়ারও করে।বর্ধমানে সুদীপ্তার বয়ফ্রেন্ড আছে।মাঝে মাঝে কলকাতায় দেখা করতে আসে।দলে টানতে তাই গৌরবের জীবনেও একটা প্রেম খুঁজে দিতে বদ্ধপরিকর সুদীপ্তা।
এগারোটা থেকে মক টেস্ট শুরু।আজকের পরীক্ষায় দশটা চ্যাপ্টার আসবে সব মিলিয়ে।গৌরব রিডিং পড়েছে মাত্র চারটে।অঙ্ক কষে দেখা অনেক দূরের কথা,শুধু কয়েকটা সূত্র মুখস্থ করে চলে এসেছে।তিন ঘন্টার বেশির ভাগ সময়টায় ওকে বসে বসে টাইম পাস করতে হবে।সিট অ্যারেঞ্জ করা হয়েছে সেন্টার থেকে,নিজের ইচ্ছামতো বসা যাবে না।গৌরবের পাশে সিট পড়লো নাক উঁচু একটি মেয়ের। টপারদের গ্রুপে থাকে।নাম শুনেছে গৌরব জয়ের থেকে। সুতনয়া। রাগী রাগী মুখে নাকের কাছে চশমা নামিয়ে চশমার কাঁচের ওপর দিয়ে তাকাচ্ছে এদিক ওদিক।গৌরবের ক্লাসে কর্মকাণ্ডের কথা ও জানে,কিছুটা ভর্ৎসনার দিকে তাকায় গৌরবের দিকে।মনে মনে হয়তো ভাবে,পড়াশোনা করে না এমন বাঁদর ছেলের স্থান হওয়া উচিত জেলে।বাইরে কেন ওকে অ্যালাউ করা হচ্ছে।খুব বিরক্ত হচ্ছে সুতনয়া।
টেস্ট শুরু হবার পর ত্রিশ মিনিট কেটেছে,গৌরব যা যা জানতো গোল করা হয়ে গেছে,আর কিছু ও পারবে না।প্রশ্নগুলোই পড়তে পারছে না ঠিক মতো,উত্তর বের করা অনেক দূরের কথা।এখনও আড়াই ঘন্টা কাটাতে হবে।বেঞ্চে বসেই পা নাচাতে লাগলো গৌরব।বেঞ্চটাও দুলতে লাগলো।
"এক্সকিউজ মি,আমার ডিস্টার্ব হচ্ছে",কটমট করে তাকিয়ে বললো সুতনয়া।
গৌরব বললো,"সরি।"
দু'মিনিট না যেতেই ও আবার পা নাচাতে লাগলো। সুতনয়া বললো,"এত অসভ্য কেন তুই?চুপচাপ বসতে পারলে বস নইলে উঠে চলে যা।"
গৌরব এবার চটে গিয়ে বললো,"ক্লাসটা কী তোর একার?আমি কি ফ্রী তে পড়ি?"
দুজনের গলা আরও উঁচুর দিকে যাবার আগেই ইনভিজিলেটর এসে কড়া গলায় ধমক দিলেন।ছুটি হতেই দু'জন দু'দিকে চলে গেল।ছোটো থেকে কোনো সামান্য বিষয় গৌরবের ওপর প্রভাব ফেলে না কখনও।সবসময় কুল ও।কিন্তু এই প্রথম ওর কারোর ওপর রাগ হচ্ছে বেশ। সুতনয়া ওকে রীতিমতো অপমান করেছে।ফেরার পথে তাড়াতাড়ি পা চালালো গৌরব।
টেস্টের দিন বিকেল। কেউ তেমন পড়তে বসেনি।গৌরব পিকনিক করবে ভেবেছিলো।কিন্তু আজ কেমন অদ্ভুত লাগছে। ও রেগে আছে কেন সামান্য ব্যাপারে ও বুঝতে পারছে না।সন্ধ্যেয় সুদীপ্তা হোয়াটসঅ্যাপে বললো,"কি রে,তোর জন্য নাকি সুতনয়া পরীক্ষা দিতে পারেনি ঠিকঠাক?মেয়েদের একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে,সেখানে অনেক কথা লিখছিল তোর নামে।খুব চটে আছে।"
"ও তো মহারানী।ওর একার ডিস্টার্ব হয়,একারই রাগ হতে পারে পৃথিবীতে।একদম আমার কাছে ওর নাম বলবি না কোনোদিন",সঙ্গে সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধ করে দিলো গৌরব।
পরেরদিন ক্লাসে সুদীপ্তা আড় চোখে লক্ষ্য করতে লাগলো দুজনকে।এই ক্লাসে উল্টো নিয়ম হয়ে গেছে অজান্তেই।টপারদের গ্রুপ বসে পিছনের দিকে,সামনে সুদীপ্তা -গৌরবরা। ওদের অঙ্ক ক্লাস নেন একজন ম্যাম, যখন অঙ্ক করতে দেন,ওরা প্রশ্ন খাতায় টোকার আগেই পেছন থেকে ওরা প্রবলেমটা সলভ করে উত্তর দিয়ে দেয় জোরে।ম্যামের প্রশংসাসূচক দৃষ্টি কার ওপর বেশি পড়বে তাই নিয়ে বিশাল কম্পিটিশন।
টিফিনের পর অঙ্ক ক্লাস আজ।গৌরব ওর দলবল নিয়ে অঙ্ক করতে হবে না বলে একদম শেষের বেঞ্চগুলোতে বসলো।ক্লাসের মধ্যেই টিফিনের পরেও আবার কারোর একটা ব্যাগ থেকে পেয়ারা বার করে কাটতে লাগলো।বেশ কথাবার্তা হচ্ছে , মেয়েদের দিক থেকে সুতনয়ারা ঘাড় ঘোরাতে লাগলো ওরা কী করছে দেখতে।একটু পরেই বুঝতে পেরে সুতনয়া ম্যামকে কমপ্লেইন করতে উঠতে যাচ্ছিল,কেউ একটা পাশ থেকে বসিয়ে দিলো।ক্লাস শেষ হবার পর আজ আর ঠেকানো গেল না।সোজা এসে সুতনয়া গৌরবের সামনে বেঞ্চটা চাপড়ে উত্তেজিত গলায় বললো,"তোকে আমি অনেকবার ওয়ার্নিং দিয়েছি,আজ শেষ দিচ্ছি। তোর জন্য আমাদের ক্লাস ডিস্টার্ব হয়।যদি তুই না শোধরাস,আমি তোর নামে রিসেপশনে কমপ্লেইন করবো।এটা আমাদের ক্যারিয়ারের ব্যাপার।"
গৌরবও আজ ছাড়বে না,উঠে দাঁড়িয়ে বললো,"তুই কি নিজেকে বিশাল হনু মনে করিস? সুতো সুতোর মতো থাকবি। আমি এখন মিউজিক বাজাবো নেক্সট ক্লাস শুরুর আগে।নাচও হবে এখানে।যা এখান থেকে তুই।"
সবার সামনে 'সুতো' বলায় সুতনয়ার বন্ধুরাও মুচকি হাসতে লাগলো।বেশ বিদ্রূপের হাসি।আসল সময়ে কেউ ওর পাশে দাঁড়ালো না।ওর হয়ে কেউ তো প্রতিবাদ করতে পারতো একটু।গৌরব গান বাজিয়েছে সত্যি। সুতনয়ার বন্ধুরাও বেশ তাল মেলাচ্ছে ওদের সাথে।চোখ ছলছল করে উঠলো ওর।সোজা বাইরে বেরিয়ে গেল। এখন পনেরো মিনিটের ব্রেক আছে।একটু একা থাকতে ইচ্ছা করছে।ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো কেবল সুদীপ্তা।গৌরবের দিকে ইশারা করে দেখালো।
"সুতনয়া,আই অ্যাম সরি,সবার সামনে ওভাবে বলাটা ভুল হয়েছে আমার,যদি তুই বলিস এক্ষুণি চল,সবার সামনে সরি বলছি।তাহলে তো তোর রাগ কমবে।কাঁদিস না প্লিজ।খারাপ লাগছে আমার,"পিছন থেকে বললো গৌরব।ক্লাসের বাইরে করিডরের এক কোণে দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছছিলো সুতনয়া।গৌরবের দিকে একবার দেখে তখনই চলে যাবে, এমন সময় গৌরব ওর হাত চেপে ধরলো।"তুই ক্ষমা না করলে আমি কোথাও যেতে দেবো না। ক্লাসে চল আমার সাথে,আমি সবার সামনে ক্ষমা চাইছি বলছি তো।"
"কী করছিস এটা।হাত ছাড়!" প্রবলভাবে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো ও।
গৌরব বললো,"কেন? আমি পড়াশোনা করি না, আমার ছোঁয়া লাগলে তাই তুই খারাপ হয়ে যাবি?ছাড়বো না যতক্ষণ না চোখ মুছবি। কী করবি কর।"
"জেদ করিস না।আমি ক্লাসে যাবো। ছাড় নইলে এবার সবাইকে ডাকবো কিন্তু চেঁচিয়ে।"
"চোখ মুছতে বলেছি",গম্ভীর গলায় বললো গৌরব।
অন্য হাতের রুমাল দিয়ে চোখ মুছলো সুতনয়া।গৌরব হাত ছেড়ে দিল।তাও ও চলে গেল না।দাঁড়িয়েই রইলো।গৌরব বললো,"কিছু বলবি?"
"আমি সুতো হলে তুই গরু",ছলছল চোখে এই প্রথম মুচকি হেসে দৌড়ে চলে গেল ও।মেয়েটা সম্পর্কে ভুল ভেবেছিলো গৌরব,আক্ষেপ হলো ওর।ক্লাসের মধ্যে ওই তো হইচই করে,এটা তো সত্যি, দোষ তো ওরই।বাবা - মা পড়তে পাঠিয়েছিল অনেক আশা নিয়ে।কিন্তু এগুলো কী করে ফেলে, ও নিজেই বুঝতে পারে না।
পরেরদিন থেকে ক্লাসে চুপচাপ থাকে গৌরব।পড়া বুঝতে পারে না হয়তো সব,তবে নিজের মতো বেঞ্চের কোণে দেওয়ালের দিকে বসে থাকে। টিফিনেও আর বেরোয় না।এতদিনে 'জে ই ই কোচিং সেন্টার' অনেকটা প্রজাপতি সেন্টারে রূপান্তরিত হয়েছে। টিফিন ব্রেকে কপোত - কপোতীরা সামনের 'জিৎ মোমো' স্টলে বা চায়ের দোকানে ভিড় জমাচ্ছে।ছবিতে ফোকাসে দুটো চায়ের ভাড়,ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে চেক ইন নর্থ ক্যালকাটা।হ্যাশট্যাগ ' টুগেদার ফরেভার '।এসবের মাঝে যেতে আর ভালো লাগে না।ঘরে একা বসে ছিলো গৌরব। সুদীপ্তাও গেছে বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে।দরজা ঠেলে ক্লাসে ঢুকলো সুতনয়া ।ওদের তিনজনের মেয়ের টিম আছে একটা।আজ হঠাৎ ঘরে কেন?
"সুদীপ্তাকে তোর কথা জিজ্ঞেস করছিলাম,তুই একা এখানে বসে আছিস বললো।বাইরে চল।এখানে কেন?এটা তো তোর হুজ্জুতি করার সময়",বললো সুতনয়া।
"এমনি,বাইরে রোদ তাই।"
"বাবা,সূর্য কোন দিকে উঠেছে আজ? শোন কোনো অজুহাত দিবি না।কদিন ধরেই দেখছি,তুই চুপচাপ।সবাইকে সব মানায় না বিশ্বাস কর।তোকে শান্ত দেখলে আমার রীতিমতো মনমরা লাগছে।প্লিজ তুই রেগে থাকিস না।আগের মতো হয়ে যা।"
"আমাকে জোকারই ভালো লাগে বল?ঠিক আছে, হাসানোর চেষ্টা করবো তোদের।"
"এভাবে কেন বলছিস বলতো?আমি সেরকম অর্থে বলিনি,ট্রাস্ট মি।"
"বুঝেছি আমি, এমনি বললাম।আমার আর ভালো লাগে না রে। ওয়ার্থলেস আমি।ঠিকই বলেছিলি তুই।কিন্তু আমার পক্ষে এই পড়াশোনা সম্ভব নয় রে। জোর করে কিছু হয় না জানিস তো।সারাজীবন ওয়ার্থলেসই থাকবো।আর তুই ভালো স্টুডেন্ট,আমার সাথে মিশে সময় নষ্ট করিস না। এটা আমার রিকোয়েস্ট।জয়কে দ্যাখ,আমরা একসাথেই এসেছিলাম কলকাতায়,অনেকটা ওর জন্যই আমি আসতে বাধ্য হয়েছিলাম।কোনোদিন এখানে আসার পর আমার সাথে কথা বলতে দেখেছিস?নিজের ভালোটা বোঝ",ঘর থেকে বেরিয়ে গেল গৌরব।
রাত নটা।সুভাষ সরোবরে একাই বসে আছে গৌরব।বন্ধুদের সঙ্গ যতটা পারছে এড়িয়ে চলছে শেষ কিছুদিন।হাওয়া দিচ্ছে বেশ।শান্তি পায় একটু একা।পিজিতে ফিরে গেলেই আবার এক চিত্র,সবাই বই মুখে গুঁজে বসে রয়েছে।মকটেস্টের একগাদা পেপার চারিদিকে।অঙ্ক,ফিজিক্সের নিউমেরিক্যাল সলভ করে চলেছে ঘড়ি ধরে,কে কত তাড়াতাড়ি পারে।স্যার ম্যামেরা বলেছেন,সময়কে হার মানাতে না পারলে অল ইন্ডিয়া এন্ট্রান্স ক্র্যাক করা অসম্ভব। রাফ পেপারে পেন ছুটবে।হাসফাঁস করে গৌরব।
হঠাৎ ফোনে একটা নোটিফিকেশনের আওয়াজ।ফোন খুলে দেখলো একটা আননোন নম্বরের মেসেজ। ডিপি দেখেই চিনতে পারলো। সুতনয়া লিখেছে,"পারমিশন না নিয়েই তোর নম্বর জোগাড় করেছি গরু।এই জন্য কি আমার শাস্তি হবে কোনো?"
গৌরব লিখলো,"কোথায় পেলি নম্বর?শাস্তি কেন হতে যাবে!"
রিপ্লাই এলো,"সেটা সিক্রেট।তোর সাথে আসলে আমার একটা দরকার আছে,তাই যোগাযোগ করতেই হতো।তোর যদি প্রবলেম না থাকে কাল ছুটির পর আশেপাশে কোথাও একটু দেখা করা যায়?"
গৌরব হাসলো।"তোর সাথে দরকার আছে ভাই,তাই ফোন করছি।হেল্প লাগবে একটু",এটা গোটা জীবনে গৌরবের শোনা সবচেয়ে কমন ডায়লগ। কখনও না করেনি ও।যে যা বলেছে হেল্প করার চেষ্টা করেছে।কাল সুতনয়াও নিশ্চয় এরকম কিছুই বলবে,তাই ওকে ডাকছে। "হ্যাঁ আসবো,কোথায় আসতে হবে বলিস।" বললো গৌরব।
"সেটা তুই তোর প্রিয় জায়গা সিলেক্ট করে আমাকে নিয়ে যাবি,কেমন?গুড নাইট।কাল দেখা হচ্ছে।"
সুভাষ সরোবরে লেকের ধারেই গৌরব নিয়ে গেল সুতনয়াকে। কী দরকার সুতনয়ার মতো মেয়ের থাকতে পারে গৌরবের সঙ্গে,আকাশ পাতাল ভেবেও কিনারা করতে পারেনি গৌরব।ক্লাসে অনেকবার চোখাচোখি হয়েছে,দুজনেই তৎক্ষণাৎ চোখ সরিয়ে নিয়েছে।
সুতনয়া বেশ খুশি খুশি মনে চারদিক দেখছে।গৌরব কিছুটা নার্ভাস।অন্যদিনের তুলনায় সেজেগুজে এসেছে আজ সুতনয়া,বেশ মিষ্টি দেখাচ্ছে আজ ঝগড়ুটে মেয়েটাকে।মনে মনে ভাবলো গৌরব।কিন্তু এসব কী ভাবছে!নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো গৌরব।
"কী বলবি বল",বললো গৌরব।
"আগে একটু বসি চুপচাপ? সবসময় এত তাড়া কীসের তোর?"বললো সুতনয়া।
"আমার আবার কীসের তাড়া? ছুটির পর এখানে বসে আছিস,সময় নষ্ট হচ্ছে।সামনে পরীক্ষা ,তাই..."
"চুপ করবি তুই?সবসময় তোর সাথে একটা ব্যারিয়ার তৈরি করার চেষ্টা করিস কেন?আমি তো সময় নষ্ট করতেই চাইছি তোর সাথে। কিচ্ছু বুঝিস না তুই বল?গরু তো গরুই।"
"কী বুঝবো?"
"তোর সাথে সারাজীবনটা নষ্ট করতে চাই,দিবি করতে?ফার্স্ট টাইম নিজে থেকে কাউকে প্রপোজ করছি। ঘ্যাম নিলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।"
গৌরবের বুকে একটা ধাক্কা লাগলো।এটা কী বলছে সুতনয়া?নিশ্চয় মজা করছে,এরপর যাতে খচাতে পারে সবাই,তাই ফাঁদ পেতেছে।কিন্তু সুতনয়ার চোখ তা বলছে না।ওর চোখে ব্যাকুল আকুতি গৌরবের কাছে।
"চুপ করে আছিস কেন?আমি জানি আমি খুব খারাপ,তুই অনেক অপমানিত হয়েছিস আমার জন্য ।কিন্তু বিশ্বাস কর,আমি অনেক ভেবেচিন্তে বলছি।আমি সবসময় এখন অন্যরকম ফিল করি,ক্লাসে গিয়ে সেটা আরও বেড়ে যায়।তোকে শান্ত,চুপচাপ দেখলে ভীষণ কষ্ট হয় বিশ্বাস কর।আমাকে নিবি তোর সাথে?সারাজীবন তোর মতো করেই থাকতে চাই আমি,পারছি না আমি আর।"
"তুই খুব ভুল করছিস সুতনয়া,নিজের জীবনটা শেষ করছিস।এই সময় পরীক্ষার আগে,এসব মাথাতে আনিস না।তোর ফিউচার আমার জন্য শেষ হোক,আমি চাইনা।আমাকে দেখলে যদি তোর পড়ায় মন বসাতে অসুবিধা হয় ক্লাসে,আমি আর আসবো না প্রয়োজনে।আমার তো এমনিতেও কিছু হবে না।কবে ফিরবো বাড়িতে দিন গুনছি।"
"তুই আমাকে রিজেক্ট করছিস তাই তো?কথাটা সোজাসুজি বললেই পারতিস।ঘুরিয়ে বলার দরকার ছিলো না। সুতনয়া মাইতি ছেলেখেলা করতে কোনো কথা বলে না।আমি তোকে ভালোবেসে ফেলেছি,সারাজীবন লড়াই করতে পারি তোর জন্য।তুই পড়াশোনায় কেমন সেটা আমার কাছে ম্যাটার করে না। তুই আরও অনেককিছু করতে পারিস যেটা আর কেউ পারবে না।এনি ওয়েজ,আমি আসছি।তুই যখন না করলি আমাকে আর এখানে দরকার নেই।আমি একা সামলে নেবো নিজেকে",গেটের দিকে প্রায় ছুটতে শুরু করলো সুতনয়া।গৌরব এবার আর ভাবলো না কিছু,দৌড়ে গিয়ে ওর হাত ধরে বললো,"ছেড়ে চলে যাবি না তো কখনো?"
"সেটা সময় উত্তর দেবে", সুতনয়া জড়িয়ে ধরলো গৌরবকে।জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়েই ওর পিঠে হাতটা রাখলো গৌরব।ওর বুকে তখন সমুদ্র উথাল পাতাল করছে।স্থিতু হতে অনেক সময় লাগবে।
সুদীপ্তাকে কিছু বলতে হয়নি,নিজেই আঁচ করে নিয়েছে ও।ক্লাসের বাকি সবাই খানিকটা বিভ্রান্ত। সুতনয়ার বন্ধুরা ওকে প্রায় বয়কট করেছে,ঝুড়িতে থাকা একটা পচা আম বাকিদেরও নষ্ট করতে শুরু করে। সুতনয়া সবাইকে কাঁচকলা দেখিয়ে গৌরবের সাথে বসা শুরু করেছে লাস্ট বেঞ্চে।আশেপাশে গৌরবের কিছু বন্ধু থাকে। টিচররা কিছু বলেনি এখনও অবধি।এখানে টিচারদের মাইনে নিয়ে চিন্তা,কে কী করলো অত মাথাব্যথা নেই।যে নিজের তাগিদে টপার হবে তার নামে পোস্টার ছাপিয়ে দেওয়া হবে।ইনস্টিটিউট থেকে টপার না বেরোলেও চাপ নেই।টাকার বিনিময়ে টপারদের কিনে নেওয়া যায় ইনস্টিটিউটের অ্যাডের জন্য।সবকিছুই এখানে যান্ত্রিক,আর নকল।কেবল একটা দামাল প্রেম ছাড়া। সুতনয়া আর গৌরবের প্রেম।টিফিন ব্রেকে ওরা চায়ের দোকানে যায়,ক্লাস শেষে সরোবরের ধারে যায়,ফুচকা খায় একসাথে। সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট দেয়নি কেউই।দুজনেরই একমত,লোককে দেখিয়ে কী হবে! প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করছে ওরা একসাথে।
সাত বছর কেটে গেছে তারপর।জয় দিল্লীতে বি.টেক কমপ্লিট করে চাকরি করছে।আর যোগাযোগ রাখেনি হাবড়াতে কারোর সঙ্গে।গৌরব হাবড়াতেই প্রথম গ্রামবাংলার অ্যাম্বিয়েন্সে একটা বিরাট রিসর্ট খুলেছে,সাথে রেস্তোরাঁ।উইক এন্ডে কলকাতা থেকেও লোকজন আসে,বেশ সাড়া পেয়েছে।যে লোন নিয়ে রিসর্ট খুলেছিল,সেটাও তাড়াতাড়িই শোধ হয়ে যাবার পথে।গৌরবের বাবা - মাও খুশি ছেলে ও বৌমার সাফল্যে। সুতনয়া ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করেছে কলকাতা থেকেই।এখন একটা আই টি কোম্পানিতে আছে।ওদের একসাথে ফেসবুক আপডেটটা প্রথম বিয়ের দিনই আসে,গৌরব ক্যাপশনে লিখেছিলো, "সুতোকে সিঁদুরদান করেই ফেললাম!" প্রথম কমেন্টটাও ছিলো সুতনয়ার, "ব্যাড লাক!এবার থেকে গরুর সাথে গোয়ালঘরেই জীবন কাটাতে হবে।"
ওদের খুনসুটি চলতে থাকবে সারাজীবন।যত খারাপ পরিস্থিতি আসুক,একে অপরের হাতটা ছাড়বে না ওরা,এটা জানে দুজনেই।প্রতিকূলতাকে পাত্তা না দিয়ে হাসি মজার মধ্যে দিয়ে একে অপরের পাশে থেকে দিন অতিবাহিত করাতেই ওদের প্রেমের সাফল্য,ওদের জীবনের গৌরব।