রংমিলান্তি
পূজা মৈত্র
আনিশা গুপ্তের নিউজটা পড়লি?
পাশের ডেস্ক থেকে বিতানের কথা ভেসে এলো অনীতের কানে। নিজের ডেস্কে বসে কালকের এডিশনের ব্যাঙ্গঁচিত্রটা রাফ স্কেচ করছিল অনীত, এ-ফোর কাগজে। বাংলার বেশ বড়প্রিন্ট মিডিয়াতে এখন কার্টুনিস্টের জব করে, একসময় নিজে ফ্লিল্যান্স শিল্পী হিসাবে নাম করার স্বপ্ন দেখা অনীত চ্যাটার্জি। ভালোবেসে কাজটা করে, তা নয়, বাধ্য হয়ে করে। নিজের আর নিজের সন্তানের জন্য।
বিতানের কথা শুনে পেন্সিল থামালো অনীত। আনিশা এসেছে কলকাতায়? ওহ, হ্যাঁ, আসার তো কথা ছিলো, হোডিং-এ মুড়ে গিয়েছিল শহর। আনিশা’স ক্রিয়েশানের আনিশা গুপ্ত খোদ আসছেন, শোরুম উদ্বোধনে। সাউথসিটি, কোয়েস্ট মল, এক্রোপলিস- তিন জায়গাতেই এখন আনিশা’স পাওয়া যাবে। ভারতের তথা বিশ্বের আরো বেশ কয়েকটা শহরের মতো। ‘কলকাতার মেয়ের বিশ্বজয়’ এসব ক্লিশে শিরোনামে নিশ্চয় খবর করেছে বিতান। ওটা নিয়েই লাফাচ্ছে।
-ইন্টারভিউ নিলো তো সপ্তর্ষিদা। আজ সকালে, হায়াতে, ব্রেকফাস্ট ইন্টারভিউ। বলছিলো, দারুণ সেক্সি নাকি, তেমন ফ্যাশানেবেল। গায়ের রঙ-টা একটু চাপা...
অনীতের পেন্সিলের শীসটা ভেঙে গেলো। হাতে চাপ পড়ে, শিট্। আবার সময় নষ্ট। ছেলেটাকে স্কুল থেকে আনতে যেতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে, বাইরে বৃষ্টিও পড়ছে মনে হয়।
-কলকাতায় থাকবে কয়েকদিন বলেছে। প্রায় বছর আটেক পর এসেছে শহরে। পুরনো সবার সথে দেখা করার আছে বলেছে।
বিতানের অনর্গল কথায় পার্থিব বললো-
-তুমি তো হাঁড়ির খবর জেনে বসে আছো, বলতেই পারতে সপ্তর্ষিদা’-কে তোমাকে নিয়ে যেতে।
-বলছিস? তা নিয়ে গেলে ভালোই হতো, যা গ্ল্যামারাস্ হিরোইন হতে পারে চাইলে।
-তোমাকে থোড়ি পাত্তা দেবে? ঋষভ রায় আছে কী করতে? বাঙালি শিল্পপতি মুম্বাইয়ে প্রতিষ্ঠিত,রায় এম্পায়ারের উত্তরসূরি, তিনি থাকতে তুমি?
অনীত আর পারল না। গলা খাঁকারি দিল। বিতান বলে উঠলো-
-সরি, সরি, অনীতদা’-র আঁকতে প্রবলেম হচ্ছে। এই অনীতদা’, তুমি কার্টুন আঁকো মাইরি, পোট্রেট আঁকতে পারো?
অনিত তাকালো – হঠাৎ এমন প্রশ্ন?
-না, একজনের পোট্রেট আঁকাতাম তোমাকে দিয়ে।
অনীত চশমা ঠিক করলো, বছর ছত্রিশেই চুলে হালকা পাক ধরেছে অনীতের, ছ ফুট দু ইঞ্চি লম্বা, চওড়া চেহারা, আগে বেশ মাসকিউলার ছিল। এখন সংসারের চাপে ভেঙে গেছে - কার আঁকাবি? বৌ-এর?
-আরে ধ্যাৎ। কাল থেকে যে আমার ক্রাশের থেকেও বেশি হয়ে গেছে তার, আনিশা গুপ্ত। এঁকে দেবে তো?
অনীত চুপ করে থাকলো। এই প্রশ্নের কোন উত্তর ওর কাছে নেই।
-যাহ বাওয়া। রেগে গেলে নাকি? সিরিয়াসলি বলেছি কিন্তু, মস্করা ভেবো না।
ফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। আননোন নাম্বার। এই সময়- ঘড়ি দেখলো অনীত, শিট্। দেড়টা বেজে গেছে! ছেলের স্কুল ছুটি হয়ে গেছে তাহলে। স্কুল থেকে না তো?
-হ্যালো?
-হ্যালো, বাপি? বাবাই বলছি।
অনীতের বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। অনীশ এমন সময় স্কুলের মধ্যে না বাইরে? কার ফোন থেকে ফোন করছে!
-বাবাই, কার ফোন থেকে কল করছিস?
-আন্টির।
-আন্টি? কোন আন্টি!
-তুমি চিনবে না। বৃষ্টি পড়ছে খুব। তোমাকে তাড়াহুড়ো করে আনতে আসতে হবে না। আন্টি আমাকে বাড়িতে ড্রপ করে দেবে, প্লিজ ওয়েট করতে বলো না। সবাই বেরিয়ে গেছে, প্লিজ বাপি...
ছেলেটা একা একা স্কুল থেকে বেরিয়েছে। বাবার দেরি দেখে অন্য কোন গার্জিয়ানের গাড়ি ধরে বাড়ি ফিরেছে। অনীত জানে এটা ঠিক না। এর থেকে বিপদ হতে পারে, কিন্তু সেটা বাবাই-কে বাড়ি ফিরলে বোঝাবে, ভদ্রমহিলার কোন অসৎ উদ্দেশ্য নেই বলেই কল করেছেন।
-বেশ, বাড়ি চিনিয়ে নিয়ে যেতে পারবি তো?
-হ্যাঁ... খুব পারবো। তুমি কাজ সেরে এসো। কেমন?
-রান্না করা আছে। মাইক্রোওয়েভে গরম করে খেয়ে নিস। আসতে দেরি হলে,
-আচ্ছা, তোমার অ-নেক লেট হবে? আন্টি দেখা করবে বলছে।
-আন্টি দেখা করবে? ঠিক আছে, কাজ সেরেই আসছি।
শনিবার আজ, অনীত ভেবেছিলো ছেলে যখন বাড়ি চলেই যাচ্ছে তখন কোন একটা বারে বসে দু’পেগ খেয়ে বাড়ি ঢুকবে, কিন্তু ভদ্রমহিলা অনেক উপকার এমনিতেই করেছেন, দেখা করতে চাইছেন যখন, দেখা করা উচিৎ।
-বাড়ি যাবে, এখনই তাই তো?
বিতান হাসলো।
-হ্যাঁ, কাজটা হয়েই গেছে প্রায়, ফাইনালটা ল্যাপটপে করে নেবো।
-যাও, একটা কথা বলি অনীতদা’!
অনীত বিতানের দিকে তাকালো।
ও জানে কথাটা কি, তাও বিতানকে নিরস্ত করলো না।
-বিয়ে করে নাও এবার বাবাই-এর তো মায়ের দরকার, তাই না? তোমার না হয় এখন মনে হচ্ছে তুমি ছাড়া অনীশের কারোর প্রয়োজন নেই – কিন্তু এইসব দিনগুলোর জন্যই বলছি। তুমি আটকে গেছো, কে না কে বাবাইকে ড্রপ করছে। এগুলো কি ঠিক? ওর মা সাথে থাকলে তিনিই করতে পারতেন এসব।
-ওর মা আছে বিতান, তার জায়গায় আমি অন্য কাউকে আনবো কি করে?
-তিনি তো এখন আর ধরাছোঁয়ার মধ্যে নেই, তুমিই বলেছো। তার স্মৃতিকে এভাবে আঁকড়ে না থেকে জীবনে এগিয়ে যাও। দেখবে ভালোই হবে।
অনীত ব্যাগ গোছালো, চুপ করে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল-
-অনীশের মায়ের অনেক পোট্রেট রয়ে গেছে যে আমার কাছে?
বিতান অবাক হলো
-পোট্রেট? সরিয়ে দিতে পারো... যদি ওগুলোর জন্য ভুলতে কষ্ট হয়...
-অনেক দামী পোট্রেটগুলো বিতান, তুই বুঝবি না। চলি রে।
অনীশ চলে গেলো। বিতান-কে হেঁয়ালির মধ্যে রেখে।
২
ছোট্টর মধ্যে বেশ গোছানো ফ্ল্যাট। আনিশার প্রথম ফ্ল্যাটে ঢুকেই এটা মনে হয়েছিলো। একটা ফ্ল্যাট কমপ্লেক্সের মধ্যে ফ্ল্যাট-টা, নীচে সিকিওরিটি আছে। লিফটও মধ্যবিত্তদের থাকার জায়গা। ঐ ফ্লোরের উল্টোদিকে ফ্ল্যাটটা বন্ধ। তালামারা ঘরে দামী আসবাব হয়তো নেই কিন্তু পর্দায়, টেবিল ক্লথে, দেওয়ালে, ল্যাম্পশেডে মালিকের রুচির ছাপ স্পষ্ট।
-এসো আন্টি, ভিতরে এসো, এটা আমাদের বাড়ি।
অনীশ বললো। চাবি দিয়ে দরজা ও-ই খুললো। এতটুকু ছেলের কাছে বাড়ির চাবি থাকে! অবাকই হল আনিশা। বাচ্চাটা খুব স্মার্ট, টরটরে, পড়াশোনায় ভালো মনে হয়। বছর সাতেক আটেক বয়স, ক্লাস টু-তে পড়ে। দোলনা ডে
স্কুল, কসবায়। এতক্ষণ গাড়িতে আসতে আসতে সবটাই শুনে নিয়েছে আনিশা। এখানে এসেছে বাচ্চাটার মা-বাবার সাথে কথা বলতে। ছেলেটার বাবার আনতে আসতে দেরি হচ্ছে দেখে স্কুল থেকে সিউওরিটি-কে ডজ করে বেরিয়ে আজ আনিশার গাড়ির সামনে পড়ছিল একটু হলেই। কোন ক্রমে ব্রেক কষে সামলেছে আনিশা। পাবলিক জড়ো হয়ে গিয়েছিল প্রায় ওকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে। তার মধ্যে দু’একজন ফেসবুক লাইভও শুরু করে দিয়েছিলো আনিশা-কে চিনতে পেরে। কোন ক্রমে মিষ্টি কথায় চিঁড়ে ভিজিয়ে বাচ্চাটাকে নিজে বাড়িতে ড্রপ করে দেবে কথা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে আনিশা। মবড হয়ে যাওয়ার ভয়, মিডিয়া চলে আসার ভয় সবসময়ই ছিল, কিন্তু কোন ক্রমে কাটাতে পেরেছে। গাড়িতে আসতে আসতে অনীশ ওরফে বাবাইয়ের সাথে অনেক কথা হয়েছে আনিশার। ভয় পাওয়া বাচ্চাটাকে সহজ করার আর উপায় ছিল না। একে হঠাৎ গাড়ির এতো কাছাকাছি চলে আসার ভয়, তার ওপর বাড়ি ফিরলে বাপি-কে কি বলবে তার ভয়। বাবা-ই শাসন করে মনে হয়। মায়ের কথা তেমন কিছু বলেনি গোটা রাস্তায়। কিন্তু আজকাল তো অন্যরকম হয় ব্যাপারটা জানতো আনিশা। খটকা লাগলেও মুখে কিছু বলেনি বরং নানারকম গল্প করে গান শুনিয়ে ভয় কাটিয়েছে। মিউজিক প্লেয়ারে আনিশার মোবাইলে থেকে নাইন্টিসের রোম্যান্টিক গান বাজাচ্ছিল। আনিশা অবাক হয়ে দেখেছে বাচ্চাটা প্রত্যেকটা গান চেনে, ওর বাবা নাকি এসব গান খুব শোনে- বলছিল অনীশ। বিশেষত, “জব কোই বাত বিগড় যায়ে...” শুনেই বলেছিল, ওর বাবার ফেভারিট গান ওটা। আনিশার ভালো লেগেছিল, গানটা ওরও বড্ড প্রিয়। এমন বৃষ্টির দিনে গাড়ির অডিও প্লেয়ারে বারবার ও-শোনে এই গানটা। বহুদিনের অভ্যাস। অনীশের গুচ্ছের প্রশ্নও ছিল। আন্টি কোথায় থাকে? কি করে? ফ্যাশান ডিজাইনের মানে কি... স-ব জানা হয়ে গেছে এই কুড়ি মিনিটে। দমদেওয়া কথা বলা পুতুল একটা, সব ঠিক থাকলেও আনিশাও এই বয়সের একটা টরটরে বাচ্চাটার মা হতে পারতো একদিন। মা ডাকে ভরিয়ে রাখতো সে আনিশা-কে, অথচ...
-জল খাও, ফ্রুট জুস খাবে? আনব...
আনিশা তাকালো – কিচ্ছু আনতে হবে না পাকা বুড়ো। তুমি বসো পাশে, জল খেয়ে গ্লাসটা সেন্টার টেবিলে রেখে অনীশের দিকে তাকালো আনিশা। এটা ওদের বসার ঘর। ছিমছাম, স্মার্ট টিভি আছে একটা, সোফাসেটও, একটা সিঙ্গেল খাটও আছে একপাশে।
-দেখো না, বাপি বললো তক্ষনি আসছে, এখনো এলো না।
-তাই তো! ভারী অন্যায়। বাপিকে বকে দেবে নাকি অনীশ?
-ইস্! বাপিকে বকা যায় নাকি? বাপি তো বড়।
-বাপি তাহলে বন্ধু না, আন্টির মতো?
অনীশ একটু ভাবলো
-বন্ধু। তবে এতোটা না।
আনিশা মিষ্টি করে হাসলো। গাড়িতে আসতে আসতে সহজ হবার জন্য পুচকেটার সাথে বন্ধুত্বও পাতিয়েছে-ও। এমন মিষ্টি ছেলের বন্ধু কে না হতে চাইবে!
-তাহলে বাপি রাগী? বকে?
-মুডের ওপর, মুড ভালো থাকলে ভুল করে রাখলেও বকে না, আর খারাপ থাকলে বকে, তেমন ভুল না থাকলেও।
-আচ্ছা! বাপি রাগী প্লাস মুডিও, বেশ।
-আজ এসে নিশ্চয় এত্তো করে বকবে, তোমার সাথে এলাম যে।
আনিশা অনীশের মাথায় হাত রাখলো।
-ঐজন্যই তো এলাম আমি, যাতে আমার বন্ধুটাকে একদম না বকে। ঠিক সময় করে আনতে যায় রোজ, দেরি না করে।
অনীশ একটু ভাবলো –তুমি কি বাপিকে বকে দেবে? লেট করার জন্য?
-অল্প। ঠিক করবো?
অনীশ বড় করে ঘাড় হেলালো –হ্যাঁ... বাপিকে তো কেউ বকে না।
-কেন? মা?
অনীশ চুপ করে গেল। আনিশা থমকে গেলো। কিছু কি ভুল বললো ও?
-অনীশ... কি হয়েছে?
চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছিল ছেলেটার, আনিশার খারাপ লাগলো। কোলের কাছে নিয়ে এলো ওকে। গায়ে মাথায় হাত বোলালো।
-কিছু ভুল বললাম আমি, বাচ্চা?
চোখ মুছল অনীশ
-না, না।
-তবে? কাঁদছো কেন? কি হয়েছে?
-আমার মা নেই আন্টি।
আনিশার বুকে বিঁধল কথাটা। অজান্তেই বাচ্চাটাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেললো ও –নেই? মানে?
-বাপি বলে, নেই বলতে নেই। কোথাও না কোথাও আছে। তবে আমাদের কাছে নেই। স্টার হয়ে গেছে মে বি।
আনিশা ছেলেটাকে কপালে আদর করে দিল, আলতো করে।
-কাঁদে না, ডোন্ট ক্রাই। ভালো ছেলে অনীশ, ব্রেভ বয়।
অনীশ চোখ মুছল –কাঁদছি না। এই দেখো।
-অনীশের নামটা কে দিয়েছে?
কথা ঘোরালো আনিশা।
-বাপি।
-খুব ভালো নাম। ইউনিক।
-তোমার নাম কি?
-আমার? আন্টি!
আনিশা ছেলেটার মন ঘোরাবার জন্য বললো। অনীশ বলল-
-সে তো আমি বলি তোমায়।
-বাপি কী করে? আই মিন কাজ?
আবার কথা ঘোরালো আনিশা।
-বাপি? বাপি ছবি আঁকে, বড় পেপারে, কার্টুন।
তাই ভদ্রলোকের রুচি বেশ ভালো। নিজে শিল্পী, সেইকারণে। মনে মনে ভাবলো আনিশা।
-বাহ্ দারুণ। আমিও আঁকি, ফ্যাশান ডিজাইনার বললাম না? আমার কাজও আঁকা, তোমার বাপি আঁকে কাগজে, আমি কাপড়ে।
অনীশ আন্টির হাত ধরলো।
-তুমি বাপি-কে বলে দেবে না তো আমি সিকিউরিটি টপকে বেরিয়ে ছুট্টে গাড়ির সামনে চলে এসেছিলাম?
আনিশা বলবে, ভদ্রলোক-কে জানানো উচিৎ এটা। সময় আর দায়িত্ব জ্ঞান বড্ড জরুরি এই মর্মে বেশ কয়েকটা কথা শোনাবে ভেবেই এসেছিলো আগে। সিঙ্গেল ফাদার, একা হাতে সব সামলাতে হয় দেখে ওতটা কড়া ভাবে বলবে না, তবে সত্যিটা ওনার জানা উচিৎ।
-বলো না আন্টি, প্লিজ...
-বুঝিয়ে বলবো তো।
-বাপি রেগে যাবে, খুব, মার খাব খুব তাহলে।
আনিশা থমকালো, মা মরা এতো মিষ্টি বাচ্চাটাকে ওর বাপি মারে? কোন প্রাণে মারে কে জানে?
-বাপি মারে?
-এমনিতে একদম মারে না।
-তবে?
-যেদিন খুব রেগে যায় ওদিন। এই ধরো বছরে একদু’দিন। এই ইয়ারে এখনও একদিনও মারেনি। যেদিন ধরে সেদিন খুব মারে।
আনিশা বুঝল নেহাত ধৈর্য্য না হারালে ভদ্রলোক ছেলেকে মারেন না। আনিশা ওনার মুড বুঝেই কথাগুলো বলবে তবে।
-বলবে না তো?
-উঁহু, বলবো না, ভয় পেয় না।
ডোরবেল বেজে উঠলো। অনীশের বাবা এসেছেন নিশ্চয়। কি নাম ভদ্রোলোকের! দরজায় কোন নেমপ্লেটও খেয়াল করেনি আনিশা। ভদ্রলোক নিশ্চয় আনিশা-কে চিনবেন। হোডিং-এ ভরে গেছে আনিশার নামে চারিদিকে। তাছাড়া আনিশা-কে চেনে না এমন বাঙ্গালিও খুব কম।
-বাপি এসেছে। খুলতে যাই আন্টি?
আনিশা ছেলেটার সহবৎ দেখে মুগ্ধ হয়। অন্য বাচ্চা হলে ছুট্টে চলে যেত। জিজ্ঞাসা করে যেতে হয়, সেই বোধ আছে। আর হবেইনা বা কেন, ভালো স্কুলে পড়ে, রুচিশীল, স্নেহশীল বাবার প্রতিপালনে বড় হচ্ছে, একটু অন্যরকমও। মা হারা বলে। কিন্তু খুব মিষ্টি, আনিশার অসমবয়সী বন্ধুটি। ঘড়ি দেখল আনিশা। মাসির বাড়ি গিয়েছিল দুপুরে। সন্ধ্যায় ঋষভের মায়ের বাড়ি যাবার কথা। সময় আছে, একটু কথা বলা যাবে ভদ্রলোকের সাথে।
-রেনকোট পরেছ বাপি? খুব বৃষ্টি? ভিজে গেছ তো?
আনিশা অনীশের কথা শুনে বুঝল ছেলেটা বাবার প্রতি খুব কেয়ারিং, ওরও হয়ত এই বয়সেরই একটা বাচ্চা থাকত। যে ওকে ভালোবাসোত, যত্ন নিতে চেষ্টা করতো, দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে ফিরলে যাকে জড়িয়ে ধরলে ক্লান্তি দূর হতো। সে সম্ভাবনা নিজের হাতেই শেষ করেছিল আনিশা, মুম্বাই-এর স্বপ্ন সফল করতে গেলে পুরনো সম্পর্কের চিহ্নটিকে বহন করার উপায় ছিল না। তাছাড়া তার পেটে আসাও সুখস্মৃতি ছিল না। নেশাগ্রস্ত প্রাক্তনের নেশার ঘোরে অত্যাচারের ফল ছিল মাত্র। তবুও... মাঝে মাঝে এতো সাফল্যের মধ্যেও বুকের একটা কোণ ফাঁকা লাগে। একটা অন্যায়বোধ, একটা পাপবোধ ঘিরে ধরে। হয়তো ঋষভের সাথে বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। ওদের বিয়ের পর আনিশা কনসিভ করবে এবং নিজের স্বপ্নের সন্তানের মা হবে। শিখরে ওঠা এখন সম্পূর্ণ আনিশার। একবাক্যে আনিশা গুপ্তা ভারতের সবচেয়ে দামী ফ্যাশান ডিজাইনার। সমস্ত বলিউড ওর হাতের মুঠোয়। ‘আনিশাস্’ ফ্যাশান এখন ভারত বিখ্যাত। বিদেশেও অজস্র শাখা তার। এবার ক’দিন থামতে চায় আনিশা, জিরোতে চায়। যে মানুষটার বন্ধুত্ব, পাশে থাকা, স্বার্থহীন ভালবাসার জন্য আজ ও এখানে তার সব সাহায্যের ঋণ চুকিয়ে সহধর্মিনী হতে চায়। সবচেয়ে বেশি করে একটা সন্তানের মা হতে চায়। মাস খানেক পরেই বিয়ে ওদের। কলকাতাতেও একটা রিসেপশান করার ঠিক করেছে দুজনে। আনিশা এই সাত-আট বছর কলকাতাকে এড়িয়েছে দুঃস্বপ্নের মতো। পালাতে চেয়েছে এই শহরের কাছ থেকে। ঋষভ ওকে ক্রমাগত বুঝিয়েছে। একটা ভুল মানুষের জন্য অন্যসব সম্পর্ক, সব বন্ধুত্ব, সব স্মৃতি, সব আত্মীয়তা পর হয়ে যায় না। ওর ভরসাতেই এখানে এসেছে আনিশা। দিন দশেক নিজের সাথে নিজে একা থাকবে এই প্রস্তাবও দিয়েছে ঋষভ-কে। ঋষভ অরাজি হয়নি। পুরনো সমস্ত কিছু-কে একবার ছুঁয়ে দেখতে চায় আনিশা, কাছ থেকে। তাদের পাশে বসে তাদের গল্প শুনতে চায়। শহরটার গল্পও শুনতে চায় একান্তে। কারোর সাথে হলে সেটা সম্ভব নয়। ঋষভ প্রথমে অবাক হলেও পরে আনিশার এই চাওয়ায় কোন প্রশ্ন করেনি। আসলে ওরা দুজনে একে অপরের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। তাই বিশ্বাসের সুতোয় টান ভীষণ জোরালো। ঋষভ একবারও আনিশার প্রাক্তনের সাথে যে কিনা ঋষভের প্রিয়তম বন্ধুও – দেখা হবার সম্ভাবনার প্রসঙ্গ তোলেনি, আনিশাও না। দেখা হতেই পারে, একই শহর একই বন্ধুবৃত্ত যখন। তবে আনিশা বন্ধুদের থেকে জেনেছে সে বৃত্তের অনেক বাইরে রাখে নিজেকে, অজ্ঞাতবাসে। কোন স্যোশাল মিডিয়াতে নেই। তার ফোন নাম্বারও বদলে ফেলেছে। এই দশদিনে তার সাথে একবার দেখা হোক এটা চায় আনিশা। কিন্তু দেখা করার চেষ্টা করতে চায় না। একবার তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে তার চোখে নিজের সাফল্যের প্রতিবিম্ব-কে দেখতে চায়। তার আটকে রাখার সমস্ত অপচেষ্টাকে ব্যর্থ করে আজ আনিশা সফল সেই সাফল্য উৎযাপন ওই মুহূর্তেই হয়ে যাবে, আর মধুর প্রতিশোধও। তাই এই শহরেও একটা রিসেপশন রাখবে আনিশা। সব সে দেখুক, শুনুক, জানুক। যেখানেই থাকুক, তার মনের মধ্যে গ্লানির প্রবাহ বইয়ে দিতে চায় আনিশা। কোনদিন তার সাথে দেখা হোক আর না হোক।
৩
-ঘণ্টা পড়তেই ছুটে বেরিয়ে এসেছিস নিশ্চয় স্কুলের বাইরে?
আনিশার কানে ভদ্রলোকের গলার আওয়াজ পৌঁছল। চিরচেনা গলার আওয়াজ। রাগত, বেশ রেগে গেছে সে, এতটা মিল গলার আওয়াজে দুটো ভিন্ন মানুষের কী করে হয়? অনীত – অনীতের মতোই তো গলাটা। আনিশার প্রাক্তন অনীত, আনিশার প্রথম ভালোবাসাও অনীত, আনিশার স্বামী অনীত, আনিশার গর্ভে প্রথম সন্তানের বীজ বপনকারী পুরুষের নামও অনীত। অনীত চ্যার্টাজি। যার সাথে সাত বছর প্রেম করার পরে বিয়ে করেছিলো আনিশা, বছর এগারো আগে। টানা তিন-সাড়েতিন বছর সংসারও করেছিল তার সাথে, তার চালচুলো না থাকা, সমস্ত দারিদ্র, সমস্ত দীনতা, সমস্ত রিক্ততা-কে মেনে নিয়েই একসাথে একত্রে শিল্প সাধনার উদ্দেশ্যে পথ চলা শুরু করেছিলো। দুজনেই আঁকতো, আঁকতে ভালো বাসতো। অনীত ক্যানভাসে, আর আনিশা কাপড়ে। একটা আর্ট এক্সিবিশনে গিয়ে আর্ট কলেজের ছাত্র অনীতের সাথে ডিজাইনিং নিয়ে পাঠরত আনিশার পরিচয় হয়েছিল এক কমন ফ্রেন্ডের মাধ্যমে কলেজের ফার্স্ট ইয়ারেই। পরিচয়টা ভালবাসায় বদলাতে সময় নেয়নি কারণ দুজনেরই আগ্রহের ক্ষেত্র-টা একইরকম ছিলো, স্বপ্নগুলোও একইরকম ছিলো। সাহচর্যেরা ডানা মেলে উড়তে শুরু করেছিল প্রায়। মা, বাবা, দাদা সবার আপত্তি সত্ত্বেও চালচুলোহীন ছেলেটার সাথে নিজের জীবন জড়াতে একমুহূর্ত ভাবেনি আনিশা। অনীতের ট্যালেন্টে আর নিজের স্বপ্নে আস্থা ছিল ওর। অথচ সেই আস্থা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিলো বছর দুয়েকেই। এই দু’বছরে আনিশার সাফল্য আর নিজের ব্যর্থতা সম্পূর্ন বদলে দেয় ব্যক্তি অনীত-কে। ভালো বাসার জায়গায় ঈর্ষার স্থান হয়, সন্দেহ আসন পাতে। বাকি দেড় বছর মুখরক্ষার জন্য সহাবস্থান করেছিলো আনিশা। মা-বাবা-দাদা-কে কি বলবে ভেবে। কিন্তু তারপর আর পারেনি। অনীতের নেশাগ্রস্ততা সম্পর্ক-টাকে শেষ করে দিয়েছিলো ছিলো একবারেই। নিজের সব স্বপ্ন-কে কবর দিয়ে, সব সুযোগের গলা টিপে বাঁচতে বাঁচতে দমবন্ধ হয়ে আসতো আনিশার। তাতেও অনীতের মন পাওয়া যেতো না। এভাবে বাঁচার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো ভেবেছিলো একসময়। শেষে ঋষভের বোঝনো-তে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, প্রায় আটবছর আগে। মুম্বাইয়ের অফারটাও তখনি পেয়েছিলো। ঋষভের বাবার কোম্পানির শেষ সুযোগ ছিল ওটা ওর... নিজের জীবনকে অর্থবহ করে তোলার লাস্ট চান্স। রোজকার অশান্তির সংসার থেকে মুক্ত হয়ে নিজের মনের মতো করে বাঁচার শেষ সুযোগ, আর সেটাই করেছে-ও। ভাগ্যিস ঋষভ ছিল। অনীতের আর্ট কলেজের সহপাঠী আর বেস্ট ফ্রেন্ড হিসাবেই ও-কে চিনেছিল আনিশা। পরে ঋষভ আনিশারও বন্ধু হয়ে ওঠে। সমস্তটা শুনে অনীত-কে অনেক করে বুঝিয়েছিল ঋষভ। পারেনি। বারবার বুঝিয়েছিল যাতে সম্পর্ক-টা না ভাঙে। শেষে আনিশা-কেই বলে সঠিক সিদ্ধান্ত-টা নিতে। সঠিক সিদ্ধান্ত-টা আট বছর আগে নিয়েছে আনিশা। আর নিয়েছে বলেই আজ ও আনিশা গুপ্তা। বিশ্বজোড়া খ্যাতি ছড়ানো ডিজাইনার। ইয়াং অ্যাচিভারও বটে।
-বল? চুপ করে আছিস কেন?
গলাটা আবারও শুনলো আনিশা। অনীতেরই গলা। অনীত চ্যাটার্জির। কিন্তু কার্টুনিস্ট? ক্যানভাস ছেড়ে কার্টুন! আর এই সন্তান? অনীত বিয়ে করেছিলো তবে। কেউ তো কিছু বলেনি আনিশা-কে! অদ্ভুত! বছর সাত-আটেকের ছেলে মানে আনিশা যেতে যেতেই বিয়ে সেরে নিয়েছিলো। ডিভোর্সের আগেই! সেই স্ত্রীর কি হলো? মারা গেছে! হাজারটা প্রশ্ন ভিড় করলো আনিশার মাথায়। প্রত্যেকটারই সুস্পষ্ট উত্তর চাই ওর।
-আন্টি আছে ড্রয়িংরুমে বাপি।
ক্ষীণ কন্ঠে বললো বাচ্চাটা। ওকেও নিশ্চয় বকাঝকা মারধোরে তটস্থ করে রাখে অনীত! স্বভাব বদলায় না মানুষের।
-আন্টি!
-এলাম যে...
রাগত গলার স্বর নরম হলো। -ও, আচ্ছা। চল, কথা বলি।
-তুমি জেনে দেখো আন্টির থেকে- আমি কিছু করিনি।
হাসির শব্দ পেলো আনিশা। -বেশ, আমি একটু বেশিই বকে ফেলেছি তবে, না জেনে।
-হ্যাঁ তো।
-দেন আই অ্যাম সরি।
আনিশা চমকে উঠলো। সরি শব্দটা আনীতের অভিধানে এলো কোত্থেকে! ও তো নিজে যেটা ঠিক ভাবে আর করে তার বাইরে কোন কিছুকেই ঠিক মনে করে না। তাহলে কি বদলে গেছে? কী করে? অনীতের দ্বিতীয়া স্ত্রীর জন্য? নাকি বাবা হয়ে? নেশা করে এখন? করলে তো বাচ্চাটার ভারি কষ্ট হয় নিশ্চয়। বাচ্চাটাকে ঠিকঠাক দেখে তো অনীত? এতো সব কিছু গুছিয়ে রেখেছে, এসবই বা পারে কি করে!
-কোলে? না পিঠে?
-কোলে নাও বাপি, বকেছ খুব।
আনিশা ঘর থেকে বুঝল অনীশ তার বাপির কোলে চেপে গলা জড়িয়ে ধরলো। বাপি তাকে আদরও করে দিল অল্প। অনীতের মুখোমুখি হবার সময় এসেছে। মনকে প্রস্তুত করলো আনিশা। সফল আনিশা ব্যর্থ অনীতের চোখে পরাজয়ের গ্লানি দেখতে চাওয়া আনিশা - এইমুহুর্তে পরিবর্তিত একটা মানুষ-কে দেখতে চাইলো। পরিবর্তনটা কতটা বাস্তবিক সেটা বুঝতে চাইলো।
-নিশা? তুমি?
অনীত আনিশা-কে দেখে চমকে উঠলো। অবাক হলো। অথচ তার চোখে কোন গ্লানি বা অপ্রস্তুত ভাব বা রাগ চোখে পড়লো না আনিশার।
-কখন এলে? ব্যাটাকে কোত্থেকে পেলে?
অত্যন্ত সহজ ব্যবহার করছে অনীত। ওর কথাবার্তায় একটুও কষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে না।
-কলকাতায় কাল এসেছি। আর এনাকে পেয়েছি স্কুলের সামনে। আনিশা-ও সহজ ভাব বজায় রাখলো।
-নিশ্চয় বেরিয়ে এসেছিলো?
আনিশা অনীতের চোখে কাকুতি দেখলো। বাবার কোলে বসে আছে সে উল্টোদিকের সোফায়।
-হ্যাঁ, আমার গাড়ির সামনে পড়ছিলো প্রায়।
অনীত ছেলের দিকে তাকালো।
-বাবাই!
-অনীত, ও-কে বকো না। আমি কথা দিয়েছি আমি ওর বাপি-কে বোঝাবো সে যেন ঠিক সময়ে আসে। এমনটা তাহলে হবে না আর।
অনীত ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো, বেশ কয়েকটা চুমু খেলো কপালে, দু’গালে –আর কখনো বেরিয়ো না বাবাই। আমি ঠিক সময় আসবো এবার থেকে, প্রমিস। ভালো বাপি হয়ে দেখাবো সবাই-কে।
আনিশা অবাক হয়ে অনীত-কে দেখছিলো, কাঁদছে। ছেলের ক্ষতির ভয়ে খুব কষ্ট পেয়েছে তবে।
-অনীশ আর এমন করবে না। কথা দিয়েছে আমায়। আমরা বন্ধুও হয়েছি আজ।
আনিশা অনীত-কে থামাতে চাইলো।
-তাই? বাহ্। তুমি এসেছো জানি, নিশা।
-কোত্থেকে?
অবাক হলো অনিশা।
-কলকাতায়। চারিদিকে এতো হোডিং! আমাদের পেপারেও তো রিপোর্ট, ইন্টারভিউ-তে ছয়লাপ।
আনিশা আঘাত দিয়ে চাইলো।
-খারাপ লাগলো দেখে?
অনিত হাসলো –একটুও না। বরং খুব ভালো লাগলো। তোমার সিদ্ধান্ত-টা ঠিক ছিল দেখে। অনীতের চোখের ঔজ্বল্য ওর সততার প্রমাণ দিল।
আনিশা মাথা নাড়লো –ঠিক তো ছিলোই। তবে আমি তোমাকে ক্যানভাস ছাড়তে দেখব ভাবিনি। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিল আনিশা।
-পেটের দায়ে। নিজের জন্য না হোক বাবাই-টার জন্য।
-দায়িত্ব নিতে শিখেছো তো বেশ।
-চেষ্টা করছি নিশা। আফসোস হয়, আর ক’বছর আগে কেন করিনি।
-এখন আফসোস করে কি লাভ?
আনিশা ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে বললো। অনীত কিছু বলতে যাচ্ছিল বাবাই বললো
-তুমি আন্টি-কে চেনো বাপি?
অনীত ঘাড় নাড়লো –চিনি, আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল একসময়।
-সত্যি! আন্টি যে মুম্বাই-এ থাকে বললো...
আনিশা দেখল অনীত অস্বস্তিতে পড়ছে, নিজেই সহজ করলো
-পাকা বুড়ো একটা। আগে কলকাতায় থাকতাম। তখন থেকেই চিনি তোর বাপি-কে।
-নিশা, এই টরটরে-টাকে চেনো না। সারাদিন বকবক ওর।
-এই একঘন্টায় বুঝেছি অনেকটাই। তবে বাপি অন্ত প্রাণ।
-আর তো কাউকে পায়নি কখনো...
অনীত অস্ফুটে কথাটা বললেও আনিশার কান এড়ালো না। পায়নি মানে, অনীতের স্ত্রী কি বাচ্চা হতে গিয়েই... ছেলেটার সামনে এসব বলা ঠিক না। আনিশা-কে অন্যমনস্ক দেখে অনীত বললো
-ক’দিন আছো এখানে?
-কলকাতায়! আট বছর পর এলাম, দিন দশেক থাকাবো মনে হয়।
-বাহ্। আমাদের বন্ধুদের জানিয়েছো?
-হ্যাঁ, প্ল্যানও করেছে ওরা। তোমাকে তো কেউ ছুঁয়েই পায়না বললো।
অনীত ম্লান হাসল।
-হ্যাঁ, সবার থেকেই দূরে সরিয়ে নিয়েছি নিজেকে। ফোন নাম্বারটাও বদলে ফেলেছি। তাই ওয়ান্টেড টু স্টার্ট আফ্রেশ। যা হয়েছে হয়েছে। নতুন করে শুরু করে নিজেকে প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম। এই ক’বছরে কিছুটা হলেও পেরেছি। আরও অনেকটা পারতে হবে।
-ডেফিনিটলি পারবে। ফোন নাম্বারটা কিন্তু আমি পেয়ে গেছি। বন্ধুরা চাইলে দেবো?
অনীত হেসে ফেললো –দেখো তবে, তুমিই প্রথম পেলে। তোমার ইচ্ছা ওদের দেবে কিনা। গ্যাদারিং-এ ডাকবে নাম্বার পেলে। ছেলেকে একা ফেলে আমার খুব একটা যাওয়া হয় না কোথাও।
-কন্ট্যাক্ট তো থাকবে এটলিস্ট। স্যোশালইজ করা খুব খারাপ নয় কিন্তু।
-ওকে, দিও। সবটা একা হাতে করা চাপের বলেই খুব প্যানিক আর স্ট্রেসড থাকি আরকি। তা, যাদের সাথে দেখা করবে ভেবে এসেছিলে তাদের আগে যার সাথে একেবারে দেখা করতে চাওনি তার সাথে দেখা হয়ে গেলো। কী বলো?
আনিশা চোখের ইশারায় অনীত-কে থামালো। অনীশের সামনে এসব আলোচনা ঠিক না। অনীত বুঝে কথা ঘোরালো। একটু চুপ থেকে বললো
-এনিওয়েজ, আই অ্যাম ভেরি ভেরি হ্যাপি অ্যান্ড প্রাউড ফর ইউ নিশা। তুমি তোমার স্বপ্নটা পূরণ করেছো। এগিয়ে চলো। আর কোনদিন দেখা না হলেও মনে রাখবে আই অ্যাম ভেরি হ্যাপি ফর ইউ।
আনিশার চোখের রাজ্যের বিস্ময় ভিড় করলো
-সত্যি?
-সত্যি, ইউ ডিজার্ভ এভরি সাকসেস ইন লাইফ, মন থেকেই বলছি।
অনিতের চোখে গ্লানির লেশমাত্র দেখতে পেল না অনিশা। খুশিও। সত্যি? মন থেকে সত্যি তো এটা? নাকি এটা অভিনয়? জানতে হবে আনিশা-কে অবশ্যই। জীবনের সবচেয়ে বড় হেঁয়ালিটাকে সমাধান করবে আনিশা। একটা মানুষ ক’বার বদলাতে পারে? তাও এরকম আমূল বদল? সত্যিটা জানতে হবে ও-কে।
-ঋষভ কেমন আছে? ও-কেও থ্যাংকস জানিও সেইসময় ও-তোমার পাশে ছিল বলে। আমার কথা কিছু বলে?
আনিশা মৃদু হাসল।
-বলে। তোমার প্রিয় বন্ধু যে।
-ঠিক পথ দেখিয়েছিল ও। আমাকে। তোমাকে। আমি বুঝিনি, তুমি বুঝেছো।
-অবশ্যই। পাশেও ছিল সবসময়।
ঋষভের সাথে নিজের আসন্ন বিয়ের কথাটাও অনীত-কে বলতে চেয়েও আটকালো আনিশার। সব কথা এভাবে বলা যায় না।
-আন্টি, তোমার নাম নিশা?
অনীশের প্রশ্নে অনিশা হেসে বললো –উঁহু, ওটা শুধু তোর বাপি ডাকে। আমার নাম আনিশা। আনিশা গুপ্তা।
-আমার মায়ের নামও তো আনিশা-- তাই না বাপি?
আনিশা অবাক চোখে তাকালো অনীতের দিকে। অনীতের সন্তানের মায়ের নাম আনিশা! কি করে হয়? যে এসেছিল তাকে তো নিজেই নষ্ট করেছে অনিশা, সজ্ঞানে। তাহলে? অনীত মিথ্যা বলেছে ছেলেটিকে? কেন?
-অনেক বড়দের কথার মধ্যে থেকেছিস, এবার ওঘরে যা।
অনীত ধমক দিলো। অনীশের মুখটা ছোট হয়ে গেল সাথে সাথেই। চোখ ছলছল করলো।
-আমি উঠি। অনীশ—এরকম আর এক্কেবারে করবে না। বাপি সঠিক সময় আনতে যাবে এবার থেকে, শুনলে তো।
-আচ্ছা।
অনীশের কান্না দেখে মনখারাপ হল আনিশার।
-এদিকে এসো। কাঁদে কেউ বোকাটা? ভালো ছেলে হয়ে থাকবে, একদম কাঁদবে না।
-তুমি কবে আসবে আবার? ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল অনীশ।
আনিশা অনীশ-কে কাছে নিলো। কোলে বসালো। আদর করে দিল অল্প। বড্ড মিষ্টি ছেলেটা, ওকে সরাসরি না করা যায় না।
-সময় পেলেই আসবো।
-প্রমিস্?
-প্রমিস।
-তোমার তো মুম্বাইয়ে অনেক কাজ...
-তাও... চেষ্টা করবো।
-এবার ঘরে গিয়ে চেঞ্জ করে রেস্ট নে। আমি ছেড়ে দিয়ে আসছি।
অনীত ছেলেকে ঘরে পাঠালো। কথায় কথা বাড়বে।
বেরিয়ে লিফটে উঠেই আনিশা প্রথমই বলল –এসব কী অনীত?
-মানে?
-তোমার সন্তানের মায়ের নাম আনিশা। এটা কী? কেন!
-ওহ, ওটা! অনীত মৃদু হাসলো।
-ওহ্, ওটা! বলে উড়িয়ে দিও না। সত্যিটা জানতে হবে আমায়।
-শান্ত হও। ওটা মিথ্যাও না, সত্যিও না। অথচ এমন মিথ্যা যাকে সত্যি বলে ভাবতে ভালো লাগে।
-মানে! কীসব হেঁয়ালি করছো।
আনিশা উত্তেজিত হলো। অনীত শান্ত ভাবে বললো
-আগে রাগ কমাও, বলছি।
-বলো।
-অনীশ আমার বায়োলজিক্যাল সন্তান নয়। এডপ্টেড। সিংগল পেরেন্ট অ্যাডপশন করেছি বছর সাড়ে পাঁচ আগে। ওর তখন দেড় কি দুই বছর বয়স মনে হয়।
-অ্যাডপশন!
অনীত হাসলো –হ্যাঁ।
-বিয়ে করোনি তবে?
-বিয়ে? কাকে করবো? যাকে ভালোবাসি তার যোগ্য নই যে। পেয়েও রাখতে পারলাম না তাই। আবারও বিয়ে! খেপেছো নাকি!
ভালোবাসি, বর্তমান। ভালোবাসতাম না। স্পষ্ট করলো অনীত। আনিশা অনীতের মুখের দিকে সরাসরি তাকালো এবার। চশমা পরে এখন। জুলপির চুল কাঁচা-পাকা, রোগাও হয়েছে অনেক। বয়স, দায়িত্ব আর পিতৃত্বের ছাপ স্পষ্ট।
-তবে, তুমি এটা কাউকে বলো না নিশা, প্লিজ। কাউকে মানে কাউকেই।
-কোনটা?
-বাবাই অ্যাডপ্টেড।
আনিশা বুঝলো –বলবো না। নিশ্চিত থাকো। হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত?
-নেশা করা ছেড়ে দিয়েছিলাম। তুমি যাওয়ার বছর খানেকের মধ্যেই। চাকরিটাও পেয়েছিলাম তখনি। কাজ শেষে ঘরে এসে খুব একা লাগতো, এর মধ্যে এক বাইক এক্সিডেন্ট করে মাসখানেক একটা মিশনারী হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। ওখান থেকে পেয়েছিলাম ব্যাটা-কে।
-বাহ্। কিন্তু মায়ের নাম...
-তোমার থেকে ও কোনকিছু কখনও দাবি করবে না নিশা, আমি কথা দিলাম। কিন্তু নিজের সন্তানের মায়ের নামের জায়গায় অন্য কারোর নাম বসাতে পারিনি। ইউ নো?
অনীত চোখ মুছলো। আনিশাও। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল দুজনেই।
-চাওয়ার ভয় আমি করিনা নীত। কিন্তু বড় হলে ও যে আমাকে ভুল বুঝবে। বিনা কারণে খারাপ ভাববে। ভাববে ওর বাবা-কে ফেলে চলে গেছি।
-ঠিকটা বোঝার বয়স হোক, বুঝিয়ে দেবো। তোমার না, সবটাই আমার দোষ।
আনিশা অবাক হলো –তুমি যে ওর সব! ও তোমাকে ভুল বুঝবে না?
-বুঝবে না। আমার ভালোবাসায়, স্নেহের জোরে আস্থা আছে। আবার আনিশার হাত ধরলো অনীত –আর ধরে নাও এটা আমাদের সেই অজাত সন্তান। সে থাকলে এমনই বয়স হতো নাকি?
আনিশা চমকালো –তুমি জানতে?
-হ্যাঁ, আন্দাজ করেছিলাম, তুমি প্রেগন্যান্ট ছিলে। যখন উই ফাইনালি পার্টেড ওয়েজ।
-কখনো কিছু বলোনি তো!
-বলা কওয়ার সময় কোথায় পেলাম, নিশা। কাগজ এলো কথার বদলে। কষ্ট হলেও সই করে দিলাম। আটকে রাখতে চেয়ে ভুল করেছিলাম ততদিনে বুঝেছি। অথচ ফিরিয়ে নেওয়ার মতো যোগ্যতাও নেই।
আনিশার চোখ থেকে জল পড়ছিলো। অনীত ওর হাতটায় চাপ দিলো।
-চোখ মোছো। কে কোথা থেকে দেখে ফেলবে, তুমি না সেলিব্রিটি।
আনিশা মাথায় স্কার্ফ টেনে নিলো। মুখটা অনেকটা ঢাকলো স্কার্ফে।
-অ্যাম সরি নীত। অথচ এছাড়া আর কোন উপায় ছিল না তখন।
-আমি বুঝেছি। তোমার মা-বাবা হয়তো চাননি, এমন অপদার্থ, অসফল, মাতালের সন্তান তুমি আনো – ঠিকই আছে, ঠিকই করেছো তুমি। অথচ আমি ওকে ভুলতে পারিনি, জানো? সবসময় মনে হতো, আমার ব্যর্থতা, আমার অযোগ্যতা জন্য ও জন্মাতে পারলো না। এই তাড়নায় রাতে ঘুমাতেও পারিনি বহুদিন। অনীতের চোখে কষ্ট-টা পড়তে পারলো আনিশা।
-অ্যাম সরি। অস্ফুটে বললো আনিশা।
-ঠিক আছে। আর এখন তো কষ্ট-টা নেই। অনীশ আছে যে, অনীত আর আনিশার সন্তান। সত্যি বলো ওকে দেখে তোমার কষ্টটা একটুও কমেনি?
আনিশা হাসলো। ম্লান সে হাসি –আমিও খুব কষ্ট পেতাম এটা নিয়ে নীত। রাতে ঘুমোলেও সে স্বপ্নে আসতো, আমাদের অজাত সন্তান। আজ থেকে আর আসবে না। কারণ সে এসে গেছে, অনীশের মধ্যে। তাই না?
-ঠিক তাই। তাই মায়ের নামটা তোমার নাম বলার জন্য মাফ কোরো আমায়। রাগ করে থেকো না আর।
আনিশা মাথা নাড়লো। ও রাগবে না একেবারেই, রাগার উপায় কই। কোন ভুল করেনি অনীত, ঠিক করেছে এই ব্যাপারে। ইতস্তত করে আর একটা কথা বললো
-মাঝে মধ্যে যোগাযোগ রাখলে আপত্তি করবে?
আনিশার কথায় অনীত থমকালো –সময় পাবে?
-বলোই না।
-তোমার ছেলে তুমি যোগাযোগ করবে। আমি কেন না করবো?
-মন থেকে বলছো আমায়? নাকি আবেগে? আসলে ওকে খুব ভালো লেগেছে আমার---
-মন থেকেই বলছি। আর ওকে ভালো না বেসে পারা মুশকিল।
-ওকে বকবে না একদম আজ। ওর মনের প্রশ্নগুলোর পারলে জবাব দিও।
-আমার মতো করে চেষ্টা করবো নিশ্চয়। তোমার মা-বাবা-দাদা ভালো আছেন?
আনিশা বুঝলো অনীত প্রসঙ্গ বদলাতে চায় –হ্যাঁ, চলছে।
-এখান থেকে কোথায় যাবে এখন?
-এলগিন রোড। ঋষভের মায়ের বাড়ি। চিত্রাঙ্গঁদা ম্যাম তোমাদের কলেজের। মনে আছে তো?
-বেশ। ড্রাইভ করে যাবে? সাবধানে যেও।
আনিশা বুঝল কথা আর বাড়াতে চায় না অনীত। অথচ ওর এখনো অনেক কিছু জানার আছে, বোঝার আছে। বদলেছে অনীত, সত্যিই কি বদলেছে? বদলালে কতটা। জানতে হবে ওকে, জানতেই হবে। জীবনের এতো বড় একটা অধ্যায় চিরতরে বন্ধ করার আগে একবার পড়ে দেখতে চায় আনিশা। কাছে থেকে, নিখুঁত ভাবে।
-চলি, তাহলে?
-এসো। অনীত গাড়ির দরজা খুলে দিলো।
-ভালো থেকো, নিশা। সুন্দর করে হেসে বিদায় জানালো অনীত। আনিশা ভালো থাকুক, এর বাইরে কিচ্ছু চায় না অনীত।
৪
সেদিন সারারাত ঘুমাতে পারেনি আনিশা। ঋষভের মায়ের বাড়ি থেকে কোন ক্রমে ভদ্রতা বজায় রেখে হোটেলের ঘরে ফিরেই ভেঙে পড়েছিলো। বারবার ফ্ল্যাশ করে যাওয়া রক্তের ঢ্যালা আর একটা রক্ত মাংসের শীশুমুখ মনে পড়ছিল। অনীত কত সহজেই না বললো সন্তানটা আনিশারও। আনিশারও নাকি অধিকার আছে কথা বলার, যোগাযোগ রাখার। অথচ অনিশা অনীত-কে পিতৃত্ব সুখের থেকে বঞ্চিত করেছে, আবেগের বশে নয়, ভেবেচিন্তে। নিজে জীবনে এগিয়ে যাওয়ার তাগিদে সেই অবাঞ্চিত শিশু-কে আনেনি পৃথিবী-তে। অথচ অনীশ-কে দেখে মনের ভেতর-টা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এতদিন এই অপূর্ণতা-কে সাফল্যের মোড়কে ভরে রেখেছিলো আনিশা। নিজের পাপবোধ-কে বাড়তে দেয়নি। মনে পড়লেই জোর করে মাটি চাপা দিয়েছে স্মৃতিকে। আজ আর পারছে না। স্মৃতিটা বেলাগাম হয়ে গিলে খেতে আসছে আনিশা-কে, একলা ঘরে। বহুদিন পর মুখোশটা খুলে ফেলেছে আনিশা। হু হু কান্নায় বালিশ ভিজিয়েছে বিস্মৃতকাল পর। সম্রাজ্ঞীর সিংহাসন থেকে নেমে সাধারণ হয়ে নিজের ভেতরকার মেয়েটির পাশে বসেছে বছর আটেক পর। যে নিজের সাফল্যের দৌড়ের বাইরে গিয়েও নিজের মনের কথা ভাবে, বিশদেই ভাবে। আর ভাবতে ভাবতেই অনীতের প্রতি চরম রাগ অভিমান আর ঘৃণার পাশাপাশি অনীতের এই আমূল বদল সম্পর্কে জানার ইচ্ছেও খুঁজে পেলো। দশটা দিন তো আছে আনিশা। আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব মিলিয়ে কত প্ল্যান। আত্মীয় অনেকেই আইবুড়োভাত দেবে ঠিক করেছে। বন্ধুদের গেটটুগেদার, পার্টি –সব শিডিউল হয়ে রয়েছে প্রায়। তার মধ্যেই রয়েছে ইন্টারভিউ দেওয়া, টলিউডের হিরো-হিরোইনদের ওর সাথে দেখা করার কাকুতি-মিনতি –সবটাই এখন এড়িয়ে যেতে ইচ্ছা করেছে। অথচ ওর সেক্রেটারি পারমিতার কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাওয়ার লিস্ট স্তুপ হয়ে আছে। এসমস্ত কিছুই আজ বিকাল থেকে অসার মনে হচ্ছে আনিশার। এই দশটা দিন ও নিজের মতো করে কাটাতে চেয়েছে, একটা নতুন শুরুর আগে। আর নিজের মতোটা এসবে নেই। অন্য কোথাও আছে নিশ্চিত।
ফোন বাজল হঠাৎ। এতো রাতে! ঋষভ দুবাই গেছে। ওখানকার ব্যবসা তদারকি করতে। ঋষভই হবে নিশ্চয়। সামনে প্যারিসে ফ্যাশান উইক আছে। ওখানে পার্টিসিপেট করার ব্যাপারটাও কনফার্ম করতে চায় ঋষভ। ইন্ডিয়ান ডিজাইনার মাত্র একজন সুযোগ পাবে ওখানে। এতো বছর কুন্দন শেট্টিই পেতেন। এবছর ঋষভ বদ্ধপরিকর আনিশা’স-কে সুযোগ পাওয়ানোর জন্য। প্যারিসে ফ্যাশান উইক কমপ্লিট করে ওই সময় ওদের হানিমুনও হবে ইউরোপে, এমনই স্থির হয়ে আছে। ওই সংক্রান্ত কোন খবরই পেয়েছে মনে হয়। নাহলে অড আওয়ারে কল করে না ঋষভ। খুব ডিসিপ্লিনড মানুষ। ফোনটা হাতে নিয়ে ভীষণ অবাক হল আনিশা।
অনীত! এতো রাতে! কি হয়েছে! ছেলেটাকে বকেনি তো! ওর যা রাগ হয়ত মারধোরও করতে পারে। রাগের চোটে আনিশাকেও তো মেরেছে অনেকবার। গায়ে হাত তোলা অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছিল শেষ বছরখানেক।
-অনীত! কি হয়েছে এতো রাতে?
-ভুল করলাম কল করে? ঘুমাচ্ছিলে, না? সরি!
আনিশা বুঝল লোকটার গলা ভারী হয়ে আছে। কাঁদছিলো হয়তো।
-ঘুম আসছিলো না। তাই কল করলাম-
আনিশা বুঝলো -আমারও, অনীশের মুখটা মনে হচ্ছিল সারাক্ষণ।
-সরি, নিশা।
-কেন?
-ওকে দেখতে হলো তোমায়, তাই। না দেখেই হয়তো শান্তিতে ছিলে।
আনিশা হাসলো। কষ্টের হাসি।
-ভুল বললে। দেখেই বরং শান্তি পেয়েছি। তোমার থেকে যা কেড়ে নিয়েছিলাম তা তুমি ফিরে পেয়েছো। শান্তি-তে আছো দেখে।
-শান্তি? হ্যাঁ শান্তিতে আছি, তুমি নিজেকে দায়ী করা বন্ধ করো নিশা। তুমিও শান্তি পাবে।
আনিশা চোখ মুছলো –অনেক চেষ্টা করেও পারছি না। সে তো আমারই ছিলো।
-সে হারায়নি, আছে তো। এভাবেই ভাবো।
-তুমি তো এভাবেই ভাবো, তাও তো জেগে আছো, তাও তো কাঁদছো।
অনীত চুপ করে থাকলো। আনিশা আবারও বললো, অনেক সংকোচে
-আমি তোমার সামনে এসে পড়ে কষ্ট দিলাম, না?
-কে বললো?
-তোমার কান্না।
-ওটার কারণ অন্য, তোমার সাথে অন্তত একবার দেখা হোক চেয়েছিলাম আমি, তোমার সাথে কথা বলার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছিলাম, তাই চেষ্টা করিনি। হয়তো এই আটবছরে কিছুটা হলেও ফিরে পেয়েছি নিজেকে, কথা বলা যায় তো এখন, কী বলো? ঘেন্না করো তুমি, জানি। সেটাই স্বাভাবিক। তবুও...
আনিশা জানলার বাইরে দেখলো, পর্দা সরিয়ে। অঝোরে বৃষ্টি আজ কলকাতায়- বাইপাস ধুয়ে যাচ্ছে।
-ঘেন্না করি, সত্যি। ভালোওবেসেছিলাম, সেটাও সত্যি।
-ভালোবাসার মতো ঘেন্নাটাকেও অতীতবাচক শব্দ করে দাও, প্লিজ। শুধু কথা বলার সম্পর্কটা থাক, আর সুযোগ হলে বন্ধুত্ব, তাহলে আমার পাপবোধটাও কমে।
আনিশা বুঝল, অনীত ওর একটা মস্ত ভুলকে ক্ষমা করে এগিয়ে গেছে। আনিশারও উচিত, এগিয়ে যাওয়া, অনীতকে ক্ষমা করে। সম্পর্কের ঐ কালো অধ্যায়টা ভুলে, চেষ্টা করবে ও, আপ্রাণ চেষ্টা করবে। ক্ষমার চেয়ে বড় ভুল কিছু হয়না মনে হয়, কিন্তু তার জন্য অনীতকে, বদলে যাওয়া অনীত-কে চিনতে হবে ওকে। আরো ভালোভাবে।
-চেষ্টা করবো আমি, মুভ অন করার চেষ্টা করবো ডেফিনিটলি।
অনীত খুশি হলো –বেশ, তাহলেই হবে।
-এবার বলো এখন কাঁদছিলে কেন?
অনীত চুপ করে থাকলো। সেই কলেজের সময়টার ছেলেটার মতো। কোন ভুল কাজ করলে মুখে কুলুপ পড়ে যেত- আনিশাকেই বুঝে নিতে হতো। প্রেমিক অনীত সত্যিই অন্যরকম ছিলো, স্বামী অনীতের থেকে। এখম মনে হয় প্রথম জনকেই আবার দেখছে আনিশা, আঠারো থেকে পঁচিশের প্রজাপতি বয়সে চিনেছিলো যাকে।
-ছেলেকে বকেছো?
-না।
-তবে?
-মেরেছি। তুমি ওর মা কিনা, তুমি কেন ছেড়ে গেছ, কবে আসবে এসব প্রশ্ন করেই যাচ্ছিলো... না ঘুমিয়ে...
-মেরেছো! নীত! আমি না তোমায় মানা করেছিলাম।
অনীত চোখ মুছল।
-আমি মারিনি নিশা, আমার অসহায়তা রাগ হয়ে ওর গালে পড়েছে।
দুজনেই চুপ থাকলো কিছুক্ষণ। আনিশাই কথা বললো
-ঘুমিয়েছে এখন?
-হ্যাঁ, মা-মা করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। এতো করে ভালোবেসেছি নিশা, কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দিইনি- অথচ এই একদিন তোমাকে দেখেই... কেমন ওলোটপালট হয়ে গেল।
-ওহ, আমি আসবো না তবে আর। ভুলে যাবে এই একদিনের দেখাটা।
-সেটা আমি বলেছি? নাকি তুমি পারবে?
-তোমার সুবিধা হবে তাতে। মা ভালো না, খারাপ। বুঝিয়ে দিও। আমার সম্মতি থাকলো।
-মিথ্যা বোঝাবো কেন? আমি জানি ওর মা কতো ভালো, আমার থেকে ভালো কেউ জানে না।
-ওর মা যে ওকে আনতে পারেনি, নীত।
-সেটাও ওর বাপির দোষ, বাপির বদলে যাওয়ার দোষ।
-নিজের বদলে যাওয়াটা বোঝো তুমি?
-মানুষ থেকে জানোয়ার হয়ে আবার মানুষ হয়েছি। বুঝবো না, ফারাকটা?
নিজের ভালোবাসার মেয়েটাকে কতভাবে আহত করেছি ভেবে নিজে লজ্জিত হই প্রতিনিয়ত।
-তোমার রাগটা বদলায়নি একটুও।
অনীত হেসে ফেললো –কেনো? ছেলেকে একটা চড় মেরেছি বলে?
-মারবে না, আর- বলে দিলাম।
-বড্ড তোমার কথা বলছিলো যে।
-ঘুম থেকে উঠলে বলবে যে আমি কাল আসবো।
অনীত খুশি হলেও মুখে প্রকাশ করলো না। ছেলেটা এটাই চেয়েছিলো।
-তোমার কাজ?
-আপাতত এটাই আমার কাজ যে। তোমার অফিস নেই তো কাল? সানডে তো।
-ঘন্টা দুয়েক যেতে হবে।
-দেখলে, কার কাজ বেশি?
-কথায় তোমায় হারানো যায় না। আগে সেই চেষ্টাটাই করতাম, ভুল করতাম।
আনিশা বললো –ভোর হতে চললো, যাও ছেলের কাছে, হয়তো জেগে গেছে। ভাবছে বাপি কেন নেই?
-যাচ্ছি। আর মারবো না ওকে কখনো নিশা, প্রমিস্।
-বেশ, মা এসে গেলে বাবাদের বকাঝকা করতে হয় না। ওটা মায়েদের কাজ, বুঝলে?
-বোঝালে, তাই বুঝলাম। এতোদিন বোঝাওনি তো।
-আমি ওর প্রতি অধিকার দেখাচ্ছি বলে তোমার খারাপ লাগছে না? কষ্ট হচ্ছে না? আমিই যে ওকে হারাবার কারণ!
-তোমার ওর উপর অধিকার আমি মানি নিশা। খারাপ লাগবে কেন?
-এতো বড় ভুলের পরও মানো! কেন?
-যা আমার তার সবই তোমার তাই।
-এখনো?
অনীত হাসলো- এটা বদলাবার নয় নিশা। ডিভোর্সের কাগজের সই দিয়ে সব বদলায়, বলো? এটা থাকবে অনন্তকাল।
আনিশা আর কোন কথা বললো না, কথাটা অনীতের মুখের কথা না মনের এটাই ওকে জানতে হবে, জানতেই হবে। এই দশদিনে।
৪
সকাল সকাল অফিস আসতে হয়েছিল অনীত-কে, এডিটরের জরুরি তলব। বাচ্চাদের পত্রিকার কয়েকটা আর্জেন্ট কাজ আছে। ন’টার মধ্যে ব্রেকফাস্ট তৈরি করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে অনীত। আজ আবার মেইড আসেনি। অনীশকে ঘুম থেকে তুলে ওর রাজ্যের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আর মান ভাঙিয়ে বেরোতে পেরেছে অনীত। কালকের রাতের জন্য সরিও বলতে হয়েছে। আনিশা আজ আসবে বলায় ছেলেটা খুশি হয়েছে বেজায়। তাই অভিমান কাটাতে বেশি সময় লাগেনি।
-বাপি, কখন আসবে?
-কে? নিশা?
-হ্যাঁ, এখনো তো এলো না।
অনীত ব্যাগ গোছাচ্ছিলো, ছেলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিলো
-ব্রেকফাস্ট করে ভালো ছেলে হয়ে থাকলেই আসবে।
-কখন?
কখন সেটা তো অনীত জানে না, বাবাইকে বুঝতে দেয়নি তাও
-সবে তো সকাল হলো, কাজ সেরেই চলে আসবে।
-তুমি ফোন করেছিলে না, রাতে?
অনীত বুঝলো ধরা পড়ে গেছে, ছেলেকে কোলে তুলে খাটের ওপর বসালো।
-আজ্ঞে হ্যাঁ, বাপ আমার।
-তাহলে এখন করো।
-কল? ধুর বোকা, কত বড় সেলিব্রিটি জানিস? ব্যস্ত থাকবে নিশ্চয়।
-স্টার?
অনীশের চোখের বিস্ময়ভাব পড়তে পারে অনীত।
-একদম, আকাশের তারা, নক্ষত্র। দেশের নাম্বার ওয়ান ডিজাইনার, ফার্স্ট। আর কোন কিছুতে ফার্স্ট হওয়াটা কত টাফ বাবাই তো জানেই।
-হার্ডওয়ার্ক লাগে, বলো?
-একদম তাই। সবসময় ফোন করা যায় না। ডিস্টার্বড হবে।
-আচ্ছা, তাহলে হোয়াটস্যাপ করে রাখো। মেসেজ দেখেই মনে পড়ে যাবে এখানে আসতে হবে।
অনীশকে দেখিয়েই আনিশা-কে হোয়াটস্যাপ করে তবেই অফিসে বেরোতে পেরেছে অনীত। ছেলের আবদারগুলো রাখতে ভালো লাগে ওর। সবকটা না পারলেও যতটুকু পারে।
এসেই মুড অফ হয়ে গেলো। সামান্য কাজ। ওভার টেলিফোনেও বলা যেত, তার জন্য রবিবারে অফিসে ডাকার কোন মানে হয় না। তার উপর বিতানও এসেছে, ডিসগাস্টিং ছেলে একটা। বড্ড ভালগার কথাবার্তা আলোচনা করে। সৌমিক দিনতিনেক অফিসে আসছে না। সৌমিক অনীতের প্রিয় সহকর্মী, ভাইয়ের মতো। সৌমিক আর ওর স্ত্রী বিদিশার জন্যই অনীত বাবাই-কে বড়ো করতে পেরেছে বলা যায়। বিদিশা বাবাইয়ের স্কুলের ম্যামও। আর্টকলেজে অনীতের বছর চারেকের জুনিয়ার ছিলো। অনীতের সেসব মনেই ছিলো না। সৌমিকের স্ত্রী হিসাবেই ঠিকমতো চিনেছে ওকে। এখন নিজের বোনের মতোই ভাবে অনীত অনীশ-কে স্কুলে দেখভাল করা, অনীত আসতে না পারলে বাড়ি নিয়ে আসা, তার উপর বাড়িতে অনীশের পড়াশুনা, সবই বিদিশার হাতে। পাশের মেট্রোএরিয়াতেই থাকে ওরা। অনীশের ম্যাম আর অনীশের কাকাই। অনীশের ভালো রেজাল্টের জন্যও বিদিশার গাইডেন্সই দায়ী। বিদিশা এখন প্রেগন্যান্ট। আর্লি স্টেজ। গত পরশু বাপের বাড়ি গেছে সপ্তাহ-খানেকের জন্য। সৌমিকও পরশু থেকেই অফিস আসেনি। যাওয়ার আগেও বাবাইকে সারাসপ্তাহের কাজ দিয়ে, পড়া বুঝিয়ে তবেই গেছে বিদিশা। ও থাকলে গতকাল শনিবার অনীশ স্কুলের গেট থেকে বেরিয়ে রাস্তায় আসার সাহস করতো না। বাপি তো কতদিনই লেট করে, কিন্তু ম্যাম ঠিক নিয়ে ফেরে সাথে করে। ম্যাম ছিলো না বলেই ছেলেটা অস্থির হয়েছে আর বেরিয়ে এসেছে। কথাটা বিদিশা-কে জানানো যাবে না, ভারী বকুনি খাবে দুষ্টু-টা। নিজের মতো করেই বিদিশা বড় করেছে অনীশ-কে। সৌমিকও খুব ভালোবাসে ছেলেটাকে। অনীতের জীবনে ওরা খুব ভরসার জায়গা। সৌমিক বছর পাঁচেক আগে পত্রিকার অফিস জয়েন করেছিলো। অনীত বাবাইকে অ্যাডপ্ট করার মাস ছয়েকের মধ্যেই। তার পরপরই ওদের বিয়ে। সেই থেকে সৌমিক আর বিদিশা অনীশকে যথেষ্ট দেখে রেখেছে। সৌমিক ঠিকই বলে দুটো পরিবার আলাদা নয়, বরং একই।
-অনীতদা’, তুমি আজকে?
বিতানের কথা শুনে তাকালো অনীত। বিতান নতুন জয়েন করেছে ওদের পেপারে বছর দেড়েক হলো। ফচকে ছেলে বলে এড়িয়ে চলে ওকে অনীত।
-হ্যাঁ। বস্ ডাকলেন, আসতে হলো।
-আমারও একই হাল। তুমি ব্রেকিং নিউজ-টা শুনলে?
অনীত ভুরু কুঁচকে তাকালো।
-কীসের?
-আনিশা গুপ্তার।
-ওহ্, কেন? আরো কোন নতুন দোকান উদ্বোধন আছে আজ নাকি?
-না, না। কৃত্তিকার অফার রিজেক্ট করেছে।
অনীত পেন্সিল বোলানো থামালো কাগজে। কনসেপ্ট-টা এখনও কাগজে আঁকে ও। পরে ল্যাপটপে।
-কৃত্তিকা, মানে হিরোইন?
-হ্যাঁ, টলি হিরোইন। ওর হয়ে ডিজাইন করার অফার দিয়েছিলো। রিজেক্টেড। নেক্সট মান্থ প্যারিসে যাচ্ছে আনিশাস, জানো তো?
-না, তুই কী কোন থিসিস ফিসিস করছিস নাকি ওনাকে নিয়ে।
অনীত বিরক্তি প্রকাশ করলো। বিতান পাত্তা দিলো না।
-থিসিস না, জেনারেল নলেজ। তুমি বুঝবে না, বাদ দাও।
-তাহলে অন্যদের বল্ গিয়ে। যারা বুঝবে।
-প্যারিসে মাত্র একজন ইন্ডিয়ান ডিজাইনার নেয়, জানো তো? সেখানে চান্স পাচ্ছে বাংলার মেয়ে, ভাবো। কুন্দন শেট্টি-কে সরিয়ে, ভাবো একবার।
-ভাবলাম, বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়, খুশি?
-ইস! তুমি বড্ড বেরসিক।
-মস্করা করলাম, তাও?
-ঋষভ রায়কে দেখেছো?
অনীত মাথা নাড়ালো –নাহ। বড় মানুষ, বড় শিল্পপতি। কী করে দেখবো?
-দেখলাম সেদিন। ফ্যাশন স্টোর চেইন ওপেনিং-এ। দারুণ পার্সনালিটি। দু’জনকে দারুণ মানায়।
অনীত থমকালো –দু’জন?
-ঋষভ স্যার আর আনিশা ম্যাম। সপ্তর্ষিদা’কে কাল অফ দ্য রেকর্ড ম্যাম বলেওছেন মাস খানেকের মধ্যেই বিয়ে ওনাদের।
অনীত কিছুক্ষণের জন্য পেন্সিলের টান দিতে ভুলে গেলো। কয়েক সেকেন্ড। পরক্ষণেই সামলে নিলো নিজেকে –বাহ্। দারুণ।
-দারুণ না বলো? গালা ওয়েডিং। কলকাতাতে হলে তো কথাই নেই... সপ্তর্ষিদা’কে বলে কার্ড নেবোই-
অনীতের ফোন বাজলো। সৌমিকের কল। ফোন ধরলো।
-বল্ ভাই।
-দাদাভাই, বিদিশার মিসক্যারেজ হয়ে গেছে আবারও। তুমি জলদি এসো।
-মিস্ ক্যারেজ! কোথায় তোরা?
-বালি। ওর বাপের বাড়ির ওখানকার নার্সিংহোমে।
-সৌমিক, বি স্ট্রং, কাঁদিস না। আমি আসছি। এক্ষুনি বেরোচ্ছি অফিস থেকে।
ফোন রেখে দিলো অনীত।
-কার মিসক্যারেজ?
-সৌমিকের ওয়াইফ বিদিশার।
অনীত চটপট ব্যাগ গেছালো –চললাম আমি। বস্-কে বলিস কাজ শেষ। মেল করে দেব ওনাকে।
বিতান-কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই অফিস থেকে প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল অনীত।
৫
সকালে উঠেই ঋষভের বাবার ফোন এসেছিলো, মুম্বাই থেকে। রঞ্জিত রায়, রায় সাম্রাজ্যের আসল অধিপতি। রাশভারী লোক। ঋষভ এখনও বেশ ভয় পায়, সমঝে চলে। আনিশাকে খুব স্নেহ করেন, ‘মা’ বলে ডাকেন। ওনার কোন কথা আনিশা ফেলতে পারে না তাই। ঋষভের বাবা মায়ের সেপারেশন হয়ে গেছে, ঋষভ তখন বছর দশেকের। তার পরের বছরই ওর মা আবার বিয়ে করেন, কলকাতায়। ঋষভ বাবার কাছে মুম্বাইয়ে বড় হয়েছে তারপর থেকে। মাঝে কলেজের সময়টা আবার কলকাতায়, মায়ের কাছে। মায়ের বাড়ি, আর্ট কলেজ। তারপর আবার মুম্বাই, বাবার ব্যবসা। রঞ্জিত রায় আর বিয়ে করেননি। ব্যবসা অন্ত প্রাণ। ওয়ার্কোহোলিক মানুষ। বাষট্টিতেও একইরকম কর্মক্ষম। ঋষভের মা আর্ট কলেজে পড়ান। শিল্পী। ঋষভের মধ্যেকার শিল্পীসত্তা একেবারে মায়ের মতো। আবার ব্যবসায়ী ঋষভ অনেকটাই বাবার মতো বলা যায়। ওর মায়ের বর্তমান হ্যাজবেন্ডও গুণী মানুষ। বিখ্যাত লেখক। এই পক্ষে ঋষভের একটা বোন আছে। ঋষভকে দেখে সমস্ত সম্পর্ক, সমস্ত পক্ষ কিভাবে হ্যান্ডেল করতে হয় শিখেছে আনিশা। বাবা-মা তো বটেই, এই পক্ষের বাবা যাকে বাপি বলে ও, বোন –সবারই সবচেয়ে পছন্দের মানুষ ঋষভ। এমন একটা মানুষের উড বি হিসাবে আনিশার থেকেও একই এক্সপেক্টেশন রাখেন সবাই। আনিশা কাউকে না করতে পারে না।
রঞ্জিত আঙ্কেলের কথা অনুযায়ী সকালে দুটো চ্যানেল আর একটা নিউজ পেপার-কে ইন্টারভিউ দেওয়া হয়ে গেছে আনিশার। এবার চতুর্থটা চলছে, এটাও প্রিন্ট মিডিয়া। বাঙালি মেয়ের বিশ্বজয় টাইপের একইরকমের হ্যাজানো প্রশ্নের সুগার কোটেড উত্তর দিয়ে চলেছে সকাল থেকেই। ঘড়ি দেখলো আনিশা। সাড়ে এগারোটা বাজতে চললো, বেরোতে হবে। অনীত অফিস যাওয়ার আগে সেই ন’টার সময় টেক্সট করে গিয়েছিলো। ছেলেটাকে বলে গেছে নিশ্চয় আনিশা আসছে। অনেক আশা করে বসে আছে সে। এদিকে আনিশা সেই সকাল থেকে সেজেগুজে আট দশবার পোশাক পাল্টে ইন্টারভিউ দিচ্ছে। এটা লাস্ট। ছবি তোলা হয়ে গেছে। আনিশা ইচ্ছা করেই শাড়ি পরেছে এখন। এই ইন্টারভিউটা দিয়েই সোজা অনীশের কাছে যাবে। ওর মা হিসাবে এই প্রথমবার। তাই শাড়ি ছাড়া অন্যকিছু পরার কথা ভাবেনি। প্রশ্নকর্তার প্রশ্ন আর শেষই হচ্ছে। এবার ইরিটেটেড লাগছিলো আনিশার, কিছু করার নেই। বাংলায় আনিশাস-কে প্রোমোট করতে গেলে ব্যক্তি আনিশার এক্সক্লুসিভ প্রোমোশান প্রয়োজন মনে করছেন রঞ্জিত আঙ্কল। ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে খুব সঠিক কথাটা। কিন্তু আজ আনিশার জাস্ট ভাল্লাগছে না। পালাতে ইচ্ছা করছে। ফিরতে ইচ্ছা করছে, নিজের কাছে নিজে।
ফোনটা রিং করলো। ল্যান্ডফোন নাম্বার। কলকাতার। কে আবার? মাসিমণিরা নাকি! “এক্সকিউজ মি” বলে উঠে পড়লো আনিশা।
-হ্যালো।
একটু দূরে গিয়ে বললো ও, ওপার থেকে কোন উত্তর নেই-
-হ্যালো, কে বলছেন?
আবার নিরুত্তর। চ্যাংড়ামো করতে কল কারে নাকি এরা। নাকি ক্রশ কানেকশান, ফোন কাটতে যাবে, হঠাৎ ওপার থেকে ফোঁপানির আওয়াজ পেল আনিশা।
-অনীশ! কী হয়েছে! বাপি বকেছে নাকি? কাঁদছো কেন?
-তুমি আসবে না?
আনিশা লজ্জিত হলো।
-এই তো, আসছি।
-তোমার অনেক কাজ, বাপি বললো; তুমি তো স্টার...
-বাপি ফিরে এসেছে?
-না। অফিস যাওয়ার আগে বললো, তবে তুমি আসবে ঠিক, এটাও বলেছে।
-বাপি কিছুটা ঠিক বলেছে। কিছুটা ভুল। আমি এসে বুঝিয়ে বলি?
-কখন? একসাথে খাবো তুমি এলে বলে ব্রেকফাস্টও করিনি-
আনিশার কষ্টটা বেড়ে গেল আরও।
-জাস্ট গিভ মি টোয়েন্টি মিনিটস্, অনীশ। আসছি আমি।
সেক্রেটারি পারমিতা-কে সব বুঝিয়ে তড়িঘড়ি করে বেরোলো আনিশা। বেলা বারোটা বাজে। ছেলেটা এখনও না খেয়ে আছে! অনীত জানলে ছেলেকে বকবে। কষ্টও পাবে। ছেলে যাতে আনিশার থেকে কিচ্ছুটি এক্সপেক্ট না করে তার জন্য তার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে অনীত। বোঝাচ্ছে বাবাই-কে। কিন্তু আনিশা তো সেটা চায় না, সব এক্সপেক্টেশন রাখতে চায় ও, যতটা পারে।
ডোরবেল বাজাতেই দরজা খুলে দিল বাবাই। আনিশা ওর শুকনো মুখ, ছলছলে চোখ দেখে নিজেকে আটকালো না। কোলে তুলে নিলো। আদর করলো প্রাণ ভরে।
-মাম্মা...
অস্ফুটে বললো অনীশ। আনিশা চোখ মুছিয়ে বেশ কয়েকটা চুমু খেলো –বল্।
-তুমিই আমার মাম্মা তাই না?
আনিশাও কাঁদছিল, খুশির কান্না। এই ডাকটাই ও কতটা শুনতে চেয়েছে ওর অবচেতনে এখন স্পষ্ট হলো। শুনে এক বিশ্বজয় হয়ে গেছে ওর, মনে হচ্ছে।
-হ্যাঁ, আমিই।
-কাল আমাকে দেখতে স্কুলের সামনে এসেছিলে, না?
আনিশা মিথ্যা বলে না, কিন্তু না বলে উপায়ও নেই এখানে
-হ্যাঁ।
-তাহলে কালই বললে না কেন? আমি যে তোমাকে আন্টি বললাম তোমার কষ্ট হয়েছে, না? সরি।
আনিশা সরল, অবোধ শিশুটিকে আঁকড়ে ধরলো। হারিয়ে ফেলা রত্ন ফিরে পেলে মানুষ এটাই করে। হারাতে চায় না আর।
-হয়েছে, কিন্তু বাবাই তো কখনো দেখেনি আমাকে- তাই কষ্ট বেশি হয়নি।
-তুমি কাঁদছ? জানো বাপিও কাল কাঁদছিলো – সারারাত।
আনিশা চোখ মুছলো।
-পাকা বুড়ো, খাবি চল, সকাল থেকে না খেয়ে বসে আছে।
-বাপি বললো তুমি সকালেই আসবে তাই ভাবলাম একসাথেই খাবো।
-একসাথেই তো খাবো, চল্।
অনীশ ওর মাম্মার গলা জড়িয়ে ধরলো – চলো।
-কোলে? দুষ্টু?
-বাপি কোলে করেই নিয়ে যায়। খাইয়েও দেয়।
আনিশা কোলে নিলো বাবাইকে –আমিও খাইয়ে দিচ্ছি, চলো।
অনীশ-কে খাওয়াতে খাওয়াতে রাজ্যের গল্প হচ্ছিল দু’জনের। আনিশাও ওর সাথেই খাচ্ছিল, অল্প করে।
-মাম্মা, জানো, বাপি মেরেছে কাল।
-বলেছে।
-ফোনে?
-হ্যাঁ। বকে দিয়েছি বাপি-কে। আর বাপি মারবে না আমার ছেলেকে।
-সত্যি?
-একদম। আমার ছেলেকে বকবো, মারবো, শাসন করবো আমি। অন্য কেউ কেন?
আনিশা ছেলেমানুষি করছিলো। অনীশের মন ভালো করতে। অনীশের ভারী মজা লাগলো।
-ঠিক বলেছো মাম্মা। আমার সব ফ্রেন্ডদেরই তাই। বাবারা কিচ্ছু বলে না। মায়েরাই বকে।
আনিশা খুশি হলো। এতদিনের না পাওয়ার ক্ষোভ একটুও নেই ছেলেটার মধ্যে।
-এখন থেকে এখানেও তাই হবে।
-কিন্তু তুমি তো মুম্বাই চলে যাবে মাম্মা, তবে?
আনিশা থমকালো। স্বপ্নের উড়ানে কেউ বাঁধা দিল যেন। কথা ভেবেচিন্তে বানিয়ে বললো আবার –সে দেরি আছে। আর গেলেই বা, চলে আসবো মাঝেমাঝেই।
-আচ্ছা, কিন্তু তা হলে তো অন্য ফ্রেন্ডদের মতো রোজ হবে না, মাম্মা।
আনিশা ছেলের মাথায় হাত রাখলো।
-রোজ না হলেও অনেকটা হচ্ছে। এতোদিন তো সেটাও হতো না।
অনীশ চুপ করে গেল। আনিশা বুঝলো এতটুকুতে ছেলে খুশি নয়। অথচ ওর এর থেকে বেশি দেওয়ার উপায়ও নেই। কথা ঘোরালো।
-তোর বাপি এলো না তো এখনো?
-অফিস যে, কাজ, তোমার মতোই।
-না আসুক, আমারাই অ-নেক গল্প অ-নেক মজা করবো। নিজেরাই কেমন?
-হ্যাঁ তো। মাম্মা – বাপির আঁকা টাস্ক আছে; সানডে তো বিকালে এসে দেখবে।
-আঁকিসনি?
-স-ব কমপ্লিট। তুমি দেখবে?
-আঁকতে ভালো লাগে, না বাপি বলে তাই আঁকিস?
-দারুণ লাগে।
আনিশা খুশি হলো –আর পড়া? পড়ায় কেমন অনীশ?
-বাপি বলেনি?
-না তো!
-র্যাঙ্ক করি। এবার সেকেন্ড হয়েছি। ম্যাম বলে ফার্ষ্ট না হলে দাম নেই। তাই তোমায় বলিনি এতক্ষণ।
-ম্যাম? স্কুলের ম্যাম?
-তুমি ম্যামকে চেনো না – মাম্মা?
আনিশা অপ্রস্তুত হলো –মনে করতে পারছি না। কে?
-ম্যাম আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, আবার বেস্ট টিচার, আবার বেস্ট গাইড। স্কুলেই পড়ায়। আবার বাড়িতেও। সৌমিক কাকাই আছে না – বাপির অফিসের। ম্যাম কাকাইয়ের ওয়াইফ। এই তো কাছেই থাকে।
আনিশার বেশ অবাক লাগলো। ‘ম্যাম’ যে অনীশের কাছে অনেকটা সেটা বুঝতে বাকি থাকলো না। এই ম্যামের ভরসাতেই অনীত অনীশ-কে বড় করতে পেরেছে, এটাও বুঝলো। হিংসা হচ্ছে কি আনিশার? না দেখা, না চেনা ম্যামের উপর? যে কিনা অনীশের বেস্ট ফ্রেন্ড, বেস্ট টিচার, বেস্ট গাইডও। এসবই তো আনিশার হবার কথা। অনীশের মা যখন ও, তবে?
-মাম্মা...
সম্বিত ভাঙল আনিশার –উঁ?
-এই দেখো।
অনীশ ভিতরের ঘর থেকে ওর ড্রয়িং খাতা নিয়ে এসেছে বেশ কয়েকটা, ততক্ষণে। আনিশা হাসলো –ওয়াও, ড্রয়িং খাতা। দেখি...
-বাপি খুশি হয়না একটুও, কখনো গুড লেখেনি।
অনীত লিখবেও না। আঁকার ব্যাপারে ভীষণ স্ট্রিক্ট আর খুঁতখুঁতে ও।
সব পেন্সিল ড্রয়িং-এর প্র্যাকটিস ভর্তি খাতা। বেস, ব্যাল্যান্স... পাতার পর পাতা।
আনিশা বললো –স্কেচপেন, রং তুলি, সিনারি?
অনীশ মুখে আঙুল দিয়ে থামতে বললো আনিশা-কে। গলার আওয়াজ নামালো।
-ওগুলো আঁকা মানা যে।
এবার বুঝলো আনিশা। অনীত ছেলের ভিতটা শক্ত হতে দিতে চায় আগে।
-ওহ্
বোঝার ভান মুখে ফোটালো আনিশা –একেবারেই না? স্কুলে দিলেও না?
-ম্যামের কাছে ওগুলো। ম্যামের বাড়ি। কার্টুনও আঁকি ওখানে, ম্যামকে বলে দিয়েছি যাতে বাপি-কে না বলে।
-আমি জেনে গেলাম যে! বলে দিলে?
অনীশ আনিশার গলা জড়িয়ে ধরলো।
-তুমি তো মাম্মা, বলবে কেন? তুমি না বললে নিজে যা করার করবে?
আনিশা কোলের মধ্যে টেনে নিলো বাবাই-কে। নাকে নাক ঘষে দিলো।
-একদম। আর সারাদিন বোরিং স্কেচ কারোর ভালো লাগে? সিনারি, কার্টুন, অল্প-অল্প আঁকতেই হয়।
-তাই না, বলো?
-ঠিক তাই। বাপি-কে বুঝিয়ে বলবো এটাও।
-বাপি তোমার স-ব কথা শোনে, বলো?
আনিশা ম্লান হাসলো –তোর কি মনে হয়?
-শোনেই তো। নাহলে কাল কত্ত বিরক্ত করেছি – একটুও বকেনি। জাস্ট একটা চড়। অন্যদিন স্কুল থেকে বেরিয়ে আসার মতো কাজ করলে –শেষ।
-তাহলে শোনে।
-তাহলে একটা মজা হবে।
-কী রকম?
-তুমি বাপি-কে বলবে আমি তোমার সাথে মুম্বাই যাবো। বাপিও যেন চলে আসে। তাহলে একসাথে থাকা যাবে, বলো?
আনিশা ছেলেটা-কে আহত করতে চাইল না। যেটা একান্তই সম্ভব নয়, অবাস্তব - তাকে ঘুরিয়ে বললো –বাপি যাবে কি করে? বাপির যে অফিস?
-ওহ্।
আনিশা বাবাই-এর চোখের জল মোছালো।
-বাপি না গেলেও বাবাই তো যেতে পারে। ওখানে নাহয় নতুন স্কুলে ভর্তি হবে?
আনিশা কথাটা ছেলেকে পরখ করতেই বলেছিলো। বলে ফেলেই বুঝলো নিজের মনের কথাই বলে ফেলেছে। এতোটা অসম্ভব কল্পনা ওর মন কী করে করলো ভেবে অবাক হয়ে গেল আনিশা। অনিশ অনীতের বেঁচে থাকার অবলম্বন। তাকে নিজের কাছে নিয়ে যাবে ভাবার মতো স্বার্থপর ও কি করে হল। ছিঃ ছিঃ।
-বাপিকে বলো।
আনিশা ভীষণ বিস্মিত হলো। অনীশ এই চব্বিশ ঘন্টায় ওকে নিজের মনের সবচেয়ে কাছের আসন-টা দিয়ে ফেলেছে! কেন? মা বলেই? মা হবার মতো কোন কিছু না করলেও ও অনায়াসে এতোটা জোর পেয়ে গেলো? অথচ যে মানুষটা একা সবকিছু করেছে তাকে দ্বিতীয় স্থানে ঠেলতে চায় না ও, একেবারেই। অথচ সন্তানের কাছে মায়ের মতো কেউ হয় না, এটাও সত্যি।
-বাপি ছাড়লে যাবি আমার সাথে?
অনীশ আনিশার দিকে ছলছলে দিকে তাকালো।
-বাপিরা তো বাইরে কাজ করে মাম্মা। সবাই তো নিজের মাম্মার সাথেই থাকে। আর বাপিকেও রিকোয়েস্ট করে অফিস মুম্বাইয়ে নিয়ে চলে যাব, হবে?
আনিশা বুঝলো ভীষণ বুদ্ধিমান ছেলে অনীশ। নিজে কি চায় স্পষ্ট জানে। কীভাবে সেটা পেতে হয়, তাও জানে। বড়দের মতো সবকিছু অহেতুক জটিল করে ভাবে না।
-বেশ, বলবো বাপি-কে।
নিজের সাথে লড়াই শেষ করে বললো আনিশা। আরো লড়াই বাকি আছে, নিজের কাছের সবার সাথে। কিন্তু তার জন্য পিছপা হবে না কিছুতেই আনিশা। এটা নিজের মনের কাছে স্পষ্ট করলো এখনই। অনীশ ওর জীবনে কতটা তা নিয়ে লুকোছাপা করবে না। সিদ্ধান্ত নিলো আনিশা। আবারও অনেক অনেক আদরে ভরিয়ে দিলো অনীশ-কে। কিছুক্ষণ পর আবিষ্কার করলো ছেলেটা আবার কাঁদছে।
-কাঁদছিস কেন?
-ভাবছি এটাও যেন স্বপ্ন না হয়, মাম্মা। রোজ রাতে দেখতাম তুমি আসছো, ভালোবাসছো... কিন্তু তোমাকে ভালো করে দেখার আগেই – চলে যেতে।
আনিশা নিজের চোখ মুছলো।
-এতো ভালো কথা বলতে শিখলি কোথা থেকে?
-বাপিও এটা বলে। ম্যাম-ও।
আনিশা একটু দম নিলো। তারপর প্রশ্নটা করেই ফেললো।
-ম্যাম ভালো?
-খু-উ-ব।
-আমার থেকেও?
অনীশ হেসে ফেললো –মাম্মা তো মাম্মাই হয়। মাম্মার থেকে ভালো কিছু হয় নাকি? বাপি বলে সবসময় –সব্বার মা তার কাছে বেস্ট।
আনিশা অনীত-কে ধন্যবাদ দিলো মনে মনে। অনীশ-কে ঠিকটা শেখানোর জন্য।
-বাপির থেকেও ভালোও কেউ হয় না, অনীশ।
-তাহলে তুমি আর রাগ করে নেই তো বাপির ওপর?
আনিশা বুঝলো নিজের কথার জালে জড়িয়ে গেছে ও।
-তোর কাছে বাপির থেকে ভালো কেউ হয় না। সেটাই বললাম।
-জানি তো। আমার বাপি খুব ভালো মাম্মা। তোমাকে খুব ভালোবাসে। সবসময় তোমার কথা বলে, তোমাকে হারিয়ে ফেলেছে নিজের দোষে বলেছে কাল। কিন্তু মাম্মা আমার বাপির মতো তো আর কেউ নেই গো। বাপি আর দোষ করবে না। তুমি শুধু ইটস্ ওকে বলে দাও। রাগ করে থেকো না আর।
আনিশা বুঝলো বাপি আর মাম্মা দু’জনকেই একসাথে চাই অনীশের। এই অসম্ভব চাওয়া মেটাবার উপায় ওর নেই। অনীতের প্রতি ওর মনে ঘৃণা আর বর্তমানে অনুকম্পা ছাড়া আর কোন অনুভূতি হয়ত নেই। সেটা এই শিশু মনকে বোঝাবে কি করে।
-বাপির লেট হচ্ছে অনেক, না?
-কল করো না, মাম্মা।
আনিশা ইতস্তত করেও কল করলো। কোথায় সে? এখনও অফিসে? তাড়াতাড়ি আসবে বললো যে, নাকি কাজের চাপে ভুলে গেছে?
-হ্যালো, নিশা।
চাপা গলা শুনে অবাক হলো অনিশা।
-কোথায় তুমি? অফিসে এখনো? গলাটা অমন ঠেকছে কেন?
-তুমি বাবাই-এর কাছে তো? খেয়েছে তো সে?
আনিশা অনীতের প্রায়োরিটি বুঝলো।
-খেয়েছে। খেয়ে গল্প করছে এখন। তবে দুজনের গল্পের ঝুড়ি প্রায় শেষ। বাপি কখন আসবে বলে ব্যস্ত এখন।
-তোমায় বিরক্ত করছে না, খুব?
-একদমই না। আর আমাকে বিরক্ত হবার অধিকারটা দাওনি তাহলে?
অনীত হাসলো –সবটুকুই দিয়েছি।
-তবে? তুমি লাঞ্চ করেছো?
বলেই আনিশা বুঝলো আটবছর আগের প্রশ্ন অভ্যাসবশত করে ফেলেছে। জীবনে কোনকিছুই অনভ্যাস হয় না। শুধু পর্দা পরে যায় বিস্মৃতির।
-আমি একটু নার্সিংহোমে এসেছি। সৌমিক ডাকলো। সৌমিক আমার কলিগ। বাবাই ওকে কাকাই বলে। আমার ভাইয়ের মতোই...
-অনীশের ম্যামের হাজব্যান্ড?
আনিশা জানতে চাইলো।
-তোমাকে সব গল্প করা হয়ে গেছে বাঁদরের? হ্যাঁ ওর ম্যাম বিদিশা। আমার বোনের মতো বলতে পারো। ক্যারি করছিলো। মিস ক্যারেজ হয়েছে আজ। বাড়ির কাছের এক নার্সিংহোমে এখন।
-ওহ, ভদ্রমহিলা ঠিক আছেন?
-ভদ্রমহিলা না। বেশ ছোট আমাদের থেকে। হ্যাঁ, ঠিক আছে বিদিশা। ব্লাড দিতে হয়েছে। বাবাই-কে বলো না এতকিছু।
-ঠিক আছে, কখন ফিরবে?
-এই তো বেরোচ্ছি। তোমার কাজ থাকলে ইতস্তত করো না। বাবাইয়ের একা থাকার অভ্যাস আছে।
-এসো।
বলেই ফোনটা কেটে দিলো আনিশা। অনীত কেন এমন করছে, ইচ্ছা করেই করছে? নাকি আনিশা-কে এড়াচ্ছে? নিজে কতটা বদলেছে ধরা দিতে চাইছে না নাকি? তাহলে কি বদলায়নি আদৌ! অনীত-কে এত সহজে মাইক্রোস্কোপের তলা থেকে যেতে দেবে না আনিশা। খুব অল্প সময় ওর হাতে আছে তার মধ্যেই সত্যি আর মিথ্যার তথাৎ-টা জানবে।
৬
ঘরে ঢোকার মুখে অনীত-কে খোঁড়াতে দেখে আনিশা বলে উঠলো
-কি হয়েছে তোমার পায়ে?
অনীত মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করাতে চাইলো। আনিশা বিরক্ত হলো
-কী হয়েছে তোমার পায়ে?
-আস্তে বলো, বাবাই শুনলে চিন্তা করবে।
-বাপিকে খোঁড়াতে দেখে বুঝতেই পারবে। বসো, চেয়ারে বসো।
অনীত-কে ধরে চেয়ারে বসালো আনিশা।
-আর ইউ ড্রাংক?
অনীত হাসলো –না, সন্দেহ হলে পরীক্ষা করে দেখতে পারো।
-সে এক্তিয়ার আমার নেই। কী করে হলো এই চোট?
-তাড়াতাড়ি করে ফিরতে গিয়ে। এই গলিতেই। বাইক স্কিড করে গিয়েছিলো।
-পড়ে গেছিলে?
-না, পড়তে পড়তে সামলেছি। ছড়ে গেছে মনে হয়...
-কই দেখাও। ডেটল কোথায় রেখেছো?
-আমি করে নেবো, নিশা।
আনিশা তাকালো –এই অধিকারটা নেই বলছো?
অনীত কষ্টের মধ্যেও হেসে ফেলল
-বাবাই-এর মতো তোমাকেও কথায় হারানো যায় না। কোথায় সে?
-ঘুম পাড়িয়েছি। সারাদিন বকবক, তাই গল্প বলে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম।
-ভালো করেছো।
-এবার প্যান্টটা তোলো। দেখি কোথায় ছড়েছে।
অনীত আনিশার কথা শুনলো।
-দেখেছো! কতটা কেটে গেছে।
তুলো দিয়ে ডেটল লাগাতে লাগাতে বললো আনিশা।
-তাও লুকাচ্ছিলে!
-তুমি তো তাও ভেবে নিলে মদ খেয়ে এসেছি।
আনিশা লজ্জিত হলো –খাও না আর?
-একদম যে খাই না বলা যাবে না। তবে খেয়ে বেহুঁশ হই না। ছেলে যাতে একটুও না বোঝে তার খেয়াল রাখি।
-স্মোকিং?
-ফুলস্টপ। দেখলে শিখে যাবে ব্যাটা।
আনিশা হাসলো –অনেক বদলেছো।
-বাবা হয়েছি। বদলাতে হয়।
আনিশা অবাক হলো –সব বাবাই-এর জন্যই?
-নাইন্টি নাইন পার্সেন্ট। বাকিটা নিজের সাথে চোখ মেলাবার জন্য বদলেছি।
আনিশা তুলো আর ডেটল রেখে এলো। হাত বাড়ালো।
-আমাকে ধরে ওঠো।
-অধিকার দিচ্ছো ছোঁয়ার?
আনিশা অনীতের হাত ধরলো –ওঠো চেঞ্জ করে নাও।
-সেটাও মনে হয় ধরে ধরেই করতে হবে।
আনিশা আপত্তি করলো না। এই মানুষ-টা একদিন সম্পূর্ণভাবে ওরই ছিলো। তার মন, তার শরীর সমস্তটা। আট বছরের দূরত্বে হয়তো স্পর্শে মরচে পড়েছে। কিন্তু একেবারে বিস্মৃত হয়নি। অনীত-কে স্পর্শ করতেই একটা স্পার্ক টের পেলো আনিশা, সারা শরীরে। এই আটবছরে সেটা একবারও পায়নি অন্যকোথাও। ঋষভের সাথে ঘনিষ্ঠতা একটা নির্দিষ্ট সীমা অবধিই রেখেছে এতোদিন। বন্ধুই তো ছিলো ওরা, মাস তিনেক আগে দুই পরিবারের জোরাজুরিতে বন্ধুত্বটাকে একটা নাম দেওয়া শ্রেয় ভেবেছে দু’জনে। তাই সবকিছুই বিয়ের পর বলে তুলে রাখা আছে। তবুও ঋষভের হাতে হাত পড়লে, ঋষভ এতো কাছে আসলে – আনিশার এই অনুভূতি-টা জাগে না। যেটা এইমুহুর্তে জাগছে। অথচ মানুষটাকে ঘৃণা করে ও। নিজের সমস্তটুকু দিয়ে ঘৃণা করে। নাকি-
-থ্যাংকস্, নিশা।
অনীতের কোথায় তাকালো আনিশা, আনিশা-কে ধরে ধরে কোনমতে চেঞ্জ করেছে লোকটা। সত্যিই পায়ে ভীষণ লেগেছে, এক্স-রে করাতে হবে।
-বসো এবার সোফায়, কাল এক্স-রে করিও।
-সেসব লাগবে না।
অনীত আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো আনিশার দিকে তাকিয়ে বললো না আর।
-কাল থেকে অফিস যেও না ক’দিন। ওয়ার্ক ফ্রম হোম করবে।
-বেশ, যাবো না। আমার বস্-কে তুমি বুঝিয়ে দিও, তাহলেই হবে...
-বেশ নিয়মমাফিক জীবনযাত্রা দেখছি তোমার আজকাল। আগে তো স্বাধীনতা চাই বাহানায় কত সুযোগ ছেড়েছো-
-ভুল করেছি। আসলে তুমি ছিলে। দায়িত্ববোধটা হওয়া উচিত ছিলো। অথচ তার চেয়ে বেশি তুমি না আমি কে কতটা আগে রেসে দৌড়তে পারি, এইটা নিয়েই ভাবতাম সারাদিন। এখন সেসবের অনর্থকতা বুঝি, চুলে পাক ধরেছে, সাথে সাথে অভিজ্ঞতাতেও –তাই নিয়মানুবর্তিতা।
-সেসব অনর্থক ছিলো মানো?
-কেন মানবোনা? নেহাতই বোকামো ছিলো। একটা ঘোরের মধ্যে করে গেছি। এটা না মানার তো কিছু নেই।
-থ্যাংকস্।
-কেন?
আনিশার দিকে তাকালো অনীত। আনিশা সামনে চলে আসা চুল ঠিক করলো।
-আমার গ্লানি আরও কিছুটা কমলো।
-গ্লানি, নাকি সন্ধান? যাকে ছেড়ে গেছো আর যাকে এসে দেখছো তাদের তফাৎ-টা সন্ধান করছো জানি। নিশ্চিত থেকো, হতাশ করবো না।
অনীত বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমত্তায় যে একটুও জং ধরেনি, আনিশা বুঝে গেলো। তাহলে যা অনীত দেখাতে চাইছে, সেটাই দেখছে না তো আনিশা! অভিনয় নয় তো এসব?
-মাম্মা... বাপি...
অনীশের গলার আওয়াজ পেয়ে দরজার দিকে তাকালো দু’জনে।
-উঠে পড়লি?
-মাম্মা, বাপি এসে গেছে ডাকোনি তো?
অনীত হাত বাড়িয়ে কোলে বসালো।
-মাম্মা আছে। দেখভাল করছে আমার, তাই ডাকিনি।
-তোমার পায়ে লেগেছে?
আনিশা বললো –অল্প লেগেছে বাবাই। তুই আমার কোলে বস্।
অনীত দেখলো ছেলের চোখে জল।
-খুব অল্প, মা কি বললো শুনলি না। যা মায়ের কাছে বস।
চোখ মুছিয়ে একটু আদর করে দিলো অনীত। আনিশা হাত বাড়িয়ে কোলে নিলো।
-মাম্মা বলছে?
অস্ফুটে বললো অনীত।
-হুঁ, তুমি শিখিয়েছো ডাকটা?
-না, আমি মা-ই শিখিয়েছি। ওটা ওর মনের খেয়াল।
-বলুক, মাম্মার সাথে মুম্বাই যাবে বলেছে আজ।
-তাই! বাহ্! ওর মাম্মা নিয়ে গেলে যেতেই পারে।
-ওর বাপির কষ্ট হবে না? হিংসে?
অনীত ছেলের গায়ে হাত বোলালো। আনিশার দিকে তাকিয়ে বললো
-কষ্ট হবে, হিংসা হবে না। বাপিও যাবে। এটা সেটা কাজ জোগাড় করে দেখা করতে।
অনীশ লাফিয়ে উঠলো।
-দেখলে মাম্মা? বাপি ঠিক যাবে। আমাদের ফেলে থাকতে পারবে নাকি!
-তোকে ছেড়ে থাকতে পারবে না তাই। যেটা পারবে না সেটাও বলছে তোর বাপি।
অনীত লুকিয়ে চোখ মুছলো।
-তুমি চাইলে ঠিক পারবো।
অস্ফুটে বললো আবার। আনিশার কান এড়ালো না। এতো ভালো নাটক কেউ করতে পারে ধারণা নেই আনিশার। অন্তত অনীত পারবে বলে মনে হয় না। এই সংশয়টাই কাটাতে হবে ওকে –এই কয়েকদিনে।
৭
বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা হতে হতেই আরো অনেককিছু জেনে গেলো আনিশা। অনীত এখন বেশ ভালো রান্না করতে পারে, বাবা-ছেলে সানডে ইভিনিং-এ কোথাও না কোথাও ঘুরতে যায়, অনীশের বাপি তাড়াহুড়োয় বাইক চালাতে গিয়ে প্রায়ই পায়ে লাগায়, এসবের সাথে সাথে যেটা বুঝলো অনীশের পড়াশুনো বিদিশা বলে মেয়েটাই দেখে। গত তিনদিন আসেনি তাই বাবাই-এর হোমওয়ার্ক রেডি নেই। সকাল থেকে বসে বসে মাম্মা আসবে কি আসবে না ভেবে সেগুলো-তে হাতও দেয়নি। এদিকে অনীতের পায়ের গোড়ালিও মচকেছে সেটা এখন স্পষ্ট হচ্ছে। বাম পায়ের গোড়ালির কাছটা ফুলে গেছে অনেকটাই। আনিশা ওকে বকেঝকে ডাইনিং রুমে বসিয়ে ঠান্ডাজল-গরমজলের আলাদা আলাদা গামলায় পা কমপ্রেস করতে দিয়েছিলো।
-এতো কিছু লাগবে না, নিশা। এমনিই সেরে যাবে, এমন কতই হয়।
অনীতের কথায় আমল দিলো না আনিশা
-বাইকটাও সাবধানে চালাতে শিখলে না এখনও। সবসময় তাড়াহুড়ো, ছেলেটার কথা ভেবে চালাবে তো।
-ওর কাছে তাড়াতাড়ি আসতেই তো তাড়াহুড়ো। আগে যেমন তোমার কাছে...
বলেই থেমে গেল অনীত।
-থামলে কেন?
-নাহ, থাক। পুরনো কথা তোমাকে কষ্ট দেবে।
আনিশা মৃদু হাসলো –বলছো যখন, ভাবোও, বুঝি। তোমাকেও তো কষ্ট দেয়।
অনীত গরমজলের গামলায় পা চোবাল। আনিশা বললো-
-বেশি গরম না তো- দেখো...
-না,ঠিক আছে। নিশা...
-কী?
-তোমার একেবারেই মনে পড়তো না, তাই না?
-পড়তো, তবে শেষের দিকের স্মৃতিগুলোর ভার এতো বেশি ছিলো, মনে করতে চাইতাম না। ভালো সময়ের স্মৃতিগুলো মুছে গেছে প্রায়।
-অথচ একসময় খুব ভালো ছিলাম আমরা। ভালোই তো ছিলাম, নাকি?
সারা কলকাতা শহরের যেখানেই যাই তুমি আমি কোথাও না কোথাও কোন না কোন ভাবে লেপ্টে আছি একসাথে স্মৃতির দেওয়ালে। মুছবে কি করে?
আনিশা অন্যদিকে তাকালো।
-সেইজন্যই আট বছর কলকাতাকেই মুছেছিলাম, আমার প্রাত্যহিকতা থেকে। এবার এয়ারপোর্ট থেকে নামার পর থেকে তাজা হয়ে গেছে স্মৃতিগুলো, আবারও।
-খারাপগুলোই, তাই না? আমার ভুলগুলোই শুধু, বলো?
আনিশা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো –তাহলে আজ এখানে দাঁড়িয়ে থাকতাম, নীত?
-একটা কথা বলি?
-জানি কি বলবে, খারাপ স্মৃতিগুলো আমিও চাই যত তাড়াতাড়ি মুছে যাক। তোমার মধ্যেকার বদলের বাস্তবতার অনুসন্ধান করছি তাই।
অনীত হাসলো –স্বীকার করলে তবে?
-বাস্তব-কে অস্বীকার করি না আমি।
-শুধু ভালো স্মৃতিটুকু নিয়ে ফিরে যেতে চাও মুম্বাই, তাই তো? বেশ, হতাশ করবো না, দেখো।
ফিরতে চায় আনিশা। কিন্তু কী নিয়ে আর কী রেখে তা গুলিয়ে যাচ্ছে ওর। আবার আদৌ কি ফিরতে চায় এমন বিভ্রমও মনে ঢুকেছে কোথাও।
-মাম্মা...
অনীত তাকালো –নিশা দেখো ফাঁকিবাজটা-কে পড়তে বসিয়ে এসেছিলে, ঠিক উঠে এসেছে। তোর জন্য বিদিশাই ঠিক, একটুও প্রশ্রয় দেয় না, সারাক্ষণ ছটফট শুধু।
আনিশা অনীতকে থামালো।
-কী হয়েছে?
-না থাক্।
-কেন রে?
-তুমি আর বাপি কথা বলো। আমি অন্য পড়াগুলো করে নিচ্ছি।
আনিশা বাবাইয়ের কাছে গেলো।
-কোন পড়াটা বুঝিসনি?
-বাপি বকবে, বলবে বুঝিসনি তো আমাকে বলিসনি কেন? ম্যামকে পরদিন যদি বলি আগেরদিন বুঝিনি ম্যামও বকুনি দেবে।
আনিশা ঝুঁকে ছেলেকে কোলে তুলে নিলো।
-বেশ, বাপি, ম্যাম কাউকেই বলতে হবে না। কিচ্ছু না বুঝলেই আমাকে বলবি, গল্প করে বুঝে নেবো দু’জনে।
অনীশ অবাক চোখে তাকালো –বকবে না?
-একটুও না।
-মারবে না?
আনিশা হেসে ফেললো –এতো ভালো ছেলেকে মারে নাকি কেউ?
-এমা! মাম্মা তুমি জানো না, সবার মাম্মাই বকে, মারেও।
-সবার মাম্মা আর অনীশের মাম্মা এক?
অনীশ একটু ভাবলো –না, তুমি তো স্টার। স্টার-রা আলাদা রকমের মাম্মা, তাইনা?
আনিশা হেসে ফেললো –একদম না, কিন্তু অনীশ তো খুব ভালো। মাম্মার সব কথা শোনে, তো মাম্মা-কে বকতে হবে কেন? চল্, এবার আমরা যেটা বুঝিনি সেই পড়াটা একসাথে বুঝে নিই।
-বাপির পা...
অনীত এতক্ষণে আনিশার মা হয়ে ওঠা প্রাণভরে দেখছিলো, বাবাইয়ের সব চাহিদা, সব শূন্যস্থান পূরণ করতে পেরেছে এতোদিন ভাবতো অনীত। এখন দু’জনকে একসাথে দেখে বুঝেছে বেশির ভাগটাই ফাঁকি রয়ে গিয়েছিলো। মা ছাড়া সন্তান প্রাণহীন পুতুল হয়। এখন প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে যেন।
-বাপি একা একাই সেঁক করে নেবে।
-পারবে?
অনীত বললো –খুব পারবো বাবা। তুমি মায়ের সাথে পড়তে যাও।
আনিশা ঘুরে অনীতের দিকে তাকালো। খুব খুশি লাগছে অনীত-কে, মন থেকেই।
অনীশের মাম্মার কাছে পড়তে দারুণ লাগছিলো। মাম্মা সব্বার চেয়ে ভালো পড়ায়। অনীশ যতবার বোঝাতে বলে ততবারই বোঝায়, প্লাস কোন ভুল হলে, দুজনেই একসাথে মেমোরাইজ করে আবার, পড়াটা নাকি পড়া না, পড়া-পড়া খেলা, মাম্মার মতে। পড়তে পড়তে অনীশ খেয়ালই করেনি বাপি এসেও খাটে বসে ওদের পড়া পড়া খেলা দেখছে।
-মাম্মা... বাপি...
আনিশা দেখেছে আগেই –বাপি থাকুক না। বাপি-কে নেওয়া হবে খেলায়?
-বাপি তুমিও খেলবে?
অনীত হাসলো –আগে কি করে খেলতে হয় শিখে নিই তোদের থেকে, তারপর।
-বাপিকে বল্ তুমি তাহলে দুধ-ভাত।
অনীত বললো –তাই সই।
-দুধ-ভাত কি, মাম্মা?
-যারা খেলা সবে সবে খেলতে শিখেছে। তেমন পারে না তারা। -
-আচ্ছা! নিউ্যুভ তাহলে।
-নিউ্যুভ? নভিস? তুই এর শর্ট ফর্ম জানলি কোত্থেকে?
অনীত অবাক হয়।
-ফ্রি ফায়ারে বলে তো, পাবজিতেও। এখন পাবজি তো ব্যানড ছিলো ক’দিন।
অনীত কিছু বলতে যাচ্ছিলো। আনিশা থামালো।
-মোবাইলে গেমস, খেলিস নাকি?
-না, না মাম্মা। সবাই খেলে তো, ক্লাসের, সিনিয়ার, সবাই মা-বাবার মোবাইলে খেলে। সিনিয়ার কারোর কারোর তো পার্সনাল সেটও আছে, জানো? আমাকে বাপি কখনো মোবাইল ধরতেই দেয় না। কাকাই-এর মোবাইল একটু একটু ধরি, তাও ম্যাম দেখলেই নিয়ে নেয়, কানমোলা দিয়ে।
অনীত হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। আনিশা প্রশংসার দৃষ্টি-তে তাকালো অনীতের দিকে –ঠিক করে বাপি। ম্যামও।
-ঐ জন্যই ওরা আমাকে ন্যুব বলে। আমি কিছু বুঝি না যে।
-বলুক। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুধভাত হওয়া ভালো।
-খেপায় যে?
-খেপবে না।
-ম্যামও তাই বলে।
আনিশার মোবাইল বেজে উঠলো হঠাৎ। পারমিতা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাস্তবে ফিরতে হল আনিশা-কে।
-হ্যাঁ পারমিতা, বলো।
-ম্যাম, কোয়েস্ট মল স্টোর আপনার পার্সোনাল অ্যাপিয়ারেন্সের জন্য খুব ডিমান্ড করছে।
-ইজ ইট?
-হ্যাঁ, সাউথ সিটি পেয়েছে বলে ওদেরও চাই...
-ওকে! আই অ্যান্ডারস্ট্যান্ড। ফ্র্যঞ্চাইজি কাদের?
-মল ওনারদেরই। আই হ্যাভ টোল্ড দেম আপনি বিজি এখন খুব পার্সোনাল ব্যাপারে, তাও...
-অ্যাপিয়ারেন্স ফি-টা বাড়িয়ে দাও...
-সেটাও করেছি। কিন্তু স্টিল দে আর পার্সুয়িং।
-ঠিক আছে। কাল ব্রেকফাস্টে তোমার সাথে কথা বলে নিচ্ছি।
পারমিতার ফোন রেখে অনীতের দিকে তাকালো আনিশা। অনীত হাসলো-
-কাকে কাটালে?
-মেহতা’স্।
-বিগ নেম। দেখো নিশা, তোমার ব্যবসার বা কেরিয়ারের ক্ষতি করে কিন্তু কিছু করো না, প্লিজ।
আনিশা মাথা নাড়লো –করছি না। এই সাত-দশটা দিন এই ইঁদুর দৌড় থেকে আমি ছুটি নিয়েছি নীত। একটা ব্রেক বলতে পারো। তার মধ্যেও তো দেখছই... কাজ পিছন ছাড়ছে না।
-যদি খুব জরুরি হয়, করো।
-করছি তো, সকালেও গুচ্ছের ইন্টারভিউ দিয়ে এলাম। ছেলেটার কাছে আসতে লেট হলো তাই। না খেয়ে বসে ছিল বেচারা।
-ডোন্ট ফিল গিল্টি। তোমার নেচার অফ জবটাই তো ওটাই। এই নাম, এই যশ এই ব্যস্ততাই তো চেয়েছো তুমি আজীবন, নিশা। অনেকে চেয়েও পায় না, এনজয় ইওর সাকসেস।
আনিশা কি সত্যি এটাই চেয়েছিলো? এটুকুই? উল্টো দিকের মানুষ-টা তখন এটা চাইতো না। আটকাতে চাইতো, বাঁধতে চাইতো, ব্যস্ত হয়ে আনিশা নিজের জন্য নিজের ভালো-মন্দের জন্য সময় পাবে না –এটা বুঝেই, নাকি? তাহলে এখন অবলীলায় কাজকেই মোক্ষ করে কিভাবে সেদিকেই ঠেলছে আনিশা-কে? অধিকার হারিয়েছে বলে? নাকি ভালোবাসাটাও?
-মাম্মা, তুমি চলে যাবে, রাতে?
আনিশা চমকে উঠলো –রাতে? হ্যাঁ, রাতে তো যেতেই হবে। সকালে অনেক কাজ আছে যে।
-রাতে তো নেই। থাকো না, প্লিজ।
অনীশের আবদারে আনিশা ইতস্তত করছে দেখে অনীত বললো
-বাবাই, জেদ করে না। মাম্মার কাজ, দেখলে না, ফোন এলো?
-সে তো ব্রেকফাস্টে।
-তার জন্য প্রিপারেশন লাগবে তো, নাকি?
-ভোর ভোর করবে।
আনিশা অনীশ-কে কোলে বসালো। জড়িয়ে ধরলো
-রাতে বাপির কাছে থাক, আমি কাজ করেই চলে আসবো।
-বাপির পায়ে ব্যথা, কত্ত লেগেছে, তুমি চলে গেলে বাপিকে সব কাজ করতে হবে, কষ্ট হবে, কাল তো স্কুলও মাম্মা। বিকালের আগে দেখাই হবে না।
-মাম্মার জামা কাপড় এখানে নেই তো বাবাই...
অনীত বললো, আনিশা থামালো ওকে,
-বাবাই খুব করে চায় মাম্মা থাকুক?
-খু-উ-ব।
-নিশা, ও তো ছোট, ওর খেয়াল মতো বলছে...
-তুমি থামো। তুমি চাও না? তাহলে স্পষ্ট করে বলো।
অনীত চুপ করে গেলো। আনিশা থাকুক এটা ওর চেয়ে বেশি করে কে-ই বা চাইবে? অথচ আনিশার নামে কোন কালির ছিটে লাগুক চায় না ও।
-বেশ, আমি তোমার কথা ভেবেই বলছিলাম। তুমি থাকো, তোমার বাড়ি-তে, তোমার ছেলের কাছে। আমি বাঁধা কেন দেবো?
-ব্যাস্, তাহলে চুপ করে থাকো এবার। বাবাই...
-হ্যাঁ, মাম্মা?
-বাপি-কে বল্ আমার ভালো এতো ভাবতে হবে না। নিজের পায়ে ব্যথা, রেস্ট নিক।
অনীত কিছু বললো না আর। আনিশা যা করছে ভেবেচিন্তে, নাকি আবেগের বশে। জানতে ইচ্ছা হলেও তাড়াহুড়ো করবে না অনীত। বাবাই-কে পেয়ে বুকে সমুদ্রের উথাল পাথাল এখন মেয়েটার, একটু থিতু হোক। হারানিধি ফিরে পাওয়ার ঘোর-টা কাটুক।
৮
অনীত ড্রয়িংরুমে বসে ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছিলো। সকালের আঁকাদুটো ফিনিশিং-টাচ দিয়ে মেইল করলো। সৌমিক কল করেছিলো। বিদিশা স্টেবল আছে এখন। আনিশা অনীত-কে কিচ্ছুটি করতে দেয়নি। ডিনার প্রিপারেশন থেকে শুরু করে ছেলেকে খাওয়ানো সবটুকু নিজে করেছে। এখন বাবাই-কে ঘুমে পাড়াচ্ছে। অনীত মনে মনে হাসলো। ক’দিনের খেলাঘর হলেও কি সুন্দর সংসারের কর্ত্রীই সংসারের হাল ধরে নিয়েছে। মা ছেলে ও ঘরে ঘুমোক। অনীত এঘরেই ঘুমিয়ে পড়বে না হয়।
-নীত-
আনিশার গলা পেয়ে তাকালো অনীত।
-সে ঘুমোলো?
-হ্যাঁ, বাধ্য ছেলে। একটু কাছে নিতেই ঘুমিয়ে পড়লো।
-বাহ্। তুমিও শুয়ে পড়ো। আমি এখানেই শুয়ে পড়ছি।
-এতো তাড়াতাড়ি?
অনীত বুঝলো আনিশা কথা বলতে চায়।
-বসো।
সোফায় বসতে বললো অনীত। আনিশা বসেই বললো
-এড়াচ্ছো কেন আমায়? এভাবে?
-এড়াচ্ছি? তোমাকে?
আনিশা ঘাড় নাড়লো –হ্যাঁ, আমাকে।
-এড়াচ্ছি না নিশা, এক্তিয়ারে থাকছি। আমি তোমার স্বামী নই এখন, তোমার যোগ্যও নই, তাই...
-ওহ, এই যে বললে পুরনো সব বাদ দিতে, তাও যোগ্য অযোগ্য কেন বলছো?
-বাস্তব তো, বলবো না? বেশ, বলবো না।
-নিজেকে অযোগ্য ভাববেও না। বাবাই-কে একা হাতে মানুষ করেছো এই যোগ্যতা সবার হয় না।
-আচ্ছা, বুঝেছি। যোগ্য পিতা আমি, সফল মানুষও তো হতে হবে নাকি?
আনিশা তাকালো –কার্টুন ছাড়ো। ক্যানভাস ধরো। পারবে।
-চেষ্টা তো করেছিলাম। হলো কোথায়? ব্যর্থ হলাম। দেখলেই তো।
-ইগো ছিলো তখন, এখন তো নেই। এবার করো। শিল্প সাধনায় ইগো থাকলে হয় না।
-বলছো?
-হ্যাঁ, চেষ্টা করো, তুমি পারবে।
অনীত আনিশার হাতে হাত রাখলো।
-বলছো যখন, নিশ্চয় পারবো।
-কথা দাও...
-কি কথা?
-আমি না থাকলেও চেষ্টাটা ছাড়বে না?
অনীত আনিশার হাতে চাপ দিলো।
-কোথায় যাবে? এই যে ফিরে এসেছো, এই কদিনের স্মৃতি চুরি করে নিয়ে চলে যাবে বলছো? এটা যে আমার হয়ে থাকলো...
-বাবাইকে বড্ড বেশি আশা দেখিয়ে ফেলছি, বলো?
-উঁহু, ও বুঝদার ছেলে। মাম্মা কতটা ব্যস্ত বুঝবে। তুমি যতটা পারো সময় দিও।
-সময়? ওটারই তো অভাব নীত। তাছাড়া ও কলকাতায়, আমি মুম্বাই-এ। হিল্লি, দিল্লী, প্যারিস, লন্ডন...
-নিয়ে গেলে শান্তি পাবে? তো নিয়ে যাও।
আনিশা অপলকে তাকিয়ে থাকলো, অনীত হাসলো
-কী এমন দেখতে পেলে হঠাৎ?
-নিজের জীবন-কে অন্য কাউকে দিতে বলতেও কেউ কী করে পারে নীত?
অনীত আনিশার হাতে চাপ দিলো
-জীবনকে জীবনের হাতে তো তুলে দিতে পারে মানুষ। সত্যি বলছি, কাল অবধি ভাবতাম অনীশের জন্য যতটা করেছি ওটাই অপটিমাম। তার থেকে বেশি কিচ্ছু লাগবে না ওর। আজ তোমার সাথে ওকে দেখে বুঝি মা হারা ছেলের মধ্যে কতকিছু না পাওয়া ছিলো।
-ভালো মা বলা যায় আমাকে নীত? আমি যে...
-সেরা মা বলবো আমি। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই প্রতিটি চাহিদা বুঝে নিয়েছো।
-থ্যাংকস্ গো। বাবাই-কে এনেছো, আগে বলোনি কেন?
অনীত চোখ মুছলো –এই মুখ কোনদিন দেখাতে পারবো ভাবিনি। অপরাধের ভার তো অনেক।
-এখনো তো কথায় কথায় তাড়াতে চাইছো।
-তোমার গায়ে কালি যেন না লাগে তাই। কে কোথা থেকে দেখে নেবে, মুখরোচক স্টোরি বানিয়ে দেবে তোমাকে আর আমাকে নিয়ে। তাতে তোমার সুনাম, প্রতিপত্তি, ব্যবসা নষ্ট হবে। তাই সাবধানে থাকছি।
-নীত-
-বলো।
-গেট টুগেদারে যাবে?
-আমি বেমানান যে?
-আবার! চলোই না। বাবাই-কেও নিয়ে যাব। তিনজনে।
অনীত চশমা খুললো
-কে কি বলতে কি বলে দেবে ছেলেটাকে...
আনিশা ঘাড় নাড়লো –তাও ঠিক। তোমার তো তাও কাগজ আছে ওর পিতৃত্বের, আমার তো...
-কাগজের চেয়েও ভালোবাসাটাই আসল-
আনিশা খুশি হল না। অনীশের মাতৃত্বের স্বীকৃতি বড্ড প্রয়োজন ওর কাছে।
অনীত আনিশার দিকে তাকালো –ওখানে গেলে ভালো লাগবে তোমার?
-লাগতো। কিন্তু বাবাই-কে যদি কেউ...
-আমি সামলে নেব চিন্তা করো না।
-অন্য কারোর ছেলে বলবে? নাকি তোমার আর অন্য কারোর-
অনীত হেসে ফেললো
-আবেগ আর ছেলেমানুষিটা একইরকম আছে দেখছি। অবশ্য সব শিল্পীদেরই থাকে।
-আগে বলো।
-আমার আর তোমার বলবো। চলবে?
আনিশা হঠাৎ-ই কেঁদে ফেললো। অঝোরে। অনীত অপ্রস্তুত হলো। বহুদিনের দূরত্বের ইতস্তত ভাব কাটিয়ে আনিশার গায়ে হাত রাখলো। টেনে বুকের মধ্যে আনলো, মাথায় চুমু খেলো একটা।
-সরি, কষ্ট দিলাম, আবার। কেঁদো না।
আনিশা অনীতের বুকে মধ্যে কেঁদেই চলেছিলো অবিরাম।
-কী হয়েছে? কী কষ্ট তোমার নিশা? একটাবার বলো আমায়। কম করে দেবো। অন্তত চেষ্টা তো করবো।
-আমার আর তোমারই বলো?
-হ্যাঁ, আলবাৎ তাই।
-তাহলে বলার এতো বাঁধা কেন নীত? কেন এতো বেড়া, এতো নিষেধ, এতো নিয়ম?
-ধৈর্য্য ধরো। আগে নিজেকে প্রশ্ন করো তুমি কি চাও। সব সহজ হবে।
-বাবাই-কে। ওর মা হবার স্বীকৃতি চাই।
-আবেগটা থিতু করে ফেলো তবে, যা চাও তা পাওয়ার উপায় নিশ্চয় আছে। সেটা আমাকে আনিশা গুপ্তার মতো সফল মানুষ-কে বোঝাতে হবে না নিশ্চয়।
আনিশা মুখ তুলে তাকালো।
-দুটো জিনিস এক নয়, নীত। তুমি বুঝছো না।
-আবেগ আর সফলতা এক নয় ঠিকই, কিন্তু আবেগেও সফল হতে গেলে বাস্তবের মাটিতে পা রেখে, হিসার করেই চলতে হয়।
অনীত আনিশার কপালে চুমু খেলো এবারে। চোখের জল মুছিয়ে দিলো।
-ভরসা রাখো। ঠিক সমাধান খুঁজে পাবে। কেবল মনটাকে শান্ত করো। তোমার কাছে কোনটা প্রায়োরিটি আর কোনটা নয়, ভাবো, একান্তে।
আনিশা অবাক চোখে তাকালো।
-এতো ভালো কথা বলতে শিখলে কবে?
-আট বছর কম সময় নয় নিশা। মানুষ চাইলে নিজেকে গড়ে নিতে পারে যেমনটা চায়। পেরেছি, কী বলো?
-ম্যাচিওরড হয়েছ অনেক।
-মানুষ হিসাবেও বেটার হতে চেয়েছি। দেখি- কতটা পারি শেষ অবধি।
আনিশা অনীতের বুকে মাথা রাখলো। স্বেচ্ছায়।
-বদলে যাবে না তো, আবার?
-কক্ষনো না। বাবাই-এর বাপি বদলাতে পারে?
আনিশা বিশ্বাস করলো, অনীত বদলাতে পারবে না এবার, কখনোই না। ফোন বাজলো তখনই। মা একপ্রস্থ ফোন করে নিয়েছে একটু আগেই। এখন কে? ঋষভ। অপ্রস্তুত হলো আনিশা। নীতের সামনে কলটা ধরবে? অথচ না ধরলেও পারমিতার থেকে জেনে যাবে আনিশা হোটেলে নেই। অনীত ততক্ষণ ঋষভের নাম দেখে নিয়েছে।
-কথা বলো। আমি ছেলের কাছে আছি।
আনিশা-কে অবাক করে পাশ থেকে উঠে গেলো অনীত। ঋষভের সাথে কথা বলার জন্য ওকে স্পেস দিয়ে চলে গেলো। অনীত কি কিছু জানে, ওর আর ঋষভের ব্যাপারে-
-হ্যালো,
আনিশা ফোন ধরে বললো
-গলার আওয়াজ ভারী কেন তোর? মনখারাপ না শরীরখারাপ? ঠান্ডা লাগিয়েছিস্?
একটা শব্দেই আনিশার মনের খবরের আন্দাজ করে নিয়েছে ঋষভ। এখনো তুই করেই বলে একে অপরকে। বন্ধুর মতো।
-না, না। জাস্ট একটু সামান্য ন্যাসাল কনজেশন।
-ডাক্তার দেখা। বিয়ের আর মাসখানেক দেরি। মনে আছে তো?
-দেখাবো, কাল। বল্, কী বলছিস?
-এমনিই কল করলাম বাবু। মিস ইউ।
-তুই আবার এসব কবে থেকে বলা শুরু করলি?
ঋষভ হো হো করে হেসে ফেললো।
-মানাচ্ছে না, তাই না? জানতাম। রোম্যান্টিক কথাবার্তা মানায় না আমায়। মা বলে বাবার ধাতটাই বেশি পেয়েছি। আর বাবা ভাবে অপদার্থ। ব্যবসা তেমন বুঝি না।
আনিশা অল্প হাসলো –বকুনি খেয়েছিস্ আজও?
-রাইট গেস। আর তুই এতো গুছিয়ে সবটা করিস, তোর কম্পারিজনে তো সবসময়ই ঝার। এনিওয়েজ, প্যারিসটা হবে মনে হচ্ছে বুঝলি?
-রিয়্যালি। কথা হলো?
-এই তো। আমার হবু বৌয়ের পছন্দের টপিকে এসে পড়েছি। আজ্ঞে, কথা হলো মাই লাভ। ডিলটাও ক্লোজ করে ফেলবো তিন-চারদিনে, তারপর সোজা তোর কাছে কলকাতায়।
-কলকাতা?
-হুম, যা কাজ তিন-চারদিনে সেরে নে। মুম্বাই চলে আয় তারপর। কত কাজ বাকি বল তো? কত প্ল্যানিং... এই আনিশা, গ্র্যান্ড ওয়েডিং হবে এটা। বুঝলি তো? প্ল্যান করতে টাইম লাগবে বস্।
আনিশার মনটা মুচড়ে উঠলো। সময় কি আরো কমে এলো তবে? আরো আট-ন’দিন পাবে- ও জানতো...
-আমার তিন-চারদিনে কাজ মিটবে না এখানকার।
ঋষভ থমকালো –কী এমন কাজ-
-ঋষভ, আমি আগেই বলেছিলাম, খুবই ব্যক্তিগত।
-ওকে, জানতে চাইছি না। ভরসা করি তোকে। তবুও যত তাড়াতাড়ি পারিস চলে আয়।
-তুই আসবি না তবে তিন-চারদিন পর?
-নাহ। তোর উৎসাহ নেই আমার আসা নিয়ে, বুঝেছি।
-ঋষভ, প্লিজ...
-আই আন্ডার স্ট্যান্ড। ভালোবাসিস না এখনো। জানি। সময় কম জানি, সময় নে। অপেক্ষা করবো। এতোগুলো বছর তো করলাম। সেই কলেজের সময় শুরুর থেকে, যখন অনীত-কে ডেট করতিস।
-আমরা তো বেস্ট ফ্রেন্ড, ঋষভ। সেটা সেই কলেজের থেকেই, এটাও সত্যি।
-ঠিক, আবার সেখানেই আটকে না থেকে এবার এগোতে হবে, এটাও সত্যি। বিয়েটা সামনেই আমাদের। চেষ্টা-টা দু’জনকেই করতে হবে তাই না! মা-বাবা, বাপি তোর মা-বাবা সবারই কতো আশা কত চাওয়া আমাদের উপর নির্ভর করছে, জানিস তো।
আনিশা উত্তর দিলো না। এতো সবার চাওয়া ওকে ঘিরে ও জানে। মানেও। তাদের অস্বীকার করার শক্তি কি ওর আদৌ আছে? যদি না থাকে তাহলে ওর এখানে থাকাটা কি উচিৎ? আর একমুহুর্তও? একদম না। অথচ ও থাকতে চায়। নিজের মনের চাওয়াটাই বিকিয়ে ফেলবে আনিশা! তঞ্চকতা হবে সেটা নিজের সাথেই। নিজেকে আর ঠকাবে না আনিশা। নিজের মতো করে বাঁচবে এবার।
৯
নিজের কোমরে অনীতের দু’হাতের বন্ধনে ঘুরে তাকালো আনিশা।
-শুতে যাবে না? জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখলে হবে? ঠান্ডা লেগে যাবে তো।
-তুমি ঘুমোওনি?
-তুমি শুতে এলে আমাকে যে ড্রয়িংরুমের সিংগেল খাটে শুতে হবে, তাই অপেক্ষা করছি।
-কেন?
-পরপুরুষ যে। ক’পাতার কাগজে কয়েকটা সই করে দিয়েছি না- মনে নেই?
-মস্করা করো না, প্লিজ। দিব্যি শোয়া যাবে, বাবাইকে মাঝে রেখে।
অনীত আনিশা-কে আলতো আদর করলো
-তাহলে তাই হোক, চলো। ব্যাটার আবার স্কুল সকালেই।
-তোমার ব্যাটার বাপির যে অফিস যাওয়া নেই, সাতদিন বাড়িতে একদম।
-জো-হুকুম।
-ছেলেকেও ক’দিন বাড়িতে রাখলে কেমন হয়?
-দারুণ হয়, কিন্তু ক্লাসটেস্ট?
-টেস্টের দিনগুলো যাবে শুধু, হবে?
-বেশ, হবে।
-নীত...
-বলো,
-এই কয়েকটা দিনের একটা মুহুর্তও আমি লস করতে চাই না, জানো?
-জানি। তাই তুমি যেটা বলবে তাই হবে। একটা প্রশ্ন করবো?
-হ্যাঁ, বলো।
-আমাকে ছাড়া কাউকে এই আটবছরে ভালোবাসতে পারলে না কেন?
আনিশা চোখ নামালো। ধরা পড়ে গেছে ও। নিজের শ্বাস ঘন হচ্ছে বুঝতে পারলো। নিজেকে সামলানো উচিৎ আনিশার, হৃদস্পন্দনের দ্রুততা বাড়ছে দেখে বললো-
-নীত... প্লিজ।
অনীত সাথে সাথে বাহুবন্ধন আলগা করলো, সত্যিটা জেনে গেছে ও।
-তোমার পা ফস্কাতে দেবো না, চিন্তা নেই। ভালোবাসি তোমায়।
আনিশা অনীতের টি-শার্ট খামচে ধরলো,
-কেন করলে এমন বলো? কেন? কেন?
অনীত আবারো কাছে টেনে নিলো, আঁকড়ে ধরলো
-ভুল ছিলাম নিশা। ভুল করেছি বড্ড। মাফ করবে না? নাহলে মরেও যে শান্তি পাবো না।
-কেন জবাব দাও, নাহলে তো সব ঠিক থাকতো...
অনীত আনিশা-কে শান্ত করলো, মাথায় হাত বুলিয়ে
-সব ঠিক আছে, এখনো।
-কিচ্ছুটি ঠিক নেই, তুমি জানো না।
-তাহলে ঠিক করো তুমি, আমাকে সাথে নাও – এই ঠিক করার খেলায়। নেবে?
-খেলাটা তুমি শুরু করেছো, পাগল।
-আমি! কী করে?
-বাবাইকে এনে। আমার সব ভুল-কে ঠিক আর ঠিক-কে ভুল করে দিয়েছো নীত। তুমি জানো না তুমি কি করেছো।
-বাকি যেটুকু আছে, তুমি করো আমি বদলে যাব না। পাশে থাকবো। সবসময়। এভাবেই। কিছু না চেয়ে, নীরবে।
-চাইবে না? কেন?
-অনেকের চাওয়ার তলায় চাপা পড়ে যাওয়া মেয়েটার থেকে আমিও চাইবো? তা হয় নাকি? তাহলে আমার আর অন্যদের ফারাক কিসে! আমি আর তোমার নীত হলাম কীকরে তবে?
আনিশা চুপ করে গেলো, অনীত বলল
-চলো, শোবে, সকালে কাজ আছে বললে না?
আনিশা অনীতের হাত ধরলো
-দুটো পৃথিবী বড্ড আলাদা যে, নীত।
-তুমি মেলাবে। তুমি পারবে। আনিশা গুপ্তা যে তুমি।
আনিশার বড্ড ইচ্ছা করছিলো অনীতের কথায় বিশ্বাস করতে। অথচ এতগুলো কিন্তুর মেঘ ওকে ঘিরে ধরেছিলো, আনিশার জোর দিয়ে হ্যাঁ বলার ক্ষমতাও নেই এখন।
অনীশের দুইদিকে দুইজন শুয়েই আবিষ্কার করলো ছেলে জেগে আছে।
-বাবাই, জেগে?
-অল্প।
অনীত হেসে ফেললো –আধ ঘুম, আধ জাগা, বুঝলে তো নিশা?
-বুঝলাম। সকালে স্কুল না? টেস্ট আছে তো!
-বাপিও ছিলো না তুমিও না।
আনিশা ছেলেকে আদর করে দিলো অনেকটা।
-গল্প করছিলাম। অনেকদিন পর দেখাতো, তাই।
-তার মানে ভাব করে নিয়েছো দু’জনে?
অনীত ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো।
-একদম, নো আড়ি। ভাব।
-ইয়েস! তাহলে তোমরা আবার ফ্রেন্ডস্? নো ঝগড়া?
-নো ঝগড়া, নো রাগারাগি, নো মান অভিমান।
আনিশা ছেলের নাক টেনে দিলো।
-তাহলে আমার মাম্মা আর বাপি আবার একসাথে থাকবে, তাই না?
আনিশা জানে এটা বাবাইয়ের মনের সবচেয়ে বড় চাওয়া।
-তাই না বাপি?
-থাকবে, যতটা পারবে থাকবে, বাবাই। আর বাবাই-কেও সময় দেবে।
-ইয়েস্!
-আর খুশিতে না লাফিয়ে ঘুমো।
অনীত বললো। বাবাই আনিশা-কে আঁকড়ে ধরলো। বুকে মুখ রাখলো। অনীত আনিশা-কে চোখের ইশারায় ছেলের গায়ে হাতে পায়ে হাত বোলাতে বললো। অনীশ ঘুমিয়ে পড়লো কিছুক্ষণের মধ্যেই।
-ঝক্কি নেই একদম, তাই না?
-ছোট্ট থেকেই। দেড় কি দুই তখন। তখন থেকেই দারুণ বুঝদার।
-পুরনো স্মৃতি আছে?
-ওখানকার? নাহ্। মাদার বলে দিয়েছিলেন ও-কে, যে বাপি বাধ্য হয়ে ক’দিন রেখে গিয়েছিলো, এখন নিতে এসেছে।
-একটু বোধ হতেই মা’কে চেয়েছে, তাই না?
-স্কুলে গিয়ে। তার আগে বেগ পেতে হয়নি তেমন। স্কুলেই গিয়েই সবার আছে ওর নেই কেন... বলতো খুব। বকেঝকে থামাতাম, কখনো বুঝিয়েও। বিদিশাও অনেকটাই চেষ্টা করেছে মায়ের অভাব ঢাকার, মিথ্যা বলবো না। কিন্তু ম্যাম আর মায়ের ফারাক থাকেই, ছিলোও। তুমি আসায় স্পষ্ট হয়েছে ও ঠিক কতটা নিজের মা’কে চাইতো।
-হয়তো মনে মনে ডাকতোও, নাহলে ঐভাবে আমার গাড়ির সামনে সেদিন এলো কি করে?
-ভাগ্য বা প্রার্থনার জোর। আমরাও তো ওকে হারিয়েই পেয়েছি। আনিশা ঘুমন্ত ছেলেকে আরো আদর
করে দিলো।
-দুঃস্বপ্নটা আর আসবে না, বলো?
-না, আর আসবে না। রক্ত মাংসে গড়া জ্যান্ত পুতুলটা তো তোমার সামনেই এখন।
-তুমি এখন ঈশ্বর-কে খুব বিশ্বাস করো না, অনীত?
-বড় অ্যাক্সিডেন্টের পরের দুইমাসে জীবন আর মৃত্যুর চুলের মতো ব্যবধানটা চিনতে শিখেছি। জীবন দর্শনই বদলে গেছে প্রায় বলা যায়। একশো আশি ডিগ্রি উল্টে গেছে সব। কোনটা প্রয়োজনীয় কোনটা অপ্রয়োজনীয় বুঝতে শিখেছি।
-বাইকে নিশ্চয়, আবারও?
-আর কি? ডান পায়ে পাত বসানো আছে, তিনদিন জ্ঞান ছিলো না।
-তারপর?
-কোনক্রমে সারভাইভ করেছি। বন্ধুদের সার্কেল থেকে ততদিনে পুরো আলাদা আমি। বছরদেড়েক চাকরিটা পেয়েছি। সেরে উঠেই বাবাই-কে আনলাম আমার কাছে।
-বাবাই-এর ব্যাপারটা ওরা জানে? সৌমিক, বিদিশা?
-না, বাবাই আসার পর সৌমিকের চাকরি। তার অল্প সময় পরই ওদের বিয়ে। অফিসে জানে বাবাই-এর মা নেই। সেই থেকেই ওরা দু’জনে প্রচুর সময় দিয়েছে ওকে।
-আলাপ করাবে আমায়?
-ওদের সাথে? বেশ তো। বিদিশা ফিরুক, করাবো। সৌমিক ভারি অবাক হয়ে যাবে এতো করে বৌদির প্রশংসা শুনেছে দাদার মুখে – বৌদি যে কে – এটা জানলে অবাক হয়ে যাবে, কী বলো?
-নাম জানাওনি!
আনিশা অবাক হলো।
-আনিশা নামে লাখ লাখ মেয়ে আছে, ম্যাডাম। দ্যা আনিশা গুপ্তা কজন ভাববে বলো তো। এই চালচুলোহীন লোকটার সাথে কল্পনা করাটাও তো বাতুলতা।
আনিশা অনীতের মুখে হাত চাপা দিলো।
-এভাবে বলতে নেই।
-এখন চালচুলো সব আছে, দেখছোই তো। তবে জানো শালা বিতান যদি জানে তুমি আমার কে – ব্যোমকে যাবে।
আনিশা হাসলো –বিতান-টা কে? কলিগ!
-হ্যাঁ, মহাখচ্চর ছেলে। বলে কিনা দাদা আনিশা গুপ্তা-কে দেখলাম সেদিন। কী যেন বলে ওরা –ক্রাশ, হ্যাঁ ক্রাশ হয়ে গেছো ওর। ওকে পোট্রেট করে দিতে হবে তোমার একটা, হারামজাদা।
-রাগ হলো বুঝি?
-হবে না।
-এখন কিন্তু অনেকেই ভাবে। অনেকেরই ক্রাশ।
-সে হোক। তারা তো আর আমাকে পোট্রেট এঁকে দিতে বলবে না আমার বউয়ের।
বলেই থেমে গেল অনীত।
-সরি, ভেরি সরি। অভ্যাস যে।
-বুঝেছি। আট বছরেও বদলাওনি দেখে ভালো লাগছে।
-বদলাইনি! সে কি!
-অভ্যাস। নিজের করে ভাবার অভ্যাসের বদল করোনি।
অনীত ছেলেকে টপকে আনিশার গালে চুমু খেলো। ও জানে আনিশা মানা করবে না
-না বদলে ভুল করছি?
-ঠিক করেছো, নীত। ভালোবাসা বদলায় কখনো? সবাই তোমার মতো ঠিকটা করতে বা বুঝতে পারে না যে।
-অঙ্কে পটু না আমি জানোই তো। অত এক্স টেক্স বুঝি না, বলতেও বাঁধে তাই।
-যা পারো না, চেষ্টাও করো না।
-করছি না, ভালোবাসা লুকায় বোকারা।
আনিশা অনীতের হাত ধরলো।
-কথা দাও, কাল যাই হোক, আগামীতে আমি যেখানেই থাকি, ভুল বুঝবে না।
-শান্তি পাবে এতে? তাহলে দেবো।
-কথা দাও, নীত।
-ভুল বুঝবো না। তোমার অনেকের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা, অনেক ঋণ আছে বুঝি, আর তোমার-আমার জগৎ-টাও তো ভীষণ আলাদা। একটু মেলাতে চেষ্টা করো। ব্যাস। আর... মনের কথা শোনো এবার, মগজ নয়। নিজের কথা শোনো অন্যের নয়।
-নিজের কথাটাই নিজে বুঝতে চাইছি নীত। নিজে কি চাই, সেটাই জানতে চাইছি। পাশে আছো তো সবসময়?
অনীত আনিশার কপালে হাত রাখলো।
-অনন্তকাল আছি। এবার চোখ বন্ধ করো, রাত হয়েছে অনেক।
আনিশা বাবাইকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো, আঁকড়ে ধরলো বলা চলে। শান্তি পেয়েছে ও, আজ। বহুদিন পর, দুঃস্বপ্নের হানাদারির থেকে। আটবছর প্রথম হওয়ার দৌড়ে দৌড়াতে গিয়ে শান্তি কাকে বলে ভুলে গিয়েছিলো, আজ বিস্মৃতকাল পর, ফিরে পেলো যেন।
১০
মাম্মার গাড়িতে চেপে আজ স্কুলে যাচ্ছে অনীশ। বাপির পায়ে ব্যথা, তাই এলো না। নাহলে বাপিরও আসার খুব মন ছিলো। মাম্মারও বাপি-কে আনার ইচ্ছা ছিলো, কিন্তু মাম্মা যাচ্ছে কাজে। কাল বাপি মাম্মা-কে হামি খেয়েছে। অনীশ শুয়ে শুয়ে দেখেছে। দু’জনেই তারপর অনীশ-কে আদর করে দিয়েছে খুব করে। তার মানে ওদের আর ঝগড়া নেই।
অনীশ সবসময় ভাবতো ওর মাম্মা কেমন হবে, মাম্মাকে পেয়ে মনে হয় মাম্মার থেকে ভালো আর কেউ না।
-এই যে পাকাবুড়ো, পেন্সিল বক্সটা ঠিক করে গুছিয়েছিস তো?
-হ্যাঁ, আজ তো টেস্ট।
-জানি তো, টেস্টে সব পারবে অনীশ?
-ট্রাই তো করবোই।
-বাহ, না পারলে?
-ম্যাম জানলে বকবে। পানিশও করতে পারে। বাপি জানলে ম্যাম-কে বলে দেবে। তুমি জানলে আবারও পড়িয়ে দেবে ঠিক করে, তাই না, মাম্মা?
আনিশা খুশি হলো খুব –একদম তাই। মাম্মা আনতে আসবে তোকে, না আসা অবধি বেরোবি না কিন্তু।
অনীশ বড় করে ঘাড় নাড়লো।
-ও মাম্মা।
আনিশা তাকালো –বলো।
-বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করলে বলবো তো আমার মা আছে? ফিরে এসেছে।
-আলবাৎ বলবি;
আনিশা কোন সংশয় বা দোনামনা রাখতে চায় না এই-বিষয়ে। অনীশ মা না থাকার যে কষ্টে ভুগেছে এতোদিন তা-কে গাসি শেষ করতে পারে চিরতেরে।
-আমার মা স্টার বলে দেব? আনিশা গুপ্তা তুমি।
আনিশা হাসলো –মা তো মা-ই হয়। স্টার-টা অন্য পার্সন। মা-টা অন্য। তাই মা এসেছে, এটা বড়, বাবাই। মা কে সেটা না।
-আমিও স্টার হবো, তোমার মতো।
-তাহলে তো প্রচুর পড়তে হবে, জানতে হবে, খাটতে হবে।
-বাট মাম্মা- স্টার হয়ে যদি বাড়ি আসতেই প্রবলেম হয় তো না হওয়াই ভালো, বলো?
আনিশার মনের মধ্যে আলোড়ন তৈরি করলো অনীশের কথাটা। স্টার হতে গিয়ে, প্রথম হতে গিয়ে সর্বস্ব বাজিতে লাগানো বোধহয় নিতান্ত মুর্খামি। এতটুকু ছেলেও সেটা জানে।
-ঠিক তাই। কিন্তু স্টার-রাও বাড়ি ফেরে। যেমন আমি ফিরলাম।
-আবার তো চলে যাবে, মুম্বাই।
-আবার আসবো, আর এখন তো তোর বাপির সাথে ভাবও হয়ে গেছে, তাহলে?
-তাহলে স্টার হওয়া ভালো?
-সবটা ব্যালেন্স করে চলতে পারলে, ভালো।
-বাপির মতো।
আনিশা ছেলের গায়ে হাত রাখলো।
-একদম। তোর বাপির মতো। চাকরি, সংসার, ছেলে সব একা হাতে করেছে। হি ইজ দ্যা রিয়াল স্টার।
নিজের কাছেই সত্যি-টা স্বীকার করলো আনিশা। সব ফেলে চলে যাওয়াতে সাফল্য নয়, সবটুকু ধরে রাখাতেও সাফল্য আছে, সুখ আছে, শান্তি আছে।
কোয়েস্ট মলের অ্যাপিয়ারেন্স-টা এড়ানো যাবে না বুঝেই আগামী পরশু সময় দিয়ে এলো আনিশা। পারমিতা আজ একটু বাড়ি যেতে চাইছিলো, কলকাতাতেই বাড়ি ওর, আনিশার জন্য হোটেলে থাকতে হচ্ছিলো। কিন্তু কিন্তু করছিলো কথাটা বলতে, আনিশা বুঝেই ছুটি দিয়ে দিয়েছে, বাড়িতে থাকুক ক’দিন। অন্যসময় তো আনিশার ছায়াসঙ্গী হয়ে চড়কি পাক খেতে হয় সারাদুনিয়া। খুব বাধ্য মেয়ে, বুদ্ধিমতীও, কাজটাও জানে, আনিশার বকাঝকাও মুখ বুজে শুনে নেয়। পরে ম্যামের মুড ভালো দেখে ভুলটা বুঝে নেয়। প্রায় দু’বছর আছে, আনিশার স্নেহভাজন। ঋষভ আর আনিশার বিয়ের ব্যাপারেও প্রচুর দায়িত্ব ওর উপর বর্তেছে।
-ম্যাম আপনি সাউথের দিকে যাবেন?
পারমিতার প্রশ্নে তাকালো আনিশা।
-হ্যাঁ, সাউথের দিকেই। কেন বলো তো?
-আসলে আমার বাড়ি...
-বুঝেছি, তুমি ঐ গাড়িটা নিয়ে নাও, আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি।
পারমিতা অবাক হলেও কিছু বলেনি। ম্যাম ওকে বহুদিনই অফিস থেকে নিজের বাংলোয় ফেরার পথে ড্রপ করে দিয়েছেন। কিন্তু আজ যেন এড়িয়ে গেলেন, হোটেলে ফেরেননি কাল - কিছু কি লুকাচ্ছেন? অবাক ভাবটা মুখে প্রকাশ করলো না পারমিতা।
-ওকে, ম্যাম।
-পারমিতা, তোমাকে আমি ছেড়েছি এটা কিন্তু ঋষভ স্যার-কে বলবে না। তাহলে খামোখা রাগ করবে।
-ওকে ম্যাম, আই আন্ডারস্ট্যান্ড।
-তোমার তো আমার সাথেই থাকার কথা সবসময়, তাই না?
জানোই তো কেমন দুর্ভাবনা করে এসব নিয়ে।
-হ্যাঁ, ম্যাম। জানি।
ঋষভ স্যার আনিশা ম্যাম-কে নিয়ে খুব পসেসিভ, এটা বোঝে পারমিতা। ম্যাম-কে ততটা মনে হয় না কখনোই।
-বাই দ্যা ওয়ে, তুমি মিলান যাচ্ছ, নেক্সট উইক।
-মিলান! বাট ম্যাম।
-স্যার-কে আমি বুঝিয়ে নেবো। অভিষেক-কেও পাঠাবো সাথে, হবে?
পারমিতা ব্লাশ করলো। অভিষেক ওর বয়ফ্রেন্ড। ম্যাম সবই জানেন।
-ওকে ম্যাম।
-সানডে থেকে শো, দেন ইউ হ্যাভ টু মুভ বাই ফ্রাইডে।
পারমিতা মনে মনে খুশি হলেও কোথাও যেন খটকা লাগলো ওর। ম্যাম কি ওকে সরাতে চাইছেন? অন্য কোথাও তো পারমিতা-কে কাছ ছাড়া করতে চান না। কিন্তু একে মিলান তার উপর অভিষেক ওর আর অন্যকিছু ভাববার ছিলো না। ও রাজি।
-ঠিক আছে, ম্যাম।
-ওকে, বাই দেন, কাল কিছু শিডিউলড আছে?
-না, একেবারে পরশু, কোয়েস্ট। কালকের দিনটা আপনার মাসিমণির বাড়িতে যাওয়ার কথা।
-গ্রেট।
-ম্যাম, জেঠি মানে আপমার মা ফোন করলে...
আনিশা মনে মনে অপ্রস্তুত হলেও মুখে প্রকাশ করলো না।
-বলবে, একটু বাড়ি এসেছো, ম্যাম-কে ওনার কালয় ব্যাপারটা জানাচ্ছো। ম্যাম কল করে নেবেন। পারমিতা বুঝলো-
-আর হ্যাঁ, বাড়িতে থাকছো বলবে না, কেমন?
-ইয়েস ম্যাম, বুঝেছি।
আনিশা পারমিতার জন্য রোজ রোজ হোটেলে ফেরার পিছুটান রাখতে চাইছিলো না। কাটিয়ে ফেলে খুশি হল। এবার অনীশ-কে আনতে বেরোবে। রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নিলো। চেঞ্জ করে জামাকাপড় গুছিয়ে নিলো আনিশা, ক’দিন ঐ বাড়িতেই থাকতে চায় ও, খুব জরুরি এটা ওর কাছে।
কলেজের বান্ধবী ঋতুপর্ণার ফোন এলো আনিশা ট্রলি গোছাতে গোছাতে, গেটটুগেদার নিশ্চয়।
-বল্, ঋতু।
-বল্ মানে? তুই তো বলবি। নেক্সট সানডে গেটটুগেদার, আসবি তো? সবাই এক্সাইটেড তুই আসবি বলে।
-চেষ্টা করবো অবশ্যই।
-এখনও চেষ্টা, নট ডান, ইয়ার।
-একশো ভাগ চেষ্টা, এটা।
ঋতুপর্ণা হাসলো –বেশ, সবাই আসবে।
-সবাই?
-অনীতের কথা বলছিস্? ও তো কোন কন্ট্যাক্টই রাখে না কারোর সাথে। একটা লিডিং নিউজ পেপারে এখন আছে মনে হয়, ও আসবে না তুই এটার জন্য এড়িয়ে যাস না। পারলে ঋষভ-কেও আনিস।
-ঋষভ তো দুবাই এখন, প্যারিস যাবে তারপর।
-ওহ্, যাক- ভাবলাম তোদের বিয়ের আগে এখানে একটা ব্যাচেলারস পার্টি হয়ে যাবে। আচ্ছা একটা কথা জানিস?
-কি?
-অনীত হ্যাজ এ চাইল্ড, ছেলেই মনে হয়। আমাদের জুনিয়ার গার্গী, মনে আছে? ওর মেয়ে যে স্কুলে পড়ে সেই স্কুলেই...
আনিশা লুকালো না –হ্যাঁ, জানি।
-বলেছে তোকে?
-না, আমার জানার কথা, তাই জানি।
-মানে...
-দেখা হলে বলি?
-বেশ। তবে অনীত তুই যাবার পর মদ, জুয়ো এসবের জন্য জেলেও গিয়েছিলো।
আনিশা এগুলো জানতো না, কিছু উত্তর করলো না তাই।
-গার্গী তো বলে ওর মেয়ের স্কুলের এক ম্যামের সাথে নাকি বেশ ঘনিষ্ঠ এখন অনীত, বাচ্চাটাও ওই ম্যামের সাথেই যাতায়াত করে সবসময়।
আনিশা বুঝলো বিদিশার কথা বলছে ঋতুপর্ণা। ফোনে এর উত্তর করা সমীচীন হবে না।
-ঋতু, আমি এখন একটু ব্যস্ত, পরে কথা বলি?
-বেশ, রাখছি তবে।
ঋতুপর্ণা ফোন কেটে দিলেও আনিশার মনে অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গেলো।
১১
অনীশ-কে গাড়িতে তুলেই আনিশা বলল-
-হাউ ওয়াজ দ্যা এক্সাম?
-গুড মাম্মা।
-লিখেছিস সব?
-হ্যাঁ...
বড় করে হ্যাঁ করলো অনীশ, আনিশা হেসে ফেললো,
-তাহলে এখন, বাড়ি?
-ইয়েস, বাপির কাছে। মাম্মা বাপি-কে কল করে দাও, পিক আপ করেছো। নাহলে টেনশন করবে খুব। ম্যামও স্কুল থেকে বেরিয়েই কল করে দেয়।
-টেক্সট করে দিয়েছি, দেখেও নিয়েছে। আর মাম্মার সাথে থাকলে বাপি টেনশন করবে না।
-মাম্মার কাছে থাকা সবচেয়ে সেফ বলে?
আনিশা মুচকি হাসলো –একদম, প্যান্ট নোংরা হলো কি করে?
-খেলছিলাম যে, টিফিনে, বাপি দেখলে দেবে কানমলা। বলবে কাচতে কষ্ট হয় না মাসির?
আনিশা হেসে ফেললো –দাগ তো ভালো, খেলাও ভালো। খেললে দাগ লাগবেই।
-বাপি-কে বুঝিয়ো।
-বোঝাবো। কানমোলা দেওয়া ঠিক না এটুকুর জন্য।
-তাই না বলো? মাসি বাপি-কে বকে, বাপি আমায়।
-আমি এসে গেছি, আর কেউ বকবে না।
অনীশ নিজেই খুশি হলো। ওর মাম্মা খুব ভালো, বেস্ট মাম্মা ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড। আজ ক্লাসেও সব্বাই-কে বলেছে ওর মাম্মা চলে এসেছে। সব্বার মতো ওর-ও মাম্মা আছে, এটা বলতে পেরেই কি দারুণ খুশি-ও বোঝাতে পারবে না কাউকে। একদিন মাম্মা-কে বলবে ক্লাসের বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। সব্বাই অবাক হয়ে যাবে ওর মাম্মা-কে দেখে। পরীর মতো দেখতে ওর মাম্মা। আর সবচেয়ে ভালো, বকে না কক্ষনো, বোঝায়, ঠান্ডা মাথায়। মাম্মার সাথে থাকতে চায় ও সবসময়, প্রতিদিন।
আনিশার ট্রলি নিয়ে আসা দেখে অনীত অবাক হলেও খুশিও হয়েছিল। ক’দিন এখানেই থাকতে চায় মেয়েটা, থাকুক। অনীশের মায়ের অধিকারে থাকতেই পারে। স্কুল থেকে এসে থেকেই ছেলেকে নিয়ে পড়ে আছে আনিশা। অনীতের পায়ে ব্যথা বলে বসিয়ে রেখেছে। স্নান করানো, চেঞ্জ করানো, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, সব করেছে একা হাতেই। কখনো মনে হচ্ছে না একটুও অনভ্যস্ত ও, বাবাই-কে দেখেও মনে হচ্ছে না মায়ের কাছে ও এসব প্রথমবার করছে। দুজনেই দুজন-কে পেয়ে খুশি খুব, এটা বোঝার জন্য নিশ্চুপে দেখে যাওয়ায় যথেষ্ট।
-নীত, খাবে এসো।
-বাবাই ঘুমোলো?
-ঘুমিয়ে পড়েছে, তুমিও ঘুমাবে, পায়ে ব্যথা নিয়ে রান্না-ঘরের সব কাজ করেছো সকাল থেকে।
-মাসি আসেনি যে...
-এসো, খাবে। মাসিকে ছুটি দিয়ে দাও ক’দিন। আমি থাকবো তো, এখানে, প্রাইভেসি থাকবে।
খেতে খেতে আনিশা বলেই ফেললো –ঋতু ফোন করেছিল।
-বিবিসি নিউজ ঋতু?
আনিশা হাসলো –হুম। অনেক খবরই রাখে তোমার ব্যাপারে।
-স্বাভাবিক, গার্গীর মেয়ে পড়ে বাবাই-য়ের সাথে, গার্গীও অনেকবার এটা সেটা বলে জানতে চেয়েছে অনেককিছু...
-তুমি জেলে ছিলে, বলোনি তো?
অনীতের আঙুল ভাত মাখতে মাখতে থেমে গেলো
-নিজেই ভুলে গিয়েছিলাম। বাবাই আসার আগের কথা।
-মদ?
-জুয়াও, তুমি যাওয়ার পরপরই।
-ওহ। এটাও ধরেছিলে?
-কেস মিটিয়ে নিয়েছি, ওগুলো মনেও রাখি না আর। পূর্বজন্মের কথা মনে করি।
-তাহলে তো আমাকেও ভুলে যেতে হয়...
-তুমি সব জন্মেই থাকবে, ঐ যে কি বলে যেন, সাতজন্ম... সাতপাক।
-বিদিশা আর তোমাকে নিয়েও ইউ নো...
-জানি, ওরা অমনই। ঐ নিয়ে ভেবো না, যেদিন আলাপ হবে ওর সাথে বুঝবে।
-এখানে এসেছে?
-কাল ফিরবে মনে হয়। বোন হয় ও আমার নিশা, ভাইফোঁটা দিয়েছে, এরপরও...
আনিশা আর কিছু বললো না, তবে বিদিশার সাথে দেখা করতে হবে ওকে, শীঘ্রই।
অনীতও বুঝলো এই দেখা হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি, অত্যন্ত। অনিশার মনের জট-টা খুলবে এতে অন্তত। ঋষভের সাথে নিশার বিয়ের খবরটা শুনেছে অনীত। হয়তো সামনেই বিয়ে, সময় নেই আনিশার হাতে তাই। যতটুকু পারে এখানে থাকতে চাইছে, ছেলের কাছে। আনিশা-কে কথাটা জিজ্ঞাসা করতে কখনো চায়নি অনীত। বিরক্ত হতে পারে, নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারেণ। বাবাই যেক’দিন মা’কে পাচ্ছে সেইকটা হাতে গোনা দিন থেকে ওকে বঞ্চিত করবে না অনীত। ঋষভের সাথে বিয়ে হলে, নিজের সংসার হলে আনিশা কী আর সময় পাবে এখানে আসার? তখন দায়িত্ব বাড়বে, ব্যস্ততাও। সন্তানও আসবে, আবারও। এই হাতে গোণা কয়েকটাদিন অনীশ আর তার বাপির স্মৃতি হয়ে থাকবে সারাজীবন, বেশ ভালোভাবেই জানে অনীত। তাই প্রশ্ন করে না কোন, শুধু দেখে যেতে চায়, যতটা ওর চোখ আর মন গ্রহণ করতে পারে।
১২
অনীত ওদের মা-ছেলের শোওয়ার ঘরে গিয়ে দেখে গল্প চলছে দু’জনের। আনিশা অনীত-কে দেখে বললো
-বাপি এসেছে এবার ঘুমা।
-বাপিও গল্প করুক।
অনীত পাশে শুয়ে পড়ল, ছেলের দিকে ঘুরলো
-দুপুরে ঘুম না হলে সন্ধ্যাবেলায় পড়বে কে?
-কাল তো স্কুল যাবো না, মাম্মা বললো।
-ওহ, পড়া বাদ তাহলে?
-ম্যামও তো আসবে না, তাই না মাম্মা?
আনিশা হাসলো –একদম, তাই আজ ছুটি।
অনীশ বিশ্বজয়ের হাসি হাসলো। মাম্মার মতো আর কেউ নেই। বাপিও ছুটি দেয় না, ম্যাম তো নয়ই। অনীত ছেলের দু’চোখ ভর্তি খুশির জোয়ার দেখে নিজের মন ভরিয়ে তুললো
-বেশ, মা বলে দিয়েছে তাহলে ছুটি।
-ইয়েস।
অনীশ ঘুরে মা-কে আঁকড়ে ধরলো। আনিশা খুশি হলো ভীষণ
-বিকালে তাহলে আঁকাআঁকি খেলা হবে বাবাই, এখন ঘুম।
-ওকে, মাম্মা। তুমি আর আমি?
-বাপি-কে নেওয়া যাবে।
আনিশা বললো, অনীশ মাথা নাড়লো।
-বাপি খালি টাস্ক দেবে তাহলে, অন্য আঁকা মানা তো।
অনীত হেসে ফেললো
-বেশ, অন্য আঁকাও হবে না হয় আজ।
-সত্যি।
-তিন সত্যি। এমনিতেই তো বিদিশার কাছে আঁকিস, অন্য আঁকা।
-স্কুলের টাস্ক তো বাপি।
-জানি তো, তবে সবে যে স্কুলের না, তাও জানি।
অনীশ অবাক চোখে তাকালো
-বকো না যে?
-সবেতেই বকতে হয় না যে। মাম্মা বলে, শুনিস না?
অনীত ছেলেকে গভীরভাবে চুমু খেলো।
-এবার ঘুমো। উঠে তিনজনে আঁকাআঁকি খেলা হবে।
অনীশ ঘুমোতেই আনিশা বললো
-পিওর ব্লিস হি ইজ, না, অনীত?
অনীত চোখ মুছলো –হ্যাঁ, অনেক কপাল করে পেয়েছি।
-দুজনেই।
অনীত আনিশার মাথায় হাত রাখলো।
-একদম, দু’জনেই। দুজনেরই তো, একসাথে।
-কাগজে নেই যে,
অনীত কিছু বলতে যাচ্ছিল, আনিশা থামালো
-আজ কি বলেছে জানো?
-বাবাই? কি বলেছে?
আনিশার চোখে জল দেখলো অনীত।
-তোমায় হার্ট করেছে? নিশা... ও তো ছোট...
-হার্ট জেনে করেনি, নিজের অজান্তেই করেছে।
-যেমন?
-মাম্মার পেটের মধ্যে বেবি থাকে শুনেছে, তাই প্রশ্ন করছিলো ও ঠিক কোথায় ছিলো।
অনীত চুপ করে থাকলো, আনিশা কাঁদছিলো, অনীত কি বলবে বুঝতে পারছিলো না।
-সরি নিশা-
-সরি কেন? ও তোমার একার?
-না, তবে...
-তবে? ওকে বুঝিয়ে দিয়েছি ও কোথায় ছিলো, ছিলোই তো তাই না, নীত? ঐ ভুলটা হয়নি তো, বলো?
অনীত আনিশার হাত ধরলো
-একদম ছিলো। আমি মানি এটা, মন থেকে মানি।
-কিন্তু কাগজ? সেটা তো নেই...
অনীত আনিশার দ্বিধা কাটালো
-কাগজ চাও তুমি? বেশ, তাই হবে।
-চাইবো না? চাওয়াটা অন্যায়? অধিকার চাইবো না? অধিকারের প্রমাণপত্র না থাকলে দাবির জোর কোথায় থাকবে নীত?
অনীত আনিশা-কে থামালো, চোখের ইশারায়। দেখালো অনীশ নড়ে উঠছে। অনীত ছেলেকে ঘুম পাড়ালো আবারও, তারপর বললো
-আলবাৎ চাইবে, চাওয়াটা খুব স্বাভাবিক। আমি উকিলের সাথে কথা বলবো।
-বলো, যত টাকা লাগে লাগুক।
-তোমার পরবর্তী-তে কোন সমস্যা হবে না তো?
কথাটা বলবে না বলবে না করেও বলে ফেললো অনীত। আনিশা জানে সমস্যা হবে, সমস্যা হতেই পারে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি জরুরি ওর কাছে অনীশের মাতৃত্বের অধিকার। বাকি কোন কিছু ভাববার মতো অবস্থায় ও নেই।
-সমস্যা হলে আমি বুঝে নেবো।
-ঠিক আছে, তবে...
-তবে?
-আমাদের ডিভোর্স ডেটের আগে নিয়ে যেতে হবে ওই কাগজের ডেট-টা।
আনিশা চোখ মুছলো
-তুমি কথা বলো, যেটা ভালো হয় করো, প্লিজ, নীত। কিন্তু অনীশের মায়ের নামটা যেন আনিশা গুপ্তাই হয়। এটা এনশিওর করো।
বিকালে তিনজনে জমিয়ে আঁকাআঁকি খেলায় মেতেছিলো। অনীশের কল্পনার রঙে রঙ দিচ্ছিলো ওর বাপি আর মাম্মা, ওর মতো করেই। একসাথে শেষ কবে এঁকেছে ভুলেই গিয়েছিলো দুজনে। অথচ একসময় একসাথেই আঁকতো, আঁকতে ভালোবাসত। দিনের পর দিন কাটিয়ে দিত আঁকা নিয়ে, আলোচনায়, গল্পে, তর্কে।
-মাম্মা, জলদি করো, বাপি জিতে যাবে যে।
আনিশা পুরনো কথা ভেবে অন্যমনস্ক হচ্ছিলো, অনীশের কথায় সম্বিৎ ফিরলো। পুরনো দিনগুলোর মতোই লাগছে আজকের দিনটা, সেই মানুষটার সাথে একসাথে বসে আঁকছে যে ওর সবকটা রঙ-কে চেনে, সবকটা রেখা-কে, সমস্ত স্ট্রোক-কে, তাই আনিশা-কে সহজেই বুঝে ফেলছে, ধরে ফেলছে সহজেই।
-বাপি বেশি ভালো আঁকে, জিততেই পারে।
আনিশা সত্যি-টা লুকালো না, অনীত মুচকি হাসলো
-বাবাই তোর মাম্মা মন দিচ্ছে না। ফাঁকিবাজি করছে তোর মতো। নাহলে তোর মাম্মার মতো ভালো আঁকতে আমি পারি নাকি!
-সে তো কাপড়ে, তার মাপ জোপ, তার ডিজাইনে, ক্যানভাসে তো-
অনীত আনিশার দিকে তাকালো
-শর্টকার্ট চাও বলে কাপড়। ক্যানভাসে তুমিই বা কম কিসের?
অনীশ বলে উঠলো –তোমরা কম্পিট করছো, না টিম হয়ে খেলছো! কম্পিট করলে নিজেকে বেস্ট বলতে হয়, তোমরা এটাও বোঝো না!
অনীত ছেলের পিঠে হাত রাখলো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো
-কম্পিট করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি বাবা। সব হারিয়ে ফেলেছি। এইক’দিন টিম হয়ে খেলি না হয়?
আনিশা অনীতের হাত ধরলো, চাপ দিলো, অল্প করে,
-বাবাই, তোর বাপিই বেস্ট, ক্যানভাসে, সত্যি!
-আঁকে না যে! আর বাপি যে বলে তুমি বেস্ট।
-এই যে টিম হয়ে আঁকছি দু’জনে। এবার থেকে রোজ ক্যানভাস ধরবে, তাই না, নীত?
-টিম হয়ে খেললে তো রোজই ক্যানভাস ধরবো, নিশা।
-বাপি তুমি মাম্মা-কে নিশা বলো আর মাম্মা তোমায় নীত বলে, তাই না?
অনীত ছেলের নাক টেনে দিলো
-দেখেছো কেমন পাকা বুড়ো হয়েছে?
আনিশা হাসলো –দেখছিই তো, তোমার প্রশ্রয়ে।
-কী! প্রশ্রয় দিই আমি?
-দাও-ই তো। চটপট রঙ করো, নাহলে হেরে যাবে।
-আচ্ছা! মা-ও দেখছি ছেলের মতো দুষ্টুমি শিখে নিয়েছে।
আনিশা চোখ মারলো
-ছিলামই, মাঝে কয়েক বছর ভুলে ছিলাম নিজেকে, আবার ফিরে পাচ্ছি।
-আর হারাতে দিও না, কখনোই।
আনিশা কিছু বলতে যাচ্ছিলো হঠাৎ ডোর বেল বেজে উঠল।
-এখন আবার কে!
অনীত বললো –দেখছি আমি।
সৌমিক-কে দরজায় দেখে অপ্রস্তুত হলেও অনীত প্রকাশ করলো না।
-আয়, ভেতরে আয়, বিদিশা ফিরেছে?
-কাল ফিরবে এখানে, বাবাই কই!
-বালি থেকে সোজা এলি? ক্লান্ত লাগছে তোকে ভাই, বস্।
-না, না। ক্লান্ত না, ভেঙে পড়েছিলাম কিছুটা। বারবার এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি তো, বাবাই... বাবাই কই দাদা? ওকে কতদিন দেখিনি বলো তো?
-ভিতরেই আছে।
-ওহ, কাকাইয়ের গলা শুনেও বেরলো না যে। জানো বিদিশা আজ খুব করে ওর কথা বলছিলো। বিদিশা ছাড়া তো থাকতেই পারে না ছেলেটা। পড়ছে কিনা ঠিক মতো, খাচ্ছে কিনা। আমাকে পাঠালো বিদিশাই, চকোলেট নিয়ে যেতে বললো সাথে করে, কাল বিদিশা এ বাড়ি এলে নিয়ে যাবো বাবাই-কে কদিনের জন্য, বলে দিয়েছে ও।
অনীত জানে সৌমিক বারংবার সন্তান হারিয়ে এখন অবিন্যস্ত, কষ্ট পাচ্ছে ভীষণ। সৌমিক আর বিদিশার এইসময় আঁকড়ে ধরার মতো কেউ নেই। অনীশ ছাড়া।
-জল খা। চোখ মোছ। কাকাই কাঁদছে দেখলে হাজারটা প্রশ্ন করবে পাকা বুড়ো-টা।
-জানে কিছু?
-না, না। ইট ওয়াজ টু আর্লি টু টেল হিম।
-ভালো করেছো। নাহলে বিদিশা-কে গিয়ে কৌতূহল বশত কি বলতে কি বলবে, পরে তোমার আমার নামে ছেলেকে পাকানোর দায় পড়বে।
-দু’চার ঘা পিঠেও পড়বে তোর ভাইপোর তার আগে।
সৌমিক হাসলো –এতো বাচ্চা ভালোবাসে মেয়েটা, ওর সাথেই কেন দাদাভাই? তাও একবার না বারংবার...
অনীত মাথা নাড়ালো –সত্যিই কষ্টের। এরপর কি করবি ভাবলি?
-ওকে আবার এই কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে দেব না এটুকু ভেবেছি।
-তোর বাড়ি? কাকু কাকিমা?
-প্রয়োজনে আলাদা হবো। এমনিতেই কম কথা শোনায় না ওকে।
-অ্যাডপশন?
-আমি আপাতত সেটাই ভাবছি। দেখি বিদিশা কি বলে, ফিরে।
-রাজি করা। দেখার হাল নেই মেয়েটার, বারংবার এইসব হয়ে...
-তোমার বোন তুমি বোঝাবে, বকেঝকে। বাবাই-কে ডাকো না দাদাভাই।
অনীত বললো –সৌমিক... একটা কথা বলা হয়নি তোকে।
-বলো।
-আসলে বিদিশা ভর্তি ছিলো, আর এই ঘটনাগুলোও এতো দ্রুত ঘটলো যে-
-কি হয়েছে?
-তোর বৌদি এসেছে।
সৌমিক ভীষণ অবাক হলো –মানে! বিয়ে করেছো তুমি! কবে? বললে না তো!
-না, বিয়ে করবো কেন?
-তবে?
-নিশা এসেছে, মানে আনিশা।
-তোমার এক্স-ওয়াইফ? বাবাই-এর মা?
-হ্যাঁ।
-কবে? ওয়াও দাদাভাই। আজই এসেছে না বৌদি? বাবাই-কে দেখবে বলে, তাই না? কোথায় ছিলেন এতোদিন? তুমি বলতে যে অনেক দূরে, বিদেশে, নাকি? বাবাই খুব খুশি বলো মা’কে পেয়ে?
অনীত হাসলো –তা বটে। খুব খুশি। ড্রয়িং রুমে মা-ছেলেতে আঁকাআঁকি খেলা চলছে, বিকাল থেকে।
-হোল্ড অন! তাহলে বৌদি থাকছে এখানে? থাকবেও তাহলে এবার থেকে? গ্রেট নিউজ দাদাভাই! আমি বিদিশা-কে বলবো আজই। তোমাদের মান অভিমান মিটে গেছে, তাই না?
-এতো এক্সাইটেড হোস্ না, চল আলাপ করাই তোকে।
-চলো।
সৌমিক বাবাই-কে যার কোলে চেপে সোফায় বসে আঁকতে দেখলো তাকে কখনো সচক্ষে এভাবে সামনাসামনি দেখবে ভাবেনি। আনিশা মানে আনিশা গুপ্তা! দাদাভাই বলেনি তো কখনো!
-নিশা, সৌমিক এসেছে, বলি না, আমার কলিগ...
আনিশা তাকালো। বাইরে থেকে সৌমিকের গলা অনেকক্ষণই পাচ্ছিলোও
-হ্যাঁ, তোমার ভাই। সৌমিক, বসো না, প্লিজ।
-কাকাই বসো। তুমি তো মাম্মা-কে দেখোইনি কখনো। এই দেখো আমার মাম্মা, মুম্বাই-এ থাকে, স্টার। তাই না মাম্মা?
আনিশা ছেলের কথায় হেসে ফেললো –কাকাই চেনে আমায়? জিজ্ঞাসা কর তো।
সৌমিকের আশ্চর্যের ঘোর কাটেনি তখনো।
-আপনাকে তো সবাই চেনে, ম্যাম। কিন্তু দাদাভাই কখনো বলেনি...
-তোমার দাদাভাই আমাকে লুকতে চায় মনে হয়।
আনিশা মিষ্টি করে হাসলো। অনীত সোফায় বসলো। আনিশার পাশে
-নট দ্যাট। কেউ হয়তো বিশ্বাস করবে না, তাই বলি না, কোথায় তুমি আর কোথায় আমরা।
আনিশা প্রসঙ্গ বদল করলো
-তোমার ওয়াইফ ঠিক আছেন এখন?
-হ্যাঁ, কাল বাড়ি আসবে।
-ম্যাম কোথায় কাকাই! শরীর খারাপ?
সৌমিক কথা ঘোরালো –না, না বাবাই। ম্যাম বালির দাদুর বাড়ি গেছিলো তো, কাল ফিরছে।
-কি মজা! কত গল্প বাকি আছে ম্যামের সাথে, কাল আসবে তো?
-পাকাবুড়ো আমার। চল কাকাই এর জন্য চা করি আমরা।
অনীত বললো –আমি করছি...
-তুমি বসো, গল্প করো। আমি চটপট চা আর টিফিন করে আনছি, বাবাই চল্
-কোলে, মাম্মা?
আনিশা হাসলো –কোলেই! চলো এবার।
সৌমিক চুপ করে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো
-কখনো বলোনি তো।
-কি বলবো, কখনো ফিরবে, কখনো দেখা হবে আবার কে জানতো।
-বাবাই-কে অতটুকু অবস্থায় ফেলে চলে গেছে... নিজের জন্য...
অনীত মিথ্যাটার জোর কমালো
-তাতে বাবাই-এর মা ও, এই সত্যিটার জোর কমে না।
-এখন কি চায়?
-জানি না। এখন প্রতি মুহুর্ত বাঁচতে চায় বাবাই-কে নিয়ে। ওকে আঁকড়ে।
-কাস্টডি চাইবে না তো দাদাভাই? নিয়ে যেতে চাইলে?
অনীত হাসলো, সত্যির আসনে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলো কয়েকটা কথা
-চাইবে দিয়ে দেবো, তারই তো সবটুকু।
-বাবাই যে তোমার সব দাদাভাই! কি করে বলছো!
-ভালোবাসি যে।
-এখনো, এতোদিন পরেও!
অনীত গলার স্বর পরিষ্কার করলো
-দোষটা আমার ছিলো সৌমিক। আমার ব্যর্থতা ওর সফলতার পথকে কাঁটায় ভরিয়ে তুলেছিলো। দিনের পর দিন ওকে ঈর্ষা করেছি। আটকেছি, কষ্ট দিয়েছি। স্বেচ্ছায় যায়নি। আমার বদলে যাওয়ায়, অমানুষ হয়ে যাওয়ায়, গিয়েছিলো।
সৌমিক চুপ করে গেলো, দাদাভাই এমনটা করেছিলো কেন? ও-তো অফিসের শুরুর দিনগুলো থেকেই দাদাভাই-কে ভদ্রসভ্যই দেখে এসেছে এতো বছর।
-এখন আমি বদলেছি দেখে পরখ করছে কতটা বদলেছি।
-থাকছে এখানে?
-হ্যাঁ।
-মিডিয়া জানলে? এত বড়ো সেলিব্রিটি তো!
-বলেছি। কেয়ার করে না।
-লিগালি ডাইভোর্স তো তোমরা?
-হ্যাঁ। প্রায় আটবছর।
-স্ক্যান্ডেল হলে? তোমাদের কমপ্লেক্সের লোকজন দেখে ফোনে মিডিয়াকে ফ্ল্যাশ করলে?
-আমি দায় নেবো। তার জন্য ওকে ওর সন্তানের থেকে আলাদা করি কী করে?
-আর ঋষভ রায়? সবাই জানে ক’দিন পর...
অনীত মুখে আঙুল দিলো
-ঋষভ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো আর্ট কলেজে। আমি জানি সবটাই।
-তাহলে? বলোনি কিছু এই নিয়ে?
-না।
-কেন! ক’দিন বাবাই-কে ভুলিয়ে চলে গেলে ওর যে আরও কষ্ট হবে দাদাভাই। বি প্র্যাক্টিক্যাল।
-সবসময় প্র্যাক্টিক্যাল হওয়া যায় না রে সৌমিক। আমার সন্তানের মা কয়েকটাদিন তার রূপকথার উড়ান থেকে মাটিতে নেমে আমার সন্তানকে তার প্রাপ্য স্নেহ ঢেলে দিচ্ছে। আমি কি করে ওকে বঞ্চিত করি বল তো।
-এতোদিন মা’কে চিনতো না বাবাই, সামলানো যেতো। এরপর?
-এরপর ওর মা নিজেই সামলাবে বাবাই-কে।
দরজার থেকে আনিশার গলা পেয়ে চমকে তাকালো দুজনেই।
-অনীত, তোমার ভাই-কে বলো আনিশা গুপ্তা নিজের সন্তান-কে সামলাতে জানে, সামলাবেও।
-নিশা, সৌমিক আমার ভালো চায় বলেই...
-আই আন্ডারস্ট্যান্ড। ওর সংশয়-টা বুঝি আমি। বাইরে থেকে যে কারোরই মনে হবে এতোদিন পর হঠাৎ এসে কি লাভ বা উদ্দেশ্য? কিন্তু কি জানো সৌমিক জীবনের কিছু মুহুর্ত লাভ-ক্ষতির হিসাবের বাইরে কেবল বাঁচার জন্য বাঁচতে হয়। ধরে নাও এখনকার মুহুর্তগুলো এমনই।
-ম্যাম আমি ওভাবে...
-বৌদি বলো, তোমার দাদাভাই আর কখনো অন্য বৌদি আনবে না। আমি এক্স হয়ে গেলেও বৌদি বলতেই পারো তাই।
সৌমিক সাহস করে বললো
-তাহলে থেকে যাও না বৌদি, এক্কেবারে। আমার দাদাভাই খুব ভালোবাসে তোমায়।
-বলেছে তোমায় বুঝি!
-প্রায়ই বলে। আনিশা নামটা লেগেই থাকে মুখে যখন মুড ভালো থাকে। তখন তো আর জানতাম না আনিশা মানে...
আনিশা হাসলো
-চা নিয়ে আসি। চা খাও।
প্রসঙ্গের পরিসমাপ্তি চাইলো ও।
অনীত বললো –বিতান শালা জানলে কি রিয়্যাকশন দেবে বলো তো?
সৌমিক হেসে ফেললো –ব্যোমকে যাবে।
-ওর নাকি ক্রাশ না কি বলছিলো- বললাম তোর বৌদি-কে, বলে এমন তো অনেকেরই।
-খুব ডাউন টু আর্থ কিন্তু।
-কে? নিশা?
-হ্যাঁ, একদম ঘরোয়া মেয়ের মতো মনে হচ্ছে।
-সংসারটা তো ওরই, সামলাচ্ছে। এতে আর নতুন কি আছে?
-তাও, একনম্বর ডিজাইনার বলে কথা, তাও সারা ভারতের। দেমাক কত থাকে জানোই তো সেলেব লোকজনের।
-জানি, দেখেছিও, নিশা এমন নয়।
-তবুও কলকাতায় ক’দিনই বা থাকতে পারবে বলো?
-আমি একদমই এতদূরের কিছু ভাবছি না সৌমিক। জাস্ট এই কয়েকটাদিন উপভোগ করতে চাইছি। সময়ের বালি ঘড়ি-টাকে সমান্তরালে রেখেছি যেন কিছুদিনের জন্য। দেখি কি ফল হয় তাতে।
-তুমি নিজে থেকে বলবে না থেকে যেতে?
-বলার মুখ নেই। যোগ্যতাও নেই।
-বাবাই-এর জন্য, প্লিজ, আমাদের জন্য।
অনীত হাসলো –তোদের তিনজনের জন্য সব পারি। কিন্তু জোর করবো কী করে বল?
অনীশ ছুটতে ছুটতে এলো ঘরে তখনি।
-বাপি-
-হ্যাঁ, বাবাই?
-মাম্মা বললো তোমাকে ডাকতে। গ্যাস নাকি ফুরিয়ে গেছে কিচেনে।
অনীত উঠে দাঁড়ালো। তাই! চল দেখি। হেল্প করে দিই তোর মাম্মা-কে।
সৌমিক বললো –বাবাই, তুই বস্ কাকাই এর কাছে, ম্যাম চকো পাঠিয়েছে।
অনীশ এলো। সৌমিক ওকে কোলে বসালো। চকোলেট দিলো, চুমু খেলো বেশ কয়েকটা, সৌমিকের একমাত্র স্নেহের পাত্র-কে।
-কাকাই তুমি কাঁদছো?
সৌমিক তড়িঘড়ি চোখ মুছলো।
-কই, না তো।
-ম্যাম কবে আসবে?
-কাল চলে আসবে এই বাড়ি। ম্যাম বলেছে তোকে নিয়ে যেতে। কদিন থাকবি ওখানে।
-মাম্মা এসেছে যে।
সৌমিক আহত হলো। বাস্তবের আঘাত বড় কঠিন হয়। বিদিশার মুখে এই প্রত্যাখ্যান না জানি কতটা বাজবে। তবুও যার জিনিস সে চলে এলে অন্য সবার এভাবেই সরে যেতে হয় হয়ত।
-তাও ঠিক। ম্যাম-কে বলবো আসতে তবে?
-কালকেই বলো।
-কালকেই, কেন?
-কতদিন দেখিনি। মিস্ করছি যে।
সৌমিক আসস্ত হলো। বিদিশার এতো ভালোবাসা বৃথা যায়নি তবে।
-কথা বলবি?
-ফোনে? বলো, বলো।
সৌমিক বিদিশা-কে কল করলো
-বিদিশা, দেখো তোমার বাবাই তোমাকে মিস করছে খুব।
বিদিশার স্নেহ ওর মন ভরিয়ে দিলো।
-কই সে? ফোনটা দাও।
অনীশ ফোনটা নিলো –হ্যালো ম্যাম, তুমি কোথায়? কবে আসবে?
-এই তো আমি। কালই আসবো বাবাই।
-বালির দাদুর বাড়ি পচা, অনেকদূর। কাকাই-এর বাড়ি কতো কাছে আর ভালো।
বিদিশা হেসে ফেললো –তা ঠিক পচা বাড়ি থেকে চলে আসছি কালই। তুমি ঠিক করে পড়ছো তো? টেস্ট ভালো করে দিয়েছো তো?
-হ্যাঁ। কাকাই চকোও দিয়েছে।
-বাহ, কাকাই-কে হামি খেয়ে নাও তাহলে।
বিদিশা হেসে বললো।
-এই যে।
সৌমিক-কে চুমু খেলো অনীশ। বিদিশার চোখে জল এসে গিয়েছিলো, মা হওয়া হয়তো হলো না ওর আর। একমাত্র স্নেহের পুতুলটাকে খুশি করতে পারলে কষ্ট-টা কমে যাবে অনেক।
-ম্যাম, কাল স্কুলে যাব না কিন্তু।
অনীশ আস্তে আস্তে বললো।
-আচ্ছা, আমি আসবো তো, স্কুলে যেতে হবে না। ক’দিন থাকবি আমার কাছে।
অনীশ কিছু বলতে যাচ্ছিলো, সৌমিক ফোনটা নিলো। বৌদির আশা-টা বিদিশা-কে এভাবে বলা যাবে না। বাবাই-এর মনে ম্যামের জন্যই মায়ের আসনটা ছিলো ভাবে বিদিশা। সেটা এভাবে বেদখল হয়ে গেছে বা ভাগ হয়ে গেছে সেটা সামনাসামনি বলতে হবে।
-আচ্ছা, অনেক কথা হলো, এবার রেস্ট করো।
-সৌমিক—
-বলো।
-ওর হোমওয়ার্ক খাতাগুলো চেক করে আসবে, প্লিজ? দাদাভাই তো খেয়ালে চলে, দেখবেই না হয়ত।
-বেশ, দেখে নিয়ে আসবো, না হলে করিয়েও দেবো।
-থ্যাঙ্ক ইউ।
-কীসের? কাজ বাকি পরে থাকলে মারটা বাবাই খায় তৎক্ষণাৎ ঠিকই কিন্তু তারপরে মনখারাপ-টা কে সইবে শুনি? এই হতভাগা আমিটাই তো।
-কাকাই যে তুমি, তুমি ছাড়া কে সইবে? ও আমার যতটা তোমার কি কম?
-জানি তো, তাই দায়িত্বটাও ঠিক ভাবে পালন করবো।
বিদিশা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
-তোমার মা কি এখনো...
-মনখারাপ তো বটেই,
-না, বাবাই-এর দিকে মন বলে বাচ্চাকাচ্চা আসছে না এইসব...ওর মা নেই তাই...
সৌমিক চুপ করে থাকলো। বিদিশা তারপর বললো
-বাবাই-কে আমার কাছ থেকে কেড়ো না, প্লিজ সৌমিক। ওর কি দোষ বলো?
-ভাবলে কি করে? প্রয়োজনে আলাদা হবো, চিন্তা করো না।
-সত্যি বলছো?
-বলছি। তুমি এইমুহুর্তে এতো ভেবো না। কাল এসো, তোমার বাবাই-কে দেখো, কাছে নাও, সব মনখারাপ কেটে যাবে।
বিদিশাও জানে সেটা। বাচ্চা ক্যারি করতে পারছে না ও। এই জুয়ো খেলে খেলে শরীর-টাও ভেঙে গেছে। সৌমিক প্রকারন্তরে বলেই দিয়েছে আর না এসব। এবার অ্যাডপশন। সৌমিকের মা-বাবা না মানলে আলাদা হবে দু’জনে, অথচ বিদিশা জানে ওর সব মনখারাপের ওষুধ অনীশের ছোট্ট মুখে জমে আছে। ছুট্টে চলে যেতে ওর মন ছেলেটার কাছে। কাল, কালই তো, কাল কখন আসবে!
১৩
-নিশা, বাঁদরটা ঘুমোলো?
অনীত সৌমিক-কে কমপ্লেক্সের বাইরে ছাড়তে গিয়েছিলো। ডিনারের পর গল্পে গল্পে দেরি হয়ে গিয়েছিলো। ফিরেই তাই প্রশ্ন করলো।
-বাপি, বাপি করতে করতে এই ঘুমিয়েছে।
অনীত আধশোয়া হয়ে ছেলে-কে আদর করলো।
-সৌমিক এখনো সন্দিহান, আমাকে নিয়ে, তাই তো?
-না, বিদিশার জন্য চিন্তিত। এই রিপিটেড অ্যাবর্শান নিয়ে।
আনিশা বললো –সারগেসি?
অনীত হাসলো –পয়সা কই ওতো? অ্যাডপ্ট করবে বলছিলো।
আনিশা ঘুমন্ত অনীশ-কে আদর করলো।
-ভাগ্যিস আমাদের নিজেদের সন্তান আছে, তাই না অনীত?
অনীত এই ব্যাপারটা নিয়ে আনিশার বিহ্বলতা-টা বোঝে, ঘোর ভাঙিয়ে কষ্ট দেয় না তাই।
-একদম, আমাদের বাবাই।
-অনীশ। নামটাও সুন্দর।
-অনীত আর আনিশা। মেলাতে চেয়েছি। এই আর কি।
-খুব ভালো করেছো।
অনীত আনিশার দিকে তাকালো।
-কতটা ভালো করেছি আগে বুঝতাম না। এখন তোমার খুশি দেখে বুঝি।
-থ্যাংক ইউ। আমার কাছে এই সন্তান খুব জরুরি অনীত। আমার পূর্ণতার জন্য, খুব জরুরি।
-বুঝি, আমার কোন একটা সিদ্ধান্ত তোমাকে পূর্ণ করেছে বুঝে খুশিও হই খুব, বাঁচতে ভালো লাগে নতুন করে।
-আর ভালোবাসতে?
আনিশা পরখ করতে চাইলো, অনীত স্নান হাসলো
-যোগ্যতা কই?
-যদি বলি আছে?
-বেশ, কিন্তু অধিকার?
আনিশা ভাবলো একটুক্ষণ –যদি বলি অধিকারও তো আর কেউ পায়নি কখনোই।
অনীত আনিশার কপালে চুমু খেলো।
-ভালোবাসতে ভয় করে যে, নিশা। দু’দিনের খেলাঘর তো, ভেঙে গেলে কষ্ট বাড়বে বই কমবে না।
আনিশা অভিমান ভরে চোখে তাকালো।
-তাহলে আজই চলে যাই? হোটেলের রুম নেওয়াই আছে। বিল বাড়ছে রোজদিনই।
-ধুর বোকা মেয়ে, তা বলেছি নাকি।
-তাহলে! যদি বলি খেলাঘরে থাকতেই ভালো লাগছে আমার। ফাইভ স্টারের চেয়েও।
-অনন্তকাল থাকো, কে আপত্তি করেছে?
-এই ভাবেই? অধিকার ছাড়া? ভালোবাসা ছাড়া?
অনীত আনিশার চোখে চোখ রাখলো
-সবটাই তো তোমার, তুমি হাত বাড়ালেই পাবে।
-ওহ, আমাকেই হাত বাড়াতে হবে তবে?
অনীত আনিশার গালে চুমু খেলো এবার
-বাড়িয়েই দেখো না।
-আর তুমি? চুপ করে থাকবে? পাথরের মতো?
আনিশা জোরে কথা বলে ফেলেছিলো। অনীশ কেঁপে উঠলো। অনীত সন্ত্রস্ত হলো।
-বাবাই, জল খাবি?
-মাম্মা...
আনিশা সামলেছে নিজেকে ততক্ষণে।
-হ্যাঁ বাবাই?
-বাপি-কে বকো না। বাপি ভালো। বাপি বেস্ট। আমার বাপির মতো আর কেউ নেই।
অনীত জল এনেছিলো ততক্ষণে।
-এই নে, জল খা।
অনীশ ঘুম চোখে উঠে খেলো। আনিশা শুইয়ে দিলো আবার। অনীত বললো-
-এবার ঘুমো।
-উ। মাম্মা... ঝগড়া ভালো না। বড়দের ঝগড়া-কে ডিভোর্স বলে বলো? তোমার আর বাপির ডিভোর্স হয়ে গেছে...
কথা শেষ করার আগেই অনীত একটা থাপ্পড় কষালো ছেলেকে, জোরে, কঁকিয়ে উঠলো অনীশ।
-নীত! কি হচ্ছে এটা?
-এই, বাঁদর, বড়দের কথা বেশি শিখে গেছিস না। কোত্থেকে শিখেছিস এগুলো? স্কুলে! দাঁড়া তোর স্কুলে কথা বলছি কাল, বিদিশা-কে বলছি।
-নীত, স্টপ ইট। ভয় পাচ্ছে ছেলেটা, কাঁদছে। তুমি ও ঘরে যাও, আমি দেখছি।
আনিশা ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছিলো।
-সহবত শেখাও ওকে নিশা। বড্ড বেশি পেকে গেছে। পুরনো চিন্তাভাবনার মানুষ আমি, তোমার মতো বন্ধু হতে পারি না ওর। বড়দের মতো কথা বললে, বড়দের কথায় কথা বললে বাপির হাতে মার খাবে খুব। বুঝিয়ে দিও, তোমার ছেলেকে।
অনীত চলে গেলে আনিশা দেখলো আনিশা-কে আঁকড়ে ধরেছে ছেলেটা, ভয়ে, কাঁদছেও। আনিশা গায়ে মাথায় হাত বোলালো। অনীতের রাগটা বড্ড বেশি। আনিশার কষ্ট হচ্ছিলো।
-বাবাই- কাঁদে না, এই তো আমি।
-সরি মাম্মা। আমি তো জানি না ওটা বড়দের কথা। স্কুলে আজ বললো তাই-
-বুঝেছি। আমি বাপি-কে বুঝিয়ে দেবো।
-বললো তোর মাম্মা এতোদিন কোথায় ছিলো, হঠাৎ ফিরে এসেছে, বাপি আর মাম্মার ডিভোর্স হয়ে গেছে কি- বড়দের ঝগড়া হলে তো নাকি ডিভোর্স হয়ে যায়।
-বুঝেছি। ওরা ভুল বলেছে। আমাদের অল্প আড়িই হয়েছিলো। এখন ভাব হয়ে গেছে।
আনিশা ছেলেকে আদর করছিলো।
-সত্যি!
-একদম সত্যি। কোথায় মেরেছে বাপি, দেখি?
-এই যে...
-ব্যথা?
-খু-ব।
আনিশা অনেক ক’টা চুমু খেলো অনীশ-কে।
-বাপিকে আমি বুঝিয়ে দেবো।
-বকেও দেবে।
আনিশা হেসে ফেললো –বেশ, বকেও দেবো। তবে তুমি আর এই কথাটা বলবে না কেমন?
-আচ্ছা।
অনীত ঘরে এলো আবার –এখনো ঘুমোয়নি?
বাবাই আনিশা-কে আঁকড়ে ধরলো। মাম্মার বুকে মুখ লুকিয়ে ফেললো।
-না, যে মেরেছে সে আদর না করলে ছেলে ঘুমোয়।
অনীত কথা বাড়ালো না। ছেলেকে মেরে ওরও মন খারাপ করছিলো। অনীশের গায়ে হাত বোলালো ও।
-বুঝিয়ে দিয়েছি ওকে ব্যাপারটা। স্কুলেই শুনেছিলো, আর বলবে না।
-স্কুলে কমপ্লেন করবো দেখো।
-নীত! থাক না। আমরা তো আছি। কোনটা ঠিক কোনটা ভুল বোঝাবার জন্য। বাপি আর মাম্মার আড়ি হয়ে গিয়েছিলো। ডিভোর্স না সেটা বোঝাতে স্কুলে যেতে হবে নাকি।
অনীত বুঝলো আনিশা এইভাবেই ছেলেকে বুঝিয়েছে।
-তা ঠিক। আর এখন তো ভাব হয়ে গেছে।
-তাহলে মাম্মা থাকবে তো এখানে সবসময়?
অনীশ তড়াক করে পাশ ফিরে বললো। আনিশা আর অনীত দু’জনেই হেসে ফেললো।
-দেখেছো কেমন দুষ্টু তোমার ছেলে?
আনিশা চোখ মুছলো –দেখছি তো তাই। ঠিক নিজের আসল কথায় চলে এসেছে।
-ভাব হয়ে গেছে তো মাম্মা, থাকবে তো, বলো?
অনীত আনিশার দিকে তাকালো। আনিশা অনীশ-কে অনেক কটা চুমু খেলো।
-যতটা পারি, থাকবো, বাবাই।
-সবসময়, প্লিজ, সব্বাই থাকে এমন, মাম্মা। সব্বার মা থাকে।
অনীত বুঝলো আনিশার কষ্ট হচ্ছে। নিজে হাল ধরলো তাই,
-কাজের বাইরে থাকবে তো, সবসময়।
অনীতের এই স্তোতবাক্যে ঘুমিয়ে পড়লো অনীশ। কিছুক্ষণের মধ্যে,
-নিশা...
-বলো।
-সরি- হঠাৎ করে ডিভোর্স টিভোর্স বলে ফেলল-
-বুঝেছি।
-রাগ করোনি তো? মারলাম তোমার ছেলেকে?
-না, শাসনের প্রয়োজন আছে, তবে একজন শাসন করলে অন্যজন-কে আশ্রয় দিতে হয়। বোঝো তো?
অনীত মাথা নাড়লো।
-বুঝতাম না, এখন বুঝি।
-বেশ, মা-বাবা হওয়াটাও অন্যরকম অনুভূতি না অনীত?
-হ্যাঁ, আর একসাথে আমরা দু’জন –এটাও খুব সুখকর।
-এটা থাকবে আজীবন। তাই না?
-হ্যাঁ, থাকবে। অবশ্যই।
-তুমি অনেক স্থির হয়েছো।
অনীত হাসলো –ভালোবাসায় তো?
-হুম।
-তোমার ছেলের বাবা হয়েছি যে। বাবাদের স্থির হতে হয়।
-মায়েদেরও। আবেগ-কে ধরে রাখতে হয়।
অনীত আনিশার হাতে চুমু খেলো –মনকেও স্থির করো, নিশা।
আনিশা অনীতের হাত জড়িয়ে ধরলো। অনীতের এতো কাছে এক বিছানায় – মন চঞ্চল হওয়া আনিশা আর কারোর শরীর চায়নি কোনদিনই।
-করছি, যতটা পারি।
-আমি আছি, থাকবো, সবসময়।
-সেটাও জানি।
-তুমি নিজে কি চাও সেটা জানো আগে। জেনে বুঝে এগোও। আমি পালিয়ে যাচ্ছি না।
আনিশা জানতে বুঝতেই চাইছে না আর। অঙ্কও কষতে চাইছে না। যা হাতের কাছে আছে, একান্ত নিজের, খড়কুটোর মতো কুড়িয়ে নিতে চাইছে, গুছিয়ে নিতে চাইছে। অনীত বদলে গেছে, অনেক বদলে গেছে। কিন্তু এই বদলে যাওয়া প্রেমিক অনীতকে এখন মন চাইছে না, চাইছে আগের অনীত-কে, স্বামী অনীত। যে অধিকার ফলাতে জানে, কাছে টানতে জানে, দস্যুতা করতে জানে, ঠিকভুলের সীমানা পার করে তাকে পেতে চাইছে আনিশা, সবসময়। অথচ এই অনীত সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ। সংসারী, হিসেবি, মনের চেয়ে মগজ দিয়ে চলে। এমন অনীতই চেয়েছিলো আনিশা, তাহলে চেয়ে এখন মন মানছে না কেন? আনিশার মনের এই উথালপাথাল যে বুঝতে পারছে তার কাছে নির্লজ্জ হতেও কোথাও আটকাচ্ছে যেন। তাই অনেককিছু বলার থাকলেও আনিশা বললো-
-ঘুমোও। গুড নাইট।
ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো আনিশার। ভীষণ বৃষ্টি পড়ছে, ছেলেটা ওর বুকের উপর উঠে ঘুমিয়ে পড়েছে। মনে মনে হাসলো আনিশা। বাবার কাছে মনে হয় এভাবেই শোয় পাগলটা। ওর বাপি কই! তাকাতেই দেখে অনীত জেগে গেছে আগেই, পাশে বসে আছে।
-এত ভোরে উঠলে?
-ঘুম আসছিলো না। তোমার লাগবে নিশা, অভ্যাস নেই তো। এভাবে আমার কোলে শোয়। দাও, আমাকে দাও।
আনিশা হাসলো –থাক কষ্ট হচ্ছে না। বরং ভালো লাগছে। এতোদিনে মা হতে পেরেছি মনে হচ্ছে।
অনীত বললো –আলবাৎ হয়েছো।
-আমি পারবো তো নীত?
অনীত আনিশার পাশে শুয়ে পড়লো, দূরত্ব রেখেই। ওর সংশয় কাটালো-
-আলবাৎ পারবে। পারছোও তো।
-এত কাজ যে চারিদিকে... ওর জন্য সময় কম পরে যাবে না তো?
-তুমি ঠিক ব্যালেন্স করতে পারবে আমি জানি।
আনিশা ছেলেকে সন্তর্পণে মাঝে শোওয়ালো।
-এতগুলো বছর অনেক কষ্ট পেয়েছে আমার ছেলে। আর পেতে দেবো না।
-এবার একটু আমাকে দাও। আদর করি, ব্যাটাকে।
-তোমার কাছেই তো থাকে।
-তো নিয়ে যাও, যদি তোমার মন চায়।
-তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবে নাকি? তুমি যাবে? চলো না, ওখানে ঠিক কাজ পেয়ে যাবে...
অনীত বললো –তুমি দেবে কাজ? তোমার কোম্পানিতে?
আনিশা অবাক হলো –করবে তুমি?
-কেন করবো না। তোমারই তো দেওয়া কাজ, এতে না করার কি আছে!
-তোমার কোথাও আটকাবে না তো?
অনীত এবার আনিশার ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো, চুমু খেলো ওকে। গভীর ভাবে, বিস্মৃতকাল পর। আনিশা কেঁপে উঠেছিলো অনীতের স্পর্শে, বুঝতে পেরেছিলো অনীত।
-আটকালো? অধিকার পেলে আটকাবে কেন?
আনিশা অনীতের দিকে তাকালো –যাবে, তবে?
-তুমি সব সিদ্ধান্ত ঠিক করে নিলে নিশ্চয় যাবো।
আনিশা অনীতের হাত ধরলো।
-আমি নিজেই ঠিক ভুল বুঝি না যে নীত।
অনীত আনিশার দ্বিধা বুঝলো- সময় নাও। সময়ই উত্তর দেবে।
-আজ তো সব্বার ছুটি, না।
প্রসঙ্গ পরিবর্তনে তাকাল অনীত –হ্যাঁ। সবার ছুটি। আমার অবশ্য পায়ে ব্যথা বলে ছুটি। ওয়ার্ক ফর্ম হোম।
-ছেলে কোথাও ঘুরতে গেছে?
-ঘুরতে... নাহ্, তেমন না। আমি তো ছুটিই পাই না তেমন।
-তাহলে চলো না আজ কোথাও ঘুরে আসি ওকে নিয়ে, কাছে পিঠে।
-তোমাকে লোকে চিনে ফেলবে যে।
আনিশা ভাবলো –দূরে চলো। নাইট স্টে। রায়চক, ডায়মন্ড হারবার, ফলতা।
অনীত ভাবলো একটু, তারপর বললো
-তোমার কাল কোয়েস্ট মল যে।
-উফ্, সে তো দুপুরে, বলো না – ছেলের টেস্ট নেই তো?
-না।
-তাহলে চলো। দেখোনা এই বর্ষা। এর মধ্যে নদীর ধারে আউটিং... খুব ভালো লাগবে।
-তুমি চাও তো? তাহলে তাই হবে।
আনিশা তাকালো -আর তুমি?
-তুমি যা যা চাও... সব চাই।
-কেন? প্রায়শ্চিও? এতোদিন যা যা চেয়েছি করতে দাওনি, তাই?
-উঁহু, ভালোবাসা।
আনিশা এবার অনীতের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট দুটো মেলে ধরলো। অনেকক্ষণ চুমু খেলো দু’জনে। হু হু কান্নার মতো চোখ দিয়ে জলও পড়ছিলো অবিশ্রান্ত। দুজনেরই। বাইরের বর্ষা-কে হার মানাচ্ছিলো তা। অসংখ্য কেনর ভিড় ঘিরে ধরেছিলো উভয়কেই। নষ্ট হয়ে যাওয়া আটবছর কৈফিয়ত চাইছিলো। অনীতকে ছেড়ে ছেলেকে আদর করতে শুরু করলো আনিশা। অনীতও সঙ্গ দিলো। বাইরে বৃষ্টিও অবিশ্রান্ত আদরের মতো ঝরে পড়তে থাকলো। আট বছর পর ভালোবাসার মেঘের যেন বর্ষা হলো ওদের ঘরে।
১৪
বিদিশার মন বালির বাপের বাড়ি থেকে সৌমিকের বাড়িতে এসে ভালো হওয়ার বদলে আরও খারাপ হয়ে গেলো। শ্বশুর-শাশুড়ির মুখ কালো, যথারীতি। বারবার অ্যাবর্শান হওয়া যেন বিদিশার হাতে। মস্ত অন্যায় করে ফেলেছে-ও, তার উপরে আজই বাবাই-এর কাছে যাবে শুনে শাশুড়ি বলেই ফেললেন
-নিজে ক’দিন রেস্ট নাও তো বাপু। মা-হারা ছেলের মা হতে গিয়েই তো এই দশা হচ্ছে বারবার।
বিদিশা খাচ্ছিলো। গ্রাস-টা মুখে তুলতে গিয়েও আটকে গিয়েছিলো যেন। সৌমিক অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলো। যাওয়ার পথে ও বিদিশাকে বাবাই-এর কাছে দিয়ে আসবে, এটাই ঠিক ছিলো।
-মা, এভাবে কেন বলছো?
-আর কিভাবে বলবো, নিজেদের ভবিষ্যতের চিন্তা না করে পরের ছেলে মানুষ করতে যাওয়া কেন? এই ছোটাছুটি-তেই তো হচ্ছে এসব।
-এবার তো শুরু থেকে রেস্টেই ছিলো। আর পর কে মা? বাবাই-কে তো আমি বা বিদিশা পর ভাবি না, নিজেরই ভাবি।
-তাহলে আর কি, নিজের সন্তানের দরকার নেই তবে। ওকে নিয়েই চলে যাবে।
বিদিশা খাওয়ার ফেলে উঠে পড়লো, সৌমিক বললো
-খাওয়ারের উপর রাগ করো না, শরীর খারাপ করবে তো।
-পেট ভরে গেছে, তুমি রেডি হলে জানিও, বেরোবো।
বেরিয়ে উবেরে সৌমিক লক্ষ্য করলো বিদিশার চোখ ছলছলে। একহাতে জড়িয়ে ধরলো তাই।
-মনখারাপ কোরো না, মা আপসেট বলেই এমন...
-এটা নিত্যদিনের গঞ্জনা। তুমি হয়ত আজ প্রথম শুনলে, তাই খারাপ লাগছে তোমার। এরপর বাবাই-কে আর তোমাদের বাড়িতে আনব না সৌমিক। কি না কি বলে দেবে তোমার মা ওর সামনে...
-আই আন্ডারস্ট্যান্ড, এনো না, তুমি থাকো, যতটা পারো।
বিদিশা অবাক চোখে তাকালো।
-তোমার আপত্তি বা ক্ষোভ নেই তো সৌমিক?
-ধুর পাগলি, পাঁচ বছরে এই চিনলে আমায়? শোনো না, তোমায় একটা কথা বলার আছে, ফোনে বলতে চাইনি
-বলো।
সৌমিক জানে বিদিশার কাছে বিষয়টা অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত এবং ওকে আহতও করবে। বাবাই-এর সাথে বিদিশার সম্পর্কের ভাগীদার যে আর দূরবাসিনী নয়, অনীশের অদেখা কল্পনা মাত্র নয় বরং বাস্তব এবং ভীষণভাবেই বাস্তব হয়ে ফিরে এসেছেন অনীশের জীবনে সেটা বিদিশা জানলে হয়ত আরও ভেঙে পড়বে।
-দাদাভাই-এর বৌ মানে এক্স ওয়াইফ এসেছেন, মুম্বাই থেকে।
-আনিশা... মানে আনিশা বৌদি?
বিদিশা ভীষণ অবাক হলেও সামলে নিলো।
-হ্যাঁ।
-কলকাতায়?
-হ্যাঁ, দাদাভাই-এর বাড়িতেও। ক’দিন থাকবেন শুনলাম।
-ওহ। তুমি দেখেছো তাকে?
সৌমিক বিদিশার হাতে হাত রাখলো। বিদিশা চুপ করে ছিলো। তারপর বললো
-বাবাই খুব খুশি, না?
-হবেই। এতো বছর যাকে চেয়েও পায়নি, সে সামনে চলে এলে খুশি তো হবেই।
বিদিশা আবেগের দরজায় খিল দিলো। কাকের ঘরে কোকিলের বাসা ছিলো এটা, মা কোকিল চলে এসেছে তাই খেলাও শেষ। তবে যদি ও যেটা ভাবছে তা ঠিক হয়, তার মা কোকিলের সত্যি-টাও দেখতে হবে পরখ করে।
-ভালো তো, যার জিনিস সেই দেখে রাখুক। সেটাই ভালো।
সৌমিক বিদিশা-কে কাছে টেনে আনলো।
-দিন সাতেকের জন্য এসেছে।
চমকে তাকালো বিদিশা।
-চলে যাবে আবার?
-হ্যাঁ, মুম্বাইয়ে। ওনার অনেক কাজ ওখানে। দাদাভাই-এর সাথে তো আইনত বিচ্ছেদ হয়ে গেছে।
-দাদাভাই-এর থেকে বাবাই-এর কাস্টডি চায় যদি?
ইচ্ছা করেই বললো বিদিশা।
-মনে হয় না চাইবে। তার জগৎ-টাই যে আলাদা। ক’দিনের পুতুল খেলাই মনে হল দেখে। খেলা হলে, ফিরে যাবে।
বিদিশা ভুরু কুঁচকে তাকালো। অনীতদা’ ওর কলেজের সিনিয়ার, অনীতদা’ চিত্রাঙ্গদা ম্যামের বাড়ির টুকটাক আসতো, অনীতদা’র প্রাক্তন স্ত্রী-কে সেটা ওর অজানা নয়। তবে সে ফিরে আসবে সেটাও অবাস্তব মনে হচ্ছে। কারণ সারা মিডিয়াময় খবর তার বিয়ে সামনে। অনীতদা’র বেস্ট ফ্রেন্ড আর চিত্রাঙ্গদা ম্যামের ছেলের সাথে। তাই তার ফিরে এসে অনীতদার ঘরে উঠে পড়া অসম্ভবই মনে হচ্ছে বিদিশার।
-তুমি দেখেছো?
-বৌদি-কে?
-হ্যাঁ।
-দেখেছি তো, কথাও বলেছি অনেকক্ষণ। ডিনারও খাইয়েছে কাল।
-বলোনি তো?
সৌমিক মুচকি হাসলো
-এই তো বলছি।
-মানুষ কেমন?
-কয়েকঘন্টায় কী বুঝবো? তবে তুমিও চেনো তাকে বিদিশা।
বিদিশা থমকে গেল –আমি কি করে চিনবো? কী সব বলছো? দাদাভাই-কে কলেজের সিনিয়ার হিসাবে ওই মুখচেনা চিনতাম মাত্র। দাদাভাইয়েরও তো মনে নেই সেসব।
-মানে সবাই চেনে। সেলেব উনি। স্টার।
-হোয়াট? দাদাভাই-এর বৌ স্টার? বিদিশা অবাক হওয়ার ভান করলো।
-এই দেখো যেমন তুমিও বিশ্বাস করছো না, তেমন আমিও করিনি।
স্বচক্ষে দেখেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো। দাদাভাই এতো সাধারণ জীবন যাপন করে অথচ...
বিদিশা অধৈর্য্য ভাবে দেখলো –কে উনি?
-আনিশা গুপ্তা। দ্যা ফ্যাশন ডিজাইনার অফ ইন্ডিয়া। চেনো তো?
বিদিশার আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হলো। আনিশা ম্যামই এসেছেন তবে। এতক্ষণ ভাবছিলো অন্য কোন মেয়েকে দাদাভাই হয়তো বিয়ে করবে। তাই বৌদি পরিচয় দিয়েই নিয়ে এসেছে। তার নামই আনিশা বলেছে ছেলে-কে ভোলানোর জন্য। কিন্তু তা তো নয়, আনিশা গুপ্তাই এসেছেন। কিন্তু কেন? ক’দিন পরই না ঋষভ রায়ের সাথে বিয়ে ওনার? এখানে কেন তবে?
বিদিশা কিছুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলো।
-বিদিশা...
-হুঁ... ওহ, হ্যাঁ। কে না চেনে ওনাকে। উনি দাদাভাই-এর বৌ? গ্রেট সারপ্রাইজ।
-দাদাভাই ছুপা রুস্তম, বলতে পারো?
-হ্যাঁ, গিয়ে বলবো। আনিশা গুপ্তার কলকাতা আসা নিয়ে তো খুব হই চই চারিদিকে, এর মধ্যে এই মধ্যবিত্ত পাড়ার সাধারণ অ্যাপার্টমেন্টে মিডিয়া...
-আমিও বলেছিলাম, বললো সমস্যা নেই।
-স্ট্রেঞ্জ।
-এসব মিডিয়া ম্যানেজ করতে ওনারা ভালোই পারেন।
-বাবাইকেও ম্যানেজ করে নিচ্ছেন নিশ্চয়, ভালোভাবেই।
সৌমিক ঘাড় নাড়লো।
-হোপ সো। আমি যতটা দেখেছি দারুণ বন্ডিং দুজনের। এতবছর দেখেননি ছেলেকে বোঝায় যায় না। তবে...
-তবে?
-বাবাই সর্বক্ষণ ম্যামের নাম করে চলে যে কোন প্রসঙ্গেই। দাদাভাই-ও বলে তোমার কথা। সেই শুনে শুনে তোমার ব্যাপারে উৎসুক, দেখা করতে চান।
-তাই নাকি? বাহ্, আমারও দেখা করার ইচ্ছা বহুদিনের। এতো সফল বাঙালি মেয়ে বলে কথা।
উবের ততক্ষণে ডেস্টিনেশনে পৌঁছে গেছিলো। ভাড়া মিটিয়ে দু’জনে অনীতের ফ্ল্যাটের সামনে যেতেই খেয়াল করলো দরজা লকড। আর কলিং বেল টিপেও উত্তর আসছে না। উল্টোদিকের ফ্ল্যাটটা তো বন্ধই থাকে। মালিক ব্যাঙ্গালোরে।
-বাবাই আজ স্কুলে যায়নি, বললে তো।
-হ্যাঁ, আর দাদাভাই-এর পা-এ লেগেছে বেশ। সাতদিন ছুটিতে আছে। ওয়ার্ক ফর্ম হোম।
-তবে? কোথায় গেলো?
-অবাক ব্যাপার তো। দাঁড়াও কল করছি দাদাভাই-কে।
সৌমিক কল করলো। রিং হচ্ছে। অনীত কল ধরলো
-বল্।
-তোমরা কোথায়? ফ্ল্যাটে তালা দেওয়া। বিদিশা আর আমি এসেছিলাম তো।
-ওঃ হো। বিদিশা আসার কথা ছিলো না, আজ?
-হ্যাঁ, কালই তো বলেছিলাম তোমায়।
-শোন না ভাই। নিশা বললো একদিনের আউটিং প্ল্যান করলে কেমন হয়, আজ ভোরেই। হঠাৎ করে বেরিয়ে চলে এলাম রায়চক। একটু বুঝিয়ে বল বিদিশা-কে, কেমন?
-একটা টেক্সট তো ছাড়তে পারতে?
-জানিসই তো আমি কেমন ভুলো, সরি রে।
-ওকে।
ফোন রেখে তাকালো সৌমিক।
-কি বললো?
-রায়চক গেছে। দাদাভাইরা, আউটিং-এ।
-হুট করে?
-হ্যাঁ, দাদাভাই-এর তো আর মধ্যবিত্ততা নেই যে প্ল্যান করতে হবে, উঠলো বাই তো কটক যাই।
বিদিশার মুখ দেখে সৌমিক কষ্ট পেলো
-কী করবে? বাড়ি যাবে!
-নাহ।
-তবে?
-পিউদের বাড়ি ড্রপ করে দিও আমায়। অনেকদিন দেখা হয়নি ওর সাথে, কালকেও বলছিলো আসতে।
-ঠিক আছে।
-তোমার মা ঠিকই বলেন হয়তো সৌমিক। পরের জিনিসের জন্য এতো টান রাখা ভালো নয়।
-বিদিশা, বাবাই-এর কি দোষ এতে? ওর মা এসেছে, ও খুশি, তা বলে ম্যামও ওর খুব প্রিয়।
-ম্যাম আর মা – অনেক ফারাক যে।
সৌমিক চুপ করে থাকে।
-একটা কথা বলি?
বিদিশার কথায় তাকালো সৌমিক।
-বলো।
-ক্যান উই গো ফর অ্যাডপশন? তুমি বলছিলে সেদিন, তোমার মা-বাবা চাইবেন না জানি।
-তুমি চাও তো?
বিদিশা মাথা নাড়লো।
-হ্যাঁ, আমি চাই।
-তাহলে সেটাই হবে। আসলে আমিও তাই চাই। তোমাকে বারবার এই কষ্টের মধ্যে ফেলতে চাই না আমি।
-সে পরের হবে না, নিজেরই হবে বলো? স্বীকৃত ভাবে?
বিদিশাকে বুকের মধ্যে টেনে নিলো সৌমিক
-হ্যাঁ, নিজের হবে, এক্কেবারে। তবে বাবাই-ও ওপরের নয়, বিদিশা। বছর দুই-আড়াই থেকে বছর সাত-আট তুমিই করেছো, মনে রাখবে, সবসময়...
-কোন স্বীকৃতি নেই যে সৌমিক।
-আছে তো। ভালোবাসার স্বীকৃতি আছে। বিদিশা, দুষ্টু-টা ফিরুক, কীভাবে তোমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, দেখবে। যে আসবে, তাকে আনব আমরা। কিন্তু যে আছে তাকেও তুমি অভিমানে দূরে সরিয়ে দিও না।
-আমি সেটা পারবো, ভাবলে কি করে!
সৌমিক হেসে ফেললো
-চেষ্টাও করবে না একদম, কথা দাও। বৌদির এসব ক’দিনের বিলাসিতা। আবার কাজে ডুবে যাবে। তুমি না থাকলে দেখবে কে ওকে?
-বলছো?
-বলছি। তাছাড়া ঋষভ রায়ের সাথে বিয়ে, সামনেই... মিডিয়ার সবাই জানে।
-দাদাভাই-ও জানে?
-জানে, জেনেও না জানার ভান করে খেলনাবাটি খেলছে, খেলুক। ক’দিনের তো ব্যাপার।
-তুমি বলোনি? বারণ করোনি!
-করেছি। কিন্তু ভালোবাসা মানুষ-কে দিয়ে অনেক অবান্তর কিছু করিয়ে নেয়। জানোই তো।
-বাবাইটার কতটা ট্রমা হবে বলো তো, যদি এমন হয়?
-আমরা আছি তো। সামলে নেবো, কী পারবে না?
বিদিশা সৌমিক-কে আঁকড়ে ধরলো
-কী হলো? এতো ভালোবাসো? বিদিশা?
-অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ আমাদের। জানতাম না ঠিক করছি না ভুল। পাঁচবছর পর বলতে দ্বিধা নেই তুমি আমার জীবনের সবচে বড় ঠিক সৌমিক।
-অনারড, মাই লাভ। চলো তোমায় ড্রপ করে দিয়ে অফিসে যাই।
সৌমিক বললো। বিদিশার মনে কয়েকটা প্রশ্নের কাঁটা খচখচ করতেই থাকলো।
১৫
রায়চকের রিসর্টে এসে অনীশের খুশি আর বাঁধ মানছিলো না। খোলামেলা জায়গা পায় না খুব একটা। স্কুলেও বিদিশার কড়া নজর থাকে। এখানে ছুটে খেলে বেরিয়েছে সারাদিন। আনিশা ও-কে সুইমিংপুলেও নামিয়েছিলো। বাচ্চাদের ছোট্ট টাব পুলে। নিজেও ছিলো ছেলের সাথে সবসময়। বাপি কোনকিছুতেই না করছে না দেখে বেজায় খুশিতে ছিলো অনীশ।
বিকালে রিভার বোর্ট রাইডিং-এ বেরোবে ওরা, আনিশা-কে একটু বিরক্ত লাগছিলো অনীতের। টেক্সট করছে, দ্রুত টাইপ করছে, যেন কারোর সাথে ঝগড়া করছে। চোখ মুখও লাল, বেশ।
বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো অনীত। ছেলে ঘুমোচ্ছে, লাঞ্চ করেছে একটু আগেই। আনিশা এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো,
-কী ভাবছো?
অনীত তাকালো –ভাবছি তোমার মুড অফ হয়ে গেলে কি করে ঠিক করতে হয় যেন!
-মুড অফের কারণ তো নেই এখন।
-টেক্সটগুলো করার সময় কিন্তু বেশ রাগরাগই ফুটে উঠছিলো চোখেমুখে।
আনিশা হাসলো। সে হাসির জোর নেই।
-তোমার চোখ-কে কি করে ফাঁকি দেবো? তুমি তো আমার প্রত্যেকটা আবেগ চেনো।
-মা?
-মা, বাবা, আরো অনেকেই...
-আচ্ছা, কি চান?
-কাজ, কাজ আর কাজ। আর কোথায় আছি কি করছি তার কৈফিয়ত।
-দিলে কৈফিয়ত?
-কেন দেবো? কটা দিন শান্তি-তে কি থাকতে পারবো না এদের জন্য?
-তোমার যেন কোন ক্ষতি না হয়, নিশা।
-ভয় পাচ্ছো?
-একটুও না। তোমার জন্য সারা দুনিয়ার সাথে লড়তে পারি। তবে তোমার গায়ে যেন আঁচড় না পরে এটাই ভয়। সন্দেহ করছে কিছু?
-তোমাকে নিয়ে? না, না। অতোটা ভাবার মতো ক্ষমতা নেই ওদের। তবে ডিসিপ্লিনড লাইফের বাইরে গেলেই ওদের মাথা ব্যথা হয়। আয়টাও কিছু কমে বলেই হয় তো।
-সোনার ডিম পাড়া হাঁস আর কি।
-ভালো বলেছো, খাঁচায় বন্দীও। বললাম কালই কোয়েস্টে যাব, তাও আজ অমুক হিরোইনের সাথে একটু গুগল মিট করে নিলে হয় না আপকামিং মুভির ড্রেস নিয়ে! ডিসগাস্টিং! কতবার বলেছি –এই কটা দিনই তো, একটু স্পেস চাই, কিন্তু-
অনীত আনিশা-কে কাছে টেনে নিলো, শান্ত করলো বুকে জড়িয়ে ধরে।
-ওসব ছাড়ো। আজ কত মজা হলো বলো দেখি।
-তোমার ছেলে মজা পেয়েছে খুব, স্পেশালি পুলে।
-উঠতেই চাইছিলো না, এমন খোলামেলা তো পায়নি আগে।
-এবার থেকে পাবে। জানো নীত, আমার বাংলো-তে অনেক বড় খেলার মাঠ আছে, পুল আছে, খেলার জন্য ছোট্ট ছোট্ট পাগুলো ছিলো না এতোদিন। এবার চলে এসেছে।
অনীত আনিশার নাকে নাক ঘষলো
-বাংলোতে তোমার মা বাবা আছেন, ভুলে যাচ্ছো? অপছন্দের অনীত আর তার সন্তান... ভাবতে পারো সেখানে?
-আমি বোঝাবো।
-না বুঝলে? কত জটিলতা বুঝতে পারছো?
-জটিল ভাবলেই জটিল। এই, শোননা...
অনীত তাকালো –বলো।
-কলেজে থাকাকালীন কিন্তু তোমাকে বেশ পছন্দই ছিলো মা-বাবার।
-তা বটে, প্রসপেক্ট ছিলো, শুনেছিলেন লোক মুখে। ঘোড় দৌড়ে জিততে পারে এমন ঘোড়ার উপরই তো বাজি লাগায় সবাই, তাই না? আমি তখন তেমন ছিলাম।
-এখনো আছো। এইবার ক্যানভাসটা ধরো, প্লিজ।
-ধরবো, তুমি থাকলে তাড়াতাড়িই ধরবো।
-আছি তো, তোমার পাশে। আগেরবারও স্বেচ্ছায় যাইনি নীত।
অনীত দীর্ঘশ্বাস ফেললো
-বদলে গিয়েছিলাম অনেক, আবার তোমার মনের মতো হতে চেয়েছি, এই আটবছরের দূরত্বে, পেরেছি তো বলো? সেই তোমার কলেজের নীতের মতো? যাকে ভালোবেসেছিলে।
আনিশা অনীতের চোখে জল দেখলো।। মুছিয়ে দিলো সযত্নে
-পেরেছো, অবশ্য-ই পেরেছো।
-তবে? এর পরেও যেতে হবে?
অনিশা অনীত-কে আঁকড়ে ধরলো। অনীতের মনের গোপনতম কথাটা শোনার পর
-কক্ষনো না। আমি চাই না সরে যেতে, বিশ্বাস করো।
-বিশ্বাস করি। তুমি না চাইলেও পারিপার্শ্বিক আর বাকিরা চাইবে, নিশা। তোমাকে কেড়ে নিতে চাইবে।
-লড়বো। একসাথে। হবে?
-খুব হবে। লাঞ্ছনা, গঞ্জনা আমি গায়ে মাখি না কখনোই। তুমিও সয়ে নিও কিছুটা- তাহলেই হবে, পারবে না?
-পারবো, খুব পারবো।
-তবে আর ভয় কিসের? তুমি শুধু স্থির থেকো নিশা, তাহলেই হবে।
-থাকবো।
-আচ্ছা, আমরা এখানে না বেড়াতে এসেছি? আমার না হয় পায়ে চোট, তোমাদের মা ছেলের মজার মাঝে এসব ভারী ভারী কথা কেন?
আনিশা হেসে ফেললো।
-ব্যাটা ঘুমোচ্ছে যে।
-রেডি করাও, ঘুম থেকে তুলে। ওর বাপি পত্রিকা অফিসের কলুর বলদগিরি করতে গিয়ে ও-কে এসব কিছুই দেবার সময় পাইনি, নিশা। তুমি এসেছো- এবার তুমি ভরিয়ে দিও ওকে।
-দেবো, নিশ্চিত থেকো। ব্যাটা যাবে রিভার গাইডে তার বাপি যাবে না!
-বাপি তো যাবেই, ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে।
-বাইক আস্তে না চালালে এবার দেখো কি হয়!
-এই বকুনি দেবার লোকটা যে আটবছর ছিলো না, এবার এসে গেছে, আর হবে না।
-রেডি হও, এবার।
অনীত প্রাণ খুলে হাসলো। আটবছর মুছে গিয়ে যেন নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে ও। আনিশা-কে পাশে পেয়ে আবার।
রিভার বোটিং থেকে ফেরার সময় বাপির পিঠে চড়ে আসছিলো অনীশ। এতো ফাঁকা, এতো সবুজ, এতো সৌন্দর্য আগে কখনো দেখেনি অনীশ। বাপি-কে এতো খুশিও দেখেনি কখনো। মাম্মা এসেছে বলেই সব এত ভালো হচ্ছে। মাম্মা থাকলে তাহলে আরও ভালো হবে।
-বাপির পিঠে চেপে চুপচাপ গেলেই হবে? আমাদের বলতে হবে না কেমন মজা-টা হলো?
আনিশা ছেলের পিঠে হাত দিয়ে বললো।
-দারুণ মজা, মাম্মা।
-তাহলে এবার বাপির পিঠ থেকে মাম্মার কোলে আয়। পায়ে ব্যথা না বাপির, লাগবে।
অনীত হেসে ফেললো –এইটুকু পুঁচকে ছেলেকে পিঠে নিয়ে যেতে ওর বাপির লাগবে? বরং বলো তুমি কোলে নিতে চাও।
আনিশা হাত বাড়ালো ছেলের দিকে।
-আয়।
অনীশ-কে বেশি বলতে হলো না। মায়ের কোলে চট করে উঠে পড়লো ও। আনিশা ছেলেকে চুমু খেলো।
-কাল টেস্ট নেই তো, সোনা?
-না, ফ্রাইডে।
-তাহলে কাল পরশু স্কুলে না গেলেও তো হয়।
-হয়। কিন্তু...
-কিন্তু?
-ম্যাম বলে স্কুল কামাই করা খারাপ, বকবে যে।
আনিশা ছেলে-কে আরও আদর করে দিলো।
-বেশ, আমি ম্যাম-কে বুঝিয়ে দেবো, দুটো দিন তো, বেশি না। আর হোমওয়ার্ক, স্কুলের পড়া সব আমি করিয়ে রাখবো, হবে তো?
অনীত আনিশার হাত ধরলো।
-সৌমিক-বিদিশা এসে ফিরে গেছে সকালে, আমি ওদের টেক্সট করে মানা করে আসতে ভুলে গিয়েছিলাম।
-এমা! এই শরীরে এসে ফিরে গেলে তো খুব কষ্ট পেয়েছে।
-অভিমানও হবে, দাদাভাই-এর উপর।
-তোমার ভাইয়ের?
-ভাই-বোন দু’জনেরই, ছেলে মানুষ একদম। কাল ফোন করে বোঝাতে হবে ওদের।
-ম্যাম কাল আসবে, বাপি? তাহলে তো হোমওয়ার্ক দেখবে সব।
অনীত আনিশা-কে চোখের ইশারা করলো।
-দেখবে তো, কেন, বাকি আছে?
-হ্যাঁ, কিছুটা, না পেলে তো...
-তো আর কি, কেউ একজন মার খাবে, কি উঠবোস খাবে, কি নীলডাউন...
-বাপি! মাম্মা জেনে যাচ্ছে তো সব।
আনিশা হেসে ফেললো।
-আমি করিয়ে দেবো সব হোমওয়ার্ক, হবে তো?
অনিশ মাম্মাকে জড়িয়ে ধরলো, ওর মাম্মা সবচেয়ে ভালো, একটুও বকে না, কাউকে বকতেও দেয় না।
-মাম্মা...
-কি?
-এবার থেকে আমি ম্যামের কাছে পড়া দেবার আগে তোমার কাছে একবার সব পড়ে নেব, হবে?
আনিশা ছেলের নাকে নাক ঘষলো।
-রোজ মাম্মার কাছে পড়বে, সোনা?
-সব্বাই তাই পড়ে তো।
অনীত দেখলো আনিশা কি বলে। সব্বার মাম্মা তো আনিশা গুপ্তা না। এটা বলতে যাচ্ছিলো অনীত, বললো না।
-তাহলে অনীশও তাই পড়বে, মায়ের কাছে, রোজ।
অনীশের মুখে অনাবিল হাসি ফুটে উঠতে দেখলো দু’জনেই। কোটি টাকা দিলেও সেই হাসির কোন তুলনা বা বিনিময় নেই বলে দু’জনেরই মনে হলো। আনিশা আঁকড়ে ধরলো ছেলেকে, চুমুতে ভরিয়ে দিলো। অনীত আনিশা-কে এক হাতে আর ছেলের গায়ে পিঠে আর একটা হাত রাখলো। স্বর্গ নেমে এলো যেন তিনজনের ছোট্ট দুনিয়াতে।
১৬
সৌমিক বেশ উদ্বিগ্ন হয়েই অনীত-কে ফোন-টা করলো। পিউদের বাড়িতে গতকাল রাত থেকে গিয়েছিলো বিদিশা, তারপর আজ এগারোটা নাগাদ বেরিয়েছে, বিকাল চারটে এখন, কোন খোঁজ নেই তার। নেট অফ, ফোন নট রিচেবল, অফিসে বসে খুব টেনশান হচ্ছিল সৌমিকের। দাদাভাই-এর বাড়ি গেছে কিনা জানতে কল করলো দাদাভাই-কে।
-বিদিশা গেছে তোমার ওখানে?
অনীত ক্যানভাস বের করেছিল আজ, বহুবছর পর। ছেলেকে দুপুরে ঘুম পাড়িয়ে আঁকছিলো। আনিশা কোয়েস্টের শোরুম থেকে মিনিট পনেরো আগে ফিরে ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করছে এখন, অনীতের ক্যানভাস ধরা দেখে বেজায় খুশি হয়েছে সে।
-কই, না তো। আসেনি তো। তোর বৌদি মিনিট কুড়ি আগে এসেছে কোয়েস্ট মল থেকে।
-ওহ, আসলে কাল রাতে পিউদের বাড়িতে ছিলো, সকালে এগারোটায় ওখান থেকে বেরিয়েছে। এখনো ফোন নট রিচেবল। হোয়াটঅ্যাপের টেক্সটও ডেলিভার হচ্ছে না, নেট অফ।
-নর্ম্যাল টেক্সট কর। এস এম এস। তবে মেয়েটা এতোক্ষণ গেলো কোথায়! কোথায় যাবে আভাস দেয়নি?
-নাহ, দরকারে বেরোবে বলেছে, কি দরকার বলেনি।
-স্ট্রেঞ্জ, এমন তো করেনা কখনো।
-সেটাই তো আমি ভাবছি। ডিপ্রেসড ছিলো বেশ, কিছু একটা করে বসেনি তো? ভয় হচ্ছে দাদাভাই।
-না না, বিদিশা অমন মেয়েই না। নিশ্চয় কোন কাজে গেছে, চলে আসবে।
-তাই যেন হয়। তুমি কল করে দেখবে একবার?
-টেনশন করিস না, এখনই কল কর দেখছি ও-কে।
অনীত বিদিশা-কে বার কয়েক কল করতে চেষ্টা করলো, নট রিচেবল, কি হলো মেয়েটার! বাপের বাড়ি থেকে চলে গেল নাকি না বলে? এমন তো করে না কখনো, চিন্তিত হলো অনীত। আনিশা পিছন থেকে এসে গলা জড়িয়ে ধরলো তখনি।
-কি এতো ভাবছো?
অনীত ঘুরে তাকালো –লাঞ্চ করে এসেছো?
সত্যিটা বললো না অনীত।
-উঁহু, ওরা অফার করেছিলো, কিন্তু খাইনি। বাড়ির রান্না খাবো বলে।
-বাড়িতে কিন্তু তোমার ডায়েট চার্ট মেনে রান্না করা নেই।
অনীত মিষ্টি হেসে বললো, আনিশা অনীতের চোখে চোখ রাখলো
-ক্যালোরি ইনটেক বাড়বে বলছো?
-স্বাভাবিক ভাবেই বাড়বে। তখন তুমি যাদের ক্রাশ তারা কষ্ট পাবে।
আনিশা অনীতের গালে চুমু খেলো
-এমনিতেই তো বেড়ে গেছে, তোমার এতো আদরে।
অনীত আনিশার কপাল থেকে নেমে আসা চুল সরিয়ে দিলো, অপলকে তাকিয়ে থাকলো তারপর। আনিশা অনীতের বিহ্বলতাকে বুঝে আরো কাছে গেলো,
-কী এতো দেখছো?
-তোমাকে,
-আমি কি নতুন? সেই তো কবে থেকে চেনো আমায়।
অনীত মৃদু হাসলো।
-নতুনই তো। আমার সন্তানের মা’কে এই প্রথম চিনছি যে।
আনিশার হৃদয় অনীশের কথাতেই ভরে উঠলো, অনীত-কে চুমুয় চুমুয় ভরিয়ে দিলো ও কিছুক্ষণ, অনীত থামায়নি, আনিশা শান্ত হতে অনীত ওকে কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে নিলো- খুশি?
-খু-ব।
অনীত আনিশা-কে কোলে বসাল, জড়িয়ে ধরলো একহাতে
-ক্যানভাস ধরলাম, নিশা।
-সেইজন্যই আরও খুশি আমি।
-আদরটা কি ঐ জন্যই বেশি?
-ঠিক ধরেছো।
-পারবো তো, বলো?
আনিশা হাসলো –তোমার চেয়ে ভালো কে পারবে?
অনীত আনিশার ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো, গভীর ভাবে চুমু খেলো কিছুক্ষণ, দুজনে। আনিশা আরো কিছুটা এগোতে চাইলেও অনীত থমকালো,
-কী হলো?
-কিছু না।
-তুমি চাও না এসব? অ্যাম আই ফোর্সিং ইউ?
অনীত আনিশার আবেগের প্রাবল্য বুঝলো। আট বছরের না পাওয়া ডানা মেলেছে এখন।
-চাই। খুব করেই চাই।
-তবে? থামলে কেন?
-আগের বারের মতো হঠকারীতা চাই না যে।
আনিশা বুঝলো অনীত কি বলতে চাইছে। ওদের শেষবারের সঙ্গমের ফলই তো অনাকাঙ্খিত কারোর আসা, যাকে ভাসিয়ে দিতে গিয়েও সে আবার ফিরে এসেছে এবং এসেছে কাঙ্ক্ষিত হয়েই। তাই কোন হঠকারীতা না করে ঠিকই করেছে অনীত। আর কেউ চলে আসুক চায় না, দুজনেই, এই পরিস্থিতিতে। আর কাউকে জলের তোরে ভাসাতে পারবে না আনিশা, এটা জানে অনীত।
-রাগ করলে?
অনীতের কথায় তাকালো আনিশা, চোখ মুছলো
-নিশা, অভিমান করো না, প্লিজ, আমি তোমাকে ভালোবাসি না বা কাছে পেতে চাই না, এসব অবাস্তব কথা ভেবে বসো না।
আনিশা অনীতের হাত ধরলো
-ভাবছি না।
-তোমার ভালোর জন্যই...
আনিশা অনীতের ঠোঁটে আঙুল রাখলো
-আমি জানি।
-ঐ ভুলটা আজো হার্ট করে আমায়।
-ভুল কই বোকা? ভুলটা ঠিক হয়ে গেছে যে।
-বাবাই?
-আর কে? আমাদের দু’জনের আর কেউ আছে নাকি একত্রের।
অনীতের চোখে জল দেখলো আনিশা। কাঁদছে, বোকা লোকটা।
-চলো।
-কোথায়?
-ছেলের কাছে। তোমার আমার মন ভালো করার জ্যান্ত পুতুলটার কাছে চলো।
-নিশা...
-বলো।
-আমাদের ছেড়ে যেও না, কখনো। তোমাকে ছাড়া আমরা থাকবো কী করে?
কথাটা বলেই অনীত ভাবলো হয়তো আনিশার না দেওয়ার মতো কিছু চেয়ে বসেছে ও, অন্যায় করে ফেলেছে। চাপ দিয়ে ফেলেছে ও-কে, বাকি সব্বার মতো।
-সরি...
-কেন?
-অন্যদের মতো আমিও তোমাকে আটকাচ্ছি, তোমার লাভ-ক্ষতি না ভেবে।
-আগেরবার যাওয়ার সময় আটকাওনি, জোর দেখাওনি, বোঝাওনি, বোঝোনি এবারেও সেসব করবে না? ছেড়ে দেবে? চলে যেতে দেবে? হেরে যাবে এভাবে? আবারও?
অনীত অবাক চোখে তাকালো।
-আটকাই, চাও?
-জোর দেখাও চাই, অধিকার দেখাও চাই, ভরসা দাও চাই, পাশে থাকো চাই।
অনীত আনিশা-কে বুকের মধ্যে টেনে নিলো, জড়িয়ে ধরলো প্রবল আবেগে।
চুমুতে ভরিয়ে দিলো আবার
-আটকালাম। আমার সমস্তটা দিয়ে আটকালাম তোমায়, নিশা।
আনিশাও অনীত-কে জড়িয়ে ধরলো
-বেশ তো, রয়ে গেলাম। আগে এভাবে ভালোবেসে বললে আগেরবারও রয়ে যেতাম, নীত।
আনিশা অনীতের বুকে কান পেতে ওর হৃদস্পন্দনের ভিতর ডুবে যেতে থাকলো।
১৭
ফেরার যে একটা ঠিকানা আছে সেটা ভুলতে বসেছিলো বিদিশা। একটা সত্যির সন্ধানে সকালে পিউদের বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলো, তন্নতন্ন করে খুঁজেছে সম্ভাব্য সমস্ত ঠিকানা যেখানে সত্যির একটা আভাস অবধি থাকতে পারে। সেখান থেকে যা কিছু জেনেছে তাতে জট কমেনি বরং আরো জট পাকিয়ে গেছে। মা-বাবাকে বারবার ফোন করে কাকুতি মিনতি করে যেটুকু জানতে পেরেছিলো তারই সন্ধানে আজ হন্য হয়ে ঘুরেছে ও।
নিজের খুব একজন কাছের মানুষের বাড়ি গিয়েছে আজ বিদিশা আটবছর পর। মুম্বাই থেকে হঠাৎ চলে আসার প্রায় আটবছর হয়ে গেলেও একবার চিত্রাঙ্গদা ম্যামের বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা হয়নি বিদিশার। যে মানুষটার ওর জীবনে এতটা অবদান, মা বাবার চেয়েও কোন অংশে কম নয়, সেই মানুষটা-কে আটবছর ভুলে ছিলো ভাবতেই অবাক হয়েছে বিদিশা। এলগিন রোডে ম্যামের বাড়ি, বিকালে এসেছে ও, ম্যাম কলেজে ছিলেন। কাকু তো বিদিশা-কে দেখে ভীষণ খুশি। কাকু নামী লেখক, একডাকে সবাই চেনে। ম্যামও নামী ছবি আঁকিয়ে সাথে নাম করা আর্ট কলেজের অধ্যাপিকা। চিত্রাঙ্গদা ম্যাম বললে সারা কলকাতা চেনে, বিদিশা ওনার কলেজেরই ছাত্রী। বিদিশারও আঁকার হাত দারুণ ভালো হওয়ায় ম্যামের নজরে পড়ে বিদিশা। তখন থেকেই আসা-যাওয়া ম্যামের বাড়ি, ম্যামের সাথে সাথে এক্সিবিশানে ঘোরা, ম্যামের বাড়িতে থাকা, সে এক দিন ছিলো। মুম্বাইয়ের চাকরিটাও ম্যামের কথাতেই ম্যামের ছেলের অফিসে। ঋষভ রায়। নামী শিল্পপতি রঞ্জিত রায় আর চিত্রাঙ্গদা ম্যামের একমাত্র ছেলে। বিদিশার কলেজের সিনিয়ার, আর বিদিশার জীবনের প্রথম ভালোবাসা। ঋষভের জীবনেরও কি নয়? তেমনটাই ভাবতো বিদিশা একসময়, ম্যামও ভাবতেন, অর্ধেন্দু কাকুও। ম্যামের বর্তমান হ্যাজবেন্ড, ঋষভের বাপি। ঋষভের বোন মৃত্তিকা অনেক ছোট ঋষভের চেয়ে, বিদিশার চেয়েও। বছর ষোলোর ফারাক দুই ভাই বোনের, বিদিশার সাথে বছর তেরোর, কলেজে পড়ছে এখন। আজ হঠাৎ করে দিশা দিভাইকে বাড়িতে আসতে দেখে সে-ও বেজায় খুশি। এমনকি আজ রাতে থাকতেই হবে সেই আগের মতো, রাতভোর গল্প হবে, এমন আবদারও করে বসেছে। বিদিশারও আপত্তি নেই তাতে, ম্যামের সাথে কথা হওয়াটা খুব জরুরি ওর, একান্তে।
রাতে বাড়ি ফিরবে না সৌমিক-কে জানিয়ে দিয়েছে বিদিশা। প্রথমে কিন্তু কিন্তু করলেও সৌমিক মেনে নিয়েছে। নিজের স্বামীর এই একটা জিনিস পছন্দ বিদিশার। যুক্তিগ্রাহ্য কোন জিনিসই অমত করে না সৌমিক। আজ একটা সত্যির সন্ধান করতে বেরিয়েছে বিদিশা, একটা হারিয়ে ফেলা জিনিসেরও। কাল রাতে পিউদের বাড়ি থাকাকালীনই মা-বাবার কাছ থেকে জেদ করে ঠিকানা-টা নিয়ে আজ সকালেই সেখানে গিয়েছিলো বিদিশা। হারানো কোহিনুরের সন্ধানে, পায়নি। এবং তার সন্ধানও পায়নি, অন্য কারোর ঘর আলো করে এখন রয়েছে সে, তার ঠিকানাও জানতে পারবে না বিদিশা কোনদিন, আইনের জটিলতায়। ম্যাম বাড়ি এসেই বিদিশা-কে দেখে ভীষণ খুশি। খুব প্রাণখোলা আর উচ্ছল মানুষ চিত্রাঙ্গদা ম্যাম, এতদিন যে বিদিশা আসেনি এই অভিমান করলেও মুখে দেখাচ্ছেন না, কাছে টেনে নিয়ে আদর করে অস্থির, পাঁচ বছর আগে কলকাতাতেই বিয়ে হয়েছে জেনে ভীষণ অবাক। তা-ও এতোদিন আসেনি কেন বলেই ফেললো মৃত্তিকা, কাকুও।
-আহা! থাক! হয়তো কাজ ছিল, ব্যস্ততা ছিলো... তাই না, দিশা?
বিদিশা ডিনার টেবিলে বসে ম্লান হাসলো।
-নাহ, নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছিলাম ম্যাম।
-দিশা দিভাই, তুমি এখানে ক’দিন থেকে যাও না, মন ভালো হবে।
কাকু মাথা নাড়লেন।
-হ্যাঁ, মা, থেকে যা। সামনেই তো বড় কাজ বাড়িতে। বাবু সোনার বিয়ে।
চিত্রাঙ্গদা আড় চোখে তাকালেনে বিদিশার থেকে। তার একমাত্র ছেলে-কে বিদিশা কতটা ভালোবাসতো সেটা তিনি জানেন। ঋষভ আর বিদিশার সম্পর্ক-টা দানা বাঁধুক চেয়েই মেয়েটাকে মুম্বাই-এ পাঠিয়েছিলেন। একদিন ঋষভই বললো কাউকে না বলে বিদিশা ফিরে চলে এসেছে কলকাতায়। তারপর থেকে বিদিশার আর কোন খোঁজ পাননি চিত্রাঙ্গদা। ফোন নাম্বারও চেঞ্জ করে ফেলেছিলো। কী হয়েছিলো? ঋষভের সাথে ঝগড়া? ব্রেকআপ? আজ বিদিশার কাছ থেকে জানবেন চিত্রাঙ্গদা।
-তোমার বাবুসোনার অনেক বড়-সড় ব্যাপার কাকু, আনিশা গুপ্তা-কে বিয়ে করছে।
-দিশাদি’ভাই, আনিশা বৌদিমণি কিন্তু খুব ভালো মানুষ, বাড়িতে এসেছিলো দেখলাম। এতো নামী মানুষ, একটুও অহংকার নেই।
বিদিশা হাসলো –আমি দেখেছি ওনাকে, মুম্বাই-এ যখন প্রথম আসেন মাসখানেক ঋষভের অফিসে প্রায়ই দেখা হতো, তারপরই তো আমি কলকাতাই চলে আসি।
চিত্রাঙ্গদা তাকালেন
-হঠাৎ করে কাউকে না জানিয়ে তড়িঘড়ি চলে এলি, আবার যোগাযোগও বন্ধ করে দিলি, কেন? আজ তো বল্।
-বলবো, বলতেই তো এসেছি। তোমাকে এই কথাটা আটবছর না বলতে পেরে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি ম্যাম।
চিত্রাঙ্গদা বিদিশার চোখে জল দেখলেন।
-ঋষভ কষ্ট দিয়েছিলো, না? আমাকে বললি না কেন? ঠিক করে দিতাম সব।
-সম্পর্ক-টা দু’জনের ছিলো ম্যাম। একজন না চাইলে তুমি আর কতোঠিক করবে বলো। আর ঋষভ তো আনিশা ম্যাম-কেই ভালোবাসে, কলেজ থেকেই। নেহাত তোমার কথায় আমার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করছিলো ক’দিন। তোমায় না করতে পারেনি বলে।
অর্ধেন্দু অবাক হলেন।
-অদ্ভুত। আনিশা-কে আগে থেকে ভালোবাসলে আগে বলেনি কেন?
চিত্রাঙ্গদা ছোট্ট করে বললেন
-আনিশা বিবাহিত ছিলো তখন। ইনফ্যাক্ট মুম্বাই যাওয়ার সময়ও ওর ডিভোর্স হয়নি। ঋষভের ব্যাচমেট অনীত-কে মনে আছে তোমার? ওরই বউ ছিলো।
-জটিল ব্যাপার-স্যাপার বাপু। আমি উঠি, কাল গল্পটা জমা দিতেই হবে।
অর্ধেন্দু উঠে গেলেন। বিদিশা কিছু বলতে যাবে ওর মোবাইল বেজে উঠলো। দাদাভাই। নাম নিতে নিতেই। এতোক্ষণে মনে পড়লো বোন-কে।
-হ্যালো...
-ম্যাম?
বিদিশা ভেবেছিলো রাগ দেখিয়ে কথা বলবে। কিন্তু একটা ডাকেই সব রাগ জল হয়ে গেলো।
-বাবাই! ঘুমোসনি এখনো!
-তোমার জন্য মনখারাপ তুমি আজ আসবে বলবে এলে না!
বিদিশার চোখে জল চলে এলো। স্নেহের বাঁধন এতো সহজে ছেঁড়া যায় না।
-আমি আমার ম্যামের বাড়ি এসেছি যে।
-তোমারও ম্যাম আছে? তোমার মতোই ভালো?
-বেস্ট একদম। মনখারাপ করিস না। ম্যাম কাল সকালেই চলে যাবে তোর কাছে।
-আচ্ছা। মাম্মা বলছে, বাপি বলছে, তুমি শরীরের যত্ন নাও...
-পাকা বুড়ো একটা। পড়ছিস তো?
-হ্যাঁ ম্যাম, তুমি কাল এসো, সব পড়া বলে দেবো। মাম্মা সব পড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু তুমি না এলে ভালো লাগে না।
বিদিশা চোখ মুছলো, কিছুই বৃথা যায়নি। ওর পাঁচ বছরের প্রতিপালন অনীশের মজ্জায় ঢুকে গেছে। সব হারিয়েও অনীশ-কে পাওয়ায় বিদিশার প্রাপ্তির ভাঁড়ার তাই অনেকটাই পূর্ণ।
ফোন রাখার পর চিত্রাঙ্গদা বললেন,
-ছাত্র?
-পুত্রকল্প বলতে পারো...
-ম্যামকে না দেখে বেশ মনখারাপ তাহলে তার।
-ম্যাম-কে না দেখলে মনখারাপ সবার হয়, কেউ বলতে পারে, কেউ পারে না।
চিত্রাঙ্গদা বুঝলেন বিদিশার অনেককিছু বলার আছে, আলাদা করে একান্তে শুনবেন, কথা বাড়ালেন না আর।
বিদিশা জেগেই ছিলো, চিত্রাঙ্গদা যখন ওর ঘরে এলেন।
-ঘুমোসনি, পাগলি?
-জানতাম তুমি আসবে।
-আসবোই তো, কৈফিয়ত নেবো না? এতো গুলো বছর যোগাযোগ না রাখার?
-আমার উপায় ছিলো না ম্যাম।
চিত্রাঙ্গদা বিদিশার পাশে বসলেন। ওর হাতদুটো নিজের হাতে নিলেন।
-বুঝতে পারছি। তা নাহলে নিজের প্যাশান ছেড়ে স্কুলে পাড়ায় আমার দিশা? তোকে কতবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি জানিস? বুঝতাম বাবুসোনার সাথে কিছু হয়েছে কিন্তু সেও তো কিছু বললো না এই আটবছরে। মুম্বাই গিয়ে ব্যবসায় ঢুকে একবারে বাবার মতো হয়ে গেলো। কেজো, ব্যবসা মনস্ক, কত ভালো আঁকত মনে আছে? এখন তো সেসবেও মন নেই।
-ভারতের একনম্বর ডিজাইনারকে বিয়ে করেছে যে। আর এঁকে কি হবে বলো?
চিত্রাঙ্গদা সঙ্গিন একটা প্রশ্ন করেই ফেললেন
-আনিশা মুম্বাই যেতেই কি তোদের...
-মাসখানেকও সময় নেয়নি তোমার ছেলে ম্যাম। ব্যবসায়ী তো, রঞ্জিত আঙ্কেলের মতো হয়ে গেছে এখন থেকেই। কিসে লাভ, কিসে ক্ষতি বোঝে।
-প্রতিবাদ করিসনি?
-ভালোবাসায় কি আর জোর চলে, বলো?
-আমাকে বলতে পারতিস, দিশা?
-তুমি জোর করে জোড়া লাগালেও দাগ থেকে যেত ম্যাম।
-তাবলে এভাবে সব ছেড়ে চলে আসা...
-আমি ঠিকই তো ছিলাম, তাই না? আটবছর পর দ্যাখো ঠিক নিজের ভালোবাসা-কে নিজের করে নিতে পারছে তোমার ছেলে। আমি থাকলে হতো এসব? আর ও যখন বলেই দিয়েছিলো, কখনো ভালোবাসেনি আমায়, নেহাত কম্পালসন ছিলো ওর আর আমার সম্পর্ক-টা তাহলে আর কী-ই বা বলার মতো থাকে?
চিত্রাঙ্গদা বিদিশার মাথায় হাত রাখলেন।
-আমার ভুল সিদ্ধান্তের জন্যই তোর এতো কষ্ট, দিশা। তাই এতো অভিমান ম্যামের উপর?
বিদিশার মনের দরজার সব আগল খুলে গেল যেন। কেঁদে ফেললো ও, ঝরঝর করে। এতোক্ষণ এতো কষ্ট পেয়েও মন খুলে কাঁদতে পারেনি। কেউ এতটা কাছে নিয়ে বুঝতে চায়নি যে।
-কাঁদিস না মা, নিজের ছেলে তো, স্নেহের বশে ভেবেছিলাম মনটা আমার মতোই পাবে। ওখানেও তোর রঞ্জিত আঙ্কেল জিতে যাবে বুঝিনি যে। আমার জন্য মিছিমিছি এতো কষ্ট পেলি। একবার অভিযোগ করতেও তো আসে লোকে, তাও এলি না... আমিও তোর বাড়ির ঠিকানাটা জানতাম না যে!
বিদিশা চিত্রাঙ্গদা-কে জড়িয়ে ধরলো। হু হু কান্নায় ভেসে যেতে থাকলো চিত্রাঙ্গদা। মেয়েটিকে কখনো হবু পুত্রবধু হিসাবে দেখেননি উনি। সবসময় নিজের মেয়ের মতোই ভেবেছেন।
-হ্যাঁ রে পাগলি, এখন সুখী তো?
বিদিশা চোখ মুছলো।
-সৌমিক খুব ভালো ম্যাম।
-বাহ, কী করে?
-পত্রিকা অফিসে কাজ করে। চিত্র সাংবাদিক।
-খুব ভালো।
-খুব মধ্যবিত্ত, ম্যাম। তবুও সুখী, আমরা, একটা বিষয় বাদে।
-শাশুড়ি?
-সে তো আছেই। সবাই কি আর নিজের মেয়ে ভাবে বলো, তোমার মতো? তোমাকে হারানো-টা আমার কাছে তোমার বাবুসোনা-কে হারানোর মতোই কষ্টের।
-আমি আছি সবসময় তোর পাশে। আবার ব্রাশ ধর, কাজ শুরু কর। আর্ট কলেজে আয়, লেকচারারশিপ নিবি?
বিদিশা চোখ মুছলো।
-ম্যাম, আর একটা কষ্ট সন্তান নিয়ে। এই পাঁচ বছরে আমার বারছয়েক অ্যাবর্শন হয়ে গেছে। নিজে থেকেই, শেষটা এই সপ্তাহেই।
-ডাক্তার দেখাসনি?
-ডাক্তার বদ্যি, বেড রেস্ট, ওষুধ সব করেছি। কোন ফল হয়নি, হবেই বা কি করে বলো, একটা পাপ আমাকে পিছু ছাড়ছে না।
চিত্রাঙ্গদা অবাক হলেন।
-পাপ?
-হ্যাঁ, আটবছর আগের ভুল। আমার বাবা-মা ছাড়া কেউ জানে না। তোমার বাবুসোনা জানে যদিও, কিন্তু ও দায় নিতে চায়নি বলেই আর বেশি জানাইনি।
চিত্রাঙ্গদা বাক্যহীন হয়ে গিয়েছিলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন
-তুই প্রেগন্যান্ট ছিলি? আটবছর আগে? এটাও আমাকে বলা যেত না?
-তোমার ছেলে বললো ওর এসব ঝামেলা বওয়ার মতো ম্যাচিওরিটি হয়নি। কী করতাম আমি? কলকাতায় চলে এসেও জানিয়েছিলাম, বিশ্বাসও হয়তো করেনি যে আমি প্রেগন্যান্ট।
-তা বলে অ্যাবর্ট করে দিলি, দিশা? আমার বাবুসোনার সন্তান-আমার দিশার সন্তান... এভাবে?
বিদিশা চিত্রাঙ্গদাকে থামালো।
-পারিনি যে ম্যাম।
-পারিসনি। মানে কি পারিসনি?
চিত্রাঙ্গদার পৃথিবী ঘুরে উঠলো।
-অ্যাবর্ট করতে।
-দিশা!
-এইটা বলতেই আজ তোমার কাছে এসেছি ম্যাম। ওকে অ্যাবর্ট করতে পারিনি আমি। সাতবছর আগে জন্ম দিয়েছিলাম।
-কোথায় সে এখন? তোর মা-বাবার কাছে? শিগগির বল আমাকে ।
-সেইটা জানতেই তো আজ সারাটাদিন হন্যে হয়ে ফিরেছি ম্যাম। খুঁজে পাইনি।
চিত্রাঙ্গদা বিদিশা-কে দু’হাতের মধ্যে ঝাঁকালেন।
-দিশা, হেঁয়ালি করিস না, স্পষ্ট করে বল, কোথায় সে।
-জানি না ম্যাম। আমার বাবার কোন এক সোর্স তাকে একটা অরফ্যানেজে রেখে এসেছিলো। আজ মা-বাবার থেকে ঠিকানা আদায় করে আমি সেখানেও গিয়েছিলাম। দিন তারিখ মিলিয়ে বললামও সবটা, বললো অ্যাডপ্টেড আউট। অন্য কারোর কাছে বড় হচ্ছে সে, আমার সন্তান।
-তুই তো সেটাই চেয়েছিলি। তাহলে আক্ষেপ কিসের? মা হতে না পেরে? আবার মা হতে পারলে হয়তো ও-কে মুছেই ফিলতিস জীবন থেকে।
বিদিশা চিত্রাঙ্গদার কাছে গেলো, জড়িয়ে ধরলো ম্যাম-কে।
-তুমি ঠিক বলেছো ম্যাম। আমিও তোমার ছেলের মতোই ও-কে জীবন থেকে মুছে ফেলেছিলাম। এখন আবার স্বার্থপর হয়ে কাঙালের মতো চাইছি। কিন্তু মা তো, মেরে তো ফেলতে পারিনি, বলো?
চিত্রাঙ্গদা মনকে শান্ত করলেন। এখন মন শান্ত করতে হবে, ঠান্ডা করতে হবে মাথা।
বকলে হবে না দিশা-কে।
-বাবুসোনা জানে?
-নাহ, ও জেনে কি করবে? নতুন জীবন শুরু করছে, ভালো থাকুক।
-জানাবি না? ওরও তো সন্তান।
-ওর না ম্যাম, আমার, শুধু আমার। তুমি ওকে আমাকে খুঁজে এনে দাও ম্যাম। সৌমিক অ্যাডপশনে রাজি।
-সবটা জেনে?
-এখন না জেনেই। তবে জানলে মানবে সৌমিক। ও বাচ্চা খুব ভালোবাসে ম্যাম। বাবাই-এর কাকাই হয়েই যা ভালোবাসে ও-কে ভাবতে পারবে না।
-বাবাই?
-অনীশ, আমার ছাত্র। কল করেছিলো না?
-ওহ।
-ওর আরো একটা পরিচয় আছে, তুমি জানো কিনা জানি না।
-বাবাইয়ের?
-হ্যাঁ।
-কী?
-আনিশা গুপ্তা আর অনীত চ্যাটার্জীর সন্তান।
-আনিশার ছেলে আছে? অনীতের সাথে? কই ঋষভ বলেনি তো!
-আট বছর আগে যখন মুম্বাই গিয়েছিলো হয়তো প্রেগন্যান্ট ছিলো। তখনো তো দাদাভাই-এর সাথে ডিভোর্স হয়নি।
-মুম্বাই গিয়ে বাচ্চা হয়েছে? তাহলে তো ঋষভ জানবেই।
-জানেও হয়তো, তোমাদের বলেনি। বাচ্চা এখন বাচ্চার বাবার কাছেই থাকে, বাবার কাস্টডিতে। ইনফ্যাক্ট ও-কে দুই-আড়াই থেকেই সাত-আট এই পাঁচবছর আমিই বড় করেছি, দাদাভাই-এর বাড়িতে। কি কোইন্সিডেন্স, না?
-অনীত সম্পর্কে তোর দাদা হয়? জানতাম না তো।
-না, না। কলেজের সিনিয়ার। নাম করেছিলো একসময় খুব। মনে আছে তোমার? এখন সৌমিকের দাদাভাই অর্থে দাদাভাই বলি।
-হ্যাঁ। অনীত কলেজে পড়ার সময় নামডাক করেছিলো খুব। ঋষভের ক্লোজ, বেস্ট ফ্রেন্ডই বলা যায়। এ বাড়িতে আসতো মাঝে মাঝে ওর সাথেই।
-হ্যাঁ, এখন সৌমিকের অফিস কলিগ। ডিভোর্স হবার পর এখন ছাপোশা চাকরি করে, পত্রিকা অফিসে।
-বুঝলাম, কিন্তু এতো সবকিছু ঋষভ-কে না বললেও নয় যে। ও বিয়ে করতে চলেছে আনিশা-কে, ওর জানা উচিৎ।
-জানেও হয়ত। সন্তানের ব্যাপার-টা তোমাদের লুকিয়েছে মে বি। ম্যাম, তুমি আমাকে আমার সন্তান খুঁজে এনে দাও, প্লিজ। তোমার তো অনেক চেনাশোনা।
চিত্রাঙ্গদা বললেন
-দেখছি। তুই শো এবার, অনেক কান্নাকাটি করলি।
-দাও না, ম্যাম।
-আমার কোলে মাথা রেখে শো, ঘুম পাড়িয়ে দিই।
-তুমি এড়িয়ে যাচ্ছো...
-এড়াবো কি করে দিশা? তুমি যাকে হারিয়ে ফেলেছিস সে তো আমারও খুব নিজের কেউ, না? খুঁজতে তো তাকে হবেই।
-পেলে এনে দেবে তো আমায়?
-চেষ্টা করবো। অন্যকেউ নিয়ে ফেললে তো একেবারে আনা মুশকিল।
-আমরা দেখবো না হয়, কথা বলে?
-আনলে কিন্তু তোকেও একটা কাজ করতে হবে, দিশা।
-তুমি যা বলবে করবো, ম্যাম।
-আমার জিনিস আমার চোখের সামনে বড় করতে হবে তোমায়। তোমার শ্বশুর বাড়িতে আমি ছাড়বো না।
-সৌমিক?
-তাকেও সবটা বলবে তুমি। কোন কিছু লুকাবে না। সে মেনে থাকতে পারলে থাকবে, নাহলে না। কী রাজি তো?
বিদিশা একমুহুর্তও ভাবলো না। ও যে কোন মুহুর্তে রাজি। যে কোন মূল্যে ওর নিজের সন্তান চাই ওর। আনিশা গুপ্তা দুধের বাচ্চা ফেলে রেখেও জন্ম দেবার সুবাদে দিব্যি মা হবার সুখ ভোগ করছে। বিদিশারও সেই সুখ চাই। বারবার হারবে না ও, হারতে চায় না, একজন মানুষের কাছে! সৌমিকের সাথে ওর বিয়ের পর অনীতদা’কে দেখে চিনতে ভুল করেনি ও। মানুষ-টাকে কলেজে যতটুকু দেখেছে, ম্যামের বাড়ি যেটুকু চিনেছে – এখনো তেমনি আছে। সরল, সৎ, ভালো মানুষ। বাবাই আনিশা ম্যামের সন্তান জেনেও দাদাভাই-এর জন্য ওকে ভালোবাসতে কখনো আটকায়নি বিদিশার। কিন্তু আনিশা ম্যাম ফিরেই সব হিসাব গন্ডগোল করে দিয়েছে। এবার তাই নিজের সন্তান চাই বিদিশার। যে কোন মূল্যেই।
১৮
বিদিশা ঘুমোলে নিজের ঘরে বসে বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন চিত্রাঙ্গদা। বিদিশা যাকে জন্ম দিয়েছে সে ঋষভের সন্তান। চিত্রাঙ্গদার একান্ত আপন, তাকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করা উচিৎ চিত্রাঙ্গদার মন বলছে। আবার কোথাও একটা বিপদ সংকেতও অনুভব করছেন চিত্রাঙ্গদা। যদি অন্য কেউ দত্তক নিয়েই ফেলে তাদের কাছ থেকে নিয়ে আসা কি এত সহজ হবে? অর্থের জোরে আনা যেতেই পারে কিন্তু তাতে পরবর্তী দীর্ঘমেয়াদী ব্ল্যাকমেলের সম্ভাবনা থাকে। ঋষভ নামী শিল্পপতি, বিদিশাকে ওর সন্তান এনে দিতে গিয়ে যদি ঋষভের ভবিষ্যৎ-এর কোন সমস্যা হয়? তাছাড়াও আনিশা ক’দিন পরে ঋষভের স্ত্রী হয়ে আসবে। সে যদি এসব না মানে? আবার আনিশার আগের পক্ষের সন্তানের ব্যাপারটাও তো বেশ চিন্তার। খুব একটা কেউ জানেই না ব্যাপার-টা! এতো লুকোছাপা কেন এতে?
এতো জটিল বিষয়ে অর্ধেন্দুর সাথে পরামর্শ অনর্থক। লেখক মানুষ, কল্পনার জগৎ-এই থাকেন। এতো জটিলতা শুনে বিহ্বল হয়ে পড়বেন। একজন-কে বলা যায়- এ পৃথিবী-তে কেবলমাত্র একজনকেই কথা গুলো নিঃসংকোচে বলতে পারেন চিত্রাঙ্গদা। কাজ পাগল মানুষটার কাজকে সতীন মনে করে বছর ছাব্বিশ আগে তাকে ছেড়েছিলেন চিত্রাঙ্গদা, মানুষটা চিত্রাঙ্গদা-কে ছাড়েননি। এতো বিত্ত এতো বৈভব থাকা সত্ত্বেও চিত্রাঙ্গদার জায়গায় কাউকে কখনো আনেননি রঞ্জিত। এখনো প্রয়োজনে সবসময় তাকে পাশে পান চিত্রাঙ্গদা, কাজের ফাঁকেই।
রঞ্জিতকে কি একটা ফোন করা উচিৎ? রাত অনেক হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো, কিন্তু বিষয়টা যখন ঋষভকে নিয়ে আর ঋষভ চিত্রাঙ্গদার যতটা রঞ্জিতের ততটাই তাই বলতে অবশ্যই হবে। কল করেই ফেললেন চিত্রাঙ্গদা, রঞ্জিত ফোন ধরলেন
-চিত্রা- এতো রাতে? সব ঠিক আছে তো?
-ঘুমিয়ে পড়েছিলে? বিরক্ত করলাম?
রঞ্জিত একটু হাসলেন –তোমার ফোনে আমি বিরক্ত হই না। এটা এতো বছর পর আবার মনে করাতে হবে? বলো- কি নিয়ে এতো ভাবছো? মনখারাপ কেন?
-কি করে বুঝলে?
-আমার মতো কেজো লোকেরা তোমাদের মতো শিল্পীদের থেকে একটু বেশিই বাস্তবটা বোঝে, তাই। ইনফ্যাক্ট আমিও তোমাকে ফোন করতাম কাল, বাবুসোনার বিয়ের ব্যাপারে।
-কেন?
-প্রশ্ন করার অভ্যাস গেলো না তোমার। আনিশা গিয়েছিলো এর মধ্যে তোমার ওখানে?
-আনিশা? নাহ। তিন-চারদিন আগে একবার এসেছিলো মনে হয়।
-হুম্।
চিত্রাঙ্গদা বুঝলেন রঞ্জিত কিছু জানে। কিন্তু বলছে না।
-রঞ্জিত, কী হয়েছে? কিছু কি জানো তুমি? ঋষভ কোন ভাবে ঠকছে না তো?
-আমিও সেই আশঙ্কাই করছি, কিন্তু তুমি কি করে বুঝলে, চিত্রা?
-তুমি বলো আগে।
রঞ্জিত হাসলেন।
-ওহ! সেই এক জেদ, একইরকম রয়ে গেলে চিরকাল।
-বলবে?
-বলবো। তোমারও যেমন আমাকে ছাড়া কাউকে বলার নেই, আমারও ঠিক তেমন-ই যে।
-মরণ!
-কেন, মন ভোলানো কথা কি তোমার পাশের ঘরে বসে কলম পিষতে থাকা ইডিয়টটাই বলতে পারে?
-রঞ্জিত!
রঞ্জিত হাসলেন –স্ত্রীয়াশ্চচরিত্রম! পতি নিন্দা শুনবেন না ম্যাডাম।
-আমি একটা জরুরী বিষয়ে ফোন করেছি তোমায়। মস্করা করতে হলে ফোন রাখো।
-চটো কেন? ভালো লাগে তোমাকে রাগাতে। এই যে তুমি আমাকে ভালোবেসেও কেবল জেদ আর রাগের বশে অন্য কারোর সাথে ছাব্বিশ বছর রয়ে গেলে, এত বোকা মেয়েকে রাতবিরেতে একা পেলে রাগাবো না?
চিত্রাঙ্গদা কিছু বললেন না। রঞ্জিত যেটা বলছেন সেটা একবর্ণও মিথ্যা না, বৃথা তর্ক করে লাভ নেই।
-সরি, রাগ করো না।
রঞ্জিতই বললেন।
-রাগ কার উপর করবো? সব সত্যিটা জেনেও যে ছাব্বিশ বছরও বদলালো না বা ফিরেও তাকালো না তার উপর রাগ কিসের?
-আমি কাজপাগল এটাই বদলাবে না, তুমি আবেগী সেটাও বদলাবার নয়। তবে, ভরসাটাও আমাকেই করো, এটাই বদলাবার নয়। যাই হোক, কিছু কথা তোমাকেও বলার ভরসা আমিও পাই, বাবুসোনার মা তুমি।
-বলো।
-আনিশা শেষ তিন-চারদিন প্রাক্তন স্বামী অনীতের বাড়িতেই থাকছে।
চিত্রাঙ্গদা চমকে উঠলেন।
-মানে! ঋষভ জানে?
-না, জানে না। ও-কে জানতেও দিইনি আমি। আমার নেটওয়ার্কে আমি জেনেছি মাত্র। গতকালই রায়চকে ওদের ছুটি কাটাতে দেখেছে আমার লোকজন। সাথে একটা বাচ্চাও ছিলো, ছেলে।
-আমিও বিদিশার কাছ থেকে জানলাম। আনিশার ছেলে, ছেলেটি, আগের পক্ষের।
-কি যা তা বলছো! আনিশা প্রায় আটবছর আগে থেকে মুম্বাই-এ, আমাদের চোখের সামনে। ছেলেটির যা ছবি দেখলাম সাত আট বছরের মতো বয়স। আনিশার ছেলে হওয়া অসম্ভব।
-তবে?
-জানি না, কিন্তু জানার চেষ্টা করছি। বিদিশা মানে যে মেয়েটিকে ঋষভের সাথে বিয়ে দিতে চাইতে? তাকে পেলে কোথায়? সে-ও তো বছর আটেক আগেই বিনা নোটিশে চাকরি ছেড়ে উধাও হয়ে গিয়েছিলো।
-আজ ফিরেছে, আমাদের বাড়িতেই আছে আজ।
-হঠাৎ?
-হঠাৎ নয়, অনেক বড় খবর আছে, রঞ্জিত।
-খবর? ঋষভ ওর মন ভেঙে ব্রেক আপ করে জোর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলো, এমন? পাত্তা দিও না, ঋষভের বিয়ে সামনে তাই এমন বলছে।
-তেমন নয়।
রঞ্জিত উৎকর্ণ হলেন।
-তবে?
-বিদিশা মুম্বাই থেকে হঠাৎ চলে আসার সময় প্রেগন্যান্ট ছিলো। ঋষভ-কে জানায়, অ্যাবর্ট করে দিতে বলে ও।
-ওহ্! তাহলে এখন কি চায়? টাকা? মুখ বন্ধ রাখার জন্য?
চিত্রাঙ্গদা বললেন,
-তোমার ব্যবসায়ী সত্ত্বা বারবার আমাকে হতাশ করে, রঞ্জিত।
-আহ্! কি বলেছে, বলো।
-বাচ্চাটা ও জন্ম দিয়েছে, বছর সাতেক আগে।
রঞ্জিত চমকে উঠলেন।
-ইজ ইট? বাচ্চাটা কোথায় আছে? ওর কাছে?
-না ওর মা-বাবা কোন অরফ্যানেজে দিয়ে দিয়েছিলেন। সেখান থেকে কেউ অ্যাডপ্ট করে নিয়েছে।
-তাহলে তো মিটেই গেলো।
-মিটেই গেলো মানে? কী করে এটা বলতে পারো রঞ্জিত?
-বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে। কেউ অ্যাডপ্ট করেছে মানে, ভালো আছে সে। এরপরও অতীত খুঁড়তে গেলে বর্তমান তো নষ্ট হয়ে যাবে, না?
-সে তো আমাদের নিজের রঞ্জিত। প্রথম পৌত্র, তাকে একবার খুঁজবোও না!
রঞ্জিত চিত্রাঙ্গদার আবেগ বুঝলেন।
-বেশ, খুঁজবো। তুমি চাও যখন, খুঁজবো। খুঁজে? রাখবে কোথায়? যারা নিয়েছে তাড়া ছাড়বে? লোক জানাজানি হবে না?
চিত্রাঙ্গদার আবেগ ওনাকে দিয়ে বলালো
-আমি রাখবো। তোমাকে বা তোমার ছেলেকে ভাবতে হবে না।
রঞ্জিত হেসে ফেললেন।
-এই বয়সে আবার মা সাজবে? বাপটা কিন্তু আমি ছাড়া অন্যকাউকে মানাবে না বলে দিলাম।
-নির্লজ্জ! মা কেন সাজবো, যা হই তাই সাজবো। তাকে পেলে সে বিদিশার কাছে থাকবে, বিদিশার দত্তক সন্তান হিসাবে।
-বিদিশার বিয়ে-থাওয়া হয়নি?
-হয়েছে।
-বাচ্চা-কাচ্চা?
-নেই। বারবার এসেও নষ্ট হচ্ছে।
রঞ্জিত চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন
-বিদিশার স্বামীর সমস্যা হবে না এতে?
-ওটা বিদিশা নিশ্চিত করবে।
-বেশ, তবে বিদিশাকে কিন্তু আমাদের হাতের কাছেই থাকতে হবে তখন। আই মিন, তোমার হাতের কাছে।
-আমাদের দু’জনের হাতের কাছ এখন কাছাকাছি নয়, জানি আমি।
রঞ্জিত মৃদু হাসলেন।
-বাবুসোনাকে কে জানাবে, তুমি না আমি?
-তুমি জানাও। তোমার কাছে থাকে যখন, মা হয়ে এসব বলাটাও...
-বুঝেছি, আমিই বলবো। ঋষভ জানলে কিভাবে রিয়্যাক্ট করবে ভেবে ভয় পাচ্ছি। তোমারই তো ছেলে, আবেগপ্রবণ। সন্তান আছে জানলে তাকে দেখার জন্য উতলা হবেই। আবার এতোদিন কথাটা লুকিয়ে রাখার জন্য বিদিশার উপর রেগেও যাবে।
-দায় কিন্তু তোমার ছেলেই নিতে চায়নি, রঞ্জিত।
-এস্কেপ করেছে, মায়ের মতো। নিরানব্বই ভাগই তো সে মায়ের মতোই হয়েছে।
চিত্রাঙ্গদা বললেন
-তার মায়ের এস্কেপ করা ছাড়া উপায় ছিলো কি? সংসার বলে বস্তুটাই যে কাজ কাজ করে শেষ হয়ে যাচ্ছিলো।
-ছেলেটার তখন মাত্র দশ বছর বয়স ছিলো চিত্রা। এতোটা স্বার্থপর নাও হতে পারতে।
-একই কথা যদি তোমায় বলি? ছেলেটার মাত্র দশবছর বয়স ছিলো, তুমিও কেরিয়ার নিয়ে এতোটা স্বার্থপর না হলেও পারতে।
দু’জনেই চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। রঞ্জিত নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বললেন,
-দুজনের স্বার্থপরতার জন্যই দুজনকে হারিয়েছি দুজনে। বাবুসোনার কৈশোরটাও...
-সেইজন্যই ঋষভের জানা উচিৎ ওর সন্তানের ঠিকানা, তাকে দেখতে পাওয়ার সুযোগ ওর প্রাপ্য, তাই না?
-ঠিক। আমরা জেনেও যদি ওকে না জানাই, বড্ড ভুল হবে। তবে জেনে যদি ও বিদিশার কাছে রাখতে নারাজ হয় বা নিজের কাছে রাখতে চায় আবেগের বশে তখন কী হবে সেটাই ভাবছি।
-তুমি বোঝাবে।
-সন্তান এমন একটা আবেগ তার কাছে সবকিছু তুচ্ছ হয়, তাই না?
-আনিশা জানলে?
-বিয়েটা ভাঙবে। আনিশা এখন অনীতের সাথে আছে এটা ঋষভ জানলেও বিয়েটা ভাঙবে। সেটা দুজনের কেরিয়ারের জন্যই লস্, আমাদের ব্যবসার জন্যও। বিয়ে নাহলে আনিশা আলাদা ব্যবসা শুরু করবে, সেটাও আমাদের ক্ষতি। তাই সবদিক বাঁচিয়ে আগে বিয়েটা দিতে হবে।
-আনিশার সন্তান?
-ও হ্যাঁ- ঐ ব্যাপারটাও খোঁজ নিতে হবে, চিত্রা-
-বলো।
-একটা অনুরোধ করি?
-হ্যাঁ বলো না।
-ভাবছি এসব কাজ দূর থেকে লোক লাগিয়ে নয়, নিজে এসেই করবো, কলকাতায়। কাল আসি? খুব গোপনীয় কাজ তো।
-আমিও তোমাকে এটাই বলতে চেয়েছিলাম। তুমি এসো। এই খোঁজে আমাকেও সাথে নিও প্লিজ।
-তুমি যাকে বলছো তাকে খুঁজে পেলে আমিও খুব খুশি হবো, চিত্রা।
-আবেগে বলছো?
রঞ্জিত হাসলেন –হ্যাঁ, আর একবার পেলে ওকে নিজের করে নেওয়ার জন্য যা করার অবশ্যই সেটা করবো।
-এখানে এসে হোটেলে থাকবে? না আলিপুরের বাড়িতে?
রঞ্জিত হাসলেন।
-বাবুসোনার মায়ের বাড়ি থাকতে বলছো?
-আপত্তি আছে?
-আমার নেই। লেখক মশাইয়ের আছে কিনা জেনে নিও।
-সেটা আমি বুঝে নেবো।
-ঋষভকে কথা এখনই বলবো, না , খুঁজে পেয়ে?
-খুঁজে পেয়েই বেশি ভালো হবে, তাই না?
-যা বলবে, কাল আসছি। একসাথে খুঁজবো – তুমি যাকে সবচেয়ে বেশি করে চাইছো, তাকে। তা সে ছেলে না মেয়ে?
-ছেলে।
-তাহলে তো তার ঠাম্মার অ্যাটনশন আর কেউ পাবেই না, কখনো।
-আর কেউ পেতে চায়?
-কে জানে? একজন একলা মানুষ আছে চিত্রা। হাজার হাজার কোটি টাকা তার অথচ দিনের শেষে বড্ড একা। তার হয়তো ওর ঠাম্মার মনযোগটা খুব দরকার।
-ছাব্বিশ বছর আগে বলতে কি হয়েছিলো?
চিত্রাঙ্গদা চোখ মুছলেন।
-আজ বলছি তো। এখনো কি সব শেষ হয়ে গেছে আমাদের? এই যে, তোমার নাতি-কে খুঁজবো, একসাথে, এটাও তো নতুনভাবে নিজেদের ফিরে পাওয়া, তাই না?
চিত্রাঙ্গদা অমত করলেন না। এইভাবে যদি ক’দিন ভালোবাসার মানুষটার সঙ্গ পাওয়া যায়, মন্দ কি।
১৯
আনিশা বেশ কয়েকটা গুগল মিট করতে বাধ্য হয়েছিলো আজ, ডিনারের পর, অফিসের তাড়নায়। বলা ভালো, ঋষভের বাবার তাগাদায়। অনেককটা ডিল পেন্ডিং হয়ে ছিলো, মিট করে সেগুলো না মেটালে দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে ঋষভকে দিয়ে বলিয়েছেন রঞ্জিত আঙ্কেল। আনিশা আজ অনেককটাই মেটালো। ভিডিও অফ করেও করেছে কিছু কিছু মিট, যেগুলোও অফ করে রাখলেও চলে। কাজ মিটতে মিটতে রাত একটা বেজে গিয়েছিলো। শোওয়ার ঘরে গিয়ে দেখে ছেলে ঘুমোচ্ছে, ছেলের বাবা জেগে।
-ঘুমাওনি?
-তুমি না এলে ঘুম আসছিলো না।
-ছেলে ঘুমিয়েছে?
-মাম্মা কখন আসবে করতে করতে ঘুমোল এই।
আনিশা বললো।
-কাল ব্যাটাকে নিয়ে একটু ঘুরতে যাবো।
-কাল বিদিশা আসবে বলেছে যে।
-ও হ্যাঁ! কখন আসবে জেনে নিও। তার আগে বা পরে বেরোবো আমরা। বারবার ফিরে গেলে খারাপ ভাববে।
শোওয়ার আগের প্রসাধন করছিলো আনিশা, নাইট ক্রিম মাখছিলো।
-নিশা...
-বলো।
-তোমার উপর চাপ আসছে না তো? ব্যবসার?
-একটু তো আসবেই। আমার তোমাদের কাছে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পাবলিক হলে আরও আসবে। হয়তো নতুন ব্যবসা শুরু করতে হবে, আলাদা হয়ে।
-ঋষভের কোম্পানির থেকে?
-হ্যাঁ।
-ব্যাপারটা কি প্রফেশনালি ডিল করা যায় না?
আনিশা হাসলো।
-হয়তো আর যায় না। ঋষভ আর আমার সম্পর্কটা নিয়ে দুই পরিবারের আগ্রহই চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিলো, তাই সেটা থ্রুটফুল নাহলে ব্যবসাও আলাদা হবেই।
অনীত উঠলো, আনিশাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
-ঋষভ এক্সপেক্ট করে, না?
-ভালোবাসে।
-ওহ, আর তুমি?
-আমার অনেক ঋণ ঋষভের কাছে, নীত। আমাকে সাহায্য করেছে, মা-বাবাকে দেখেছে...
-ঋণের বশেই কি বিয়েতে হ্যাঁ বলা?
আনিশা চমকে তাকালো –তুমি জানতে?
-সারা ভারত জানে, নিশা।
-জেনেও...
-জেনেও? দূরে ঠেলতাম তোমায়? পারিনি। স্বার্থপর হয়েছি এইক’দিন। নিজের ভালোবাসার কথাটাই জানিয়েছি সারাক্ষণ। আমি যে বদলে গেছি সেটা বুঝিয়ে ভরসা দিয়েছি। এরপরেও হেরে গেলে অন্তত নিজের কাছে সৎ থাকার চেষ্টা তো করেছি, কী বলো?
আনিশা অবাক চোখে দেখছিলো অনীতকে।
-কী এতো দেখছো?
-আমার ভালোবাসার মানুষটাকে, কতটা বুদ্ধিমান হয়েছে ভাবছি। ভাগ্যিস ভালোবাসা দিয়েছো নীত, ভাগ্যিস আটকেছো, নাহলে কবে ভেসে যেতাম...
-আছি তো আমি।
অনীত আনিশার গালে চুমু খেলো।
-থাকবোও সারাজীবন।
-মাম্মা...
অনীশের ডাকে ঘুরে তাকালো দুজনেই, আনিশা বললো
-জেগে গেছো, বাবাই?
-তুমি কই...
অনীত ছেলেকে কোলে করে নিয়ে এলো আনিশার কাছে।
-এই যে তোর মাম্মা।
আনিশা কোলে নিলো বাবাই-কে।
-ঘুম ভেঙে গেলো, বাবাই?
-তুমি না থাকলে ঘুম আসে?
-মুম্বাই গেলেও সবসময় মাম্মার কাছে ঘুমোবে বাবাই?
-আমি, বাপি আর তুমি। বাপিকে নেবে তো, মাম্মা?
আনিশা অনেক আদর করে দিলো অনীশকে।
-নেবো। বাপিকে ছাড়া মাম্মা পারবে নাকি একা অনীশকে রাখতে?
অনীত বললো –মাম্মা খুব স্ট্রং। মাম্মা পারবে। কিন্তু বাপিও চায়, মাম্মা আর বাবাই-এর সাথে সবসময় একসাথে থাকতে।
নিশ্চিত হলো অনীশ। ঘুমিয়ে পরলো।
রাতে অনীশ ঘুমলে অনীত বললো
-বিয়েটা ভাঙলে বড় সোরগোল হবে কিন্তু, নিশা। তুমি ভেবে এগিয়ো।
-জানি, অনেক চাপও আসবে। তবে আমার আর ভাবার কিছু নেই। তোমাকে, বাবাইকে ছাড়া থাকতে পারবো না।
-মিডিয়ার চাপও কম না।
-জানি। আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত। নীত, একটা জিনিস অ্যারেঞ্জ করতে পারবে?
-বলো।
-ব্যাকডেটে রেজিস্ট্রির নোটিশ ফেলতে পারবে, আমাদের? টাকাপয়সা যা লাগে, আমি দেবো।
-বেশ, কালই চেষ্টা করছি। আমার এক বন্ধুর মামা রেজিস্টার।
-এমনভাবে ফেলো যে কাল-পরশুর মধ্যেই আমরা রেজিস্ট্রি করে নিতে পারি। সময় বড্ড কম।
অনীত আনিশার উতলা হওয়ার যৌক্তিকতা বুঝলো।
-বেশ, আমি একশো ভাগ চেষ্টা করছি।
-কাল বা পরশু নীত। আর দেরি নয়, এমনিই দেরি হয়ে গেছে অনেক।
আনিশার আর কিচ্ছু ভাববার নেই। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও, এই বিষয়ে। অনীত বদলেছে, ঠিক আনিশা যেমনটা চাইতো তেমনটাই হয়ে গেছে ও। তাহলে আর ভাববে কেন! সমস্ত পরীক্ষা নেওয়া শেষ যে।
অনীত সম্মত হলো, আর দেরি করা ঠিক হবে না। আনিশা যখন মনস্থির করেই ফেলেছে দেরি করা সমীচীন হবে না। আটবছর আগে অসাবধানতাবশত যাকে হারিয়ে ফেলেছিলো, তাকে যখন একবার ফিরে পেয়েছে, তখন আর হারাবে না অনীত। কোন মূল্যেই হারাবে না। আরো একটা কাজ করতে হবে, নিশার সাথে রেজিস্ট্রি করার পর, বাবাই-এর অ্যাডপশনের পেপারে আনিশার নাম ঢোকাতে হবে। আইনত বাবাই-এর মা তখনি হতে পারবে মেয়েটা। অনীতের স্ত্রী হলে সেটা সহজেই সম্ভব হবে, মুম্বাই-এ গিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে হবে অনীত-কে। নতুন চ্যালেঞ্জ থাকবে অনেক, নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদও থাকবে, অনেক বিতর্ক থাকবে বিষয়টাকে ঘিরে। সবকিছু সামলেই জিততে হবে অনীতকে, জিততেই হবে।
২০
বিদিশাকে দেখে একবারেই চিনতে পেরেছিলো আনিশা। বছর আটেক আগে দেখলেও স্পষ্ট মনে আছে। ঋষভের অফিসে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছিলো, ঋষভের পি-এ। আনিশা মুম্বাই যাওয়ার মাসখানেকের মধ্যেই মেয়েটা কলকাতায় ফিরে যায়। কেন, কী বৃত্তান্ত ঋষভ কখনো বলেনি – আনিশারও কাজের চাপে মনেই ছিলো না। কিন্তু আজ বিদিশাকে সামনাসামনি দেখেই চিনতে একমুহুর্তও লাগেনি ওর। বিদিশাও চিনেছে, আনিশা গুপ্তা-কে না, ব্যক্তি আনিশাকে। সেটা ওর চোখ মুখ দেখেই বুঝেছে অনিশা। অনীত ওর বন্ধুর রেজিস্টার মামার কাছে গিয়েছিলো, সকালেই। বিদিশা তখনই এসেছে। ম্যাম এসেছে দেখে অনীশ ছুট্টে এসে সোজা ম্যামের কোলে। আনিশা এটুকু সময়েই বুঝেছে বাবাইয়ের উপর আনিশার মতোই আরো একজনের স্নেহের গভীর প্রভাব আছে। একঅদ্ভুত মায়ার বাঁধন আছে দুজনের মধ্যে। যেটা অল্পক্ষনের মধ্যেই বোঝা যায়। বিদিশার সাথে একান্তে কথা বলা দরকার আনিশার।
-বাবাই-
-হ্যাঁ, মাম্মা?
-আমরা কি আর আঁকাটা কমপ্লিট করবো না?
ছেলেকে নিয়ে সকালেই আঁকতে বসেছিলো আনিশা।
-করবো তো, ম্যাম এসে গেলো, ম্যামও আঁকবে।
বিদিশা আনিশার উদ্দেশ্য বুঝেই বললো
-বাবাই- তুই আঁকাটা কমপ্লিট কর, আমরা এসে দেখছি।
অনীশের কথাটা মনের মতো না হলেও ম্যামের কথা নড়চড় করা যায় না তাই চুপচাপ চলে গেলো ও।
আনিশাই কথা শুরু করলো।
-প্রায় আট বছর পর তোমাকে দেখলাম, বিদিশা।
-চিনতে পেরেছেন তবে?
-চিনবো না? আমার স্মৃতিশক্তি দুর্বল নয়। হঠাৎ মুম্বাই ছেড়ে সেই যে চলে এলে আর কোন খোঁজই পাওয়া গেল না তোমার।
বিদিশা মুচকি হাসলো।
-মুম্বাইয়ে আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিলো।
-আগে তো আঁকতে, এখানে কী শুরু থেকেই স্কুলে?
-আঁকাটাও মুম্বাইয়ের সাথেও ছেড়েছি। বছর ছয়েক স্কুলেই, তারপর বাবাই-এর কাকাই এর সাথে বছর পাঁচেক আগে বিয়ের পর আরো সংসারে বেঁধে গিয়ে সেসব আর হয় না।
-সৌমিকের খুব প্রশংসা করে অনীত। আমিও আলাপ করে দেখলাম, খুব সরল ছেলে। তোমারও প্রশংসা করে খুব, বাপ ছেলে দুজনেই, তুমি না থাকলে বাবাই-টাকে বড় করতে পারতো না, বারবার বলে তোমার দাদাভাই।
-ভালো। তবে সে প্রয়োজন তো এখন ফুরিয়েছে, আপনি চলে এসেছেন, অনীশের মা।
আনিশা জানতো এই কথাটা উঠবে। এই দ্বন্দ্ব-টার জন্য প্রস্তুত ছিলো ও।
-হ্যাঁ, তা এসেছে। কিন্তু মা চলে এলেই কি ম্যামের কাজ শেষ হয়, দেখলে না কতটা ভালোবাসে তোমায়, আসতেই কিভাবে বুকের মধে ঝাঁপিয়ে পড়লো!
বিদিশাকে ভালোবাসে বাবাই। আনিশা তাই কোন টানাপোড়েন চায় না।
-বাবাইকে আমিও বড্ড ভালোবাসি।
-বুঝি। তোমার শরীর এখন ঠিক আছে তো? বারবার এসব হলে তো...
-চলছে কোনক্রমে।
-ভালো ডাক্তার দেখাচ্ছো?
-নাহ। আর ডাক্তার দেখাবো না, অনেক হলো। সৌমিক আর আমি ঠিক করেছি অ্যাডপ্ট করবো।
আনিশা অবাক হলেও মুখে কিছু বললো না। বিদিশা বললো
-মুম্বাই কবে ফিরছেন?
-একটু গুছিয়ে নিই, সবটা।
-ঋষভ, আই মিন স্যারের সাথে বিয়েরও তো দেরি নেই... মিডিয়াতে দেখলাম...
আনিশা সতর্ক হলো। মেপে কথা বলতে হবে। বিদিশার সাথে ঋষভের যোগাযোগ কতটা আছে ও জানে না। ঋষভের মায়ের বেশ কাছের ছাত্রী ছিলো বিদিশা। এমনটাও শুনেছে একসময়।
-দেখি কতটা কি হয়। আপাতত বাবাই আমার প্রায়োরিটি। বহুবছর পর এভাবে মা পেয়েছে ছেলেটা, আগে ওকে নিয়ে আমার সমস্ত ভাবনা বাস্তবায়িত করি... তারপর...
-আপনি মুম্বাই-এ যাওয়ার সময়ই প্রেগন্যান্ট ছিলেন, তাই না?
বাবাই-এর মাতৃত্ব নিয়ে প্রশ্নটা করছে বিদিশা। বুঝেই আনিশা মনে মনে হাসলো। একটা সুবিধা আছে, ওকে মিথ্যা বলতে হবে না পুরোপুরি।
-কাছাকাছি সময়েই হয়েছে সব, বিদিশা। বাবাইয়ের জন্ম- অনীতের সাথে সেপারেশন- আমাদের ডিভোর্স- আমার মুম্বাই যাওয়া...
আনিশা ইচ্ছা করেই প্রেপন্যান্সির সময়কাল স্পষ্ট করলো না। ঋষভ, ঋষভের মা- দুজনের কাছেই খবর দিতে পারে বিদিশা মেয়েটা। বাবাই-এর মাতৃত্বের উপর কোন প্রশ্নচিহ্ন আসুক চায় না আনিশা। তাই ঘটনাবলী-কে সঠিক ক্রমে ইচ্ছা করেই বললো না।
-তোমার দাদাভাই-এর সাথে দূরত্বটা তখন এতোটাই ছিলো যে বিচ্ছেদটা এড়াতে পারিনি। এতবছর পর ফিরে এসে দেখছি বদলে গেছে মানুষটা। যাকে আমি কলেজে ভালোবেসেছিলাম ঠিক তার মতোই হয়ে গেছে। উপরি পাওনা ওর বাপির সযত্নে মানুষ করা আমাদের সন্তান। তাই এর বাইরে আপাতত কিছু ভাবছি না।
-দাদাভাই-এর সত্যি তুলনা হয়না। যদি পারেন, সব ভুলে নতুন করে সব শুরু করুন না দুজনে, বাবাইকে মাঝে রেখে। যদি না সারা ভারতের সামনে কি জবাবদিহি করবেন সেটা নিয়ে বেশি চিন্তিত না হন।
বিদিশা কথাটা বলেই ফেললো, মনের কথা। ঋষভ আনিশাকে পেয়ে সুখী হোক –বিদিশা কখনোই চায় না।
আনিশা হাসলেন।
-আমি জানি, তোমার দাদাভাই-এর মতো কেউ হয় না। আর জবারদিহির ভয় আমি পাই না বিদিশা, কখনো পালাইনি তাই কোথাও থেকে।
বিদিশা কথার ইঙ্গিতটা বুঝলো
-যে পালায়, তার পালানোরও যথেষ্ট কারণ থাকে।
-কারণটা কী?
-আপনার মুম্বাই আসা।
-মানে!
বিদিশা হাসলো।
-মানেটা খুব সহজ। আমি আর ঋষভ একটা রিলেশনশিপে ছিলাম তখন। আপনি মুম্বাই আসতেই ঋষভের মনে হলো ও আপনাকে পেতে পারে, তো আমি কেন? ব্রেক আপ করলো, আমিও আর সম্মান খুইয়ে থাকাটা সমীচীন মনে করলাম না।
-হোল্ড অন, তুমি আর ঋষভ রিলেশনশিপে ছিলে! কই, ঋষভ তো কখনো বলেনি আমায়।
-লুকিয়েছে। সন্দেহ হলে ম্যাম-কে মানে ঋষভের মা-কে ফোন করতে পারেন, রঞ্জিত আঙ্কেলকেও।
আনিশা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো। ঋষভ এত বড় কথা লুকিয়েছে ওকে!
ডোরবেল বেজে উঠলো হঠাৎ, অনীশ ছুটে এলো ঘর থেকে।
-বাপি এসেছে, মাম্মা।
আনিশা সামলে নিয়েছিলো, অনীশকে কোলে তুলে নিলো।
-বাপি এসেছে বলে দুষ্টুটাকে আঁকা ছেড়ে উঠে আসতে হবে?
বাবাই-এর দু’গালে চুমু খেলো আনিশা।
-সরি, মাম্মা। সরি, ম্যাম।
বিদিশা আনিশার সাথে অনীশকে দেখছিলো, মায়ের কোলে খুব খুশি লাগে বাবাই-কে। এই খোলামেলা হাসিটা ও আগে কখনো দেখেনি। বিদিশার নিজের সন্তান বিদিশার কোলে চড়লেও এমনই লাগবে।
-আমি দেখছি।
দরজা খুলতে গেলো বিদিশা।
-কাকাই!
সৌমিককে দেখে লাফিয়ে উঠলো অনীশ।
-এই যে! কাকাই চলে এসেছে তো, বৌদি, কেমন আছো?
-ভালো আছি গো।
-দাদাভাই কই?
-একটু বেরিয়েছে।
-ঐ পা নিয়ে?
-উবেরে গেছে ভাই। জরুরি ছিলো। চা খাবে?
-না, না। অফিসে যাবো। বিদিশা বাড়ি যাবে তো?
-আমার কয়েকটা কাজ আছে সৌমিক।
-আজও?
-হ্যাঁ, কাজ শেষ হলে তোমাকে বলবো।
-এই শরীরের অবস্থায় এতো ছুটে চলেছো...
-চিন্তা করো না, কাছের মানুষদের আশ্রয়ে আছি। চলি- আমাকে যেতে হবে, আনিশা ম্যাম, আসছি। বাবাই, আসছি।
-পড়াবে না ম্যাম?
-ক’দিন পরে বাবাই। মাম্মা, বাপির কাছে ক’দিন পড়ে নাও, কেমন?
ব্যতিব্যস্ত হয়ে চলে গেল বিদিশা। আনিশা-কে অনেক কটা হেঁয়ালির সামনে রেখে গেলো। ঋষভ আর বিদিশার কি সত্যিই সম্পর্ক ছিলো? যদি থাকেও ঋষভ তা বলেনি কেন? বিদিশাই বা এতোদিন পর বলছে কেন এসব? আজ সৌমিককে দেখেই চলে যাওয়াটা কেমন অসংলগ্ন লাগলো। ওদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সব ঠিক আছে তো!
-মেয়েটার জন্য চিন্তা হচ্ছে বৌদি।
সৌমিকের কথায় তাকালো বিদিশা।
-একটু বেশিই স্ট্রেস নিচ্ছে মনে হয়।
-হ্যাঁ, ইস্যু নিয়ে। আমার দিক থেকে কোন চাপ নেই যদিও, কিন্তু বাড়িতে জানোই তো...
-হ্যাঁ, বুঝি। বাবাই... যাও তুমি আঁকাটা শেষ করে নাও।
অনীশকে ঘরে পাঠালো আনিশা। এসব ও শুনুক- চায় না।
-অ্যাডপশন করতে চায় বলছিলো।
-আমার অমত নেই, দরকার হলে বাড়ি থেকে আলাদাও থাকবো। কিন্তু সেই সন্ধানটা তো দুজনে একসাথে করাই তো ঠিক, তাই না? অথচ কি একটা যেন খুঁজে বেরাচ্ছে বিদিশা। আজ এক বন্ধুর বাড়ি থাকছে তো কাল অন্য কোন খানে...
-হয়তো খোঁজ করছে কোথায় যাওয়া ভালো।
-একসাথে নয় কেন সেটা?
-একটু স্পেস দাও সৌমিক। ও-কে আমার বেশ ডিস্টাবর্ড মনে হলো।
-দাদাভাই-ও তাই বললো। উঠছি বৌদি, দাদাভাই এলে বলো এসেছিলাম।
-আচ্ছা।
সৌমিক চলে গেলেও বিদিশা, আনিশার সামনে বেশ কয়েকটা প্রশ্ন রেখে গেলো। যার উত্তর যার কাছে তাকে এইমুহুর্তে নক করতে চায় না আনিশা, সচেতন করতে চায় না। আগে অনীত আর ওর রেজিস্ট্রিটা নির্বিঘ্নে হোক। তারপর বিদিশার স্বীকারোক্তিকেও প্রয়োজনে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করবে আনিশা।
২১
রঞ্জিতের সাথে একছাদের তলায় ছাব্বিশবছর পর থাকবেন চিত্রাঙ্গদা, ছাব্বিশবছর বড্ড দীর্ঘসময়। এরমধ্যে ঋষভকে ঘিরে কিছু অনুষ্ঠানে দু’জনের দেখা হয়েছিলো। কিছু কথাও হয়েছিলো সামনাসামনি তখন। ফোনে নিয়মিত কথাটা ছাব্বিশবছর নিরবিচ্ছিন্নই ছিলো। কিন্তু সেসবের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবারের ব্যাপারটা। চিত্রাঙ্গদা বিষয়টাকে নিয়ে আশঙ্কিত ছিলেন তাই। রঞ্জিত খুব পারফেক্টশনিষ্ট, সময়ের দিক থেকে, পছন্দের দিক থেকেও। সব ঠিক জিনিস ঠিক সময় হাতের কাছে চাই ওর। এদিকে এবাড়িতে সবকিছুই খেয়ালখুশি মতো চলে। ঘড়ির কাঁটা ধরে না। অর্ধেন্দু সারাদিন নিজের লেখা নিয়ে ব্যস্ত। মেয়েও সবসময় নিজের কলেজ, টিউশান আর আঁকার জগতে থাকে। যেটুকু গোছানোর সেটা চিত্রাঙ্গদাকেই করতে হয়, যে কিনা রঞ্জিতের কথায় ভীষণ অগোছালো।
অর্ধেন্দু রঞ্জিতের আসা বা থাকা নিয়ে অমত করেননি। বাবুসোনার বিয়ের সময় এটা খুব স্বাভাবিকই ঠেকেছে তার। বিয়ের একটা রিসেপশন কলকাতায় হোক খুব সাধ লোকটার। ঋষভও বাপির কথায় অমত করে না। এবার দুবাই হয়ে প্যারিস যাওয়ার আগে ওর বাপিকে কথা দিয়ে গেছে এখানে একটা রিসেপশন হবে। বোনকে ভীষণ ভালোবাসে ঋষভ। মৃত্তিকাকে বিয়ের একসপ্তাহ আগে থেকে মুম্বাই যেতেই হবে বলে রেখেছে। সেও দাদাভাই এর বিয়ের আনন্দে মশগুল। ঋষভ যখন আঠারো, কলেজ পড়তে কলকাতায় এলো, মৃত্তিকার বছর দুই। যে পাঁচ-ছয় বছর ঋষভ কলকাতায় ছিলো বোনকে কোলেপিঠে মানুষ করেছে। মুম্বাইয়ে গিয়েও বোনের খোঁজ সবসময় রাখে সে। এমন একটা ছেলে হঠাৎ করেই আনিশাকে দেখে বিদিশাকে ছেড়ে দিলো কি হিসাবে? আনিশার তখনো ডিভোর্স হয়নি, বিয়েতে মত দিতেও তো আটবছর নিলো, আটবছর আগের চাল কি তখনই সাজিয়ে নিতে পেরেছিলো ঋষভ? একেবারে রঞ্জিতের মতোই তো বলতে হয় তাহলে ওকে। সন্তান সম্ভাবনা শুনেও অ্যাবর্ট করতে বলার মতো মানসিক জোর চিত্রাঙ্গদার বাবুসোনা পেলো কোত্থেকে ভাবলেই কাল থেকে নিজের কাছে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছেন চিত্রাঙ্গদা।
রঞ্জিত এ বাড়িতে আসা থেকে অবাক করছে চিত্রাঙ্গদাকে। ছাব্বিশ বছরে তবে অনেক বদলে গেছে ও। সবকিছুই হাতের কাছে চায়, কিন্তু নিজে করে নিতেই পছন্দ করে। একাকীত্ব ওকে মনে হয় এই বিষয়টাতে অভ্যস্ত করে তুলেছে। চিত্রাঙ্গদারই ষাট হতে চললো, রঞ্জিতের বছর বাষট্টি বয়স। অথচ এখনো ভীষণ ফিট, জিম করে নিয়মিত, বোঝা-ই যায়। সবচেয়ে বড় কথা, মৃত্তিকার সাথে খুব ভালো ভাবে মিশে গেছে এসে থেকেই। মৃত্তিকা ভীষণ ভয়ে ছিলো, দাদাভাই-এর কাছ থেকে শুনেছে দাদাভাই-এর বাবা খুব পাংচুয়াল, খুব মেথডিক্যাল, পারফেক্টশানিস্ট আর রাগীও। তাই মায়ের কাছ থেকে যখনই শুনেছে উনি আসবেন আবার থাকবেনও তখন থেকেই টিউশনের বাহানায় পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিলো। এর মধ্যে একবার দু’বার চিত্রাঙ্গদার সাথে রঞ্জিত মেয়েকে দেখলেও সামনাসামনি বসে কথা বলা হয়ে ওঠেনি খুব একটা। এবার রঞ্জিত এসে ফ্রেশ হয়েই তাই বলেছিলেন
-তোমার মেয়ে কোথায়, কলেজ?
চিত্রাঙ্গদা অর্ধেন্দুর দিকে তাকালেন, অর্ধেন্দু বললেন
-না, পড়ছে। স্টাডিতেই আছে, ডাকবো?
-না, না, পড়ছে যখন, পড়ুক। আমিই যাচ্ছি, ওর জন্যে একটা জিনিস এনেছি, তাই।
চিত্রাঙ্গদা অবাক হলেও মুখে কিছু বলেননি। মেয়ের স্টাডিতে যেতে যেতে রঞ্জিতকে বললেন
-মৃত্তিকা কিন্তু খুব শাই আর আবেগপ্রবণ।
রঞ্জিত মুচকি হাসলেন।
-তোমার মেয়ে, এমনই তো হবে, ডাকনাম কি?
-মাম্,
-আমাকে কি বলে ডাকবে? দাদাভাই-এর বাবাটা কেমন কেমন শোনাবে না?
চিত্রাঙ্গদা হেসে ফেললেন।
-ঋষভ বলেছে এটা?
-হ্যাঁ, বোনকে খুব ভালোবাসে। বোন নিয়ে প্রচুর গল্প ওর। বোনকে মুম্বাই নিয়ে যাবে ওর সাথে, ব্যবসাতে বোনের ক্রিয়েটিভিটি কাজে লাগাবে – আনিশাকেও অনেকবার বলেছে একথা।
-ষোলো বছর বয়সের ফারাক দু’জনের। আমি প্রথমে আশঙ্কিত ছিলাম বাবুসোনা বোনকে কীভাবে নেবে ভেবে, এখানে যবে থেকে থাকতে এলো আমার সব আশঙ্কায় জল ঢেলে দিয়ে মামের সব দায়িত্ব নিজে নিয়ে নিলো।
-বুঝদার ছেলে, বাবার মতো হয়েছে একদম।
-এই যে বলো নিরানব্বই ভাগ আমার মতো?
রঞ্জিত চোখ মারলেন।
-একভাগটাই বেশি জোরালো। তোমার নিরানব্বই ভাগের চেয়ে।
চিত্রাঙ্গদা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, খেয়াল করলেন মামের ঘরের দরজার সামনে এসে গেছেন ওনারা, মাম ওদের দু’জনের হাসি মুখকে গভীরভাবে দেখছে।
-মাম... তোর পড়ার চাপ শুনে নিজেই চলে এলো।
চিত্রাঙ্গদা ইতস্তত করলেন, রঞ্জিত হাত ধরলেন
-আসলে মামের দাদাভাই-এর মুখে এতো প্রশংসা যে সামনাসামনি আলাপটা আরও বাড়াবার ইচ্ছা হলো।
মৃত্তিকা অস্বস্তিতে পড়েছিলো। দাদাভাই বলে দাদাভাইয়ের বাবা রাগী, গম্ভীর, দু’একবার ওর নিজের দেখেও তাই মনে হয়েছে। কই, আজ তো তেমন মনে হচ্ছে না। আজ বেশ অন্যরকম লাগছে, হাসিখুশি, আলাপ জমাতে আগ্রহী। নাকি ও বড় হয়েছে বলে অন্যরকম লাগছে?
-বসতে পারি?
মৃত্তিকার উল্টোদিকের চেয়ারটা দেখালেন রঞ্জিত। মৃত্তিকা লজ্জিত হলো
-বসুন না... মা... খেয়েছেন কিছু উনি?
চিত্রাঙ্গদা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, রঞ্জিত থামালেন
-এসে ফ্রেশ হলাম। তারপরই শুনলাম চিত্রার পরী মেয়েটা স্টাডিতে বসে আছে। মেয়েকে ছাড়া খাবার টেবিল কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগবে, না? তাই ডাকতে এলাম।
চিত্রাঙ্গদা ভাবছিলেন রঞ্জিত এতো কথা শিখলো কোত্থেকে? নাকি ব্যবসা করতে করতে এসব শিখে ফেলে মানুষ।
-ওহ্। অ্যাম সরি। আসলে কলেজের কাজ ছিলো তো... নীচে চলুন...
-ইটস্ ওকে। বাপের সামনে মেয়ে এতো ফর্ম্যাল হলে কী ভালো লাগে! কি বলো, চিত্রা?
চিত্রাঙ্গদা বুঝলেন লোকটা সহজ হতে চাইছে।
-একদম, আসলে ওর দাদাভাই-এর কাছে শুনেছে হয়তো তোমার ব্যাপারে...
-তা ঠিক, বাবুসোনা কি বলেছে, মাম?
মৃত্তিকা চমকে তাকালো
-আমি রাগী, গম্ভীর, চুপচাপ, ডিসিপ্লিনড –এসব?
-না, তেমন কিছু না।
-বললে ঠিকই বলেছে, তবে সেটা ছেলের সাথে হওয়াই যায়। মেয়ের সাথে বাবা এমন হলে মানায়? কী বলিস্?
চিত্রাঙ্গদা মৃত্তিকার অবাক ভাব দেখেই বললেন
-তোমার তো মেয়ের শখ ছিলো বরাবর, ঋষভের সময়ও মেয়েই চেয়েছিলে।
রঞ্জিত মুচকি হাসলেন।
-ঠিক, তবে এমন পরীর মতো মেয়ে যাব, ভাবিনি। আর এতো গুণী, বাবুসোনা তো সবসময় বলে বোন কতো ভালো আঁকে, বোনকে মুম্বাই নিয়ে যাবে, কীভাবে বোনের ক্রিয়েটিভিটি-কে কাজে লাগাবে...
-দাদাভাই বলে তোমায়, মানে আপনাকে?
-বাবাকে আপনি বলে? দাদাভাই-এর বাবাটা শুনতে খারাপ লাগে, না?
রঞ্জিত মৃত্তিকার হাত ধরলেন।
-বলিনি তো কখনো...
-তাতে কি? মা’কে জিজ্ঞাসা কর, আপত্তি আছে নাকি মায়ের।
চিত্রা মেয়ের পিঠে হাত রাখলেন
-ও খুব লাজুক, রঞ্জিত।
-জানি। তাই গ্রুম করছি। ব্যবসাটা সামলাবে নাহলে কি করে?
-বাবা বলি তো... বাবাকে, কী বলে ডাকবো তবে তোমায়?
রঞ্জিত ভাবলেন –ক্রিয়েটিভ কিছু ভাব, ভেবে ডাকিস, এখন চল বড্ড খিদে পেয়েছে। ও হ্যাঁ, তোর জন্য এনেছি এটা...
কোটের ভিতরের পকেট থেকে বার করলেন রঞ্জিত।
-তোর দাদাভাই বলছিলো... বোনের আবদার। তা সে তো প্যারিসে, তাই আমিই নিয়ে এলাম।
মৃত্তিকা মায়ের দিকে তাকালো। আই ফোনের লেটেস্ট মডেল, দাদাভাই খুব করে বলছিলো কি নিবি বল, বলে অপশনও দিয়েছিলো অনেক, জোরাজোরিতে বলে ফেলেছিল মৃত্তিকা। কিন্তু দাদাভাই সেটা বলে দেবে আর উনি নিয়ে আসবেন তা তো জানতো না, মা এসব বিলাসিতা মোটেও পছন্দ করে না, বকবে এবার।
চিত্রাঙ্গদা মৃত্তিকার দিকে তাকালেন, মৃত্তিকা ফিসফিস করে বললো
-দাদাভাই-ই বলেছিলো...
-নিয়ে নে, কত মনে করে এনেছে বলতো লোকটা।
চিত্রাঙ্গদা মেয়েকে আশ্বস্থ করলেন, মৃত্তিকা নিলো
-থ্যাংক ইউ।
-থ্যাংক ইউ, এরপর?
-তুমি যেটা চাইবে।
-বাবা বাদে, তাই তো?
মৃত্তিকা বললো –বাপি বলি? দাদাভাই বাবাকে বলে।
রঞ্জিত চিত্রাঙ্গদার দিকে তাকালো।
-বাপি বলবে মাম্?
চিত্রাঙ্গদা মৃদু হাসলেন।
-তোমাদের বাপ মেয়ের ব্যাপারে আমাকে টানা কেন?
রঞ্জিত মৃত্তিকার হাত ধরলেন, চুমু খেলেন হাতে।
-কারণ তুমি আমাদের বাপ মেয়ের মধ্যেকার সেতু যে, তুমি না থাকলে এমন পরীর মতো মেয়ে পেতাম কোথায়!
-রঞ্জিত!
চিত্রাঙ্গদা জীবনে রঞ্জিতের মুখে এই কথা শুনবেন ভাবেননি।
-অবাক হচ্ছো কেন? মন থেকেই বলছি।
-অ্যাম আই দ্যাট স্পেশাল, বাপি?
মৃত্তিকা অবাক হলো।
-ইউ আর, মাই চাইল্ড। কেন, বিশ্বাস হচ্ছে না?
-দাদাভাই তো বেস্ট। সবচেয়ে স্পেশাল, মায়ের কাছে, বাবার কাছে, তোমার কাছে।
রঞ্জিত হেসে ফেললেন
-মায়ের কাছে হতে পারে, বাপির কাছে দু’জনেই সমান স্পেশাল।
চিত্রাঙ্গদা মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন।
-মায়ের কাছেও তাই, দুজনেই একইরকম স্পেশাল।
-এবার খিদে পাচ্ছে না, তোমাদের?
মৃত্তিকার কথায় হেসে ফেললো রঞ্জিত আর চিত্রাঙ্গদা।
-চলো, নীচে যাই।
চিত্রাঙ্গদা বললো।
২২
বেশ বিকাল হয়ে গিয়েছিলো অনীতের ফিরতে ফিরতে। রেজিস্টার-কে রাজি করাতে পেরেছে, তবে কাঞ্চনমূল্য লাগবে অনেক। আনিশার সাহায্য ছাড়া ওর পক্ষে তা সম্ভব নয় বলেই অনেক ইতস্তত করেই আনিশাকে হোয়াটস্যাপে লিখেছিলো কথাটা। একবারে রাজি হয়ে গিয়েছিলো আনিশা। কাল রেজিস্টার বাড়ি এসে রেজিস্ট্রি করাবেন, সকালেই। আনিশাকে শুধু মোটা অঙ্কের চেক লিখে দিতে হবে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে ট্যাক্সিতে সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিলো অনীতের। আনিশার সামনাসামনি জীবনে আর কখনো দাঁড়াতে পারবে না ভাবতো এতদিন। অথচ বিগত কয়েকদিনেই আনিশার মনে নিজের জায়গাটা পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে অনীত, অবলীলায়। নাকি জায়গাটা বরাবরই ছিলো, হারায়নি। অনীতের বদলে যাওয়া যে দূরত্বটা সৃষ্টি করেছিলো দু’জনের মধ্যে সেটা একজন্মের ব্যবধান মনে হলেও আনিশার ভালোবাসার নামটা বদলায়নি কখনো। তাই নিজেকে আনিশার মনের মতো করে আনিশার সামনে নিয়ে যেতেই সেই জায়গাটা অনীতেরই হয়েছে, আবারও।
ঋষভের সাথে তাহলে আনিশার কি ছিলো? শুধু বন্ধুত্ব? কৃতজ্ঞতা? পারস্পরিক সম্মান? দুই পরিবারের মধ্যস্থতা? তাতেই বিয়ের মতো একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে কেন রাজি হলো আনিশা? একা থাকা যায় না বলে? সমাজ কি ভাববে বলে? নাকি অবলম্বন চাই বলে? সন্তান? সন্তানও একটা চাওয়ার বিষয় হতেই পারে। প্রতিটি মানুষই হয়তো নিজের সন্তান কামনা করে। স্বাধীনচেতা সফল আনিশাও কি সমাজ, পরিবার, সন্তান এইসব অংকেই ঋষভকে সেই স্থান দিতেও সম্মত হয়েছিলো, যেটা ঋষভের ছিলোই না কখনো! যদি অনীতের সাথে আনিশার আর কখনো দেখা না হতো, যদি বাবাই-এর স্কুলের সামনে বাবাই আনিশার গাড়ির সামনে না পড়তো, তবে তো ঋষভ কৃতজ্ঞতার মূল্যে আনিশার জীবনে সেই জায়গা পেয়ে যেত যা ওর ছিলোই না কখনো। একে নিজের সৌভাগ্য বলবে অনীত নাকি ঋষভের দুভাগ্য নাকি এক অদ্ভুত সমাপতন, যেটাই হোক তাকে নিয়ে বেশি না ভাবাই শ্রেয়। আনিশাকে গিয়ে বলতে হবে কালই রেজিস্ট্রি। কালই- ভীষণ খুশি হবে মেয়েটা। কোনমতেই দেরি করতে চাইছে না ও। কিছু একটার ভয় পাচ্ছে, সেটা কি জানে না অনীত। বদনাম হওয়ার ভয় তো করে না আনিশা। তবে শুধু নাম হয়, ব্যবসা, খ্যাতি, প্রতিপত্তি, সাম্রাজ্য সবই বাজি লাগিয়েছে ও। অনীতের সাথে বিয়ে হলে আনিশাস ক্রিয়েশানকে একলা চলতে হবে। ঋষভ বা ঋষভের বাবার ব্যাকিং ছাড়া। এতে ইন্ডাস্ট্রিতে আনিশার পজিশন বিপন্ন হতে পারে, আর্থিক ক্ষতি হতে পারে, সবকিছু মেনেও ও বিয়েটা করতে চায়। অনীতের জন্য, নিজের ভালোবাসার জন্য, নিজের আবেগের সাথে সৎ থাকার জন্য, সর্বোপরি বাবাই-এর জন্য। বাবাই এর মা হওয়ার জন্য ওর ব্যাগ্রতা অনীত জানে। আর সেই আয়োজনে কোন ফাঁক রাখতে চায় না মেয়েটা। আইনত বাবাই-এর মা হওয়া খুব জরুরী আনিশার কাছে। তার জন্য ও নিজের সবকিছুকেই বাজি রাখতে প্রস্তুত। এমনকি নিজের মা বাবার সাথে সম্পর্ককেও। ভয়টা মনে হয় এটা নিয়েই পাই যে কোনমতে রেজিস্ট্রির আগে আনিশার মা বাবা জেনে গেলে মিডিয়াতে বেফাঁস কথা বলতে পারে, সিনক্রিয়েট করতে পারে। তাই সেসবের আগেই বিয়েটা সেরে ফেলতে চায় আনিশা। ওর সেই আবেগ, সেই ইচ্ছা, সেই আস্থার প্রতি সম্মান জানিয়েই অনীত কালকেই আয়োজন করেছে ব্যাপারটার।
আনিশার চোখে হাজার তারার ঝলক দেখতে পেলো অনীত।
-কাল? সত্যি বলছো?
-ইয়েস ম্যাডাম, কাল।
-এই নীত... তুমি যে বললে পরশু কি তার পরের দিন?
অনীত মিষ্টি করে হাসলো
-কালই ডেট পেয়ে গেলাম যে।
আনিশা অনীতকে জড়িয়ে ধরলো, চুমুতে ভরিয়ে দিলো ওকে। সেই কলেজের দিনগুলোর মতো। অনীত থামালো না, কিছুক্ষণ পর অনীত নিজে থেকেই থেমে গেলো, বললো
-খুব খুশি আমি, নীত।
-আমিও, এতো খুশি জীবনে হয়নি। আমার হারিয়ে ফেলা রাজকন্যাকে আবার ফিরে পাবো, ভাবিনি যে কখনো।
-পেলে তো, খুশি এবার?
অনীত আনিশার কপালে চুমু খেল।
-ভীষণ, তুমি?
-এতো খুশি আর কিছুতে হইনি কখনো।
-কেন? এতো খুশি কিসের শুনি?
-আমার ভালোবাসার মানুষটাকে ফিরে পেলাম বলে। আর...
-আর?
-আমার সন্তানের মা হবার অধিকার পেলাম। সেটাই বা কম কি অনীত?
-স্বর্গসুখ সেটা, নিশা।
-ঠিক বলেছো। সারাদিন কি খেলে শুনি?
অনীত হাসলো –খাওয়া হয়নি তো।
-দেখেছো, কেমন বোকা তুমি, এসে বলবে তো যে খিদে পেয়েছে, খাবো।
-খবরটা না দিয়ে খেতাম কি করে? ছেলে ঘুমাচ্ছে?
-বাপি বাপি করে ঘুমিয়েছে অবশেষে। ওকে কাল স্কুলে পাঠাবে, প্লিজ?
অনীত আনিশার ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো। গভীরভাবে চুমু খেলো, অনেকক্ষণ। আনিশার চোখে জল দেখলো অনীত।
-কী হলো, পাগলি?
আনিশা অনীতের বুকে মাথা রাখলো।
-কিছু না গো।
-আমার নিশা হারাবার ভয় পাচ্ছে না তো... কিছু?
-তোমার নিশা পাওয়ার আনন্দে কাঁদছে নীত। তার প্রাপ্তির ভান্ডার আজ উপচে পড়ছে।
-ছেলেকে কাল স্কুলে পাঠানোই ভালো।
-হ্যাঁ, আমিও চাই না ও এসব সই সাবুদ দেখুক। বাবা-মার ডিভোর্স হয়েছিলো এটা ওর না জানাই ভালো।
-ঠিক, নিশা-
-হুঁ!
-ওর অ্যাডপশন পেপারে তোমার নাম ঢোকানোর কথাও বলে এসেছি। আমাদের ডিভোর্সের আগের ডেটে।
-তবে ওর নামের বার্থ সার্টিফিকেট আমার চাই অনীত। এটা আজই ভেবেছি।
অনীত চমকালো –কী বলছো! এটা হয় নাকি?
-যেটা সত্যি তাই বলছি, ও তো এসেছিলো আমার মধ্যে। আমার থেকেই তো-
আনিশাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো অনীত।
-বেশ, তাই ঠিক। তুমি যা চাও তাই হবে নিশা।
-আগে তুমি বলো তুমি মন থেকে এটাই মানো কিনা?
অনীত বললো
-এর বাইরে অন্যকিছু মানার কারণ নেই তো।
-তাহলে এনে দেবে, কথা দাও।
অনীত হাসলো –দেবো, এবার কিছু খেতে দেওয়া যাবে, ম্যাডাম?
আনিশা অনীতের ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো, আবার।
-এই যে এতো কিছু খেলে?
অনীত ভাবার ভান করলো
-এতোকিছু, কই না তো?
আনিশা কপট রাগ দেখালো
-অসভ্য একটা!
অনীতের ঠোঁট আনিশাকে আরো কিছু বলার আগেই চুপ করিয়ে দিলো আবার।
২৩
রঞ্জিত চিত্রাঙ্গদার বেডরুমের দরজায় নক করলেন। চিত্রাঙ্গদা তাকালেন। অর্ধেন্দু একটা সেমিনারে গেছেন। মৃত্তিকাও টিউশানে বেরোলো। চিত্রাঙ্গদা শাড়ি বদল করে তৈরি হচ্ছিলেন। রঞ্জিতের সাথে বেরোবেন বলে। বিদিশার বলে দেওয়া ঠিকানায়। বিদিশাও যেতে চাইছিলো সাথে। রঞ্জিত বুঝিয়ে নিরস্ত্র করেছেন। চিত্রাঙ্গদারও তাই-ই মত। শরীর খারাপ, অনেক ধকল গেছে মেয়েটার উপর, একটু বিশ্রাম নিক। খোঁজাখুঁজির ওনারাই করবেন। বাচ্চাটাকে খুঁজে পাওয়া গেলে বিদিশার হাতে তুলে দিয়ে একটু শান্তি পাবেন চিত্রাঙ্গদা। ঋষভকে কীভাবে সামলাবেন জানেন না, তবে রঞ্জিত নিশ্চয় কিছু করবেন।
-আসতে পারি?
-এসো না, হয়েই গেছে। রেডি, একদম।
রঞ্জিত চিত্রাঙ্গদার পিছনে এসে দাঁড়ালেন। আয়নায় দেখে চুল ঠিক করছিলেন চিত্রাঙ্গদা। রঞ্জিত আর একটু কাছে এলেন।
-বেশ লাগছে তোমায় চিত্রা।
চিত্রাঙ্গদা ঘুরে তাকালনে –তাই?
রঞ্জিত মাথা নাড়লেন –ঠিক তাই। ছাব্বিশটা বছর এতো কাছ থেকে দেখিনি তো। তাই আরো বেশি ভালোলাগছে।
-তাও ঠিক। তাহলে অদর্শণের গুণ। কী বলো?
রঞ্জিত চিত্রার কোমর জড়িয়ে ধরলেন।
-না, এতোদিন যেটা চেয়েছি সেটা ঘটতে দেখলে মানুষের ভালো লাগে বৈকি।
চিত্রাঙ্গদা রঞ্জিতের বাহুবন্ধন ছাড়ালেন না।
-কী চেয়েছো, শুনি?
-তোমাকে এতো কাছ থেকে দেখতে, আবারো।
রঞ্জিত চিত্রাঙ্গদার গালে চুমু খেলেন, চিত্রাঙ্গদা লজ্জা পেলেন।
-ধ্যাৎ! কী করছো!
-বেশি কিছুই না। আমার ছেলেমেয়ের মা’কে ভালোবাসছি।
-এসব ভালোবাসার কথা শিখলে কোত্থেকে বলো তো?
-ছাব্বিশ বছর ধরে একলা থেকে তোমার মনের মতো সবকিছুই হয়তো শিখে ফেলেছি, চিত্রা। চাইলে পরীক্ষা করতে পারো।
চিত্রাঙ্গদা রঞ্জিতের চোখ মুছে দিলেন।
-এতোটা মিস্ করতে! তাহলে একবারো বলোনি যে?
-জেদ ছিলো। ভাঙব তবু মচকাবো না। এখন মনে হচ্ছে খুব ভুল করেছি।
চিত্রাঙ্গদা রঞ্জিতের দিকে ঘুরলেন।
-এখন ভাঙছো যে!
-এখন যে আর বেশি সময় নেই- জীবন তো ফুরিয়ে আসছে।
-কী যে বলো।
-সত্যিটাই বলি। তোমাকে ভালোবাসি, এই কথাটা বুকের মধ্যে রেখে মরেও শান্তি পেতাম, বলো?
চিত্রাঙ্গদার চোখে জল এলো।
-থামাওনি কেন তবে আমাকে? ভুল করার হাত থেকে?
-তখন বুঝিনি যে- এতোটাই দেরি হয়ে যাবে- এই কথাটা বলার সময় আসতে আসতে।
চিত্রাঙ্গদার কপালে চুমু খেলেন রঞ্জিত। সমস্ত স্নেহ ঢেলে দিলেন তাতে।
-জানি, ভালোবাসো আমায়। আমাকেই ভালোবাসো। তবুও আমার ব্যস্ততা, আমার অমনোযোগ তোমাকে কেড়ে নিলো।
-আমার অস্থিরতা, আমার উচাটনেরও দোষ আছে, রঞ্জিত।
রঞ্জিত চিত্রাঙ্গদার চোখের পাতায় চুমু খেলেন
-তোমার অভিমান মুছে দিতে তো জানতাম আমি। কীভাবে হারিয়ে ফেললাম চাবিকাঠি-টা কে জানে?
-বদলে গেছিলাম, দুজনেই।
রঞ্জিত মাথা নাড়লেন
-উঁহু। কিচ্ছু বদলায়নি। দেখো না- কেমন এক আছি, সেই আগের মতো। চিত্রা- আজ কোথাও যাবে আমার সাথে? দু’জনে?
-ডেট? কাজটা করবে না?
-কাজটা করেই। যাবে, বলো না?
চিত্রাঙ্গদা হাসলেন –এমন তো চল্লিশ বছর আগে করতে- যখন প্রেম করতাম দুজনে।
-চল্লিশ বছর আগেই ফিরে যাই, চলো। আবার নতুন করে।
-তুমিও শিল্পীদের মতো কল্পনা করতে শিখেছো দেখছি।
রঞ্জিত হাসলেন।
-শিখবো না? বিখ্যাত শিল্পী চিত্রাঙ্গদা রায়ের হাজব্যান্ড – এটুকুও জানবো না?
চিত্রাঙ্গদার চোখের বিস্ময় পড়তে পারলেন রঞ্জিত। আবারো বললেন
-আমার কাছে যে স্ট্যাটাসটা বদলায়নি কখনোই। ঋষভের মা, আমার কে হতে পারে, চিত্রা?
চিত্রাঙ্গদা রঞ্জিতের বুকে মাথা রাখলেন।
-কেন এগোলে না জীবনে রঞ্জিত? কেন আর কাউকে-
-উত্তরটা আমার বুকেই আছে। কান পেতে শোনো-
-আমার জন্য তোমার জীবনটা-
রঞ্জিত চিত্রাঙ্গদাকে জড়িয়ে ধরলেন
-নষ্ট? না, কিচ্ছু হয়নি। এই তো আবারও পেয়েছি তোমায়।
-আমি যে অন্যের...
রঞ্জিত চিত্রাঙ্গদাকে থামিয়ে দিলেন
-ওটা তোমার জেদ, তোমার ভ্রম। খাতায় কলমে অন্যের হয়েছো, শরীরে মনে?
নাহলে তোমার আমার ছোঁয়া ভালোই লাগতো না। সরিয়ে দিতে। চিনি তোমায়।
চিত্রাঙ্গদা অস্বীকার করলেন না। রঞ্জিতের মতো আর কাউকেই শরীর মন দুই দিয়ে ভালোবাসতে পারেননি চিত্রাঙ্গদা। পারবেনও না কখনো।
-এবার চলো, তোমার সন্ধানে বেরোই।
রঞ্জিতের দিকে তাকালেন চিত্রা
-শুধু আমার সন্ধান?
-না, আমাদের। একত্রে। যে জিনিস খুঁজতে যাচ্ছি সেটাও তো দুজনেরই, একত্রে, তাই না?
-ঠিক তাই। ওকে পেলে রাখবো আমি রঞ্জিত, তুমি পাশে থাকবে তো?
-থাকবো, একান্ত চাওয়ার জিনিস সে, বুঝেছি। তার জন্য বাবুসোনার সাথে যদি একটু দূরত্ব রাখতে হয় আমাদের, তুমি রাজি তো?
-ঋষভের সাথে! কেন?
-ওর কেরিয়ারের জন্য। ওর আর আনিশার বিয়ের জন্য। ভবিষ্যৎ-এর জন্য। ওকে এসবে জড়াবো না আমরা, কেমন?
চিত্রাঙ্গদা রাজি হলেন।
-বেশ। তাহলে ও বিদিশার সাথে থাকবে?
-হ্যাঁ। কিন্তু আমাদের নজরদারিতে।
-তুমি তো মুম্বাই...
-ছেলের বিয়ের পর এখান থেকেই ব্যবসা সামলাবো ভাবছি। অনেকতো কাজ করেছি।
চিত্রাঙ্গদা অবাক হলেন।
-সত্যি? মন থেকে বলছো?
-মন থেকেই বলছি। তোমাকে কাছে পাবো শেষ জীবনটা। তোমার মেয়েকে আর তোমার অনুসন্ধানের ফলকেও কাছে পাবো। ওখানে সবকিছু থাকলেও দিনের শেষে একটা প্রাসাদে নিজের ঘরে একা। বয়স তো হচ্ছে, আর ভালোলাগে, বলো?
-মুখের কথা তোমার। আবার শুরু হয়ে যাবে হিল্লি দিল্লী-
-শুরু হলেও, শেষটা তোমার কাছেই হবে, কলকাতায়। আলিপুরের বাড়িতে। চলো আগে দেখি যাকে চাইছো, তাকে পাও কিনা, তারপর সেই মতো ভাবতে হবে।
চিত্রাঙ্গদা অভিমানী চোখে তাকালেন।
-ওহ। না পেলে কলকাতার প্ল্যান বাতিল বুঝি!
রঞ্জিত হেসে ফেললেন।
-দেখলে কেমন ধরা দিলে? এটাই শুনতে চেয়েছিলাম। দেখলে তো তুমি নিজেও কত করে চাও, আমি থাকি?
চিত্রাঙ্গদা লুকালেন না।
-চাই তো। মিথ্যা বলবো কেন? তোমার সঙ্গটাই তো সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত আমার কাছে।
-হ্যাঁ, আমার ব্যবসা তোমার সতীন। ছেলে বড় হয়েছে, যোগ্য হয়েছে, ও-ই তাহলে সৎ মা’কে সামলাক, নাকি?
চিত্রাঙ্গদা মস্করা চালিয়ে গেলেন।
-তুমি থাকতে পারবে তো আমার সতীনকে ছেড়ে?
-তোমাকে সর্বক্ষণ পেলে স-ব ছাড়তে পারি। ছাব্বিশবছর আগে উপরে ওঠার মোহ ছিলো চিত্রা। নাম যশের আকর্ষণ ছিলো। এখন বুঝি তুমি না থাকলে সবই অসার।
-যাবে না?
রঞ্জিত চিত্রাকে আবার চুমু খেলেন।
-চলো, তোমার অনুসন্ধানটা সেরে আসি।
-আমাদের।
-বেশ, আমাদের।
২৪
সৌমিককে ডেকে পাঠিয়েছিলো অনীত। কাল ওদের রেজিস্ট্রি, সাক্ষী চাই। সৌমিক আর বিদিশার বাইরে কাউকে এই ব্যাপারে বিশ্বাস করতে পারছে না অনীত। গোপনীয়তা প্রয়োজন, খুব প্রয়োজন। নাহলে অনেক বড় বিপদ হতে পারে। আনিশা বেরিয়েছে, ছেলেকে নিয়ে গেছে সাথে। অনীত বাবাই-কে মানা করলেও ও মাম্মার কাছ ছাড়া কিছুতেই হবে না। জেদ সচরাচর করে না, কিন্তু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। আনিশা ওর কান্না দেখে ফেলে যেতে পারলো না, নিয়ে গেছে। কালকের কয়েকটা ছবি তোলা প্রয়োজন, অনীতের কিছু জামাকাপড় নেই সেই মতো। সেগুলোর জন্যই মূলত আনিশার বেরোনো। কিনেই ফিরে আসবে। রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট-টা এলে স্যোশাল মিডিয়ায় আপলোড করতে হবে ছবিগুলো। পরিচিত কারোর সাথে না দেখা হয়ে যায় বাইরে গিয়ে। ওদের একসাথে দেখলে ছেলের সামনেই আনিশাকে অনেক অবাঞ্ছিত প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। আনিশা যথারীতি স্কার্ফ জড়িয়ে সানগ্লাস পরেই বেরিয়েছে, তবুও লোকজনের চোখ মারাত্মক।
সৌমিককে দেখে সৌমিকের মুডটা একদমই ডাউন মনে হলো অনীতের। জিজ্ঞাসা না করে পারলো না
-কী ভাবছিস্ এতো?
-বিদিশার কথা, আমাকে এভাবে এড়াচ্ছে কেন জানি না।
-স্পেস চাই হয়তো ওর।
-ওর যা চাই- আমি তো মানা করি না। কিন্তু এভাবে দিনের পর দিন বাড়ি ফিরছে না, বাইরে কাটাচ্ছে, আমার বাড়িতেও তো জবাবদিহি করতে হয়, বলো।
-আছে কোথায়?
-এলগিন রোডে। ওর ম্যামের বাড়ি।
-ম্যাম?
-হ্যাঁ, ওর কলেজের প্রফেসর, চিত্রাঙ্গদা রায়।
অনীত থমকালো। চিত্রাঙ্গদা আন্টি তো ঋষভের মা, বিদিশা ওখানে থাকছে?
অনীতের কলেজের প্রফেসর, বিদিশাও এই কলেজেরই ছাত্রী। চিত্রাঙ্গদা ম্যামের বাড়িতে ওকে কয়েকবার দেখেওছে অনীত।
কথাটা কী সৌমিককে বলা উচিৎ? মনে হয় না। তবে বিদিশাকে কী কাল ডাকা উচিৎ? ঋষভের মায়ের বাড়িতেই ও যখন থাকছে।
-বলো- কী জন্য ডেকেছো?
অন্যমনস্কতা কাটালো অনীত। নিজেকে গুছিয়ে নিলো। চশমা ঠিক করলো
-একটা সিদ্ধান্ত জানাতে।
-সিদ্ধান্ত?
-হ্যাঁ, কাল আনিশা আর আমি রেজিস্ট্রি করছি। উই আর টায়িং নটস্ এগেইন।
-হোয়াট! কনগ্রাচুলেশন দাদাভাই। কিন্তু এত কম সময়ে রেজিস্ট্রেশন এরেঞ্জ করলে কি করে?
অনীত মুচকি হাসলো।
-কিছুটা নিজের চ্যানেলে কিছুটা তোর বৌদির অর্থসাহায্যে।
-গ্রেট। আমি তোমাকে বলেইছিলাম, বৌদিকে বুঝিয়ে বলো, একটাবার।
-ঠিক। কিন্তু শুধু লাফালে হবে না, কয়েকটা দায়িত্বও নিতে হবে তোকে, ভাই।
-বলো না।
-কাল অফিস ছুটি নে।
-সেটা তো না বললেও নিতাম, আর?
-সাক্ষী হিসাবে এখানে থাকিস।
-অফকোর্স, সাক্ষী দিতে বিদিশাকেও ডেকে নিই?
-না।
সৌমিক অবাক হলো।
-ওহ্কে! কিন্তু কেন?
অনীত জানে বিদিশাকে সন্দেহ করছে ও। এই কথাটা সৌমিককে জানতে দেওয়া যাবে না।
-আমার বোনকে দিয়ে আর একটা কাজ করাতে হবে তোকে।
-কাজ?
-হ্যাঁ, বাবাইকে সামলানো। প্রথমে ভেবেছিলাম স্কুলে পাঠাবো, পরে ভাবলাম বিদিশার কাছে রাখাই ভালো। আমরা দুজনেই চাই না এই সই সাবুদ বাবাই-এর সামনে হোক। ওর মনে এসব ডির্ভোস রিম্যারেজ এইসব না ঢোকানোই ভালো।
সৌমিক সম্মত হলো।
-ঠিক আছে, বিদিশা রাজি হয়ে যাবে। ওর বাবাইকে কাছে পেলে ভালো লাগবে, আনস্টেবিলিটি, মনখারাপ কমবে।
-বেশ, তবে বিদিশাকে জানাস না, কালকের কথাটা।
সৌমিক থমকালো।
-কেন? বৌদি চায় না?
-আমি চাই না। বিদিশা বাড়ি থাকলে অন্য কথা ছিলো, বাইরে আছে। গোপনীয়তার ব্যাপারটা নিয়ে আমি খুব কনশার্ন। বুঝিসই তো।
-বুঝেছি। কিন্তু আর কোন সাক্ষীকে পাবে তুমি?
অনীত ভাবলো একটু।
-পেয়ে যাবো, আনিশার পক্ষ থেকেও দুজনকে চাই...
-বৌদির কোন বন্ধু?
-ঋষভেরও বন্ধু তারা, আমাদের বন্ধুদের বৃত্তটা কমনই।
-তাও ঠিক। বিতানকে বলবে নাকি? চমকে চুয়াত্তর হয়ে যাবে শালা।
অনীত শব্দ করেই হেসে ফেললো
-না, না। মিডিয়া ফ্ল্যাশ হয়ে যাবে।
-ছবি টবি তো তোলা দরকার, আমার এস এল আরটা আনবো?
-হ্যাঁ, ঐটে আনিস। কাজে লাগবে।
সৌমিক কিছু বললো না আর। দাদাভাই বিদিশাকে এড়াতে চাইছে স্পষ্ট বুঝলো ও। কিন্তু কেন? উত্তরটা ওর জানা নেই, তবে জানতে চায়।
২৫
চিত্রাঙ্গদা আর রঞ্জিত যেখানে গিয়েছিলেন বিদিশার দেওয়া ঠিকানা খুঁজে সেখান থেকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে ওনাদের। কর্তৃপক্ষ নারাজ অ্যাডপ্টেড আউট কারোর কোন তথ্য জানাতে। মিশনারী ওটা, মাদারের সাথেও কথা বলেছেন রঞ্জিত, চিত্রাঙ্গদা। প্রত্যাখ্যান ছাড়া কিছুই পাননি। ফেরার সময় নিজের কার্ড দিয়ে এসেছেন রঞ্জিত। যদি কখনো প্রয়োজন হয় কথা বলে নিতে বলেছেন। মাদার ঘুরিয়ে প্রশ্নও করেছেন বিশেষত এই শিশুটি নিয়ে এতো আগ্রহ কেন ওনাদের, রঞ্জিত ভাঙেননি। চিত্রাঙ্গদা ফেরার সময় গাড়িতে চুপ করে বসেছিলেন।
রঞ্জিত ওর হাত ধরলেন
-মনখারাপ? পজিটিভ কিছু হলো না বলে?
-তোমার মনখারাপ না?
-নাহ। কারণ আমি জানি পজেটিভ কিছু হবে।
-কী বলছো?
-কার্ডটা এমনি দিয়ে আসিনি।
-মাদারকে? উনি এসের পরোয়া করেন বলে মনে হলো তোমার?
খুব স্ট্রং উইল ভদ্রমহিলার।
-উনি কখনোই বলবেন না। তবে স্মোক করার নাম করে বেরিয়ে আমি ওদের হেড ক্লার্ককেও কার্ডটা ধরিয়ে দিয়ে এসেছি, ওখান থেকে রেসপন্স আসবে।
চিত্রাঙ্গদা বিহ্বল হয়ে তাকালেন রঞ্জিতের দিকে।
-তুমি নিশ্চিত?
-একশো ভাগ। আজ না হলেও কাল উত্তর আসবেই। তুমি চিন্তাটা কমাও এবার, আমি আছি তো।
চিত্রা বললেন
-কোথাও যাবে বলেছিলে যে?
-যাবোই তো। তবে তোমার পছন্দের জায়গায় নিয়ে চলো। মুখোমুখি বসে কথা বলা যাবে, দুজনে।
চিত্রাঙ্গদার ফোন বেজে উঠলো হঠাৎ, মৃত্তিকা।
-মাম ফোন করেছে। এক সেকেন্ড।
-হ্যাঁ। ধরে নাও।
মৃত্তিকার টিউশন হয়ে গেছে, ও বাড়ি ফিরবে। তাই গাড়ি কোথায় জানতে কল করেছে। রঞ্জিত চোখের ইশারায় চিত্রাঙ্গদাকে বললেন, মৃত্তিকা যেখানে আছে থাকুক, পিক আপ করে নেবেন। মৃত্তিকাকে চিত্রাঙ্গদাও তাই বললেন।
-সরি-
-কেন?
-বসাটা হলো না- আমাদের।
-কে বললো? মামকে পিক আপ করে চলো, বসি কোথাও।
-শিওর?
-ড্যাম শিওর। তুমি ভাবছো দুজনে বসা হবে না তাই রাগ হবে আমার?
চিত্রা হাসলেন।
-তা নয়। একসঙ্গে বসাটা তো হচ্ছে না।
-মামও এক্সপেক্ট করে যে তুমি ওকে পিক আপ করবে। ইটস্ নট এ বিগ ডিল চিত্রা। বাবুসোনা দশবছর বয়স থেকে যেটা পায়নি, সেটা মাম পাক- আমি চাই।
চিত্রা চুপ করে গেলেন। কিছুক্ষণ পর চোখ মুছে বললেন
-আমি খুব খারাপ মা, তাই না?
-কে বললো?
-তুমিই, একটু আগে। বাবুসোনার বড় হওয়াতে ফাঁক ছিলো বলেই হয়তো- আজ আমাদের এভাবে হন্যে হয়ে ঘুরতে হচ্ছে।
রঞ্জিত হাসলেন।
-দুজনেই খারাপ তবে আমরা, মা বাবা হিসাবে। এখন একটু ভালো হবার চেষ্টা করি?
চিত্রাঙ্গদা ম্লান হাসলেন। রঞ্জিত ওটাকে ভোলাবার জন্যই বললেন, এটা জানেন।
মৃত্তিকা ওরফে মাম যতই দাদাভাই-এর বাবাকে দেখছিলো ততই অবাক হচ্ছিলো। দাদাভাই ঠিকই বলে উনি ভীষণ স্মার্ট, হ্যান্ডসাম। কিন্তু রাগী না তো- একটুও। অল্প কথাও বলেন না, মায়ের সাথে ওর সাথে বেশ ভালোই কথা বলছেন দাদাভাই-এর বাবা, মানে বাপি। কোয়েস্ট মলে এসেছে ওরা, হঠাৎ-ই বাপি প্ল্যান করলো বাইরে খাওয়া হবে, মা-ও রাজি। মৃত্তিকার অনেকদিন বাইরে খাওয়া হয়না শুনেই হঠাৎ প্ল্যান। আর তিনজন সোজা একটা নামজাদা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে পৌঁছে গেলো। বাড়িতে হলে বাবা তো লেখার টেবিল থেকে উঠতেই চাইতো না আর মা-ও বলতো যেতে হবে না, বাড়ির রান্না খেয়ে নিতে। মা বাড়িতে কেমন চুপচাপ থাকে, নিজের কাজে থাকে, এখানে বাপির সাথে হাসছে, গল্প করছে অনর্গল। মা কি বাপিকে ভালোবাসে, এখনো? তাহলে বাবাকে বিয়ে করলো কেন? বাপি আর মায়ের মধ্যে কোন দূরত্ব বোঝাই যাচ্ছে না আজ। কোন অস্বস্তিবোধ করছে না ওরা, যেমনটা প্রক্তনের সাথে করে মানুষে।
-ড্রিকংস স্যার?
-চিত্রা, কী নেবে? মাম?
চিত্রাঙ্গদা হাসলেন।
-মাম মনে হয় ওসব কিছু খায় না।
-তাই? খাসনি কখনো? বন্ধুদের সাথে?
মৃত্তিকা মায়ের সামনে কী করে বলবে, অথচ ও খেয়েছে বন্ধুদের সাথে। বিয়ার, ককটেল, ভদকা –সবই।
-না, বাপি। থাক।
-চিত্রা?
-ককটেল নিতে পারি একটা।
-ওকে। সেক্স অন দ্যা বিচ তো, ফেভারিট তোমার, ওটাই বলি?
মৃত্তিকা দেখলো মায়ের চোখে অবাক ভাবটা গাঢ় হলো। বাপি ছাব্বিশবছরেও মায়ের পছন্দ-অপছন্দ কিচ্ছু ভোলেনি। বাপি মায়ের কানে কানে কিছু একটা বললো। মা হাসলো।
-বেশ তো। মাম খেলে অর্ডার করো।
-তোর জন্য একটা মোইতো বলি, মাম?
মৃত্তিকা বুঝলো বাপি মাকে কনভেন্স করালো ওর ড্রিংকস-এর ব্যাপারে।
-খুব কড়া না তো?
-একদম না। একটা মইতো, একটা সেক্স অন দ্যা বিচ।
-স্যার, আপনার?
-আমার একটা জে ডি লার্জ পেগ। উইথ সোডা।
খাবারের অর্ডারটা পুরোই মৃত্তিকা দিয়েছে। ও যেটা যেটা অর্ডার করেছে দুজনেই সেটাই দারুণ বলে খেয়ে নিয়েছে। মা উঠে ওয়াশরুমে গেলো একটু, মৃত্তিকা বাপিকে বললো
-ইউ কনভিন্সড হার না?
-ফর হোয়াট?
-ফর মাই ড্রিংক?
-ওহ ইয়েস। তুই খেতে চাইলেও মায়ের ভয়ে বলতে পারছিলি না, সেটা বুঝেই বললাম।
-থ্যাক ইউ।
-মা’কে ভয় পাস?
-অল্প হলেও পাই। দাদাভাই তো মা’কে ভয়ই পায় না তেমন। তোমাকে খুব ভয় পায়।
রঞ্জিত হাসলেন।
-দাদাভাই পাক। তুই না পেলেই হলো, মেয়েরা বাবার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়।
মৃত্তিকা মোইতোর স্ট্র-টা হাত দিয়ে ঘোরালো।
-ইউ স্টিল লাভ, মা?
রঞ্জিত অপ্রস্তুত হলেন না।
-ইয়েস আই ডু, ভুল করি?
-না, না। সেটা তো বলিনি। তুমি তো বিয়েও করোনি আর।
-ঠিক, তোর মা’র মতো কেউ নেই যে।
-আই থিংক শি অলসো লাভ ইউ।
রঞ্জিত চোখ ছোট করলেন।
-তাই? কি করে বুঝলি?
-বোঝা যায়। মা আজ খুব খুশি। এমনিতে এমন হাসি খুশি থাকেই না।
-আচ্ছা, তাহলে বাসে, সেটাও তো ভুল না।
-আমি তো ভুল বলিনি। বরং এই যে মা হাসছে, বাইরে বেরোচ্ছে, ঘুরতে যাচ্ছে –এটা ভালো। অন্যসময় তো বাড়ি, সেমিনার, আর্ট গ্যালারি, এক্সিবিশন- ব্যাস।
-হুম, তোর মায়ের ভালোলাগা গুলো জানলে তবে না ওকে হাসানো যাবে?
-তুমি তো সব জানো, না?
-সবটা, পা থেকে মাথা অব্দি। মনের ভিতরটা, মাথার অন্দরমহলও।
মৃত্তিকা হাসলো।
-এতগুলো বছরে যদি বদলে যায়।
রঞ্জিত মাথা নাড়লেন।
-সবার জন্য বদলালেও আমার জন্য বদলাবে না।
-খুব কনফিডেন্স তোমার, না?
-একদম। তুই-ও আমাকে যথেষ্ট পছন্দ করিস, এটাও বুঝে ফেলেছি।
মৃত্তিকা হঠাৎ ইশারায় বাইরেটা দেখালো।
-বাপি...
-কী?
-বৌদি না?
রঞ্জিত বাইরে তাকালেন। কাঁচের ওপাশে আনিশাকে দেখা যাচ্ছে। একহাতে শপিং ব্যাগ, একহাতে একটা বাচ্চার হাত ধরে আছে। এস্কেলেটারের দিকে এগোচ্ছে, নামবে।
-হ্যাঁ, আনিশা।
-সাথে বাচ্চাটা?
রঞ্জিত কিছু একটা ভাবছিলেন। এই বাচ্চাটাই তবে অনীত চ্যাটার্জির ছেলে। আনিশার সাথে এমনভাবে গেলো যেন আনিশারই ছেলে মনে হলো। অথচ সেটা কী করে সম্ভব? আনিশা তো অনীতের কাছ থেকে চলে আসা এবং ডিভোর্সের আগের সময়টা মুম্বাইয়ে ছিলো। যদি সন্তান গর্ভে নিয়েও এসে থাকে, তাহলে জন্ম দিলো কীভাবে? সবার নজর এড়িয়ে কী ভাবে সম্ভব সেটা? মৃত্তিকার কথায় সম্বিৎ ফিরে এলো রঞ্জিতের।
-ওর কোন রিলেটিভের বাচ্চা হবে...
-ওহ।
-মাম, দাদাভাই-কে আমি না বলা অব্দি যেটা দেখলে বলবে না, কেমন?
মৃত্তিকা মাথা নাড়লো। কোন একটা ব্যাপার আছে যেটা বাপিকে চিন্তায় ফেলেছে। আর সেটার নিজেই সলভ করতে চায়, দাদাভাই-কে জড়াতে চায় না এর মধ্যে, কী সেটা! মৃত্তিকা বুঝতে পারলো না। তবে বাপির কথা অমান্য করে দাদাভাই-কে বলা যাবে না, এটা বুঝতে পারলো। বাপির কথায় সেই ওজন আর দৃঢ়তা খুঁজে পেলো।
২৬
সৌমিকের ফোনে বেশ অবাক হলো বিদিশা। সারাদিন বাড়িতেই ছিলো, ম্যামের বাড়িতে। ম্যাম আর রঞ্জিত আঙ্কেল খালি হাতে ফেরায় মনটা বেশ খারাপ ছিলো ওর। সৌমিকের ফোন পেয়ে মনে হয়েছিলো যে আবার বাড়ি ফেরার কথা বলবে। ঐ পরিবেশে ফিরতে আর মন নেই বিদিশার। যাকে খুঁজছে তাকে পেলে তো নয়ই। না পেলেও আলাদা সংসার পাতবে।
ম্যামকে আজ বেশ অন্যরকম লাগছিলো, ঝলমলে এককথায়। গাম্ভীর্যের আবরণটা নেই যেন আজ। অর্ধেন্দুকাকু আর ম্যামের মধ্যে কেজো কথাবার্তা ছাড়া কখনোই তেমনকিছু স্পার্ক দেখেনি বিদিশা। রঞ্জিত আঙ্কেল আর ম্যামকে এই প্রথম একসাথে দেখলো। ঝলমল করছেন দুজননেই, একসাথে। রঞ্জিত আঙ্কেলকেও বড্ড চুপচাপ গম্ভীর দেখে অভ্যস্থ বিদিশা। অন্তত মুম্বাই-এ তাই দেখেছে। এখানে রঞ্জিত আঙ্কেলও অনেক খোলামেলা, হাসিখুশি। ছাব্বিশ বছর পর একে অপরকে কাছে পেয়ে ভরে উঠেছেন যেন, ভেতর থেকে।
ম্যামের পাশেই বসেছিলো বিদিশা, যখন সৌমিকের ফোন আসে। রঞ্জিত আঙ্কেলও ছিলেন, চা খাচ্ছিলেন দুজনেই।
-বাবাইকে কাল আমাকে রাখতে হবে?
বিদিশার গলায় খুশির সাথে বিস্ময় বোধটাও টের পেলো সৌমিক।
-হ্যাঁ, দাদাভাই তাই বললো। অফিসের একটা অ্যাসাইনমেন্ট আছে।
-আনিশা ম্যাম... আই মিন বৌদি?
রঞ্জিত চা খাওয়া থামালেন। বিদিশার দিকে তাকালেন।
-বৌদিরও কিছু একটা মিডিয়া এফেয়ার আছে। তোমার কাছে থাকলে তুমিও খুশি হবে – তাই আমিই বললাম।
-ওহ, বৌদির পুতুলখেলার শখ কমেছে তবে?
-বিদিশা- তোমার মন ভালো করার জন্যই কিন্তু আমাদের এতো আয়োজন।
-বেশ, কাল দিয়ে যেও ওকে।
-কোথায়? তোমার ম্যামের বাড়ি?
-আর কোথায়? তোমাদের বাড়ি তো আর ওকে নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা নেই, সৌমিক!
-বেশ, তাই হবে। তবে তুমি এবার আমাকে কষ্ট দিচ্ছো, এভাবে দূরে থেকে।
-নিজেকে কষ্ট দিচ্ছি সবচেয়ে বেশি। প্রায়শ্চিত্ত করছি বলতে পারো। রাখি?
-তুমি কি এড়াচ্ছো আমায়, স্পষ্ট করে বলো?
-না তো।
-তবে? যে সন্ধান করছো তাতে আমাকে নিচ্ছো না কেন? তোমার সব সিদ্ধান্তেই তো আমি রাজি। আর অ্যাডপশন আমিও চাই। তাহলে?
-যা খুঁজছি সেটা আমাকে একাই খুঁজতে হবে সৌমিক।
-কী এমন জিনিস? বলো আমাকে।
-পেলে বলবো।
-না, বলো, আমি শুনতে চাই।
বিদিশা হাসলো।
-তুমিও আর সব্বার মতো জোর করতেই জানলে শুধু।
-বিদিশা, কী সব বলছো? ভেবে বলো একটু প্লিজ।
-কাল বাবাইকে নিয়ে এসো, আমি তোমার গলার কাঁটা এখন, বেশ বুঝেছি। চাইলে সরে যাব। অন্যকাউকে বিয়ে করো, বাবা হতে পারবে।
-এসব বুদ্ধি কে দিচ্ছে তোমায়? তোমার ম্যাম?
-সৌমিক স্টপ ইট, এনাফ ইজ এনাফ।
-না এনাফ নয়, কিচ্ছু এনাফ নয়। আমার স্ত্রী দিনের পর দিন আমাকে এড়িয়ে অন্য কারোর বাড়িতে থাকছে কেন এটার জবার প্রয়োজন আমার, এখনই।
-কাল সকালে এসো, সব জবাব পেয়ে যাবে।
ফোন কেটে দিয়েছিলো বিদিশা। চিত্রাঙ্গদা বিদিশার পিঠে হাত রেখেছিলেন।
-শান্ত হ।
-কী করে হই বলো তো? একে তাকে খুঁজে পাচ্ছি না- তার মধ্যে হাজারটা প্রশ্ন-
রঞ্জিত কথা বললেন এবার
-ছেলেটি তোমার স্বামী?
বিদিশা চোখ মুছলো।
-হ্যাঁ, আঙ্কেল।
-হয়তো সে চিন্তিত তোমায় নিয়ে। তোমার শরীর ভালো না, তোমার ম্যাম বলছিলো। এই অবস্থায় বাড়ির বাইরে কেন? এটা তো সঙ্গত প্রশ্ন।
-কিন্তু ওকে খুঁজে পেলে তো...
-সে তো আমরা জানি, সে তো জানে না। এনিওয়েজ, ছেলেটাকে ভালো মনে হল কথাবার্তা শুনে। তোমায় ভালোবাসে। একটু ঠান্ডা মাথায় কথা বলো এরপর দেখা হলে।
সৌমিক ভালোবাসে এটা বিদিশাও জানে, তাই বিদিশাকে ছেড়ে থাকতে পারছে না। কিন্তু বিদিশার কথা শুনছে না তবে? কেন একটুও স্পেস দিচ্ছে না? বিদিশা যেটা করছে ওদের দু’জনের ভালোর জন্যই। একটুও আস্থা নেই কেন?
রঞ্জিত প্রশ্ন করলেন।
-কাকে রাখতে হবে বললো কালকে? আনিশাকে নিয়েও কিছু বলছিলো...
-দাদাভাই-এর ছেলেকে, মানে অনীত চ্যাটার্জির ছেলেকে। বাবাই। ও আমার ছাত্র।
-হুম। বয়স কত ছেলেটির।
-বছর সাতেক কি আটেক। ক্লাস টু-এ পড়ে।
-সাত না আট?
-ঠিক জানি না। তবে জানতে পারবো চাইলেই। কেন?
-চিত্রা এই ছেলেটিই তো আনিশার বলে শোনা যাচ্ছে, না?
বিদিশা মাথা নাড়লো।
-হ্যাঁ, আনিশা ম্যামেরই ছেলে। মুম্বাই যাওয়ার কাছাকাছি সময়ই প্রেগন্যান্ট ছিলো বলেছে। ডিভোর্স বাচ্চা হবার পরেই হয়েছে।
-স্ট্রেঞ্জ!
বিদিশা চমকে তাকালো –কেন?
-তারপর থেকে তো মুম্বাই-এ ছিলো। বাচ্চাটা কবে হলো?
-আনিশা গুপ্তার বাচ্চা না তাহলে? বাবাই? তাহলে কে ও?
বিদিশা জানতে চাইলো, রঞ্জিত মাথা নাড়লেন।
-সম্ভাবনা খুব কম যদি বাচ্চাটির বয়স সাত হয়। আবার আট হলে বাচ্চা জন্ম দিয়ে বাচ্চা বাবার কাছে রেখে চলে এসেছে – এমনও হতে পারে। তবে সেটা আমাদের কখনো জানায়নি কেন? ডিভোর্স হলে তো মুম্বাই-এ আসার বছর খানেক পর। সেইসময় কোন কাস্টডি ক্লেম করেনি কেন? ওইটুকু দুধের বাচ্চার কাস্টডি ক্লেম করাটাই তো স্বাভাবিক, নাকি? যে কোন মায়ের পক্ষে।
চিত্রাঙ্গদা বললেন –হয়তো অনীত দিতে চায়নি, একমাত্র সন্তান, ছাড়তে চায়নি।
-হয়তো আনিশা নিতে চায়নি। বাড়তি হ্যাপা মনে করেছিলো। তাহলে এখন ঋষভের সাথে বিয়ের একমাস আগে এই নাটকগুলো করছে কেন?
-নাটক?
চিত্রাঙ্গদার অবাক ভাব পড়তে পেরে রঞ্জিত মুচকি হাসলেন।
-আজ কোয়েস্টে আমি আর মাম দেখলাম আনিশাকে। বাচ্চাটাকে নিয়ে শপিং-এ এসেছিলো।
-সেকি! ডাকলে না কেন একবার?
-অনেকটা দূরে ছিলো। বাচ্চাটাকে ওর সাথে দেখে ওরই আত্মজ মনে হলো।
বিদিশা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
-জটিল ব্যাপার। তবে হ্যাঁ আঙ্কেল, বাবাই-কে আনিশা ম্যামের নিজের সন্তানই মনে হয়েছে ওদের বন্ডিং দেখে।
-এই জন্যই জানতে চাইলাম সাত না আট বছর ছেলেটার।
বিদিশা গুরুত্ব বুঝলো বিষয়টার।
-আমি দাদাভাই-এর থেকে কথার ছলে জেনে নেবো এটা।
-অনীত কেমন ছেলে? তোমার তো ছাত্র চিত্রা, বিদিশার তো দাদাভাই।
রঞ্জিতের প্রশ্নে বিদিশা অকপট হলো।
-এককথায় অসাধারণ। যেমন ভদ্র, তেমন ট্যালেন্টেড। তেমনি ভালো বাবা, দায়িত্বশীল দাদাও। বাবাই, সৌমিক, আমার সব্বার গার্জেন।
-আনিশা তো বলতো মাতাল, ইনসিকিওরড, অত্যাচারী?
-একদমই না। অকেশনালি দুই ভাইয়ে একদু’পেগ তার বেশি না।
-হুম। বিদিশা বাবুসোনাকে কখনো জানিয়েছিলে যে...
রঞ্জিত কথাটা শেষ করলো না। বিদিশা মুখটা অন্যদিকে ঘোরালো।
-হ্যাঁ, হি টোল্ড টু অ্যাবর্ট। হয়তো সত্যতার বিশ্বাস ছিলো না বা এড়াতে চেয়েছিলো।
-এখন জানাতে চাও?
-খুঁজে পেলে?
-হ্যাঁ, জানাবে ঋষভকে?
-ম্যাম আর আপনি যদি বলেন – তবেই। জানালে হয়তো আনিশা ম্যাম আর ওর বিবাহিত জীবনে সমস্যা হতে পারে।
অনেক ভেবে ধীরে ধীরে বললো বিদিশা।
-ঠিক। এই জন্যই আমি ওকে এসবে জড়াতেই চাই না।
চিত্রাঙ্গদা রঞ্জিতের হাত ধরলেন।
-বাবুসোনার ছেলে- বাবুসোনা জানবেও না কখনো? একেবারেই না?
-আমরা জানছি তো, ওকে মানুষ করবো আমরা। বঞ্চিত করবো না কোনমতেই। বিদিশা এইজন্যেই সৌমিককে চটিয়ো না। তোমার ছেলেকে খুঁজে পেলেও ওর কিন্তু একজন বাবাও লাগবে অবশ্যই। এবং সৌমিক ছেলেটি এটা পারবে – তুমিও জানো। অনীতদাদার ছেলেকেই যখন এতো ভালোবাসে।
বিদিশা মাথা নাড়লো –ও এই বিষয়টার গুরুত্ব বোঝে।
-কাল আশা করি ফোনটা আসবে ওর খোঁজ নিয়ে। কাল অথবা পরশু বড়জোর। তারপর আমাদের ওকে নিজের করে নিতে একশোভাগ চেষ্টা করতে হবে।
-আপনি নিশ্চিত কাল অথবা পরশু কল আসবে?
-আমার এতো বছরের ব্যবসার অভিজ্ঞতা ভুল হবে না।
বিদিশার চোখ দিয়ে জল পড়ছিলো। চিত্রাঙ্গদা বললেন
-সৌমিককে ফোন করে নিস রাতে একবার।
-হ্যাঁ, ম্যাম।
-বিশ্রাম নাও। অসুস্থতা কাটবে। তোমার বিশ্রাম প্রয়োজন।
রঞ্জিতের কথায় বিদিশা চলে গেলে রঞ্জিত চিত্রাঙ্গদার দিকে চিন্তিত ভাবে তাকালেন।
-বিয়েটা না হলে বিপদ, চিত্রা।
-কেন গো? যদি ছেলেটা সত্যিই আনিশার হয়...
-ঋষভ জেনেও বিয়েটা করবে, আমি জানি। ও আনিশাকে ভালোবাসে।
-আনিশা কী ওকে জানায়নি এতোদিন?
-জানালে ঋষভ আমাদের বলতো, ও লুকাবার ছেলে না।
-বিদিশার ব্যাপারটাই তো...
-হ্যাঁ, লুকিয়েছে। হয়তো ভেবেছিলো চ্যাপ্টার ক্লোজড। এই নিয়ে আবারও কখনো টানাটানি হবে জানলে লুকাতো না। বিয়েটা না হলে ঋষভ ভেঙে পড়বে। সাথে সাথে আমার ব্যবসাও। ও রায় এম্পায়ারের উত্তরাধিকারী, মনে রেখো।
-আনিশা হাত ছাড়া হয়ে যাবে ভয় পাচ্ছো?
-পাচ্ছি বৈকি। বেশ লাভজনক প্রতিষ্ঠান এই আনিশাস। রায়দের ছেড়ে গেলে সমস্যা, নেবার অনেক লোক আছে আনিশাস্-কে।
-কী চাইছো বলতো?
-সন্তানটা আনিশার হলেও বাবুসোনাকে তুমি বুঝিও – এ নিয়ে। কোন ট্যাবু না রাখতে। আনিশাকে বিয়ে করে নিতে। ছেলে তো অনীতের কাছেই থাকবে।
-বোঝাবো। কিন্তু কখনো ভেবেছো ঋষভের সন্তান আছে এটা আনিশা কোনদিন জানতে পারলে কি হবে?
-জানবে না...
-কী করে নিশ্চিত হচ্ছো?
রঞ্জিত হাসলেন।
-কারণ আমরা গোপনীয়তা রাখবো সবাই।
-বিদিশা?
-ওকে তো ঐ জন্যই খুব কাছে রাখতে হবে চিত্রা। আমাদের নজরদারীতে।
-আনিশা ওর এক্সহাজব্যান্ডকে ভালোবাসে না তো? অনীতকেই এখনো ভালোবাসে যদি? নাহলে ওর বাড়িতে কেন এখন? অনীত কিন্তু খুব ভালো ছেলে।
চিত্রা বলেই থমকে গেলেন। রঞ্জিত একটু ভাবলেন।
-বাসতেই পারে। তাতে কিছু যায় আসবে না। আনিশা উচ্চাকাঙ্ক্ষী মেয়ে। ব্যবসা বোঝে। যদি সন্তান সহ ঋষভ মেনে নেয় কোন সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। যে মেয়ে দুধের বাচ্চা ছেড়ে চলে গিয়েছিলো মুম্বাইয়ে তাকে ব্যবসা বোঝানো শক্ত নয়।
চিত্রাঙ্গদা কিছু বললেন না আর। রঞ্জিত কিছু অনুমান করছে নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে, তার কতটুকু ঠিক, কতটুকু ভুল চিত্রা জানেন না। শুধু জানেন ঋষভ, বিদিশা, আনিশা সবাই যেন ভালো থাকে। আনিশার সন্তান, ঋষভের না খুঁজে পাওয়া সন্তান – তারাও যেন সুস্থ থাকে। সুরক্ষিত থাকে। সবকিছুরই যেন একটা সুষ্ঠ সমাধান হয়। রঞ্জিত একটুক্ষণ পর বললেন –চিত্রা...
-বলো।
-একটা পরামর্শ দাও না।
-আমি? তোমার মতো বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন তুখোড় মেধার মানুষকে আমি কি পরামর্শ দিতে পারি?
-তুমি মন থেকে ভাবো, মাথা দিয়ে নয়। ঐজন্যই বলছি তোমার পরামর্শটা এক্ষেত্রে কাজে লাগতে পারে।
-বেশ, শুনি।
-আনিশার মা বাবা’কে কি প্রশ্নটা করা সমীচিন হবে, আনিশার সন্তানের ব্যাপারে
চিত্রাঙ্গদা একটু ভাবলেন –বিয়ের একমাস আগে এরকম ডেলিকেট প্রশ্ন...
-সেটাই, ওনারা হয়তো লুকাতে চেয়েছেন, আনিশাও। পিছুটান ফেলে এগোতে চেয়েছে, অনেকেই চায় সেটা।
-আমাকে বললে ঘুরিয়ে?
রঞ্জিত হাসলেন –না। তুমি চলে গিয়েও দায়িত্ববিমুখ হওনি তো। ঋষভের মায়ের দায়িত্ব পালন করেছো সবসময়। ওর কলেজের সময়টা – যেটা একটা ছেলের জীবন ভাঙে গড়ে – তুমিই তো পাশে থেকেছো, পথ দেখিয়েছো। হাতে ধরে শিখিয়েছো তোমার শিল্প, ছেলেটা তাই আমার থেকেও ভালো ব্যবসায়ী হয়েছে, মাথা আর মন দুই দিয়েই ভালো।
চিত্রা মাথা নাড়লেন –মানুষ হয়েছে কী, রঞ্জিত? নাহলে অ্যাবর্ট করতে বলে কীকরে এভাবে?
-সম্পর্কটা আর এগোবে না তাই। হয়তো বিদিশার শস্তার নাটক ভেবেছিলো ব্যাপারটাকে।
-তাও নিজের সন্তান – এভাবে-
রঞ্জিত চিত্রাঙ্গদার হাতে হাত রাখলেন।
-ঋষভ আমাদের সন্তান, ওর নিশ্চয় কোন কম্পালশন ছিলো চিত্রা। হয়তো আনিশার প্রতি ভালোবাসা ওর আবেগ ওকে কর্তব্য থেকে বিচ্চুত করেছিলো। এই নিয়ে ভেবো না। ওকে দূরের করে দিও না নিজের মনের জটিলতায়। ভালোবাসা অপরাধ নয়। এই যে আমি তোমাকে, তোমাকেই ভালোবাসি – এটাও কোন অন্যায়ের মধ্যে ধরবে কী? তুমিও তো অপরের স্ত্রী, তবে?
চিত্রা চুপ কর থাকলো। চোখ থেকে অনর্গল জল পড়ছিল ওর। ঋষভের প্রতি অভিমানে। রঞ্জিত বইতে দিলেন। আবেগী মানুষের চোখের জল বয়ে যাওয়াই ভালো।
-এই যে তুমি আমাকে ভালবাসো – এটাও তো সেই অর্থে অন্যায়। না, চিত্রা? সামাজিক মূল্যবোধের মাপকাঠিতে ভালোবাসা মাপা যায়, তুমিই বলো?
-রঞ্জিত?
-বলো।
-ছাব্বিশটা বছর ফেরানো যায় না?
চিত্রার কথায় রঞ্জিতের চোখেও জল এলো। অনেক কষ্টে সম্বরন করলেন।
-আমার সমস্ত সম্পত্তির বিনিময়ে ফেরাতে পারলেও, ফেরাতাম।
-তুমি পরজন্মে বিশ্বাস করো?
-নাহ, করতাম না। তবে এখন তোমায় নিজের করে আবার পাওয়ার আশায় পরজন্মের লোভ যে হয় না, বলবো না।
-তুমি থাকবে তো সত্যি?
-কলকাতায়? থাকবো তো। যত কাজ করি, যেখানেই যাই – ফিরবো এখানেই।
-যাকে সবাই খুঁজছি, তাকে না পেলেও থাকবে তো?
রঞ্জিত চিত্রাঙ্গদার মাথায় হাত রাখলেন। স্নেহের হাত, ভালোবাসার স্পর্শ আছে তাতে।
-আমি যাকে এতোদিন খুঁজছি সে তো আমার সামনেই। এতোদিন পর পেয়েছি, আর কোথায় যাবো? বলতো?
এই প্রশ্নের উত্তরে আর কিছুই বলার থাকে না। চিত্রাঙ্গদা রঞ্জিতের মনের কথাটা পুরোটাই পড়তে পারলেন এখন, আয়নার মতো।
২৭
ফ্ল্যাটে ফিরে বাবাই-এর মাম্মার সাথে প্রথমবার আউটিং আর শপিং-এর উত্তেজনা আর তার গল্পে অনীত আর আনিশা মেতে ছিলো। মাম্মার সাথে কোথায় কোথায় গেছে, কত্ত বড় মল, মাম্মার কত কি কিনলো, ওর কত্ত নতুন ড্রেস, জুতো হলো, ওরা কোথায় খেলো, মাম্মাকে দেখে লোকে চিনে ফেলছিলো কিডস্ স্টোরে, তখন তারা কীভাবে অটোগ্রাফ চাইলো – সব বাপিকে না বলা অব্দি ওর শান্তি নেই, অনীত মন দিয়ে শুনেছে সব, আনিশাও থামায়নি। রাতে অনীতের কোলের মধ্যে গল্প করতে করতে বাবাই ঘুমিয়ে পড়লে, আনিশা ঘরে এলো।
-পাকা বুড়ো থেমেছে?
-জাস্ট থামলো। খুব খুশি আজ সে।
-হবে না? মায়ের সাথে প্রথম আউটিং, শপিং – আনন্দ হওয়া স্বাভাবিক। আমিও খুব খুশি ওকে এতো খুশি করতে পেরে।
অনীত উঠে বসলো ছেলে পাশে সরিয়ে।
-নিশা, একটা কথা আমার মাথায় এসেছে।
-বলো।
-আমাদের ডিভোর্সের আগে বাবাই-এর অ্যাডপশন পেপারস্ দেখালে প্রশ্ন উঠবে তুমি মুম্বাইয়ে চলে যাবার পরও কেন আমাদের এই যৌথ সিদ্ধান্ত।
আনিশা হাসলো।
-অ্যাডপশন পেপার তো আমার চাই না, নীত। কী চাই – তুমি জানো।
অনীত ম্লান হাসলো।
-কোথায় পাবো? এ তো বড্ড কঠিন কাজ।
-পাবো। ইনফ্যাক্ট পেয়ে গেছি ধরতে পারো।
অনীত আকাশ থেকে পড়লো।
-মানে কীভাবে পাবে?
-কৃত্তিকা ব্যানার্জি-কে চেনো?
-টলি হিরোইন?
-হ্যাঁ – ওর বয়ফ্রেন্ড তো রাজ্যের মন্ত্রী। ওর একটা কস্টিউম ডিজাইন করার কথা দিলাম আজ, বদলে এটা হয়ে যাবে বললো। গোপনীয়তাও থাকবে।
-বলো কি! বার্থ সার্টিফিকেট এভাবে হবে?
আনিশা অনীতের হাত ধরলো।
-এতে আমার কাজের লেভেলে অনেকটা নামতে হলেও, তাই সই। কারণ এই নামার বিনিয়মে আমি আমার সবচেয়ে বড় পাওনাটা পাব যে। আরও কয়েকটা কথা আছে নীত। বাবাইয়ের পাতলা ঘুম, জেগে যাবে। ও ঘরে যাবে?
অনীত অমত করলো না। ড্রয়িংরুমে এসে সোফায় মুখোমুখি বসলো দুজনে।
-বলো, কী বলছো।
-বাবাই-এর জন্ম আমি মুম্বাই চলে যাবার পর দেখালে কোনমতেই হবে না। অনেকেই আমাকে ঐ সময় চোখের সামনে দেখেছে তখন। ঋষভ আর রঞ্জিত আঙ্কেলের সাথে রোজ দেখা হয়েছে।
-তাহলে?
-একবছর এগোবো, মানে কলকাতাতে আমরা সংসার করার সময়ই জন্ম হয়েছে ওর। দুধের বাচ্চা রেখে মুম্বাই চলে গেছি এটাই দেখাতে হবে।
-নিশা! এতে তোমার বদনাম হবে – সারা ভারতে। মিডিয়ার লোক কী না কীবলবে!
-হোক, তাও বাবাই আমার হবে, সর্বতোভাবে।
-তোমার মা-বাবা? তারা যদি অন্যকিছু বলে? দাদা-বৌদি?
আনিশা মাথা নাড়লো।
-এই হিসাবটা আমিও কষেছি। তবে তোমার মনে আছে কিনা জানি না – ঐবছরটা মা-বাবা মুসৌরিতে ছিলো। দাদার কাছে। বৌদি এক্সপেক্টিং ছিলো।
-ইয়েস! তোমার ভাইঝি হয় তখন।
-ঠিক। তখন দাদা-বৌদির দিকে দেখতে গিয়ে মা-বাবা তাদের লস্ট কেস মেয়েটাকে ভুলেই গিয়েছিলেন প্রায়, মনে পড়ে? আমি তোমায় ছেড়ে মুম্বাই যাওয়ার পরেও নিশ্চিত ছিলেন না এটা ঠিক হলো কিনা। দাদাকে নিয়েই পড়ে ছিলেন।
-হ্যাঁ, তুমি মুম্বাই যাওয়ার কতদিন পর থেকে ওখানে তোমার মা-বাবা?
-ডিভোর্সের কাগজ হাতে পাওয়া নাগাদ থেকে। মানে আরও একবছর ধরো। তখন আমি সফল হতে শুরু করেছি। মুম্বাইয়ে ফ্ল্যাট হয়েছে, নিজের গাড়ি।
-তুমি কি তাহলে তোমার মা-বাবার ঐ বছর দুয়েকের অনুপস্থিতিটাকে বা অমনোযোগটাকেই...
আনিশা অনীতের দিকে ঘেঁষে এলো। অনীতের হাতে হাত রাখলো।
-হ্যাঁ, ব্যবহার করছি। নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতিটার জন্য। ভুল করছি?
অনীত আনিশার হাতে চাপ দিলো।
-ঋষভ? ওর সাথে তো ফোনে কথা হতো ঐসময়।
-হতো। তবে চোখে তো দেখেনি কখনোই আমাকে। আমি ঐ একবছর ভীষণ ডিপ্রেসড থাকতাম। মনে পড়ে? পাবলিক প্লেসে যেতামই না প্রায়?
অনীত ম্লাস হাসলো।
-হ্যাঁ, আর আমি ভাবতাম আমি সফল। আটকাতে পেরেছি তোমায়।
-বাদ দাও ওসব। এখনকার কথা ভাবো। বার্থ আর নার্সংহোম ডিসচার্জ সার্টিফিকেট দুটোই করে দেবে কৃত্তিকা।
অনীত আনিশার হাতে চাপ দিলো।
-তোমার বাবা-মা কিন্তু সন্দেহ করবেন ভীষণ। প্রশ্নও।
-আমার উপর ছাড়ো এটা। আমি দেখে নেবো। ওনারা আমার উপর নির্ভরশীল।
-মিডিয়া?
-আমার পি আর ম্যানেজমেন্টের বড় গ্রুপ আছে। কালকের দিনটা ঠিকঠাক মিটুক তারপর দেখছি।
অনীত কিছুটা ইতস্তত করেই পরেই কথাটা বললো।
-নিশা, তোমাকে না জিজ্ঞাসা করেই একটা কাজ করেছি আজ।
আনিশা অনীতের বুকে মাথা রাখলো। অনীত জড়িয়ে ধরলো ওকে।
-বাবাইকে কাল স্কুলে না, বিদিশার কাছে রাখবো।
আনিশা তাকালো।
-বিদিশার কাছে? কোথায় সৌমিকের বাড়ি?
-না, ও এখন চিত্রাঙ্গদা ম্যামের বাড়ি আছে।
-ওয়েট- হোয়াট! ঋষভের মায়ের বাড়ি? আমাদের ছেলেকে রাখবে? আমাদের বিয়ের দিন?
-জানি- এটা খুব অড। কিন্তু বিদিশা কোনক্রমেই বিয়ের কথাটা এখন জানুক আমি চাই না। ঋষভের সাথে ওর যথেষ্ট কন্ট্যাক্ট হয়তো থাকতেই পারে বা না থাকলেও যদি ম্যামকে বলে আর ম্যাম ঋষভকে... এটলিস্ট এই সার্টিফিকেট গুলো আসার আগে আমি রিস্ক নিতে চাই না।
আনিশা ভাবলো একটু –বেশ, তবে বাবাই-এর পরিচয় কিন্তু তোমার ছেলে হিসাবেই ওখানে পৌঁছবে।
-তোমার ছেলে হিসাবেও। বিদিশা এই কদিনে পৌঁছেও দিয়েছে নিশা।
-তার মানে কনফ্রন্টেশনের সময় এগিয়ে আসছে, তাই তো?
অনীত আনিশার মাথায় চুমু খেলো।
-একদম। তবে ওরা যেহেতু তোমার আর ঋষভের বিয়েটা কোনমতেই ভাঙতে চাইবে না তাই চট করে কনফ্রন্টও করবেও না। আমরা ক’দিন সময় পাব কাগজপত্রের জন্য।
আনিশা অনীতের কথার গুরুত্ব বুঝলো। সময়, কয়েকটাদিন সময়, দুই তিন দিন পেলেও হয়। তার মধ্যেই সমস্তটা এরেঞ্জ করে নেবে আনিশা। যেভাবেই হোক অনীতকে আর বাবাইকে চাই ওর নিজের পাশে, আজীবন।
২৮
রঞ্জিতের মুড সকাল থেকে অফ ছিলো। যে ফোনটা আশা করেছিলেন এসেছিলো। কিন্তু একরাশ হতাশা নিয়ে, কাঙ্ক্ষিত খবর ছাড়াই। ঐ বছরের রেজিস্টারটাই নাকি উধাও। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কী করে সম্ভব এটা ভেবেই অবাক হয়েছিলেন। কেউ দাবাতে চাল চেলেছে আর ওনার থেকেও দ্রুত গতিতে। বিষয়টা ভীষণরকম হতাশাজনক। চিত্রাকে কী বলে সান্ত্বনা দেবেন ভেবেই খারাপ লাগছিলো। হঠাৎ অচেনা গলার স্বর শুনতে পেয়ে কৌতূহলী হলেন। কে এসেছে এখন আবার! দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নীচে তাকালেন। মনে হয় বিদিশার হাজব্যান্ড এসেছে। কি নাম যেন ছেলেটার – সৌমিক। সাথে অনীত চ্যাটার্জির ছেলেকে নিয়ে এসেছে। বাচ্চাটার বিদিশার খুব কাছের, খুব প্রিয় – অল্পক্ষণ ওদের দেখেই বুঝলেন রঞ্জিত। বিদিশাকে এসেই জড়িয়ে ধরলো। বিদিশার মুখেও বেশ খুশির ঝিলিক দেখতে পেলেন রঞ্জিত। কথা বলুক ওরা, রঞ্জিত আজ আবার অরফ্যানেজে যাবেন। সত্যিটা জানতেই হবে ওনাকে। যে কোন মূল্যে।
বিদিশা, সৌমিককে নিয়ে ও এই বাড়িতে যে ঘরে থাকছে সেই ঘরে এলো। অনীশকে কোলে করে নিজে খাটে বসলো, সৌমিকের পাশে।
-বাবাই... স্কুল ছুটি আজ? মজা?
-ছুটি না তো ম্যাম। মাম্মা বই খাতা সব দিয়ে দিয়েছে, বলেছে ম্যামের কাছে স-ব হোমওয়ার্ক করে আসবি। কিন্তু তুমি কাকাই-এর বাড়ি থাকবে ভেবেছিলাম...
সৌমিক অপ্রস্তুত হলো। বিদিশা সামলালো।
-এটাও আমার আর একটা বাড়ি, আমার ম্যাম থাকে।
সৌমিক উঠে দাঁড়ালেন।
-আমার কাজ আছে, চলি।
-অফিস?
-আর কোথায়? ফেরার পথে বাবাই-কে নিয়ে যাব।
-সৌমিক... অ্যাম সরি।
সৌমিক হাসলো –না, না, সরি কেন? তুমি তো যা খুশি বলতে শুরু করেছো আমায়। প্যাঞ্চিং ব্যাগ আমি তোমার। সব ফাস্ট্রেশন আমার উপর তোলো, সবসময়।
-এভাবে বোলো না, আমার মন সত্যিই খারাপ ছিলো। বিশ্বাস করো।
সৌমিকের হাত ধরলো বিদিশা।
-থ্যাংকস বাবাই-কে এনে দেওয়ার জন্য। আমার মনখারাপের মহৌষধ।
সৌমিক হেসে ফেললো এবার।
-থাকো, ওষুধ আর রুগী একসাথে তাহলে। কাকাই চললো, বাবাই।
-বাবাই বলে দে শুকনো মুখে চলে গেলে হবে?
সৌমিক ঝুকলো। ঝুঁকে চুমু খেলো অনীশকে। তারপর অনীশের ম্যামকে।
-তোমাকে ভালোবাসি বিদিশা। আমার বাড়ির জন্য আমাকে কষ্ট দিও না। চলো না – যা খুঁজছি – একসাথেই খুঁজি।
-বেশ তো। তুমি অফিস থেকে ফেরো। তারপর-
সৌমিক খুশি হলো। বিদিশার মন শান্ত হয়েছে তবে, ওকে না দেওয়ার মতো সৌমিকের কিছু নেই। শুধু সেরে উঠুক, শরীরে, মনে।
চিত্রাঙ্গদা বিদিশার কোলে বসা অনীশকে দেখলেন। বইখাতা নিয়ে বসে পড়েছে, ভারী মিষ্টি দেখতে বাচ্চাটাকে। ওকে দেখে খুব চেনা মনে হচ্ছে জানো চিত্রাঙ্গদার।
-দিশা- এসেই পড়তে বসিয়ে দিয়েছিস?
চিত্রাঙ্গদা এসে বললেন, বিদিশা বললো
-হোমওয়ার্ক বাকি পরে আছে গুচ্ছের। আমি না করালে তো হয় না।
-না, না ম্যাম। মাম্মাও করিয়েছে। কিন্তু কাল তো অনেক ঘুরেছি আমি আর মাম্মা, তাই বাদ পড়ে গিয়েছিলো। প্লিজ করিয়ে দাও-
চিত্রাঙ্গদার কথাগুলো খুব সাজানো আর সুন্দর মনে হল। বেশ ভালো ভাবে ছেলেকে মানুষ করেছে অনীত, একা হাতে।
-বাবাই আমি যেমন তোর ম্যাম- ইনি আমার ম্যাম।
-জানি তো, তুমি বললে তো সেদিনই।
চিত্রাঙ্গদা বললেন
-দিশা তোর পুতুলটি তো বেশ ভালো কথা বলে।
-টরটরে একদম।
-মিষ্টিও। আজই প্রথম দেখলাম কিন্তু যেন মনে হচ্ছে কবে থেকে চিনি।
-তোমার ম্যাম আমার তবে কে হবে ম্যাম?
বিদিশার কী বলবে ভাবছিলো। চিত্রাঙ্গদাই বললেন
-ঠাম্মা। তাই না দিশা?
বিদিশা বুঝলো ম্যাম ভবিষ্যৎ-এর কথা ভেবেই কথাটা ভেবে রাখলেন।
-একদম।
সায় দিলো বিদিশা। আনিশা ম্যাম যদি ঋষভকে বিয়ে করে – তাহলে বাবাই-এর ঠাম্মাই হবে ম্যাম।
চিত্রাঙ্গদা অনীশের মাথায় হাত রাখলেন।
-ম্যামের কাছে পড়ো। আমি আসছি।
-ঠাম্মা...
চিত্রাঙ্গদা চমকে তাকালেন।
-বলো।
-তুমিও আঁকো, না?
চিত্রাঙ্গদা হেসে ফেললেন
-ওই অল্প-সল্প। কী করে জানলে?
-সারা বাড়িতে কত ছবি। মাম্মা আর বাপিও আঁকে। ম্যামও।
-আর বাবাই?
-আমিও আঁকি। তবে বাড়িতে বাপি যেমন বলে ওটাই। মাম্মা আর ম্যামের কাছে নিজের খেয়াল মতো আঁকা যায়।
বিদিশা বললো
-আর সেটাই বেশি পছন্দের। বাপির দেওয়া টাস্কগুলো না।
চিত্রাঙ্গদা হেসে ফেললেন
-ঋষভও ছোটবেলায় এমন করতো। আমি যা টাস্ক দিতাম না করে নিজের মনের খেয়ালে পাতা ভরিয়ে রাখতো।
-ঋষভ কে ঠাম্মা?
-আমার ছেলে। একদম তোর মতোই টরটরে আর মিষ্টি ছিলো ছোটবেলায়।
বলেই চিত্রাঙ্গদা খেয়াল করলেন বাচ্চাটার সাথে এতক্ষণ কার মিল পাচ্ছিলেন। ঋষভের ছোটবেলার মতো আচার আচরণ ছেলেটার। অমনই শান্ত কিন্তু টরটরে, অমনি মিষ্টি। ঋষভও নিশ্চয় এইরকম বাচ্চাই পছন্দ করবে। আনিশা ঋষভের বিয়ের পর যদি সত্যিটা সামনে আসে তাহলেও সমস্যা নেই। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন চিত্রাঙ্গদা। একদিক দিয়ে।
সিঁড়ি দিয়ে উপরে পৌঁছতেই রঞ্জিতের থাকার ঘরে রঞ্জিত আর মামকে কথা বলতে দেখলেন চিত্রাঙ্গদা। রঞ্জিতও দেখলেন ওনাকে।
-চিত্রা, মামকে গল্প করছিলাম। কীভাবে আমাদের দেখা হয়েছিলো- কীভাবে প্রেমে পড়েছিলাম- কীভাবে বিয়ে-
চিত্রাঙ্গদা মুচকি হাসলেন।
-মেয়ের সাথে দু’দিনেই যতটা বন্ধুত্ব করে ফেলেছো ছেলের সাথে তো জীবনে পারলে না।
রঞ্জিত মৃত্তিকার মাথায় আদরের হাত রাখলেন।
-তোমার বাবুসোনার যত প্রশ্ন যত জিজ্ঞাসা তুমি অব্দিই ছিলো।
এদিকে আসেনিতো খুব একটা। আর মাম ঠিক সময়ে ঠিক প্রশ্নটা করতে জানে।
-মেয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ একদম।
-মা-
-বল্
-দিশা দিভাই-এর সাথে যে বাচ্চাটা এলো – চেনো তুমি তাকে?
চিত্রাঙ্গদা রঞ্জিতের দিকে তাকালেন। রঞ্জিত হাত ধরলেন।
-চেনে তোর মা।
-আনিশা বৌদির সাথের বাচ্চাটাই তো বাপি, তাই না?
-হ্যাঁ।
-তোমরা আমাকে কিছু লুকাচ্ছ বুঝতে পারছি। কিন্তু সে লুকাও, কিন্তু দাদাভাই-কে কিছু লুকিও না। দাদাভাই আর বৌদির বিয়ের আর একমাসও নেই।
রঞ্জিত মৃত্তিকাকে আশ্বস্ত করলেন
-সময় আসুক সব বলবো তোর দাদাভাই-কে।
-বাচ্চাটা কে, মা? কার?
চিত্রাঙ্গদা বললেন।
-মাম, বড়দের কথায় থাকতে মানা করেছি না তোকে?
মৃত্তিকা উঠে দাঁড়ালো।
-আমি আর ছোট নেই মা, কলেজে পড়ি। অনীত চ্যাটার্জি যে আনিশা বৌদির এক্স আমি জানি। শুধু দেখো আমার দাদাভাই-টা যেন না ঠকে।
বলেই মৃত্তিকা উঠে চলে গেলো। রঞ্জিত বললেন
-কাঁদালে তো মেয়েটাকে, অনর্থক বকে?
-এত প্রশ্ন ভালো না সবেতে।
-প্রশ্নগুলো তো ন্যায্য, চিত্রা।
-তাহলে বাবুসোনাকেও জানাও, সেই বেলা চুপ কেন।
-বাদ দাও, তুমি বুঝবে না, আমি একটু আসছি।
চিত্রাঙ্গদা থমকালেন।
-কোথায় যাবে?
-কাল যেখানে গিয়েছিলাম।
-ফোন আসেনি?
-এসেছিলো। নাকি ওই বছরের সব তথ্য লোপাট হয়ে গেছে ওদের অফিস থেকে।
চিত্রাঙ্গদা অবাক হলেন।
-মানে?
-মানে ঐ বছরের কোন রেজিস্টার খুঁজে পায়নি লোকটা। কেউ সরিয়েছে অ্যাডপ্টেড আউটের ঠিকানাটা।
-কে সরাবে! কি অদ্ভুত!
রঞ্জিত তাকালেন।
-যে বা যারা চায় আমরা ওকে খুঁজে না পাই।
-কারা তারা?
-সেটাই তো দেখাতে যাচ্ছি।
-আমিও যাবো।
-মেয়েটার কাছে থাকো। আমার সামনেও বকে দিয়েছো ওকে। অভিমান হবে।
চিত্রাঙ্গদা রঞ্জিতের হাত ধরলেন।
-সরি বলে নিচ্ছি ওকে। কিন্তু আমি যাব, তোমার সাথে।
-বেশ, চলো।
রঞ্জিত চিত্রার হাত ধরে টানলেন।
-কোথায়?
-মামের কাছে। একসাথে। রাগটা না কমিয়ে ওর বাপি যাবে কি করে!
মৃত্তিকা আরও কিছু বলবে বলে রাগ অভিমান নিয়ে দরজার কাছে এসেছিলো। রঞ্জিতের কথা শুনে এগিয়ে এলো
-মা, বাপি... তোমরা কোথায় যাবে যাও, আমি রাগ অভিমান করে নেই।
চিত্রাঙ্গদা মেয়েকে বললেন
-আমি বকতে চাইনি মাম, আসলে পরিস্থিতিটাই এমন-
-বুঝেছি মা। তবে তোমরা সামলে নেবে নিশ্চয়, একটা কথা বলি?
-বল্।
-এতো স্ট্রেস নিয়ো না প্লিজ, তোমরা দুজনেই। সব ঠিক হবে। আর এত বছর পরে তোমাকে এত খুশি দেখছি মা – এই সময়টা নষ্ট কোরো না এতো চিন্তা ভাবনা করে। আমি বাপিকেও বলেছি কথাটা – ইট ইজ সো অভিয়াস দ্যাট ইউ লাভ হিম এন্ড হি লাভস ইউ। ছোট মুখে বড় কথাই বললাম কিন্তু। ছাব্বিশ বছর পর যে সময়টা পেয়েছো দুজনে সেটা এভাবে নষ্ট করো না। যা হবার তা হবেই। কিন্তু এই সময়টা আর ফিরে পাবে না। ব্যস্ততার জন্য।
রঞ্জিত চিত্রাঙ্গদাকে বললেন
-দেখেছো কত বুঝদার মেয়ে আমাদের!
-আচ্ছা বাপি, তুমি এসেছো এখানে দাদাভাই-কে বলেছো?
রঞ্জিত ভাবলেন একটু -না রে বলা হয়নি তো।
-এক কাজ করবে?
-বল্।
-আমাদের একটা সেলফি তুলে তোমাদের বাবুসোনাকে পাঠাবে? তোমাদের দু’জনের রাজ্যের চিন্তা যাকে নিয়ে - সে কেমন খুশি হয় দেখো। আর সে খুশি হলে তোমরাও খুশি।
রঞ্জিত হাসলেন।
-বেশ, তাই কর। তবে মামের দাদাভাই-এর বোনের খুশিটাও আমাদের দু’জনের কাছে সমান ম্যাটার করে, তাই না চিত্রা?
চিত্রাঙ্গদা বললেন
-মাম তোর বাপির দেওয়া ফোনটাতেই তোল তবে-
-বাব্বাহ! মা তুমি দামী ফোনের চরম বিরোধী তো, বদলে গেলে কী করে?
-না দেখি কেমন আসে – এতো দামী ফোন তো-
মৃত্তিকা সেলফি নিলো
-আরটু হাসতে কী হচ্ছে দুজনের?
রঞ্জিত এক হাত চিত্রাঙ্গদার কাঁধে আর এক হাত মৃত্তিকার কাঁধে রাখলেন
-এবার ঠিক আছে?
-তুমি ঠিক আছো, হান্ডসাম লাগছো। মা- ক্যামেরার সামনে একটু হাসো। এরপর ছেলের বিয়ে, সেলিব্রিটি ম্যারেজ, সারাদিন ছবিই তো তুলতে হবে।
চিত্রাঙ্গদা হাসলেন।
-ঠিক আছে!
-একদম, হোল্ড দা স্মাইল। ইয়েস। হয়ে গেছে। এই পাঠাচ্ছি তোমাদের বাবুসোনার কাছে।
চিত্রাঙ্গদা রঞ্জিতের হাত ধরলেন, অস্ফুটে বললেন বহুদিনের না বলা কথা-
-ভালোবাসি তোমায়।
রঞ্জিত চিত্রাঙ্গদার হাতে হাতের চাপ দিলেন।
-আমিও। তোমাকেই। শুধু তোমাকেই।
২৯
সইসাবুদ ভালোয় ভালোয় মিটে যাওয়ায় যারপরনাই খুশি ছিলো অনীত-আনিশা দুজনেই। সৌমিক মুহুর্তগুলোকে সযত্নে ক্যামেরাবন্দী করে রেখেছে। ম্যারেজসার্টিফিকেটও দিয়ে গেছেন রেজিস্টার। সাক্ষীদের অনীত নিজ দায়িত্বে জোগাড় করেছিলো। অনীতের দুজন বিশ্বস্ত বন্ধু এসেছিলো স্কুল লাইফের, আর একজন এসেছিলেন – যার কথা অনীতের মুখে আগেও শুনেছে আনিশা। অনীতের বড় অ্যাক্সিডেন্টের সময় মিশনারী হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীন যে মাদার ওর জীবন পরিবর্তন করে দেন – তিনি। এনার বোঝানোতেই অনীত মদ ছাড়ে, জুয়োও, খারাপ সঙ্গও। এনার আস্থা জিতেই বাবাই-কে অ্যাডপ্ট করতে পারে অনীত। মাদার যোহানা, দীর্ঘাঙ্গী, ছিপছিপে, চাপা গায়ের রঙ, ষাটের আশেপাশে বয়সের মহিলা। উনিও আজ সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন, অনীতের আমন্ত্রণে। অনীতের প্রতি বেশ স্নেহপ্রবণ মনে হলো ওনাকে।
আনিশা সৌমিককে বললো
-ঠিকঠাক এসেছে ফটোগুলো?
সৌমিক হাসলো –তোমার মুম্বাই-এর ফ্যাশন ক্যামেরাম্যানদের মতো হয়নি মনে হয়।
-আমার কলকাতার বিখ্যাত সংবাদপত্রের অন্যতম সেরা ফটোগ্রাফারের মতো ছবি হলেই চলবে।
সৌমিক দেখতে দিলো আনিশাকে, ওর ল্যাপটপে। ক্যামেরা থেকে ল্যাপটপে নিয়ে নিয়েছিলো ফটোগুলো ও ততক্ষণে।
-তাহলে দেখো, তার মতো হলো কিনা।
আনিশা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকটা ছবি দেখলো। পোক্ত হাত সৌমিকের। অ্যাঙ্গেল, লাইট, সেন্সও দারুণ।
-বাহ। খুব ভালো হয়েছে।
-তাহলে আনিশা’সে একটা চান্স আশা করতে পারি?
আনিশা হেসে ফেললো
-অফ কোর্স। চলে এসো মুম্বাই। আমার পার্সোনাল ফটোগ্রাফার হয়ে।
-বলছো? তবে আমাদের সম্পর্কটাও এখন দেওর-বৌদির, অফিশিয়ালি- মনে আছে তো?
আনিশা মস্করাটা বুঝলো, বুঝেই বললো
-লক্ষণ দেওর তো আমার।
সৌমিক হেসে ফেললো
-তোমার সেন্স অফ হিউমারটাও দারুণ। দাদাভাই এমনি এমনি প্রেমে পড়েনি।
-তোমার দাদার প্রেমে আমি পড়েছিলাম। ও তখন আর্ট কলেজ। আমি পাশের ফ্যাশন ডিজাইনিং ইন্সটিটিউট। সদ্য পড়ুয়া এক ছেলের এক্সিবিশন হচ্ছে আর্ট গ্যালারিতে শুনে আমরা তো অবাক, বন্ধুরা মিলে দেখতে গিয়েছিলাম, আর গিয়েই মন নিয়ে আর ফিরতে পারিনি। দিয়ে আসতে হয়েছিলো।
-তুমি প্রোপোজ করেছিলে?
-অনেক সাহস করে। প্রথমে আমার এক বন্ধুর ওদের কলেজে বয়ফ্রেন্ড ছিলো তাকে দিয়ে এপ্রোচ, তারপর দেখা সাক্ষাৎ, তারপর বন্ধুত্ব। মাসছয়েক পরে বাবুঘাটে একদিন বলেই ফেলেছিলাম।
-দাদাভাই তখন মেসে থাকতো, না?
আনিশা হাসলো।
-হ্যাঁ, ওর তো মা-বাবা খুব অল্পবয়সেই মারা গিয়েছিলেন। গ্রামে কাকাদের কাছে থাকতো। সেখান থেকে কলকাতায়। সেখান থেকে নিজের চেষ্টায় এগিয়েছে, এতটা।
-বিদিশার ম্যাম মানে চিত্রাঙ্গদা ম্যামও তো ওই আর্ট কলেজেরই প্রফেসর না?
-হ্যাঁ, বিদিশাও তো আর্ট কলেজ গ্র্যাজুয়েট। আমাদের থেকে তিনচার বছরের ছোট বলে চিনতাম না। নাহলে অনীতের আগের পরের দুই ব্যাচেরই সবাইকেই চিনি বলা যায়। মুম্বাই-এ যখন ছিল তখন দেখেছিলাম। মাসখানেক একই অফিসে কাজ করেছি। তারপর তো ও আবার কলকাতা চলে এলো।
সৌমিক অবাক হলো
-বিদিশা মুম্বাই-এ কাজ করতো? তোমার পূর্বপরিচিত?
-হ্যাঁ, পূর্বপরিচিতি তো ছিলোই, ও ঋষভের অফিসে কাজ করতো, ঋষভের সেক্রেটারি ছিলো। কেন তুমি জানতে না? ঋষভ তো চিত্রাঙ্গদা ম্যামেরই ছেলে।
সৌমিক একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলো, সামলে নিয়ে অপ্রস্তুত হাসি হাসলো
-নাহ, জানতাম পাশ আউট হয়েই স্কুলে পড়াতো। ওর ম্যামের কথা বেশ কয়েকবার ওর মুখে শুনেছি। ম্যামের ছেলের কথা শুনিনি, তার অফিসে কাজ করার কথাও জানতাম না। হয়তো অনেককিছুই জানি না বৌদি আমি বোকাটা। হয়তো আরো অনেককিছু জানতে বাকি আছে, তাই এই লুকোছাপা, স্পেস চাওয়া।
আনিশা কিছু বললো না আর। ঋষভের সাথে বিদিশার সম্পর্ক নিয়ে ও সৌমিক-কে কিছু বলবে না কখনোই। ঋষভ সারাক্ষণ আনিশাকেও এই সত্যিটা লুকিয়েছে। হয়তো আনিশাকে পাওয়ার দুরাশাতেই ঋষভ বিদিশাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো। সেসবের কোন মূল্য আজ আর নেই আনিশার কাছে। ওর জীবন ও বেছে নিয়েছে অনীতের সাথে। অনীতের স্ত্রী হিসাবে, আবারো। অন্যকারোর কোনকিছুতেই কিছু যায় আসে না আনিশার।
মাদার যোহানার সাথে একান্তে কথা বলছিলো অনীত। মাদার কিছু গোপনীয় কথা বলবেন বলছিলেন।
-অনীত- কেউ তোমার বাবাই-কে নিয়ে খোঁজ চালাচ্ছে।
অনীত এইরকম কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না।
-খোঁজ মানে?
-কয়েকদিন আগে একজন ত্রিশের আশেপাশের মেয়ে ওর ডিটেলস্ নিয়ে , সঠিক দিন তারিখ স্টেট করে ওকে খুঁজতে এসেছিলো।
-ওকেই কী করে বুঝলেন?
মাদার হাসলেন।
-ছেড়ে যাওয়ার দিন, তারিখ, সাল, জেন্ডার দেখে।
-ওহ!
-মেয়েটির অস্থিরতা দেখে মনে হয়েছিল মেয়েটি ওর সাথে ব্যক্তিগতভাবেই জড়িত।
-জন্মদাত্রী?
ইতস্তত করে বললো অনীত।
-হতেই পারে। এমন প্রায়ই আসে, আমরা অ্যাডপ্টেড আউট হলে আর পাত্তা দিই না। কোন তথ্য দেওয়া যাবে না বলে পত্রপাঠ বিদায় করে দিই।
-একে করেননি?
-অবশ্যই করেছি। ভুলেই গিয়েছিলাম ব্যাপারটা পরে, কিন্তু কালকে আরও দুজন এসেছিলেন একই ডিটেলস নিয়ে খুঁজতে।
-আরো দুজন! এরা কারা?
-বয়স্ক। দম্পতিই মনে হয়। তবে ভীষণই পয়সাওলা কেউ ওনারা।
-ধনী?
-অত্যন্ত। তাই ওদের পক্ষে ইনস্টিটিউশনের কাউকে ব্রাইব করা খুব সহজ হবে বলে আমি কালই রেজিস্টারটা অফিস থেকে সরিয়ে দিয়েছি।
-রেজিস্টার? কোন রেজিস্টার?
-সেই বছরের অ্যাডপ্টেড ইন রেজিস্টার আর ওর অ্যাডপ্টেড আউট হবার বছরের রেজিস্টার, দুটোই সরিয়েছি। কোন চান্স নিইনি। কারণ ওই মেয়েটি না হয় জন্মদাত্রী হল কিন্তু এনারা কারা? সংযত আবেগ এদের, মেপে কথা বলেন, বাবাই-এর ক্ষতির সম্ভাবণা ভেবেই...
-ভালো করেছেন, মাদার... ওদের চিনতে পারবেন? মানে নাম জানেন!
-নাম? ওহ! আমাকে একটা কার্ড দিয়ে গেছেন। দাঁড়াও দেখছি আছে কিনা পার্সে।
-কার্ড?
-হ্যাঁ – যদি কিছু মনে পড়ে বা জানাতে ইচ্ছা করে তাহলে যেন কল করি তাই।
-আপনাকে ঘুষ খাওয়াতে পারবে ভেবেছিলো মাদার? দুঃসাহস তো খুব!
-খুবই। এই যে, পেয়েছি।
কার্ডটা অনীতকে দিলেন মাদার যোহানা। নামটা দেখে থ হয়ে গেলো অনীত। ঋষভের বাবা রঞ্জিত আঙ্কেল? বাবাই-এর ইতিহাস খুঁজছেন? সাথে কে ছিলো? চিত্রাঙ্গদা ম্যাম? নাহলে অন্য কোন বয়স্কা মহিলা হবেন! তারমানে অনীশের উপস্থিতি জেনে ঋষভ জানতে চাইছে সন্তানটির উৎস। অনীত আর আনিশার সন্তান বলে একটুও বিশ্বাস করছেন না ওনারা। অনীশের জন্মরহস্য জানার জন্য এতো ব্যাতিব্যস্ততা তাই। নিশা তাহলে ঠিকই করেছে! বাবাই-এর বার্থ সার্টিফিকেট নিজেদের নামে করার ব্যবস্থা করে। না, না, এতো কৌতূহল কেন ওদের? ঋষভ কী আনিশার বায়োলজিক্যাল সন্তান আছে কিনা বাস্তবিকই – এটা তলিয়ে দেখতে এতকিছু করছে? তাই হবে। একমাস পরে ও জানে ও বিয়ে করবে আনিশাকে। তাই সমস্তটা ওর জানতেই হবে আনিশার ব্যাপারে। তার জন্য রঞ্জিত আঙ্কেলের মতো বড় ব্যবসায়ীও সব কাজ ছেড়ে কলকাতায় এসেছেন! আর চিত্রাঙ্গদা ম্যাম ও উনি একসাথে? এটাও খুব খটকা লাগার মতো ঘটনা। চিত্রাঙ্গদা ম্যামের সাথে ওনার কোন সংযোগ অনীত দেখেনি যখন ঋষভ আর ও একসাথে আর্টকলেজে পড়তো। বাবাইকে খুঁজে পেয়ে কী করতে চায় ওরা তবে? সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া অনীশের উপস্থিতিই বা ওনারা জানলেন কি করে? আনিশার এখানে এত যাওয়া আসা, থাকায়? নাকি- শিট! বিদিশা। বিদিশা তো এখন চিত্রাঙ্গদা ম্যামেরই বাড়িতে! শিট! বাবাই-ও তো ওখানে।
অনীতকে এখনই যেতে হবে অনীশকে আনতে। দেরি করলে চলবে না।
-সৌমিক চল্।
অনীতের এমন কথায় চমকে তাকালো সৌমিক।
-কেন, দাদাভাই? কোথায় যাবে?
-বাবাইকে আনতে।
-এখনি?
-হ্যাঁ এখনি। সব কাজ তো হয়ে গেছে।
-বিকালে যাব বলেছিলাম তো। আর আমি এনে দিতাম। তুমি ব্যস্ত হচ্ছো কেন? বৌদি-ও তো এক্সপেক্ট করে তোমায় আজকের দিনে।
-তুই যাবি না তাহলে? আমি একাই যাচ্ছি।
সৌমিক বুঝলো কিছু একটা হয়েছে। দাদাভাই-কে আটকানো যাবে না। তাড়াহুড়োতে নিজেই বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়বে।
-চলো, বলি কি – জামাটা বদলে যাও, এইসব পোশাক তো আর রোজ-রোজ পরো না, চোখে পড়তে পারে।
অনীত মানলো।
-ঠিক আছে। আমি চেঞ্জ করে আসছি।
-বলেছিলাম ছেলেকে বিদিশার কাছে না ছাড়তে।
আনিশার কথায় অনীত মাথা নীচু করলো।
-স্কুলে পাঠালে কী এমন হতো? এই নাও তোমার ক্যাজুয়াল শার্ট। পরে যাও, আর নিয়ে এসো আমার ছেলেকে, জলদি।
-আমি ভেবেছিলাম বিদিশার মনটাও ভালো হবে। আর ওনাদেরও একটা ধাক্কা দেওয়া যাবে।
-ওনারা আমার এখানে যাওয়া আসা বা রায়চক ট্রিপ বা বাবাই-কে নিয়ে কাল বেরোনো এগুলোর কোননা কোন একটা বা সবগুলোই হয়তো অবজার্ভ করেছেন।
-হতে পারে। তোমাকে স্পেস দেবে বলেছিলো ঋষভ কিন্তু হয়তো অবজার্ভার ছিলোই। তোমার পিছনে, সবসময়।
-পসিবল্। রঞ্জিত আঙ্কেলকে চিনি আমি, এটা উনিই করবেন করলে।
-ঋষভ নয়?
-মনে হয় না। বা তোমার আদরের বোন বিদিশাও হয়তো এসবের মধে রয়েছে। ঋষভের প্রত্যাখ্যানের ঘা এখনও ওর মনে রয়েছে।
-প্রত্যাখ্যান মানে? ঋষভের সাথে ওর রিলেশান ছিলো নাকি! কই – জানিনা তো!
-তোমার বোন বলেনি তোমায় – মুম্বাই-এ ছিলো? ঋষভের পি এ হয়ে?
-হেঁয়ালি করো না নিশা। বিদিশাকে আমি আগে ঋষভের বাড়িতে কয়েকবার দেখেছি বটে, চিত্রাঙ্গদা ম্যামের খুব ফেভারিট ছাত্রী ছিলো, কিন্তু তিন ক্লাস বা চার ক্লাস জুনিয়র হওয়ায় অত মনে ছিলো না। সৌমিকের সূত্রেই ভালো করে চিনি, ও পরিচয় না দিলে মনেই পড়তো না ও আর্ট কলেজের জুনিয়র।
-বিদিশার কথা অনুযায়ী ও মুম্বাই-এ ঋষভের পি এ হয়ে কাজ করতো। আমি মুম্বাই যাওয়ার একমাসের মধ্যে ও মুম্বাই ছেড়ে চলে আসে।
-তুমি দেখেছিলে, ওকে, ওখানে?
-মুম্বাই-এ? হ্যাঁ, অফকোর্স। এখন ও দাবী করে ঋষভ আর বিদিশার নাকি একটা অ্যাফেয়ার ছিলো। সেটার ব্রেক আপ হয় তখনই এবং সেইজন্যই ও কলকাতায় ফিরে আসে। আর ব্রেক আপটা হয় আমার মুম্বাই যাওয়ার জন্য নাকি।
-বিদিশাকে তুমি কলকাতা থাকাকালীন চিনতে? বা ও তোমাকে?
-নাহ। তোমাদের তিন চার বছরের জুনিয়র, চিনতাম না। তোমাদের মানে তোমার বা ঋষভের কাছ থেকে ওর কথা তেমন শুনিওনি কখনো, সেইসময়। ইনফ্যাক্ট আমাদের কলেজ আলাদা হওয়ার জন্য তোমাদের অত জুনিয়র ব্যাচের আমাদের রিলেশনটাও জানবার কথা না তেমন। বিদিশা মেয়েটি চিত্রাঙ্গদা ম্যামের বাড়িতে থাকার জন্য জেনে থাকতে পারে।
-ঠিক। আমিও সৌমিকের বউ হিসাবে দেখে প্রথমে রিকল করতে পারিনি। পরে আর্ট কলেজের গ্র্যাজুয়েট শুনে আর চিত্রাঙ্গদা ম্যামের কথা শুনে আবছা মনে পড়েছিলো। আমাকে ও কখনো ঋষভের কথা বলেনি। কলেজ বা তারপরেও ঋষভও ওর কথা বলেনি তেমন। বাবাই-এর মায়ের নাম আনিশা ও জানতো বরাবরই। কোন্ আনিশা কখনো প্রশ্ন করেনি কিন্তু আমায়।
-বিদিশা ক্লেম করে ওদের মধ্যে রিলেশন ছিলো। আর ও আমাকে চিনতো, ঋষভের অফিসের দেখেছে। তোমার স্ত্রী হিসাবেও আন্দাজ করেছিলো হয়তো।
-কী জানি! আমার ওয়াইফের নাম বা বাবাই-এর মায়ের নাম আনিশা, এটা জানতো। কিন্তু সেটা যে তুমি আর ও সেটা জানে বুঝতে দেয়নি কখনো।
-হ্যাঁ। কে জানে, আমার সন্তানকে এতো যত্নে মানুষ করলো কি করে! ওর যথেষ্ট ক্ষোভ আছে আমার উপর। আমাকে ওর দুর্ভাগ্য বা কষ্টের কারণ ভাবে। আমার আসায় ওর যাওয়া – এমনটায় ভাবে ও। তবুও পাঁচপাঁচটা বছর বাবাই-কে মানুষ করলো এভাবে, অবাক লাগে। তবে আমার সন্তানের উপর ও নিজের দাবির ছাপ রেখে সুখ পায় হয়তো। আমি ছিলাম না এতোদিন। একদিক থেকে আমাকে হারিয়েছে ভাবতো তাই, সেটাও হাতছাড়া হতে এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। রঞ্জিত আঙ্কেল আর ঋষভের মা’কে ব্যবহার করছে নিজের চালে।
-এসব আমাকে আগে জানালে আমি বাবাই-কে আজ ছাড়তাম না।
-বিদিশা বাবাই-এর স্কুলে ভর্তির সময়কার ডকুমেন্টস গুলো অ্যাকসেস করতে পারে?
অনীত একটু ভাবলো
-মনে হয় না। আমার ছেলে মাদার যোহানার রেকমেন্ডেশনে ভর্তি হয়েছিলো। স্কুলের প্রিন্সিপাল মাদারের ব্যাপারে অবশ্যই গোপনীয়তা রাখবেন।
-রাখলেই ভালো। তবে সন্দেহ যখন ওদের হয়েছে – ওরা সর্বতোভাবে চেষ্টা করবে বাবাই-এর জন্ম রহস্য জানার।
-তোমার মা বাবাকে প্রশ্ন করলে?
-করতেই পারে। তবে এখনও করেনি। করলে আমার ফোনে পরপর কল চলে আসতো। নীত, হোল্ড অন।
-কি, বলো—
-ওরা কী প্রত্যেকটা এমন ঠিকানায় যাচ্ছে? নাকি ডেফিনিট ইনফর্মেশন পেয়েছে বলেই মাদারের ওখানে গেছে? আই মিন প্রত্যেকটা অর্ফানেজেই ওনাদের নক করার মতো সময় আছে? এতো ব্যস্ত তো দুজন।
-ডেফিনিট ইনফরমেশন? কী বলতে চাও?
-ঐজন্য জিজ্ঞাসা করলাম স্কুল ভর্তির ডকুমেন্টস গুলো একসেসিবল কি না।
-ঠিকই তো বলেছো, হঠাৎ ওখানেই, কেন?
-হয়তো তোমার ওখানকার হাসপাতালে ভর্তির ইতিহাস জেনেছে বা মাদারের কাছে যাওয়া আসার কথা।
অনীত ঘাড় নাড়লো।
-হতে পারে, লজিক্যাল। নিশা, আমি রেডি। ছেলেকে নিয়ে আসি চট করে।
আনিশা বললো
-নিয়ে এসো। তাড়াতাড়ি।
-অ্যাম সরি, নিশা। আমার একটা ভুলের জন্য আজকের দিনেও এভাবে যেতে হচ্ছে-
-তাড়াতাড়ি যাও, এমনিতেই পাকা বুড়ো বাড়ি এসে মাম্মা সিঁদুর পরেছে গয়না পরেছে দেখলে হাজারটা প্রশ্ন করবে। আমিও চেঞ্জ করে নিই। ঘরে পরার শাড়ি পরে নিই।
অনীত আনিশার দিকে তাকালো।
-একটু সেজে থাকো আজ। আমার ভালো লাগবে।
-অনীত চ্যাটার্জি স্ত্রীর আর অনীশ চ্যাটার্জির মায়ের যতটা সাজলে মানায়, সেজে থাকবো।
আনিশার উত্তরে অনীতের মন কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো। সব ভুলোগুলোই ঠিক হয়ে গেছে যেন আজ। আট বছরের ব্যবধান একটা সইয়ে মিটে গেছে। আনিশা ওর হয়ে গেছে আবার, একান্তই ওর, আর কারোর না।
৩০
সৌমিক ফেরার পথে গাড়ি চালাতে চালাতে খেয়াল করলো দাদাভাই পিছনের সিটে বাবাই-কে কোলে নিয়ে বসেছে। আঁকড়ে ধরে, পাশে বসায়নি।
-একটুক্ষণ ছেলেকে না দেখেই মন ভালো নেই, দাদাভাই?
অনীত বিদিশার কাছ থেকে তাড়াহুড়ো করে ছেলেকে নিয়ে চলে এসেছে। জরুরী কাজ আছে, ছেলেকে নিয়ে বেরোবে, তার অজুহাতে। বিদিশা অবাক হলেও প্রশ্ন করেনি। সৌমিকও এই মুহুর্তে বিদিশাকে কোন প্রশ্ন করেনি। পরে করবে, একান্তে। জীবনের একটা বড় অধ্যায় ও-কে লুকিয়েছে বিদিশা। সেটা কেন এবং সেই অধ্যায়ের ভিতরেও আরো কোন অধ্যায় আছে কিনা তা জানার অধিকার সৌমিকের আছে। অনীত ছেলেকে অনেক করে চুমু খেলো, নিজের সেরা সম্পদ একটু অনব্ধানের জন্য হারিয়ে ফেলেছিলো যেন, আবার ফিরে পেয়ে খুশি বাঁধ মানছিলো না।
-বাপি, এত্ত আদর?
-এই এত্তো।
-তোমার খুব খুশি আজ না?
অনীত হাসলো –ভীষণ।
-তাহলে বাড়ি গিয়ে মাম্মাকে বলবে, বিকালে ছুটি দিতে, সক্কাল থেকে পড়েছি ম্যামের কাছে।
-তোর মা ছুটি দেবে – বলে দেবো মা’কে।
-জানো বাপি, ম্যামের এই বাড়িটাও খুব ভালো। ম্যামের ম্যামের বাড়ি। না, ঠাম্মা বলতে বলেছে। ঠাম্মার বাড়ি। ঠাম্মার ছেলেও আমার মতো ছিলো নাকি – ঠাম্মার দেওয়া টাস্ক কম আর নিজের আঁকাআঁকি বেশি, কি যেন নাম – ঋষভ...
সৌমিক আড়চোখে গাড়ির সামনের আয়নায় দেখলো, দাদাভাই-এর মুখ ছোট্ট হয়ে গেছে, ঠাম্মাটা কেন শেখালো সেটা বুঝেই হয়তো।
-তোর ম্যাম কেমন আছে?
কথা ঘোরালো সৌমিক।
-ম্যাম? বলছিলো মনখারাপ। ঠাম্মা আর ঠাম্মার হাজব্যান্ড দাদুভাই কোথায় একটা বেরোলো।
অনীত বুঝলো অনুসন্ধান চলছে, বাবাই-এর জন্ম রহস্যের। জেনে কি করবে? মিডিয়া ফ্ল্যাশ? তারপর আনিশাকে ব্ল্যাকমেইল। তার আগে আনিশা আর ওর বিয়ের খবরটা পাবলিশ হয়ে যাওয়া দরকার।
-কাকাই-
-বল্,বাবাই।
-ম্যামকে সেই কবে বলেছিলাম ভাই কি বোন এনে দিতে – ম্যাম বললো এখন এনে দেবে, তোমাকে বলেছে নাকি।
সৌমিক বুঝলো অ্যাডপশনের কথা বাবাই-এর মনে এভাবেই সহজ করে ঢুকিয়েছে বিদিশা।
-হ্যাঁ, দেবেই তো এনে।
-ম্যাম বলে খোঁজ চলছে, এনে দেবে।
-বাহ। কে করছে খোঁজ? তোর ম্যাম?
-ম্যাম তো করছেই । বললো তোমাকেও বলতে, খুঁজতে।
সৌমিক বুঝলো বিদিশা ওদের পুত্রকল্প মাধ্যমে বার্তা পাঠিয়েছে সৌমিককে।
-বেশ তো, খুঁজবো। তোর ম্যাম ফিরুক।
অনীতের মনে তখন প্রশ্নের ঢেউ চলছিলো। বিদিশা যদি অ্যাডপশনের জন্য হন্যে হয়ে বাচ্চা খোঁজে তো খুঁজুক। অনীশকে নিয়ে এতো ভাবনা কেন! নাকি ঋষভের মা-বাবা এটা ওকে লুকিয়েই করছেন। ভেবেই থমকালো অনীত। মাদারের একটা কথা কানে বাজলো যেন, রঞ্জিত আঙ্কেল আর চিত্রাঙ্গদা ম্যাম বাদে একজন বছর ত্রিশের মহিলা গেছিলো মাদারের কাছে, একই ডিটেলস নিয়ে। অনীশের ব্যাপারে সেই মহিলা আবেগী আর চিন্তিতও। কে সে? নিজের ফোন থেকে মাদারকে চট করে একটা হোয়াটস্যাপ করলো অনীত। দুরুদুরু বুকে উত্তরের অপেক্ষা করতে থাকলো। মাদার সাধারণত হোয়াটস্যাপে সন্ধ্যা বাদে অন থাকেন না। তাও যদি দেখেন, ও যা ভাবছে তা যদি ঠিক হয় তাহলে মস্ত বিপদ। মনে মনে এই ভাবনা যেন অসত্য হয় তার জন্য প্রার্থনা করলো অনীত। কারণ সত্যি হলে ওদের দুনিয়াটাই বদলে যাবে। মাদার অন ছিলেন। কিছুক্ষণ পরেই উত্তর এলো অনীতের কাছে। ফোন করলেন মাদার।
-এই মেয়েটিই এসেছিলো সেদিন। তুমি কি করে চিনলে একে?
অনীতের পৃথিবী দুলে উঠলো যেন। যেটা ও চাইনি, একেবারেই চাইনি, ঠিক সেটাই হলো। কিন্তু জন্মদাত্রী, জন্মদাত্রীই কি, নাকি রঞ্জিত আঙ্কেলের স্পাই ও! কিন্তু মাদারের চোখ তো ভুল হবার নয়। উনি বলেছিলেন, ওর মধ্যে আবেগ ছিলো। আবেগ! আবেগ থাকবে কেন! সাধারণ খোঁজে। ঐ জন্যই তবে স্পেস চাই? সৌমিককে সরিয়ে একাই অনুসন্ধান করার তাগিদ তাই এতো! সব অঙ্ক মিলছে এবারে। তার মানে বাবাই, বাবাই কি... তাহলে অনুসন্ধানটা বাবাই-এর জন্য নয়, পরিত্যক্ত সন্তানের অনুসন্ধান। কিন্তু তার মধ্যে রঞ্জিত আঙ্কেল আর চিত্রাঙ্গদা ম্যাম কেন? ওনারা খুঁজছেন কেন? তবে কি...
অনীত ভাবতে পারলো না আর। সবকটা কথা নিশাকে বলতে হবে, সামনাসামনি। অনীত ছেলেকে আরও আঁকড়ে ধরলো।
-বাপি...
অনীতের চোখে জল চলে এসেছিলো। মুছে বললো
-বলো, বাপি।
-তুমি চলে এলে যে, পায়ে ব্যথা না? কষ্ট হবে। কাকাই আসতো।
অনীত ছেলের কপালে চুমু খেলো।
-হোক। তোর জন্যই তো। তোর জন্য সব করতে পারে তোর বাপি।
-আমিও পারি, তোমার জন্য সব করতে। আর মাম্মার জন্য।
-মা’কে গিয়ে বলবে এটা, কেমন?
-বলবোই তো। তুমি খালি আর কেঁদো না।
অনীত অনীশকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিলো।
-কাঁদছি না তো।
-চলো, বাড়ি চলো। মাম্মা, তুমি, আমি অনেক গল্প করবো। আর কান্না পাবে না তোমার।
-ঠিক বলেছিস্। তাড়াতাড়ি বাড়ি চল্।
৩১
ঋষভের ফোন এসেছিলো। রঞ্জিত আর চিত্রাঙ্গদা আবারো বিদিশার দেওয়া ঠিকানায় গিয়েছিলেন। কোন লাভ হয়নি, খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিলো দু’জনকে। রঞ্জিত গাড়ি চালাচ্ছিলেন, আজ ড্রাইভার নেননি। হঠাৎ-ই চিত্রাঙ্গদাকে বলেছিলেন, আলিপুরে ওদের পুরনো বাড়িতে যেতে। চিত্রাঙ্গদা অবাক হলেও না করেননি। মৃত্তিকার কথা মনে পড়েছিলো। মনখারাপ থাকলেও, চিন্তার মেঘ জমলেও এই মুহুর্তগুলোকে না হারাতে, বলেছে মৃত্তিকা।
আলিপুরের বাড়িটা অব্যবহৃতই থাকে। কেয়ারটেকার রাখা আছে। বাড়ি না প্রাসাদ বলা যায়। রঞ্জিতের পৈতৃক বাড়ি। ছাব্বিশ বছরের সদ্য যুবক রঞ্জিত আর বছর তেইশের চিত্রাঙ্গদা চার বছর প্রেম করার পর এই বাড়িতেই উঠেছিলেন। বিয়ে করে ঋষভের জন্মও এখানে। এখান থেকেই রঞ্জিতের উত্থান, মুম্বাই-এ সাম্রাজ্য বিস্তার, বছর দশ এগারোর দাম্পত্য। ভালোবাসার অনেক স্মৃতি – এই বাড়ির প্রতিটা কোণায় লেগে আছে। আবার রঞ্জিতের ব্যস্ততার জন্য চিত্রাঙ্গদার একাকীত্ব, মনখারাপের দিনলিপি আর ভুল বোঝাবুঝির ইতিকথাও।
রঞ্জিতের সাথে নিজেদের পুরনো বেডরুমে ঢুকে যারপরনাই অবাক হলেন চিত্রাঙ্গদা। সবকিছু একইরকম আছে, যেভাবে উনি ফেলে গিয়েছিলেন ছাব্বিশ বছর আগে – ঠিক তেমন। রঞ্জিত চিত্রাঙ্গদার মুগ্ধতা বুঝেই কাছে এলেন। কোমর জড়িয়ে ধরলেন আবারো।
-অবাক হলে?
-হলাম বৈকি। সব অবিকল একই রেখেছো, একটুও বদলাওনি?
-বদলাবো কেন? যার ঘর সে অনুমতি দিলে তো বদলাবো।
রঞ্জিত চিত্রাঙ্গদার পিঠে চুমু খেলেন।
-আমি জানতাম তুমি একদিন না একদিন এই ঘরে আসবে, আসবেই।
চিত্রাঙ্গদা রঞ্জিতের বাহুবন্ধন সরালেন। ঘুরে ওনার বুকে মাথা রাখলেন।
-আগে বলোনি কেন? ডাকোনি কেন?
-জেদ ছিলো যে।
-ভালোবাসার থেকেও জেদ বেশি?
-ভুল ছিলো। ছাব্বিশ বছর মাসুল দিলাম। এবার সব ঠিক করে দাও, প্লিজ।
চিত্রাঙ্গদা রঞ্জিতের চোখে চোখ রাখলেন।
-ঠিক?
-হ্যাঁ, যা মিথ্যা তা ছেড়ে যা সত্যি সেটাকে মেনে নাও।
-সবকিছু এতো সহজ হলে তো সমস্যাই থাকে না, রঞ্জিত।
রঞ্জিত চিত্রাঙ্গদার ঠোঁটে ঠোঁট রাখলেন। গভীর ভাবে চুমু খেলেন দুজনে, দীর্ঘক্ষণ। তারপর সরে এসে রঞ্জিত বললেন
-এই তো ঠিকঠাক। বাকি সব ভুল চিত্রা, এটা তুমি মানো তো?
-আমি মানলেও, সমাজ?
-সমাজ কী বলবে? নেহাত খামখেয়ালি বলতে পারে তোমায়। আমার জন্য সইবে না হয়, সেটুকু।
-আবারো কেউ কষ্ট পাবে রঞ্জিত।
-পাক না। সে ছাব্বিশ বছর যা পেয়েছে তার এক অংশেরও যোগ্য কি?
চিত্রাঙ্গদা কিছু বললেন না। অর্ধেন্দু অত্যন্ত ভালো মানুষ, স্কলার। রঞ্জিতের আকর্ষণীয় নন, সুপুরুষ নন। চিত্রাঙ্গদার মনের ভালোবাসার আকাশটা দখল করতে পারেননি তাই, কখনোই। বন্ধু হয়েছেন, সঙ্গ দিয়েছেন, সময়ও দিয়েছেন। প্রচুর চর্চা করেছেন দুজনে একসাথে, প্রচুর পড়াশোনা। কিন্তু মাম যে বলে স্পার্ক – ঐ স্পার্কটারই অভাব দুজনের মধ্যে।
-কী ভাবছো? মানুষটা ভালো, কষ্ট পাবে, এসব? আর আমি কষ্ট পেলে বুঝি কিছু না? তুমি নিজে কষ্ট পেলে বুঝি কিছু না?
চিত্রাঙ্গদা রঞ্জিতের গলা জড়িয়ে ধরলেন।
-কী চাও?
-তোমাকে।
-এখনি পেতে পারো।
রঞ্জিত হাসলেন।
-শরীর আমি চাইছি না চিত্রা। তুমি চাইলে অবশ্যই আমার শরীর পাবে, এখনি। আমি তোমার আত্মাকে চাই। মিসেস চিত্রাঙ্গদা রায়কে চাই, আবারো।
-এখন এসবের সময় আর বাকি আছে, বলো? ছেলের বিয়ে সামনে।
-খুব বাকি আছে, আরো বেশ ক’বছর বাঁচবো দুজনে। আলাদা ভাবে বেঁচে কি লাভ?
-তোমার ব্যস্ততা একসাথে থাকতে দেবে, আদৌ?
রঞ্জিত চিত্রাঙ্গদার কপালে চুমু খেলেন।
-চাকরি শেষ কবে তোমার?
-বছর খানেক আর। ষাট অব্দিই করবো। তারপর ভি আর এস।
-তারপর সব বিজনেস ট্রিপে যাবে আমার সাথে। এখন তো আর ছেলে মানুষ করার জন্য ঘরে বসে থাকার বাহানা নেই। মেয়েটাও বড় হয়ে গেছে।
-মামকে ছেড়ে এভাবে!
-আমি ছাড়তে বলিনি তো। মামকে তোমার দরকার, মামেরও তোমাকে। দশবছরের ছেলেকে ছাড়তে উৎসাহ দেবার মতো নির্বোধ আমি নই চিত্রা। অনেক বাস্তববাদী, ইনফ্যাক্ট মামকে আমিও বেশ পছন্দ করি। ভালোওবাসি। তোমার ছবি দেখি ওর মধ্যে।
-বাবুসোনা কীভাবে নেবে এসব?
-তোমার বাবুসোনাকে আমি বুঝিয়ে বলবো না হয়।
রঞ্জিত চিত্রাঙ্গদার হাত ধরলেন।
-আর কোন সংশয়?
চিত্রাঙ্গদা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ওনার মোবাইলে ঋষভের ফোন এলো।
-ঋষভ?
-মা, বাবা কলকাতায়?
-হ্যাঁ, এই তো পাশেই আছে।
-গ্রেট, মাম পাঠাল ছবি, দেখলাম। খুব ভালো লাগলো দেখে।
-তুই কোথায়, বাবুসোনা?
ঋষভ মায়ের মুখে ডাকটা শুনলো। চোখে জল চলে এলো ওর। বহুদিন পর মা আদর করে ডাকলো ওকে।
-এই যে মা, প্যারিস থেকে দুবাই। মুম্বাই ফিরছি, কাল। খুব মন করছে তোমাদের দেখতে, দুজনকে একসাথে।
-চলে আয়।
-সত্যি? বাবা রাগ করবে না তো? অনেক কাজ আছে যে।
রঞ্জিত চিত্রাঙ্গদার কাছ থেকে ফোনটা নিলেন।
-বাবুসোনা – চলে আয় কাল। বহুদিন পর সবাই একসাথে, ভালোই হবে।
ঋষভ ভীষণ খুশি হল।
-একদম। আসছি বাবা, আসছি মা, কালই আসছি। আনিশাও তো কলকাতায় আছে, আর আমার বোন তো আছেই। সবাই একসাথে খুব মজা হবে।
ঋষভ ফোন রাখতেই চিত্রাঙ্গদা বললেন
-দেখেছো কী নরম মন তোমার ছেলের? মা বাবাকে একসাথে দেখেই কত খুশি, ও অ্যাবর্ট করতে বলতে পারে বলো?
রঞ্জিত মুচকি হাসলেন। -বিদিশা তো তাই বললো। মিথ্যা বলবে? কী লাভ ওর? ওর তো এখন দরকার সন্তানের, হন্যে হয়ে খুঁজছে। নিজেরটা না থাকলে খুঁজত না এভাবে।
-কিন্তু কোন খোঁজ তো পেলে না। নিজেরা গিয়েই তো দেখলাম, কোন প্রমাণ নেই। থাকলেও তাকে পাওয়া তো অসম্ভব।
-লেট মি ফিগার দিস আউট, চিত্রা। তবে আমার মন বলছে, সে আমাদের খুব কাছেই আছে।
চিত্রাঙ্গদা চুপ করে থাকলেন। চোখ মুছলেন তারপর
-অনীতের ছেলেটাকে আজ দেখে শূন্যতা আরও বেড়েছে।
-হুম, অনীত তো ঋষভেরই বয়সী।
-ক্লাসমেট। আর্ট কলেজে একসাথে পড়তো দু’জনে। আর বাচ্চাটা ভীষণ মিষ্টি, ভীষণ স্মার্টও। বাধ্য, সভ্য। একবারে বাবুসোনার ছোটবেলার মতো।
-বাহ। প্রথমদিনেই বেশ ভালো লেগেছে দেখছি।
-যাকে খুঁজছি সেও একই বয়সের বলো?
-হ্যাঁ, বিদিশা তো তাই বলছে?
-বিদিশার কোলে দারুণ মানাচ্ছিলো বাচ্চাটাকে। বিদিশাই ও-কে বছর দুই-আড়াই থেকে বড় করেছে না, তাই ওর ভীষণ বাধ্য, ভালোওবাসে খুব ম্যামকে।
-যাকে খুঁজছি সে এলে আরো মানাবে। সে বিদিশা-কে মা বলবে আর তোমাকে ঠাম্মা। সৌমিক ছেলেটাকে অত্যন্ত ভালো মনে হল, অসুবিধা হবে না।
চিত্রাঙ্গদা ম্লান হাসলেন –আজও তো কিছু পজেটিভ খবর পেলাম না। যদি না পাওয়া যায়, রঞ্জিত?
রঞ্জিতের মনেও এই সংশয় যে একেবারেই নেই তা নয়। কিন্তু চিত্রাকে বুঝতে দিলেন না।
-চেষ্টা তো করছি, না পাওয়া গেলে সেটা ভবিতব্য।
-বাবুসোনা জানবেও না যে ওর- আরো একবার ভাবো।
রঞ্জিত মাথা নাড়লেন।
-কিছু জিনিস না জানাই ভালো, চিত্রা।
দুজনের মধ্যে সন্ধ্যা নেমে এলো।
৩২
আনিশা খুব খুশি ছিলো আজ। ও যা চেয়েছে তাই হয়েছে। অনীশের বার্থ সার্টিফিকেটের কাজটাও হয়ে যাবে, কালই। টলি নায়িকা কথা দিয়েছে। বদলে ওর কিছু ড্রেস ডিজাইন করে দিতে হবে – এই আব্দার করেছে। অনীশের জন্মসালটা একবছর পিছলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। মা-বাবা অবাক হবেন ভীষণ ভাবেই, বিরোধীতা করবেন, চেঁচামেচিও করতে পারেন। কিন্তু আনিশা ওদের সামলে নেবে। মা-বাবা আনিশার ওপর নির্ভরশীল, এই নির্ভরতা দাদার কাছে পাবে না কিছুতেই। তাই আনিশাকে চটানোর সাহস খুব একটা হবে না।
অনীশকে আরো একবার জড়িয়ে ধরলো আনিশা। ও মন থেকে বিশ্বাস করে ওর মধ্যে যে এসেছিল সে-ই অনীশ। সে জন্মেছে, নষ্ট হয়নি। নষ্ট করতে চেয়েও পারেনি আনিশা। সে যেন কোন মূল্যেই তাই হারাতে চায় না ওকে। ছেলেকে আদর করছিলো, ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ। সারাদিন নাকি ম্যামের কাছে পড়েছে। ক্লান্ত ছিলো খুব। আনিশা আর জাগতে দেয়নি বেশিক্ষণ, ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে।
অনীতের স্পর্শে তাকালো আনিশা।
-ছেলে ঘুমোল?
-অনেকক্ষণ। তুমিও শুয়ে পড়ো।
অনীত আনিশাকে ইতস্তত করেই বললো
-একটু ওঘরে যাবে?
আনিশা অবাক হলেও অখুশি হল না। আজকের রাতটা বিশেষ রাত। অনীতের চাওয়া ভুল নয়। ন্যায্য। এতো বছর পর স্ত্রী হিসাবে পেয়েছে আনিশাকে। খুব স্বাভাবিক ওর এই চাওয়া। সন্তর্পণে উঠলো আনিশা
-চলো।
অনীত আনিশার হাত ধরলো।
-খুব জরুরি কিছু কথা আছে, নিশা। এই ঘরে বলা যাবে না, ছেলে জেগে গেলে বিপদ।
আনিশা থমকালো, কথা? একটু আহতও হল।
-কাল সকালে বলি না হয়?
-দেরি হয়ে যাবে নিশা। আমি খুব টেনস্ড। প্লিজ শোনো একটিবার। আনিশা আর অমত করলো না। দুজনেই অন্য ঘরে গেলো, সোফায় মুখোমুখী বসলো।
-বলো।
-বাবাই-এর জন্ম রহস্যের খোঁজ রঞ্জিত আঙ্কেল আর চিত্রাঙ্গদা ম্যাম করছেন জানোই তো।
-হ্যাঁ, আমি ওর জন্মদাত্রী কিনা – জানার কৌতূহল ওনাদের। মনে হয় সব অর্ফানেজই হাতড়াচ্ছেন।
-হয়তো। তবে ওর জন্মদাত্রীও খোঁজ করছে আজ জানলাম।
আনিশা থ হয়ে গেলো।
-জন্মদাত্রী! কে সে? কী করে জানলে?
-মাদারই বলেছেন। বছর ত্রিশের এক মেয়েও গিয়েছিলো সেখানে। ওনাদের যাওয়ার আগে, খুব অসংলগ্ন আর আবেগপ্রবণ মনে হয়েছিলো তাকে।
আনিশার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিলো। তবে কি তীরে এসে তরী ডুববে?
-কে সে? মাদার চেনেন? মানে ডেসক্রাইব করেছেন?
-হুম। আমিই দুইয়ে দুইয়ে চার করলাম।
-মানে, কে?
-যে এখন দত্তক নেবার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজছে, সে।
আনিশা চোখে মুখে অন্ধকার দেখলো।
-বিদিশা? সত্যি!
-হ্যাঁ।
-ঐ জন্যই সৌমিককে এড়াচ্ছে?
-হ্যাঁ, স্পেস চাইছে। আর রঞ্জিত আঙ্কেল আর চিত্রাঙ্গদা ম্যামের ইনভলমেন্ট দেখে বিদিশা যাকে খুঁজছে তার পিতৃপরিচয়ও আশা করি বুঝতে পারছো তুমি।
আনিশা চুপ করে গেলো। অনীত জানে প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা। ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিলো তাই। হু হু কান্নায় ভেঙে পড়লো আনিশা।
-শেষে এটাই হতে হলো নীত? এটাই? জিতে গেলো তো ওরা।
অনীতের মনের ভিতরটাও হু হু করছিলো। সত্যিটা বড়ই তেতো, সত্যিটা হজম করা বড়ই কঠিন। আনিশা অনীতের পাঞ্জাবির কলার ধরলো। নাড়া দিলো।
-চুপ করে আছো কেন? বলো। বলো কেন এমন হলো? এটাই কেন হতে হলো – বলো।
এর উত্তর অনীতের জানা নেই। আনিশার মাথায় কপালে হাত বলালো ও।
-কেঁদো না। শরীর খারাপ করবে।
-আগে বলো এটা ঠিক না – মিথ্যা।
অনীত আনিশার চোখ মোছালো। কপালে, চোখে, মুখে, নাকে, কপালে, অনেক করে চুমু খেলো। নিজেকে সামলালো এভাবে।
-মিথ্যাই তো, নিশা। মনে কোন কিন্তু রেখো না। ও আমার আর তোমারই।
আনিশা চোখ মুছলো।
-হ্যাঁ, এটাই বলো। এটাই বলবে বারবার। আর কাল তো কাগজ পেয়েই যাচ্ছি...
অনীত আনিশাকে আরো আদর করলো। শান্ত করলো ওকে। আনিশা অনীতের ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো। আলত করে চুমু খেলো একটা।
-নীত-
-বলো।
-সত্যিটা জেনেও ওকে আগের মতোই ভালোবাসবে তো?
অনীত জানে প্রশ্ন ওঠাটা ন্যায্য। আনিশাকে যে মানুষটা অনীতের থেকে কেড়ে নিতে বসেছিলো তার সন্তানকে মানা খুব কঠিন।
-সত্যি হলো ও আমার ছেলে। আমাদের ছেলে। আর এখন আমরা দুজনে আছি। একসাথে আরো বেশি ভালোবাসবো তাই না।
-ওরা সত্যিটা জেনে নিতে আসে যদি।
-জানবে কোত্থেকে? কাগজ সব সরিয়ে দিয়েছেন মাদার।
-শিওর তো?
-একশো ভাগ।
-ওখানে না পেলে দমে যাবে তো, বলো?
-সেটাই তো উচিৎ। ঋষভ, বিদিশা কি ম্যামকে নিয়ে আমার চিন্তা নেই, নিশা। সমস্যা রঞ্জিত আঙ্কেল কে নিয়ে। উনি খুব বুদ্ধিমান।
-কালই বিয়ের খবরটা পাবলিক করি?
অনীত মাথা নাড়লো
-হ্যাঁ করো। তার সাথে অনীশের জন্মের সত্যিটাও জুড়ে দিও। কলকাতা ছেড়ে যাবার কয়েকমাস আগেই যে ও হয়েছিলো – এটা বলো প্রেসকে।
-বলবো। কাল একসাথে তিনজনের ছবি তুলতে হবে কয়েকটা।
-তোমার মা বাবাকে নিয়ে আমি চিন্তিত।
-খবরটার শক কতটা নিতে পারবে কে জানে?
-বিয়ের না বাবাই থাকার?
আনিশা মুচকি হাসলো।
-দুটোরই। কিন্তু আমার ইমেজের কথা ভেবে পাবলিকালি যাতে কিছু না বলে, আমি দেখবো।
-তাহলে কাল সকালেই?
-না, বিকালে। সার্টিফিকেটটা হাতে আসুক।
অনীত আনিশার কথার যুক্তিটা বুঝলো। আনিশা অনীতের বুকে মাথা রাখলো।
-আজ আবার আমাদের বিয়ের রাত, নীত। প্রায় বারো বছর পর, আবারো।
-ঠিক, বারো বছর পর, আবার। কোনদিন ভাবিনি এমন হবে, জানো। যা হারিয়েছি তা ফিরে পাবো – ভাবাটা স্বপ্নেরও বেশি তাই না? একযুগ পর এই দেখো আমার বুকের মধ্যে চলে এসেছো আবার। আমার স্ত্রী হয়ে।
-ফিরে পেয়েছো?
আনিশার দিকে তাকালো অনীত।
-পেয়েছি তো। এই যে আমার বাহুবন্ধনেই রয়েছে সে। অন্যের হতেই দিইনি।
আনিশা তাকালো।
-পুরোটা ফিরে পেয়েছো?
অনীত আনিশার ইঙ্গিত বুঝলো। আনিশার আবেগ, আনিশার চাওয়ার যৌক্তিকতা।
-পাইনি তবে পেতে চাই।
-তাহলে দেরি কেন?
অনীত আনিশার হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছিলো। নিজেকে আটকাবে না আর ঠিক করলো। আজকের রাতে অন্তত আর হিসেবি হবে না। আনিশার দিকে ঝুঁকতে যাবে হঠাৎ-ই বাবাই-এর গলা শুনতে পেলো
-বাপি...
অনীত থমকালো আনিশার শ্বাস ঘন হয়ে এসেছে। নিজেকে অপরাধী মনে হলো ওর। ছেলেকে কিছু বলতে যাবে ওকে অবাক করে আনিশাই বললো
-ঘুম ভেঙে গেছে দুষ্টু?
অনীত অস্ফুটে আনিশাকে বললো
-সরি।
-কেন? বারো বছর আগের সাথে এখনের অনেক ফারাক তো থাকবেই তো। এখন আমরা মা বাবা যে।
আনিশা উঠে দাঁড়ালো
-হিসি?
অনীশ মাথা নাড়লো। আনিশা ওকে কোলে তুলে নিলো –চলো।
-তুমি শোওনি কেন?
-বাপির সাথে কথা বলছিলাম যে।
-সিক্রেট কথা? তাই এঘরে মাম্মা?
আনিশা কিছু বলতে যাবে অনীত বললো
-পাকা বুড়োর কথা শুনলে নিশা?
আনিশা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। ছেলেকে বকেনি অনীত। অন্যদিন হলে বকতো খুব।
-শুনছি তো। চল্ হিসি করিয়ে আনি।
-বাপি কোলে যাব।
অনীত হেসে ফেললো এবার। আনিশাও।
-এমন বাপ ন্যাওটা ছেলে জন্মেও দেখিনি। নীত নিয়ে যাও তোমার গুণধরকে।
অনীত চোখ মুছলো। নাহ, কিছু বৃথা যায়নি। ওর এতোগুলো বছরের রক্ত জল করা পরিশ্রম, ভালোবাসা সব অনীশের রক্তে মিশে গেছে। উঠে এসে কোলে নিলো অনীশকে। চুমু খেলো, নাহ, অন্যের কেন হবে? হতেই পারে না।
-বাপি কোলে যাবে বাবাই? চলো।
আনিশা অনীতের খুশির পরিমাপ করতে পারলো। ওর পিঠে হাত রাখলো তাই।
-তুমি পেরেছো, অনীত।
আস্তে করে বললো আনিশা।
-তুমিও।
অনীত যোগ করলো।
৩৩
ঋষভ কলকাতায় এসে ওদের বাড়িতে বিদিশাকে দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছিলো। চিত্রাঙ্গদা ওর চোখে মুখে অবাক ভাবটা পড়তে পেরেছিলেন। অস্বস্তিটাও। অর্ধেন্দু খেয়াল করেছিলেন বিষয়টা। ঋষভকে কিশোরকাল থেকে খুব ভালো মতো চেনেন অর্ধেন্দু। কী সে ও খুশি হয় কিসে অখুশি, জানেন।
-বাবুসোনা- চল্ স্টাডিতে গিয়ে গল্প করি একটু।
ঋষভ বুঝলো বাপি ও-কে আলাদা করে কিছু বলবে। এখানে মা, বাবা, বোন আছে- বিদিশাও। এখানে বাপি থাকতে চাইছে না। বাপি অমনই, নিভৃতচারী। সবার মাঝে থেকেও সবার থেকে আলাদা থাকতে জানে। সংসারের কাদা গায়ে মাখে না কখনোই। ঋষভ বাপির থেকে এটা শেখার চেষ্টা করে। কীভাবে নির্বিবাদী হওয়া যায়, নির্লিপ্তও। উঠে দাঁড়ালো ও, চিত্রাঙ্গদা ওকে আটকালো না। এটা ঋষভ আর অর্ধেন্দুর উই টাইম।
-চলো, তোমার নতুন নভেলের প্লটটাও বলবে আমায়।
অর্ধেন্দু ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসলেন। ঋষভ উল্টোদিকের চেয়ারে বসলো।
-ক্লান্ত লাগছে তোকে।
-হুম, অনেকটা জার্নি হলো আজ।
-ক’দিন থাক এখানে, আমাদের কাছে।
ঋষভ ম্লান হাসলো।
-প্রচুর কাজের চাপ গো বাপি, সামনেই আবার...
-হ্যাঁ, সামনেই আবার তোর বিয়ে, মহাযজ্ঞ। তোর মায়ের, আমার খুব কাঙ্ক্ষিত অনুষ্ঠান।
-তুমি একমাস লেখালিখি বন্ধ করে মুম্বাই যাবে কিন্তু।
-ওরে বাবা! একমাস নিঃশ্বাস না নিলে মরে যাব যে!
ঋষভ রাগ দেখালো।
-আবার তোমার এসব কথা!
-ভুল বললাম? লেখালিখির বাইরের জগতে আমার প্রয়োজন তো খুব একটা নেই, বাপি।
অর্ধেন্দু ঋষভকে বাপি বলেও ডাকেন মাঝে মাঝে।
-দেখছিস না- যার জিনিস সে নিতে চলে এসেছে, ছাব্বিশ বছর আমার কাছে গচ্ছিত ছিলো মাত্র। আমার কোনদিন হয়নি। ফাঁকি ছিলো সবটাই। তাদের মান অভিমানের খেলায় মাঝে পরে গিয়েছিলাম আমি।
ঋষভ চুপ করে থাকলো। বাপির চোখে জল দেখলো ঋষভ। মানুষটা খুব নরম মনের আর আবেগী। বাবার এভাবে মায়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা দেখে কষ্ট পেলেও মুখ ফুটে বলতে পারছেন না কিছুই। বলবেনও না কখনোই। ঋষভ জানে। অত্যন্ত মিতভাষী ভদ্রলোক উনি। ঋষভের মনে মা-বাবাকে একসাথে দেখার জন্য যে আনন্দ ছিলো অনেকটাই মিলিয়ে গেলো বাপির কষ্ট দেখে।
-আমি তো আছি, বোনও।
অর্ধেন্দু সামলালেন নিজেকে।
-বোন তার মায়ের মতোই হয়েছে। তুই আছিস, এটুকুই ভরসা।
ঋষভ অর্ধেন্দুর হাত নিজের হাতের মধ্যে নিলো। মা যখন এই লোকটার সাথে বাড়ি ঘর, বাবাকে, ওকে ছেড়েছিলো লোকটাকে ভীষণ ঘেন্না করা শুরু করেছিলো ঋষভ। দশ বছরের ঋষভ আঠারো বছরে এসে লোকটাকে পায়। কাছ থেকে দেখে বছর পাঁচেক। আর বোঝে ঘর ভাঙার জন্য এই মানুষটি কোন মতে দায়ী না। দায় যদি কারো থেকে থাকে তাহলে সেটা ওর মা-বাবার ইগোর।
-আমি তো আছিই বাপি। এককাজ করো, তুমি চলো আমার সাথে, মুম্বাই। আনিশাকে বললে খুব খুশি হবে, থাকবে আমাদের সাথে, অনেক বড় বাংলো, খোলামেলা। লিখতে সুবিধা হবে তোমার, চলো।
অর্ধেন্দু বুঝলেন ঋষভ সত্যিটা বুঝে গেছে। চিত্রাঙ্গদা আর ওনার সম্পর্কের মধ্যে আর কিছু অবশিষ্ট নেই কয়েকঝলক দেখেই বুঝে নিয়েছে বুদ্ধিমান ছেলেটা।
-সে সময় আসুক, যাবো।
ঋষভ বাপির হাতে চাপ দিলো।
-কথা দিলে কিন্তু।
-কথা? হ্যাঁ, কথা। কথায় তো রাখছি সারাজীবন বাপিই।
ঋষভ কথা ঘোরালো।
-কতদিন পর এঘরে আড্ডা দিচ্ছি বলো তো?
-কলেজের পর এই প্রথম, তাই না?
-ঠিক বলেছো, মায়ের বকার হাত থেকে বাঁচার ঘর ছিলো আমার এটা। মা গুচ্ছের আঁকার কাজ দিয়ে রাখতো – কলেজের কাজের উপরেও। ঐ গুলো কোনদিনই শেষ করে রাখতাম না – তাই মা বাড়ি ফেরার আগেই তোমার স্টাডিতে আশ্রয় নিতাম।
অর্ধেন্দু ঋষভের দিকে তাকালেন।
-মনে আছে তোর?
-থাকবে না? তার আগে তোমার বাপি তো বুঝতোই না বাবাকে কেবল ভয় পেতে নেই। ভালোওবাসা যায়, আব্দার করা যায়, গল্প করা যায়, বন্ধু হওয়া যায়। তুমি না থাকলে এসব কোনদিন জানতামই না। নিজে বাবা হলে তোমার মতোই হবার চেষ্টা করবো।
অর্ধেন্দু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
-সব বৃথা যায়নি তবে, কী বল?
-কিচ্ছু বৃথা যায়নি। এবার আমাকে কথা বলো তো, বিদিশা এখানে কী করছে?
অর্ধেন্দু তাকালেন।
-ক’দিন ধরেই তো আছে দেখছি।
-কেন? বিবাহিত মনে হল তো।
-হ্যাঁ, ওর স্বামীও এসেছিলো সেদিন। সৌমিক নাম মনে হয়। ওর রিপিটেড অ্যাবর্শান হচ্ছে, তোর মা বলছিলো বটে একদিন। এই কারণেই শ্বশুর বাড়িতে অশান্তি হবে হয়তো।
-ওহ, এখন তো সুস্থই মনে হচ্ছে...
-হ্যাঁ।
-তাহলে এখনো এখানে?
অর্ধেন্দু ঋষভের দিকে তাকালেন।
-অস্বস্তি হচ্ছে তোর, না?
ঋষভ অন্যদিকে তাকালো।
-কী রে বল্? সম্পর্ক ছিলো ওর সাথে, এটা তো জানি। ভাঙলি কেন?
ঋষভ চুপ করে থাকলো। বাপিকে ও মিথ্যা বলে না। কিন্তু এই কথাটা বলাও যাবে না।
-জানিস বাবুসোনা, তোর অল্প বয়সে এই স্টাডি তে বসেই আমাকে গল্পের ছলে চমৎকার চমৎকার প্লট বলতিস। তোর কল্পনা শক্তির প্রশংসা করতাম আমি, মনে মনে। একটা দুটো কলেজ প্রেমের নভেলে তোর প্লটের লাইন ব্যবহারও করেছি, মনে পড়ে। তখন ভাবিনি জীবনটাকে আমার ছেলে একটা প্লট বানিয়ে রেখে দেবে।
ঋষভের খুব খারাপ লাগছিলো। বাপি কক্ষনো বকেনি ওকে, খারাপ কথা বলেনি। আজ এই কথাগুলো বুকে বড্ড বিঁধছিল, তাই।
-একজনকে ভালোবাসলে অন্যজনকে ফেরাতে হয় – প্রথমজনকে পাওয়ার সামান্যতম সুযোগে – এটা ঠিক আমার ছেলের মতো হল না, ঋষভ।
ঋষভ চমকে উঠলো। বাপি ওকে ভালো নাম ধরে কখনো ডাকে না। তাহলে কী বিদিশাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো বলে সবাই ওর উপর বিরূপ এখন? বাপি কথাগুলো বলছে, হয়তো পরে মা-বাবাও বলবে – অথচ আনিশার বাইরে কাউকে ভালোবাসেনি ঋষভ কোনদিন। আনিশাকে পেতে চেয়েছে সারাজীবন। আনিশা ফেরার পরও ওর দিকে সম্পূর্ণ ডিভোটেড না হয়ে অনিচ্ছার একতরফা সম্পর্ক বয়ে বেরাবার কোন যুক্তি দেখেনি ও। তিনজন অভিভাবকই অখুশি হবে হয়তো তাতে।
-আমি বিদিশাকে ভালোবাসিনি কখনো, বাপি।
-বেশ, তাহলে সেটা ওকে আগে থেকেই জানাতে হতো, তাই না? বৃথা আশা দিলি কেন এতগুলো বছর?
-মা ওকে খুব ভালোবাসতো, তাই সরাসরি না করতে পারিনি ওকে।
-মায়ের কথা ভেবে সম্পর্কে ছিলি, তাই তো?
-হুম।
-তাহলে ছাড়ার সময় মা’কে জানাসনি কেন? ঠিক কী কারণে ছাড়ছিস? মেয়েটা নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলো প্রায়। তোর মা কত খুঁজেছে জানিস ওকে? কত কষ্ট পেয়েছে? কত কেঁদেছে? মেয়ের মতো ভালোবাসে চিত্রাঙ্গদা বিদিশাকে, এটা জেনেও...
ঋষভ চুপ করে থাকলো। অন্যায় করেছে ও, হয়তো কোন ক্ষমা নেই এই অন্যায়ের।
-আমি বিদিশাকে সরি বলে নেবো, তোমার সামনে। তুমি আমাকে ক্ষমা করবে তো তাহলে?
অর্ধেন্দু ঋষভের কাঁধে হাত রাখলেন।
-বেশ, তাই কর। আমার সামনে প্রয়োজন নেই, একান্তে কর। মেয়েটা মা হতে পারছে না বলে বিপর্যস্ত রয়েছে। অ্যাডপশনের চেষ্টা করছে। তোর মা-বাবাও ওকে সাহায্য করছে এ বিষয়ে।
-মা... হতে পারছে না?
-না, বারবার অ্যাবর্শন হয়ে যাচ্ছে।
-ওহ।
ঋষভের গলার কাছে অপরাধবোধ দলা পাকালো। তাহলে কি সত্যিই প্রেগন্যান্ট ছিলো তখন? ঋষভ ব্ল্যাকমেলিং ভেবেছিলো তখন। তাই অ্যাবর্ট করতে বলে দিয়েছিলো। ঐ অ্যাবর্শন করার ফলেই কি – জানতে হবে ঋষভকে সত্যিটা। যদি তাই হয়ে থাকে খুবই অনুচিত হয়েছে বিষয়টা। ভীষণ অন্যায় হয়েছে।
-বাপি, আমি বিদিশাকে সরি বলে আসি?
-বেশ।
ঋষভ অর্ধেন্দুকে প্রণাম করলো।
-তুমিও আমাকে ক্ষমা করে দিও বাপি। আমি বুঝিনি যে আমার প্রত্যাখ্যানে ও এতো কষ্ট পাবে।
অর্ধেন্দু ঋষভের মাথায় আর্শীবাদের হাত রাখলেন।
-ভুল শুধরে নাও, সময় আছে, এখনো।
-হ্যাঁ, বাপি।
চিত্রাঙ্গদা বিদিশার ঘরেই ছিলেন। ঋষভকে সামনাসামনি দেখে মেয়েটার মন খারাপ, আর সেটাই স্বাভাবিক।
-আজ বাড়ি চলে যাব, ম্যাম।
চিত্রাঙ্গদা অবাক হলেন।
-কেন রে? শরীর তো সারেনি এখনো।
-ভালো লাগছে না এখানে।
-ঋষভ এসেছে, তাই?
-হ্যাঁ, ভেবেছিলাম ওকে একবার সামনাসামনি দেখলে ভালো লাগবে, কিন্তু খারাপ লাগাটা হাজার গুণ বেড়ে যাচ্ছে।
-সৌমিককে বলেছিস্?
-নাহ, বলবো। তবে ঐ বাড়ি যেতেও মন করছে না, দাদাভাই-কে বলবো ভাবছি।
-আনিশা থাকতে পারে ওখানে।
-না গো। আজ তোমার ছেলে এসেছে, ঠিক চলে আসবে তোমাদের বাড়ি, চিনি আমি ওনাকে। আমি গেলে বাবাই-টাকে পাবো, মনখারাপ কেটে যাবে।
-বড্ড ভালোবাসিস, না?
-ওর বাইরে তো সন্তানসুখ পেলামই না, ম্যাম। যাকে জন্ম দিলাম তাকে তো খুঁজেই পাচ্ছো না তোমরা।
চিত্রাঙ্গদা বললো –বিকালে যাস্। এখন শো দেখি একটু, আমার কোলে মাথা রেখে শো।
বিদিশা মানা করলো না। ম্যামের কোলে মাথা রেখে শুলো। চিত্রাঙ্গদা বিদিশার মাথা টিপে দিতে থাকলেন আস্তে আস্তে।
-ম্যাম...
-বল্।
-বুঝলোই না – বলো?
-কে? ঋষভ?
-আর কে? ওকে কতটা ভালোবাসি কখনো বুঝতেই পারলো না।
-বাদ দে, সৌমিক অনেক ভালো ছেলে।
বিদিশা ম্লান হাসলো।
-জানি তো। ওর মতো স্বামী পাওয়া ভাগ্যের।
-তাহলে?
-ভালোবাসার নাম তো বদলায় না। তুমিও তো এখনো রঞ্জিত আঙ্কেলকেই ভালোবাসো।
চিত্রাঙ্গদা লুকোলেন না।
-তা বাসি।
-এবার একসাথে থাকো। আঙ্কেলকে বললেই রাজি হয়ে যাবে, কলকাতায় থাকতে।
-জানি রে। এখন তার মাথায় কেবল ঐ খোঁজটাই ঘুরছে, দিশা। দেখলি না – ছেলে এলো তাও কোথা থেকে কি খবর পেয়ে চলে গেলো।
-তোমাকে প্রমিস করেছে না, এনে দেবেই, তাই।
ঋষভ ঘরে এসেছিলো ততক্ষণে। গলা খাঁকারি দিলো। বিদিশা উঠে বসলো, চিত্রাঙ্গদা ছেলের দিকে তাকালেন
-ফ্রেশ হয়ে নে, রেস্ট কর।
-পরে করবো। বিদিশা- তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
চিত্রাঙ্গদা উঠে দাঁড়ালেন।
-নে, কথা বল্, আমি আসছি।
ঋষভ মা চলে গেলে দরজা ভেজিয়ে দিলো। বিদিশা এই কনফ্রন্টেশনের জন্য শুরুতে প্রস্তুত না থাকলেও মিনিট খানেকের মধ্যে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিলো।
-বলো কি বলবে?
-বসি একটু? তোমার সামনে?
-ওসব নাটক না করলেও হবে, ঋষভ।
-নাটক না। বসে ঠান্ডা মাথায় কয়েকটা কথা বলতে চাই তোমায়।
বিদিশা হাসলো।
-আমার জীবন নষ্ট করে দিয়ে আমাকেই কথা বলবে? বেশ, বলো, শুনি।
-সরি, তোমার কাছে আমি ক্ষমা প্রার্থী বিদিশা। আমার নিজের স্বার্থের জন্য...
বিদিশা থামিয়ে দিলো।
-বেশ তো, করলাম ক্ষমা। আর?
-এতো সহজে?
-তোমার প্রতি আমার কোন প্রত্যাশা নেই, যার প্রতি প্রত্যাশা নেই তাকে ক্ষমা করতে সময় লাগে না।
ঋষভ মাথা নাড়লো।
-বেশ, কেমন আছো?
-যেমন রেখেছো, দেখতেই তো পাচ্ছো।
-হাজব্যান্ড...
-সৌমিক খুব ভালো ছেলে,
-বাহ। তাহলে শ্বশুরবাড়িতে সমস্যা? এতো শুকনো লাগছে কেন তোমায়?
-তুমি জেনে কী করবে?
-আমি চাই তুমি ভালো থাকো, তাই।
-ওহ, সমস্যা আমার মধ্যে, আমি মা হতে চেয়েও পারছি না তাই।
-কেন?
বিদিশা হাসলো –আমার পাপের জন্য।
ঋষভ ওর চোখে চোখ রাখলো।
-পাপ? কিসের পাপ?
ঋষভ সত্যিটা জানতে চায়। অ্যাবর্শন করেই কি এমন হয়েছে?
-তুমি জানো কোন পাপ।
-তুমি প্রেগন্যান্ট ছিলে – অ্যাবর্ট করেছো – তাই জটিলতা?
বিদিশা চোখ মুছলো। নিজের আবেগ কে বাঁধ দিতে চাইছিলো যেন, কিন্তু পারছিলো না।
-বিদিশা – আমি – আমি তখন বিশ্বাস করতে পারিনি তুমি প্রেগন্যান্ট।
ঋষভ হাত ধরলো বিদিশার। বিদিশা হাত ছাড়িয়ে নিলো।
-বাহ, মিথ্যাবাদীও ভেবেছিলে আমায়, বেশ তো। রিপোর্ট চেয়েছিলে দেখেই বুঝেছিলাম।
-আমি ভেবেছিলাম সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলে বলেই এইসব বলছো।
-নিজের ছেলেকে নিয়ে মিথ্যা বলবো, তাই তো?
বিদিশা বলেই বুঝলো ভুল বলে ফেলেছে। অথচ শুধরাবার উপায় ছিলো না।
ঋষভ ধরে ফেলেছিলো –ছেলে? অ্যাবর্ট করোনি? জেন্ডার জানলে কি করে?
-সন্তান বলতে গিয়ে ছেলে বলে ফেলেছি।
বিদিশা ঢাকতে চাইলো। ঋষভ বিদিশার দুই কাঁধে হাত রাখলো।
-মিথ্যাটা আজও খুব খারাপ ভাবে বলো। অ্যাবর্ট করোনি, তাই না?
বিদিশা চুপ করে থাকলো। ঋষভ ওকে দু’হাতের মাঝে নিয়ে ঝাঁকালো প্রবল রাগে।
-স্পিক আপ! কেন করলে এমন, কেন? শাস্তি দিতে চেয়েছিলে আমায়, তাই না? কেন করলে?
বিদিশা নিজের কাঁধ থেকে ঋষভের হাত সরিয়ে নিলো।
-আমি চাইনি তোমাকে বা নিজেকে শাস্তি দিতে। আবার ওকে মেরেও ফেলতে পারিনি, কোথাও একটা বেঁধেছিলো যেন।
ঋষভ অঝোরে কাঁদছিলো। বিদিশাও। ঋষভ চমশা খুলে চোখ মুছলো বেশ কিছুক্ষণ অঝোরে কাঁদার পর। নিজের জীবন সম্পর্কে জীবনের একটা বড় অংশ সম্পর্কে মানুষ হঠাৎ জানলে কান্নাটাই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া আসে বৈকি। এতটা কান্না শেষ কবে কেঁদেছিলো ঋষভ? দশবছর বয়সে যেদিন সব ফেলে মা চলে গেলো, সেদিনই শেষ, তাই না?
-দিশা – শান্ত হও।
ঋষভ নিজেকে শান্ত করতেই কথাটা বললো। বেশকিছুক্ষণ কেটে গেছে, ওদের জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যটা মুখোমুখি বসে ভাগ করে নেবার পর। এখন শান্ত হতেই হবে।
-দিশা – তোমার না শরীর খারাপ? এভাবে কাঁদতে নেই।
ঋষভ বিদিশার মাথায় হাত রাখলো। বিদিশা ঋষভকে আঁকড়ে ধরলো প্রবল আবেগে। ঋষভের বুকের মধ্যে হু হু কান্নায় ভেসে যেতে থাকলো। ঋষভ বাঁধা দিলো না, বিদিশার মাথায় পিঠে হাত বোলাচ্ছিলো ও।
-আমি ইচ্ছা করে করিনি ঋষভ। আমি যে মেরে ফেলতে পারিনি। আমি যে ওর মা, আমি জানি আমি ভুল করেছি, কিন্তু...
ঋষভ নিজের সন্তানের জন্মদাত্রীর কপালে চুমু খেলো।
-আমিও পারতাম না, যদি জানতাম প্রেগন্যান্সির কথাটা সত্যি। আমাকে রিপোর্ট পাঠাওনি কেন? বলো তো? আমি চেয়েছিলাম তো...
-ঘেন্নায়। তোমার অবিশ্বাস আর লোভ দেখে ঘেন্না করেছিলাম তোমায়।
-ন্যায্য কথা বলেছো। কিন্তু এই ঘেন্নার পাত্রর সন্তানেরই তো জন্ম দিলে, দিশা। তারই তো মা হলে।
বিদিশা ঋষভের বুকের মধ্যে সজোরে মাথা নাড়লো।
-তোমার কেউ না, ও আমার একার। তুমি তো অস্বীকার করেইছো। কক্ষণো তোমার না।
-না বুঝে করেছি তো? আমার ভাগটা দেবে না? কোথায় সে? তাকে দেখাও আমায়?
বিদিশা মুখ তুললো। ঋষভের চোখের জল ওর মুখে ঝোরে পড়ছিলো।
-দেখতে চাও?
-নিশ্চয়। নিজেরও করতে চাই, নাম দিতে চাই।
-আবেগে বলছো এসব।
-একদম নয়। ভেবেচিন্তে বলছি। কোথায় সে? নিয়ে চলো তার কাছে, প্লিজ।
-এখানে থেকে তাকেই তো খুঁজছি ঋষভ। আমি, আঙ্কেল, ম্যাম...
ঋষভ চমকালো। এতো লজ্জার কথা বাবা-মা জানে!
-বাবা-মা জানে!
-সব জানে। আঙ্কেল আর ম্যাম হন্যে হয়ে খুঁজছে তাকে।
-কোথায়?
-যেখানে সাতবছর আগে ছেড়েছিলো আমার মা-বাবা।
-কাগজপত্র দেখলেই তো...
বিদিশা চোখ মুছলো।
-সেই বছরের ফ্যাইলই উধাও করে দিয়েছে কেউ।
ঋষভ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো।
-ইজ ইট? তার মানে পাওয়ার আশা নেই?
-জানি না, হয়তো নেই। আঙ্কেল যখন পাচ্ছেন না এতো সোর্স দিয়েও...
ঋষভ একটু ভাবলো, তারপর বললো
-পেলে বাবা কী করবেন, বলেছেন?
-অ্যাডপ্ট করাবেন আমাকে দিয়ে। আমার আর সৌমিকের বাচ্চার পরিচয়ে।
ঋষভ ব্যাঙ্গের হাসি হাসলো।
-জানতাম, বাবা এটাই ভাববে। বাবা মাথা দিয়ে ভাবে তো, তাই খুব প্রেডিক্টেবল হয়।
-তোমাকে ওর কথা বলতে মানা করেছিলেন আঙ্কেল।
ঋষভ বিদিশার হাত ধরলো।
-সেটাও জানি। চিন্তা নেই, আমি যে জানি বাবা-মা কে বলবো না। কিন্তু নিজে খুঁজবো ওকে। অন্যের ভরসা করবো না।
-খুঁজে?
-নাম দেবো। আমার নাম।
-তোমার তো বিয়ে সামনে-
-আনিশাকে জানাবো, ও খুব ভালো মনের মেয়ে দিশা, মানবে নিশ্চয়। না মানলে বিয়ে হবে না।
-আর আমি? আমি যে ওর সাথে থাকতে চাই। ওর মা হয়ে বাঁচতে চাই।
-বেশ তো। ঋষভ রায়ের ছেলের মায়ের পরিচয়ে বাঁচার সাহসটুকু করতে হবে তবে।
বিদিশা অবাক চোখে তাকালো।
-ঋষভ – আমি বিবাহিত।
-জানি তো। তা বলে আমার ছেলেকে অন্যের ছেলের নামে পরিচিত করতে দেবো না তোমায় দিশা। তুমি ওর মা, ওর সাথে থাকবে। খুব ভালো কথা, কিন্তু ওর প্রকৃত পরিচয়ে। এখানে সেটা অসম্ভব ঠেকলে – মুম্বাই যেতে হবে তোমায়।
-কী সব বলছো?
-ঠিকই বলছি। সন্তানটা আমারও, দাবী জানাচ্ছি। অন্যায্য নয় তো সেটা।
-দাবী জানানোর মতো কি করেছো?
-করতে দিয়েছো কী? এসব তর্ক ছাড়ো। আগে খুঁজি ওকে, খুঁজে পাই, পরে ভাববো। তোমাকে ঠকাবো না আমি, নিশ্চিত থেকো। তোমার ছেলে তুমি অবশ্যই পাবে।
ঋষভের কথায় এমন কিছু ছিলো বিদিশা চুপ করে গেলো। ঋষভ যা বলছে, ভেবেই বলছে, নিশ্চয়।
৩৪
অনীশ বাপিকে খুব অন্যমনস্ক দেখছিলো আজ। ব্যস্তও। মাম্মা একটু আগে বেরোলো। বাপি এখনো ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। আজ ছবি তুলতে এসেছিলো ওদের, এত্ত বড় ক্যামেরা নিয়ে, কাকাই-এর সাথে কয়েকটা লোক। মাম্মা ওকে সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে তুলে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছিলো নিজের হাতে। নতুন কুর্তা, পাজামা, হাফ জ্যাকেট পরিয়ে দিয়েছিলো। বারবার আয়নায় দেখছিলো ঠিকঠাক হয়েছে কিনা। অনীশ উসখুশ করছিলো, মাম্মা বুঝেই বলেছিলো
-আর একটুক্ষণ।
-কত্তক্ষণ সাজুগুজু মাম্মা।
-এট্টু সাজুগুজু করতে হয় তো, ছবিতে ভালো লাগবে। হয়েই গেছে, এবার যা, বাপির কাছে গিয়ে বস।
-কেন?
-আমি রেডি হই।
-তো হও। আমি থাকি। তোমাকে আমি সাজুগুজু করিয়ে দেবো না হয়।
-পাকা বুড়ো, তুই পারবি নাকি?
বাপি কখন দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলো খেয়াল করেনি অনীশ। বাপির গলা পেয়ে চমকে উঠেছিলো
-মাম্মা কী বললো বাবাই?
-সরি, বাপি।
-ওঘরে চল্। মা-কে রেডি হতে দে।
অনীশ কাঁচুমাচু মুখ করে নেমে যাচ্ছিলো খাট থেকে।
-নীত, থাকুক, না হলে কষ্ট পাবে।
-প্রশ্রয় দাও, আরো।
মাম্মা রেগে গিয়েছিলো
-আমি কেবল প্রশ্রয়ই দিই বলতে চাও?
-দিচ্ছো তো এখন। ঐ বাঁদর, ওঘরে চল্। তিন গুণবে বাপি, না গেলে কী হবে, তুই জানিস্।
অনীশ কাঁচুমাচু মুখ করে ওঘরে চলে গিয়েছিলো। চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছিলো ওর। বাপি এসে ওকে দেখে চোখ মুছিয়ে দিয়েছিলো। কোলে বসিয়েছিলো তারপরে।
-মাম্মা সাজবে তো... ডিস্টার্ব হবে আমরা থাকলে।
অনীশ উত্তর দেয়নি। মাম্মা তো থাকতে বলেছিলো, মাম্মার ডিস্টার্ব হবে না, বাপির বকতে ইচ্ছা হয়েছে, বকেছে।
-সকাল থেকে পড়া নেই – ম্যামকে বলবো?
বাপি ইচ্ছা করেই বলেছিলো কথাটা।
-পড়তাম তো। মাম্মাই তো রেডি করলো। স্কুলেও যেতে দিলো না, আজ টেস্ট ছিলো।
-মাম্মা রেডি হতে হতে একটু আঁকাআঁকি হবে? স্কুলে কথা বলে নিয়েছি, তোর টেস্ট কাল নেবে।
অনীশ মাথা নাড়লো। বাপির সাথে খেলবে না ও। বাপিও ঠিক ওর মতোই ড্রেস আপ করেছে। কুর্তা, পাজামা, জ্যাকেট, বাপিকে দারুণ লাগছে।
-হবে না? আচ্ছা! এটাও ম্যামকে বলতে হবে তবে। অনীশ পড়ছে না, আঁকছে না, বাপির অবাধ্য হচ্ছে, আঁকাআঁকিও খেলছে না...
-বলো। তারপর অনীশকে ম্যাম কী মারটাই না মারবে তুমি জানো। তোমার মজা হবে, তোমার ছেলে মার খেলে।
অনীত ছেলেকে আদর করলো –বলবো না তবে।
-না, না, বলো। বাবাই এটা করেনি – ওটা করেনি, ব্যাস। তারপর বাবাই নীলডাউন হলে, কি উঠবোস্ খেলে – তুমিই কষ্ট পাবে। মুচকি হাসবে উপর উপর, রাতে আমাকে অনেক করে আদর করে দেবে।
-এই তো বললি মজা হবে, বাপির।
-ওটা উপরে উপরে। ভিতরে কষ্ট হবে। এবার আঁকাআঁকি খেলবো, আনো।
-মা রেডি হয়ে যাবে তো।
-একঘণ্টা লাগবে বাপি, অনেক খেলা হয়ে যাবে।
অনীত হেসে ফেলেছিলো।
-মাম্মার সাজতে লেট হয় এটাও জেনে গেছো, পাকা বুড়ো।
-হি হি, মাম্মাকে বলো না।
-কেন? তোর মা তো তোকে কক্ষণো বকেনা?
-আমার মাম্মার কষ্ট পায়। এই যে আমাকে নিয়ে এলে বকেঝকে, দেখো রেগে মুখ ভার করে আছে।
-মা-বাবাকে খুব ভালো চেনো, বাঁদর।
-আমার বাপিকে মাম্মাকে আমি চিনবো না, কে চিনবে?
বাপির চোখে জল চলে এসেছিলো, বাপি কাঁদছিলো। অনীশ অনেক করে চোখ মুছিয়েছে বাপির। তবুও কাঁদছিলো। অনীশ অনেক সাহস করে বাপির দুগালে আদর করে দিয়েছে অনেক। বাপি ওকে জড়িয়ে কাঁদছিলো তারপর – থামছিলোই না।
মাম্মা ঘর থেকে বেরিয়ে ছিলো, কিছু একটা আনতে। বাপিকে ওভাবে কাঁদতে দেখে এঘরে এসে বাপিকে ডাকে
-নীত – কাঁদছো কেন? বাবাই, কী হয়েছে?
-জানি না, মাম্মা। বাপি – ও বাপি – আমি কিচ্ছু করিনি। মাম্মা, বিশ্বাস করো। বাপিকে কষ্ট দিইনি।
আনিশা বুঝলো এটা অনীতের নিজের মনেরই জট খোলার কান্না। পাশে বসলো
-নীত, এভাবে কাঁদে না পাগল। ছেলেটা কী ভাববে?
আস্তে করে বললো আনিশা। ছেলের সামনেই অনীতকে চুমু খেলো বেশ কয়েকটা।
-শান্ত হও। বকলে এতো মনখারাপ হলে বকো কেন?
-কিচ্ছু বৃথা যায়নি, নিশা...
-জানি। কিছু বৃথা যাবেও না। শক্ত হও। বাবাই – চল্। আমি রেডি। বাকি সাজুগুজু একসাথে করবো।
-বাপির মানা যে, তুমি সাজবে একা একা।
আনিশা হাসলো –বাপিও যাবে। চলুন মশাই, শাড়ির কুঁচিটা ধরতে হবে।
বাপি আর মাম্মা-কে ছবি তোলার সময় খুব খুশি লাগছিলো। অনীশকে কোলে নিয়েও অনেক ছবি তুলেছে দুজনে। দাঁড়িয়ে ছবি তুলে বাপির কোলে, বসে ছবি তুললে মাম্মার কোলে, কি মাঝে। আর ওরা দুজনে যখন ছবি তুলছিলো কাকাইয়ের কাছে ছিলো অনীশ। কাকাইরা চলে গেলে মাম্মাও চেঞ্জ করে বেরোলো। খুব তাড়াতাড়ি করছিলো মাম্মা। বাপিও সেই থেকে ল্যাপটপে কীসব খুঁজছে, কথাও বলছে না একটুও।
অনীশ সাহস করে বলেই ফেললো
-ও বাপি...
-হুম?
-খিদে পাচ্ছে।
অনীত লজ্জিত হলো। চট করে ল্যাপটপ-টা শাটডাউন করলো।
-অনেক বেজে গেছে না? চল্ খাইয়ে দিই। আগে বলবি তো বোকা।
-তুমি কাজ করছিলে।
অনীত আনিশার সার্টিফিকেটগুলো না পাওয়া অব্দি টেনশড থাকবে। মেয়েটা ওগুলো আনতে গেছে, ওটা পেয়ে গেলেই সব চ্যানেলে নিউজ ব্রেক করবে ওদের বিয়ের। অনীত ওদের ম্যারেজ সার্টিফিকেটটা সাইটে আপলোড হয়েছে কিনা দেখছিলো এতক্ষণ, পেয়ে গেছে। এবার বার্থ সার্টিফিকেট-টা আর নার্সিংহোমের ডিসচার্জ পেলেই হয়।
-খাবি চল্।
-বাপি, তুমি সব ভুলে যাচ্ছো, আগে স্নান।
অনীত লজ্জিত হলো আবারও।
-হ্যাঁ, বাবাই। বাপি একটু টেনশনে আছে।
-সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমার পা ব্যথা, আমি স্নান করে নিই, একা।
অনীত মাথা নাড়লো
-একদম না। আমি করিয়ে দিচ্ছি, চল্
-বাপি – একটু শোনো-
অনীত মাথা নামালো ছেলের ডাকে। অনীশ বাবার গলা জড়িয়ে চুমু খেলো।
-টেনশন করো না। সব ঠিক হবে।
-বলছিস্?
-হ্যাঁ তো। এক্সামের আগে তুমিই তো বলো এটা, যা পারবি লিখে আসবি, একদম টেনশন করবি না। আমিও তাই বললাম তোমায়, তোমার এক্সাম, বাপি!
অনীত ছেলেকে কোলে তুলে নিলো
-বাপির জীবনের সবচেয়ে বড় এক্সাম আজ, বাবাই। পাশ যে করতেই হবে।
-করে যাবে। রেজাল্ট একটু খারাপ হলেই বা কি, তুমি তো আমার বাপিই থাকবে, আর মাম্মার হাজব্যান্ড, তাই না?
অনীত ছেলের একটা সরল ব্যাখ্যায় বাক্যহারা হয়ে গিয়েছিলো। ঠিকই তো, ফলাফল যায় হোক – এই দুটো সত্যি তো আর বদলাবে না। অপরিবর্তনীয় এটা। তাহলে আর চিন্তা কিসের।
৩৫
রঞ্জিত চিত্রাঙ্গদাকে নিয়ে আলিপুরের বাড়িতে এসেছিলেন, আবার। বাড়িতে সব কথা হয় না, হওয়া সম্ভবও নয়। চিত্রাঙ্গদা সারাটা রাস্তা চুপচাপ ছিলেন। বাড়িতে নিজেদের ঘরে এসে মুখ খুললেন।
-পেলে?
-নাহ্, তবে পাবো।
-ঋষভ বেরোলো একটু আগেই, তুমি ফেরোনি তখনো...
-আনিশার সাথে দেখা করতে গেলো হয়তো।
চিত্রাঙ্গদা মাথা নাড়লেন।
-নাহ, বিদিশা সাথে ছিলো।
-হোয়াট? কোথায় গেলো?
-জানি না।
-বিদিশা ঋষভকে সত্যিটা বলে দেয়নি তো।
-সেটাও জানি না। তবে আজ বাড়ি চলে যাবে বলছিলো।
-বেশ, চলে যাক। ওর ঋষভের সামনে বেশি না থাকাই ভালো। তুমি আটকালে না কেন ওদের?
চিত্রাঙ্গদা ম্লান হাসলেন।
-ছেলে মেয়ে বড় হলে আটকানো যায়?
-যায়। সেই জোরটা রাখতে হয়।
-জোর দিয়ে সব হয়না, রঞ্জিত।
-হয়। আটকানো যায়। আমি তোমার বেলায় সেটা কেন করিনি এখন ভাবি।
চিত্রাঙ্গদা অবাক হলেন।
-জোর করতে?
-জোর করবো কেন? জোর দেখাতাম। দাবির জোর, ভালোবাসার জোর।
-আর সময়?
-দেব এবার থেকে। যত চাও।
-আমার খুব ভয় করছে, রঞ্জিত।
রঞ্জিত চিত্রাঙ্গদাকে বুকে টেনে নিলেন।
-কেন? আমি তো আছি, ভয় কীসের?
-খুব খারাপ কিছু ঘটবে, মনে হচ্ছে।
-বিদিশা বাবুসোনাকে অনীতের বাড়ি নিয়ে যায়নি তো, চিত্রা? ওখানে আনিশা আছে, বিয়েটা ভাঙুক আমি কিছুতেই চাই না।
-গেলে?
-কেলেঙ্কারি হবে।
-আজ বিদিশা অনীতের বাড়িতেই রাতে থাকবে বলেছিলো। শ্বশুরবাড়ি যাবে না।
-উফ! চিত্রা। এটা এখন বলছো আমাকে?
চিত্রাঙ্গদা চুপ করে থাকলেন। রঞ্জিত রেগে গেছেন। রেগে থাকলে উনার সামনে কথা বলা যায় না। রঞ্জিত নিজেকে সামলালেন।
-বেশ। যা হবার হয়েছে। তোমার সুপুত্রকে ফোন করো একটা।
-এখন?
-হ্যাঁ, এখনি। বলো বাবা ডাকছে। তাড়াতাড়ি আসতে।
-তুমি করলে ভালো হতো না?
রঞ্জিত নিজের মোবাইলই বার করলেন। ঋষভকে কল করতে যাবেন, হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন বুকের বামদিকে হঠাৎ ব্যথা লাগায়। চাপ ধরা ব্যথা, দম নেওয়া যাচ্ছে না, চোখেও অন্ধকার দেখছেন।
-চিত্রা!
আর্তনাদের মতো শোনালো রঞ্জিতের গলা। বুক চেপে ধরে বসে পড়লেন খাটে।
-কী হলো? কী হলো তোমার? ওগো-
-জল – জল দাও।
চিত্রাঙ্গদা জল দিলেন চটপট। ব্যাগে সরবিট্রেট আর গ্যাসের ওষুধ রাখা থাকে সবসময়।
-এটা জিভের তলায় দাও... আর এটা খাও। বুক ব্যথা করছে? হ্যাঁ গো...
রঞ্জিত চিত্রার কথামতো সব করলেন। বুকটায় চাপ ধরেছিলে, দম আটকে আসছিলো যেন। চিত্রার ওষুধ দুটো আর জল খেয়ে চাপটা আর নেই। শ্বাস নিতে পারছেন, চোখে মুখে অন্ধকারও নেই, আরাম লাগছে একটু।
-হ্যাঁ গো, কমলো? হাসপাতাল যাবে? কি গো কিছু বলো...
রঞ্জিত মাথা নাড়লেন।
-ঠিক আছি। কোত্থাও যাব না, যেতে হবে না। তুমি আছো তো সাথে, দুটো ওষুধেই কমে গেছে। ডাক্তারি শিখলে কবে থেকে বলো তো।
-এখনো মস্করা। হার্টের প্রবলেম দেখা দিয়েছে – তার মধ্যেও ইয়ার্কি। জল খাও দেখি একটু।
রঞ্জিত জল খেলেন। ঢকঢক করে।
-ডাক্তার দেখাতে চলো এখনই... খালি নিজের অবহেলা। তোমার কিছু হলে আমাদের কি হবে বলো তো? আমার, বাবুসোনার, মামের...
-কী আর হবে? ছেলেমেয়েদেরও আর একটা বাবা আছে। তুমিও বিধবা হবে না।
চিত্রাঙ্গদা হঠাৎ রেগে গিয়ে রঞ্জিতের কলার ধরলেন। ঝাঁকাতে থাকলেন বার কয়েক, জোরে জোরে।
-কিচ্ছু হবে না তাই না – কিচ্ছু হবে না-
রঞ্জিত চিত্রাঙ্গার রাগ, অভিমান চেনেন। ওনার কোমর জড়িয়ে ধরলেন, শাড়ির আঁচল সরিয়ে বুকে মুখ গুঁজলেন।
-আর বলবো না।
চিত্রাঙ্গদা রঞ্জিতের পিঠে কপট কিল মারলেন বেশ কয়েকটা।
-হার্ট অ্যাটাক হচ্ছিলো পাঁচমিনিট আগে তোমার সত্যবানের, তুমি সাবিত্রী হয়ে ফেরত আনলে, এনে আবার মারছো?
-কীসের সাবিত্রী! বললে না – বিধবা তো হবো না-
রঞ্জিত চিত্রাঙ্গার পেটের অনাবৃত অংশে চুমু খাচ্ছিলেন।
-বিধবা না হলে সাবিত্রী হয় না বুঝি?
-না তুমি কি বলেছো আমি বুঝেছি, বেশ, তুমি ওটাই চাও তো, তাই হবে। তোমার জেদের কাছে হাজার বার হার হয়েছে আমার। এখন ডাক্তারের কাছে চলো লক্ষীটি। তুমি না থাকলে আমি নিঃস্ব।
-যাবো তো, কোনটা চাই বললে না তো?
-মিসেস চিত্রাঙ্গদা রায় – হতে রাজি আমি।
-ঠিক বলছো?
-বলছি।
রঞ্জিত মুখ তুলে তাকালেন।
-বেশ, আমিও ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি, একটা শর্তে।
-বলো।
-বাবুসোনা আর মামকে জানাবে না কিচ্ছু, টেনশন করবে খামোখা।
-বেশ, তাই হবে, তবু চলো এখনি।
রঞ্জিত চিত্রাঙ্গদাকে আবার জড়িয়ে ধরলেন।
-যাবে বললে যে, ছাড়ো!
-এতো বছর পর পেয়েছি চিত্রা, ছাড়তে ইচ্ছা করে না।
চিত্রাঙ্গদা রঞ্জিতের মাথায় চুমু খেলেন।
-বুঝি। এই পাগলামিগুলো ছাব্বিশবছর আগে করলে হারাতেই হতো না।
-চলো তোমার ডাক্তারের কাছে, ছাব্বিশ বছর পুষিয়ে নিতে হবে যে – অনেকটা বেঁচে।
-রঞ্জিত?
-বলো।
-কথা দাও কখনো ছেড়ে যাবে না আমায়? কখনো বিধবা হতে দেবে না আমায়? তোমার হাতের সিঁদুর পরে যেতে চাই আমি – দেবে তো?
রঞ্জিত হেসে ফেললেন।
-কথাগুলো উচ্চশিক্ষিতা আধুনিকা আর্ট কলেজের প্রফেসরের মতো শোনাচ্ছে না যে।
-আঃ, বলো না, দেবে তো?
রঞ্জিত চিত্রাঙ্গদাকে আশ্বস্ত করলেন –সহজে মরবো না, কথা দিলাম।
চিত্রাঙ্গদা রঞ্জিতের হাত ধরলেন –চলো।
৩৬
বিদিশা আগেও এখানে এসেছে, ঋষভ এই প্রথম। যথারীতি ওদের মাদার যোহানার ঘরের সামনে বেঞ্চিতে বসে অপেক্ষা করতে হচ্ছিলো। ঋষভ বললো
-মা-বাবা এসেছিলো, এখানেই?
-হ্যাঁ, ফিরিয়ে দিয়েছেন মাদার।
-ওহ।
-আঙ্কেল একজন ক্লার্ক-কে ধরে ভিতর থেকে কোথায় অ্যাডপ্টেড আউট বার করতে চেষ্টা করেছিলেন। ঐ বছরের রেজিস্টারটাই নাকি উধাও হয়ে গেছে অফিস থেকে।
-স্ট্রেঞ্জ।
-স্ট্রেঞ্জই।
-তার মানে যারা অ্যাডপ্ট করেছে তারা এখানকার কর্তৃপক্ষের খুব ক্লোজ।
ঋষভ ঘড়ি দেখলো
-কতক্ষণ আর?
-ওয়েট করতে হয় এখানে। তোমাকে আমার আর একটা কথাও বলা হয়নি।
ঋষভ তাকালো। ব্যাঙ্গের হাসি হাসলো
-আবারও সারপ্রাইজ? বলো না – আমার পাশে বসেই তুমি প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছো।
-তোমার এখনো আমাদের সন্তানকে মিথ্যা বলে মনে হয়?
ঋষভ মাথা নাড়লো।
-একদম না।
-রিপোর্ট দেখতে চাও? মা-বাবার কাছে তখনকার সব রিপোর্ট আছে, দেখাচ্ছি। এতো অবিশ্বাস হলে দেখাবো।
-বার্থ সার্টিফিকেটটা লাগবে। ছেলেকে খুঁজে পেলে।
-আছে, আমার বালির বাড়িতে।
-বাবার নাম ঋষভ রায় রেখেছো তো? নাকি ব্ল্যাঙ্ক?
বিদিশা অন্যদিকে তাকালো।
-আমি ব্ল্যাঙ্ক রাখতে চেয়েছিলাম, বাবা তোমার নাম রেখেছিলেন সার্টিফিকেটে। জোর করে , আমার মত ছিলো না।
-আর ছেলের নাম?
-মায়া বাড়াবো না বলে দেওয়া হয়নি, বেবি অফ বিদিশা সরকারই আছে।
-বলো, আবার কি বলবে?
-অনীত চ্যাটার্জি আমার হাজব্যান্ডের অফিস কলিগ। নিজের দাদার থেকেও বেশি।
ঋষভ চমকে তাকালো।
-অনীত? অফিসে কাজ করে? কোন অফিসে?
-হ্যাঁ বড় পত্রিকায়। সৌমিক ওখানে ক্যামেরা পার্সেন। দাদাভাই কার্টুনিস্ট।
-বাব্বা। উদীয়মান প্রতিভাবান শিল্পী এখন কাগজে কার্টুন আঁকেন? বাহ।
-তোমার বেস্টফ্রেন্ড ছিলো তো দাদাভাই, কলেজে...
-বুলশিট। আনিশার বয়ফ্রেন্ড ছিলো। তারপর বিয়ে করলো ওকে। তারপর কটা বছর কী অত্যাচারই না করলো মেয়েটাকে। নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলো আনিশা কতবার। লাস্টবছর খানেক তো ডিপ্রেশানেই ছিলো। আমি না থাকলে, না বোঝালে হয়তো মরেই যেত।
-দাদাভাই বদলে গেছে ঋষভ, এখন ফ্যামিলি ম্যান একদম।
-বাহ ভালো তো। বাড়ি চেন ওর?
-হ্যাঁ, যাই তো আমি। ওর ছেলেকে পড়াই। ওদের স্কুলের ম্যাম আমি।
-বাহ। সংসারী হয়েছে, বিয়ে করেছে তবে। বউ কেমন? ঘরোয়া? কাজ করা মেয়ে তো পোষায় না ওর।
বিদিশা কিছু বলতে যাচ্ছিলো, ভিতর থেকে বেয়ারা এলো।
-আপনাদের ডাকছেন, মাদার।
ঋষভ বললো –চলো। আগে নিজেদের কাজটা ঠিক ভাবে সমাধান করে আসি।
মাদারের সামনের চেয়ারে বসলো দুজনে। মাদার দৃশ্যত বিরক্তই বুঝলো বিদিশা।
-মাদার... ওই বাচ্চাটার কোন খোঁজ পাওয়া গেল?
-ম্যাম, আমি আপনাকে বলেই ছিলাম – অ্যাডপ্টেড আউট বাচ্চা সম্পর্কে কোন তথ্য আমরা দিই না।
-প্লিজ মাদার, একটা একসেপশন করুন না।
-কেন? আপনি কে হন বাচ্চাটার?
বিদিশা ঋষভের দিকে তাকালো। ঋষভ বিদিশাকে চোখের ইশারায় আশ্বাস দিলো
-আমি ওর জন্মদাত্রী।
-আর ইনি?
-উনি বাচ্চাটার জনক...
-বাহ, সাতবছর আগে একটা বাচ্চা ফেলে গিয়ে সাতবছর পর হঠাৎ খোঁজ নেবার ইচ্ছা হলো কেন আপনাদের? ফেলে দেওয়ার সময় বিবেকে বাঁধেনি?
ঋষভ কথা বললো
-মাদার তখন পরিস্থিতি ছিলো না ওকে আপন করার, এখন হয়েছে।
-এখনো পরিস্থিতি নেই। সেই বাড়িতে তার মা-বাবার কাছে বাচ্চাটি ভালো আছে, এটুকু জেনে রাখুন।
-মাদার, আমরা কি একবার ওকে চোখের দেখা দেখতে পারি? একটি বার?
বিদিশার চোখ দিয়ে জল পড়ছিলো, ঋষভ ওর কাঁধে আলতো চাপ দিলো।
-সম্ভব না। নিয়মের বাইরে।
-মাদার, আমি ঋষভ রায়। রায় পরিবারের বিজনেস এমপ্লয়ারের নাম তো শুনেছেন নিশ্চয়, আমার সন্তানের জন্য আমি ব্ল্যাঙ্ক চেক দিচ্ছি আপনাত প্রতিষ্ঠানকে। প্লিজ মাদার, ডোনেশনটা গ্রহণ করুণ।
-কিনতে চাইছেন?
মাদার যোহানা স্থির চোখে তাকালেন।
-সে ধৃষ্টতা আমার নেই। শুধু এই ইনস্টিটিউটটাকে বেটার করতে চাইছি।
ঋষভ বললো।
-তাছাড়া বেশ কিছু মিনিস্টার আমার পরিচিত মাদার। লোকাল এম এল এ আমার বাল্যবন্ধুর বাবা।
মাদার হাসলেন।
-চাপ দেওয়াবেন? ডাল গলবে না যে, মিস্টার রায়। আপনি আসুন তবে। আজ, সন্ধ্যা হতে গেল, বৃষ্টিও পড়ছে। আমার প্রার্থনার সময় হয়েছে।
বিদিশা হাত জোড় করলো।
-মাদার – একটাবার চোখের দেখা না দেখলে বাঁচবো না আমি, ওর বাবাও ঠিক তাই...
-দেখে কী করবেন মায়া বাড়িয়ে? ফিরে তো আর পাবেন না, আপনারা দুজনেই এখনো অল্প বয়সী, পরিস্থিতি অনুকূল বললেন, নিজেদের সন্তান নেওয়ার মনস্থ করুণ। ওকে ভুল যান।
ঋষভ উঠে দাঁড়ালো। আর তর্কের কোন মানে হয় না। বিদিশা ভেঙে পড়েছিলো, ওর হাত ধরলো ঋষভ।
-চলো। আমি ঠিক খুঁজে এনে দেবো তোমায়। কথা দিচ্ছি।
বিদিশা ঋষভের হাত ধরে উঠলো। বৃষ্টি পড়ছে বাইরে, অঝোরে।
-বাড়ি যাবে?
-তোমাদের বাড়ি আর যাবো না।
-তবে?
-ভাবছিলাম অনীত দাদাভাই-এর বাড়ি যাব, ওখানে থাকবো আজ।
-তোমার হাবি জানে?
-সৌমিককে বলেছি।
-সমস্যাটা কার সাথে? শাশুড়ি?
-শর্ট অফ। বারবার অ্যাবরশনের জন্য অখুশি ওনারা।
ঋষভ বিদিশার কাঁধে হাত রাখলো।
-সরি, আমার ইমম্যাচিওর ডিসিশনের জন্য এমনটা হলো।
-নাহ, আমার জেদটাও তো ছিলো, দোষ আমারও।
-হাল ছাড়বো না দিশা, খুঁজবো, দুজনেই। তোমার কাছে তোমার ছেলেকে এনে দেবো।
ঋষভ ভরসা জোগালো।
-বৃষ্টি ধরলো। চলো তোমাকে ড্রপ করে দিই তোমার দাদাভাই-এর বাড়ি।
-বেশ।
-আমি যাবো? অনীত বেশ অবাক হবে কিন্তু। ওর হেরে যাওয়াটা, মধ্যবিত্ততা দেখতে আমারও ভালো লাগবে।
-তোমার ইচ্ছা।
ঋষভ পকেট থেকে ফোনটা বার করলো। সাইলেন্ট মোডে ছিলো এতক্ষণ। মিসড কল? মায়ের এতগুলো? বাপিরও? বাপিকেই ফোন করলো ঋষভ।
-বাপি – এতোবার ফোন...
-বাড়ি আয়।
-কেন, কী হলো?
-এমার্জেন্সি। বাড়ি আয়। বিদিশাকে নিয়ে।
ফোন রেখে যারপরনাই অবাক হলো ঋষভ। বাপির মতো মানুষকেও বেশ চিন্তিত মনে হল, কী এমন হয়েছে?
-দিশা, আমাদের বাড়িতে চলো।
-কেন?
-কিছু একটা হয়েছে। মা আর বাপি ডাকছে, এমার্জেন্সি বললো।
-সেকি! চলো।
ঋষভ গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট করলো।
৩৭
মাম্মা তখন থেকে ফোনে কথা বলেই যাচ্ছে, একের পর এক। বাপিও চুপচাপ। অনীত বাপিকে অনেক সাহস করে প্রশ্ন করলো।
-মাম্মা কী করছে?
-মাম্মা? ইন্টারভিউ দিচ্ছে?
-প্রেস?
-হ্যাঁ।
-কটা প্রেস? তখন থেকে দিয়েই যাচ্ছে?
আনিশা ফোন রেখে এঘরে এসেছিলো ততক্ষণে।
-কী বলছে আমার ছেলে?
অনীত হাসলো –বলছে, কটা প্রেসকে ইন্টারভিউ দিচ্ছে মাম্মা? এতক্ষণ লাগছে।
-সত্যিই তো। বাড়ি এসে খালি ফোন, খুব আছে মাম্মা। সব কাজ শেষ এবার ফোনটা সাইলেন্সে দিয়ে দিলাম।
-আঁকাআঁকি হবে এখন, বাপি?
অনীত আনিশার দিকে তাকালো।
-তোর মাম্মা ক্লান্ত, খেলবে কি?
-কেন খেলবো না, আলবাৎ খেলবো। আজ বাবাই আমার দলে, তুমি হেরো আজ।
অনীত হেসে ফেললো।
-তোমাদের কাছে রোজ হারতেও বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই আমার।
ছেলেকে কোলে বসিয়ে ওর মন রাখতে রং তুলিতে মেতেছিলো দুজনে।
প্রথম প্রথম ছেলে ভোলানো খেলায় খেলছিলো, পরে মন দিয়ে আঁকতে থাকে দুজনেই। তুলির জাদুতে একের পর এক ফিগার তৈরি হতে থাকে। ভাঙতে থাকে গড়তে থাকে।
আনিশা খেয়াল করে অনীশ চুপ করে একমনে দেখছে, মাম্মা-বাপির এই খেলা, নাকি খেলার ছলে সৃষ্টি।
-বাবাই – চুপ যে একদম?
-তোমরা কত্ত ভালো আঁকো, মাম্মা – বাপি –
অনীত ছেলের দিকে তাকালো।
-প্র্যাকটিস করলে তুই-ও পারবি।
-তোমাদের মতো?
-একদম আমাদের মতো। এবার তো পড়তে বসতে হয়, বাবাই?
অনীত ইচ্ছা করেই বললো।
-হ্যাঁ, বাপি। কাল স্কুলে যাবো, টেস্ট আছে।
-তাই? বলিসনি তো?
-ম্যামকে বলেছি তো মাম্মা। ম্যাম সব পড়িয়ে দিয়েছে, একবার দেখলেই হবে।
আনিশার মুখটা বিস্বাদ হয়ে গেলো। অনীত সেটা বুঝেই বললো
-বেশ – তুই বই খুলে পড়তে থাক, আমি এসে দেখে নিচ্ছি।
বাবাই চলে গেলে অনীত বললো
-নিশা, মনখারাপ করে না, আর তো ক’দিন, তারপর তোমার ছেলেকে নিয়ে মুম্বাই চলে যাবে তুমি। নতুন স্কুল, নতুন ক্লাস, সব ভুলে যাবে ও আস্তে আস্তে।
-বিদিশার নামটা শুনলেই একটা খারাপ লাগা ঘিরে ধরে।
-জানি। খবরটা এখন দাবানলের মতো ছড়িয়েছে, নিশা।
আনিশা মুচকি হাসলো।
-হ্যাঁ, সব নিউজ মিডিয়াতেই ওটাই দেখাচ্ছে। শহরে ফিরে আবার প্রক্তন স্বামীকেই বিয়ে আনিশা গুপ্তার।
-বাবাইকে নিয়ে কিছু বলছে?
-হুম। আনিশার সন্তান এতোদিন শিল্পী অনীত চ্যাটার্জির কাছে থাকতো। তাকেও প্রকাশ্যে আনলেন আজ দম্পতি।
-বাহ। তোমার স্যোশাল মিডিয়াতে কেমন রেসপন্স?
-দারুণ। এতোটা পজেটিভ হবে ভাবিনি। আমার পি আর গ্রুপ ইনস্টাতে অনেক কটা ছবি ছেড়েছে। তাতে ট্রু লাভ, ভালোবাসার জয় – এসব লিখছে প্রচুর লোক।
-বাহ, আমি তো ভয়ে ছিলাম, ভাবছিলাম ঋষভ-কে ছাড়ার জন্য কিছু না ব্লেম করে বসে।
-করেনি, সবাই লিখছে গালা ওয়েডিং ছেড়ে ছোট্ট বাসাতে সন্তুষ্ট আনিশা গুপ্তা। বাবাইকে নিয়েও দারুণ ক্রেজ সবার মধ্যে।
-টেনশনে ছিলাম খুব, জানো?
-আমিও। হঠাৎ করে মতের এই পরিবর্তন লোকে কী ভাবে নেবে ভেবে ভয় পাচ্ছিলাম। তবে আমাদের অতীতের বৈবাহিক জীবন নিয়ে মিডিয়ায় কখনো সেভাবে মুখ না খোলাটা আমায় খুব কাজে দিয়েছে।
-থ্যাংক ইউ। নাহলে তো আমার অতীতের খারাপ সময়টা নিয়ে টানাটানি চলতো।
-মুম্বাই থেকেও প্রচুর ফোন এসেছে জানো, ইন্ডাস্ট্রির চেনা শোনা অনেকেই। আশা করি ব্যবসাটাও সামলে নিতে পারবো।
-তোমার মা-বাবা? কিছু বললেন?
-ফোন করেছিলো। বুঝিয়ে বলেছি।
-বুঝেছেন?
-হোপ সো। হয়তো বোঝেনওনি অনেকটাই। তবে বাইরে কিছু বলবেন না, এটুকু কথা দিয়েছেন।
-ঋষভ আজ কলকাতায়, জানো তো?
আনিশা চমকে তাকালো
-কে বললো?
-মাদার। আজ বিদিশাকে নিয়ে মাদারের কাছে গিয়েছিলো ঋষভ। জন্মদাতা-দাত্রীর পরিচয়ে। টাকা অফার করেছে। ভয়ও দেখিয়েছে। কাজ হয়নি।
-পরিচয় দিয়েছে? আশ্চর্য!
-আমিও অবাক তাই। তোমাকে বিয়ে করার প্ল্যানের সাথে এটা যাচ্ছে না ঠিক।
-হয়তো ভেবেছিলো আমাকে বুঝিয়ে নিতে পারবে। সন্তান বড় আবেগের জায়গা হয় নীত। সব্বাই দুর্বল সেখানে।
-কন্ট্যাক্ট করেছে – খবরটা ব্রেক হওয়ার পর?
আনিশা মাথা নাড়লো।
-নাহ, আজ কিছু করবে না। কাল মাথা ঠান্ডা করে ফোন করবে।
-ঋষভ কষ্ট পাবে খুব। তোমাকে ভালোবাসে ও।
আনিশা অনীতের হাত ধরলো। সত্যিটা বলতে হবে।
-আর আমি তোমাকে।
- একবার মুখোমুখি হতে পারলে বুঝিয়ে বলতাম ওকে নিশা। হাজার হোক বন্ধু ছিলো আমার। বেস্ট ফ্রেন্ড। পাঁচ বছরের অনেক স্মৃতি আছে কলেজের ভালো সময়গুলোর।
-প্রয়োজন নেই। আমি কমফোর্টেবেল হবো না। মনে পড়ে যাবে সত্যিটা।
অনীত আনিশাকে বুকের মাঝে টেনে নিলো।
-ঠিক আছে। তুমি যা চাও তা-ই হবে।
আনিশা অনীতের বুকে মাথা রাখলো।
-মুম্বাই চলে আসবে তো, তাড়াতাড়ি?
-আসবো। একমাসের নোটিশটা মেল করেছি আজ, অফিসে।
আনিশা চুমু খেলো অনীতকে।
-একমাস তো, আর?
-একদিনও বেশি না। তুমি ছেলেকে নিয়ে চলে যেও তার আগেই।
-ইচ্ছা করছে না। এই একমাস থেকে যাই?
অনীত আনিশাকে আদর করলো।
-তোমার কাজের ক্ষতি হবে নিশা। এখন তুমি মুম্বাই-এ না থাকলে অনেক দাবার চাল প্রতিপক্ষ অত্যন্ত সহজে চেলে ফেলবে।
-সেইজন্যই তো যেতে হবে, ভাবছি বাবাই-এর টার্মটা শেষ হতে আর চারদিন, পরের দিনই যাই?
-তাই ভালো, ওকে নিয়ে যাবে তো?
-একদিনও ছেড়ে থাকতে পারবো না, জানোই তো।
অনীত মুচকি হাসলো
-বেশ, তোমার ছেলে তুমি নিয়ে যাবে।
-কষ্ট হবে ছেলের বাপির?
-খু-ব। কিন্তু তোমাদের দুজনের কষ্টটা একত্রে দাঁড়িপাল্লায় ভারি হবে।
আনিশা অনীতের গালে আদর করলো।
-একমাস পরে মুম্বাই এসে আমার সাথে কাজ করবে তো?
-করবো। পাশাপাশি ক্যানভাসও ধরবো। তুমি চাইলে।
-ওটা তো আমার স্বপ্ন, নীত। তোমার আবার শো হবে, আর্ট গ্যালারিতে। লোক আসবে, ভিড় হবে, ঠিক সেই কলেজের দিনগুলোর মতো। কি বিয়ের পর পরের মতো।
-এত্তো ভালবাসো?
আনিশার ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো অনীত।
-মুখে বলতে হবে? ন-দশ বছর আগে যখন তোমার কেরিয়ারের ডেকলাইন এসেছিলো, তকনও আমি চাইতাম তোমারই স্বপ্নপূরণ হোক, আমারটা না হলেও।
-আমি বোকাটা ভুল বুঝে আটকাতাম তোমায়, হিংসা করতাম। কী বাজে না আমি?
আনিশা মাথা নাড়লো।
-নাহ, তুমি ভালো, সবচেয়ে ভালো। ভাগ্যিস আমি সেদিন বাবাই-এর স্কুলের সামনে গাড়ি নিয়ে এসে পড়েছিলাম – নাহলে এই আসল তোমায় ফিরে পেতাম না।
-আসল?
-হ্যাঁ, এটাই তো আসল। আমার অনীত বদলে গিয়েছিলো মাঝেই দেড়-দুই বছর, আবার আমার হয়ে উঠেছে।
-তোমার মনের মতো হতে পেরেছি তো?
-নাহলে বিয়ে করি? আর-
-আর?
আনিশা অনীতের দিকে দু’চোখ ভরে তাকালো। ওর চুলগুলোকে সরিয়ে দিলো।
-আর আমার হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে ফিরিয়ে দিলে যে। তুমিই পারতে এটা, কারণ তুমিই ওর পিতা। কীভাবে ঠিক বুঝে নিয়েছিলে এইটাই আমার একান্ত চাওয়া।
অনীত আনিশাকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরলো।
-হারায়নি তো। ঠিক চলে এসেছিলো আমার কোলে।
-একটা কথা বলি?
-বলো?
-বাথরুমের সেই ফ্ল্যাশের আওয়াজের দুঃস্বপ্নটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন ছিলো। আর বাবাই-এর বার্থ সার্টিফিকেটে মাদারর্স নেম আনিশা গুপ্তা হওয়াটা আমার জীবনের সর্বোত্তম প্রাপ্তি।
-তোমার নামের পাশে আমার নামটাও থাকবে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। আনিশা বললো তারপর
-তোমার বাঁদর একা একা পড়ছে অনেকক্ষণ।
-মন এঘরে পড়ে থাকবে, মাম্মা বাপি কী না কি সিক্রেট গল্প করে নিলো। যাচ্ছি আমি।
-না, আমিই যাই। গল্প করে পড়াই ওকে।
-বেশ, আমাকেও কি নেওয়া যাবে না? গল্প করে পড়ানোটা শেখার জন্য?
অনীতের উজ্জ্বল হাসিতে নিজের সব চাওয়াটুকু পাওয়া হয়ে যেতে দেখলো আনিশা। এই সাতদিনে যা করেছে যতটা করেছে মনের কথা শুনে করেছে, একটুও ভুল করেনি সেখানে। সব রঙ সুন্দরভাবে মিশে গেছে তাই। অনীতের প্রতি আর একফোঁটাও রাগ, অভিমান নেই ওর। ঘেন্নাটা অতীতবাচক শব্দ হয়ে গেছে।
৩৮
বাড়ির অবহাওয়া ভীষণই থমথমে ছিলো। নিউজটা ব্রেক করার সময় রঞ্জিত আর চিত্রাঙ্গদা ডাক্তার দেখিয়ে বেরোচ্ছিলেন। রঞ্জিতের ইসিজিতে সমস্যা আছে। কাল সমস্ত টেস্ট করাতে হবে ডাক্তার বলে দিয়েছে। অ্যাপোলোতে এপয়েন্টমেন্টও নিয়ে ফেলেছিলেন চিত্রাঙ্গদা। নিজে গাড়ি চালাচ্ছিলেন, রঞ্জিত পাশে বসে ছিলেন। হঠাৎ অর্ধেন্দুর ফোন, “বাড়ি এসো, তাড়াতাড়ি” এই তিনটে শব্দের বাইরে কিছুই বলেননি অর্ধেন্দু। কিন্তু চিত্রাঙ্গদা বুঝেছিলেন কিছু একটা সিরিয়াস হয়েছে, নাহলে এভাবে কথা বলেন না অর্ধেন্দু। বাড়ি ফিরেই টিভিতে এই খবর। অর্ধেন্দু, মামের মুখ থমথমে। রঞ্জিত শুধু একবার বললেন, “বাবুসোনা-কে ডেকে পাঠাও”, “এখনি?”, “হ্যাঁ, সাথে বিদিশাকেও ডাকবে”, ওনার কথা শুনেই ঋষভকে বারবার ফোন করে বাড়ি ডেকে আনা হয়। বাড়িতে এসে খবরটা পাওয়ার পর থেকেই ঋষভ চুপ হয়ে গেছে। এটা ওর ছোট থেকেই স্বভাব। চিৎকার করা, রাগ দেখানো, চেঁচিয়ে কান্না বা সবার সামনে কান্না ওর ধাতে নেই। গুম হয়ে যায় নিজের মধ্যে। এবারও নিজেকে ঘর বন্দী করে নিয়েছে। বিদিশাও চুপচাপ হয়ে গেছে। ও যে ঘরে থাকতো সেখানেই বসে আছে। রঞ্জিত নিজের ঘরে শুয়ে আছেন, শরীরটা ভালো নেই। চিত্রাঙ্গদা অনেকক্ষণ ওখানে ছিলেন – ঘুরে ফিরে সেই একই কথা উঠছে দেখে নিজেই উঠে এসেছেন। মানুষটা এই পরাজয় মেনে নিতে পারছেন না। লজ্জার সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছেন যেন। ফোন সুইচড অফ করে দিয়েছেন, প্রেস, মিডিয়াকে এড়াতে। এত বড় ষড়যন্ত্র, আনিশার এত বড় পরিকল্পিত ব্লাফ না ধরতে পারায় নিজের বুদ্ধিমাত্তাকেই দুষছেন সারাক্ষণ। চিত্রাঙ্গদাকে বারংবার সেইসব কথাই শোনাচ্ছেন – কত কী করেছেন আনিশার জন্য, আনিশার পরিবারের জন্য, অথচ কেউ কিচ্ছুটি জানায়নি, জানতে দেয়নি। আনিশার সন্তানের কথাও এতোগুলো বছর সুচারু ভাবে লুকিয়ে গিয়েছিলেন ওনারা। চিত্রাঙ্গদা রঞ্জিতকে বলেছিলেন, একবার আনিশার মা-বাবাকে কল করে নিতে – কিন্তু রঞ্জিত রাজি হননি। এখন এই সমস্ত কিছু অবান্তর, নিষ্প্রয়োজন। কেবল বলে চলেছে, “বাবুসোনা মেয়েটাকে বড্ড ভালোবাসতো চিত্রা, আমাদের ছেলেটার কী হবে বলো তো?” কতজনের, কতগুলো প্রশ্নের জবাব দেবে ও সারাজীবন? এভাবে কীভাবে বাঁচবে? এই লজ্জার পাহাড় বয়ে? রঞ্জিতকে কখনো এতটা ভাঙতে দেখেননি চিত্রাঙ্গদা। থামাবার সব চেষ্টা করলেও চোখ থেকে জল পড়ছিলো অঝোরে। মৃত্তিকা এসে চিত্রাঙ্গদাকে বলে, “মা তুমি যাও, আমি বাপির পাশে বসছি।”
-তোর বাপি যে অসুস্থ মাম। কষ্ট পাচ্ছে।
-তুমিও পাচ্ছো। তুমিও বিশ্রাম করো। কাল দুজনকেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।
রঞ্জিত হেসেছিলেন, কষ্টের মধ্যেও।
-ঠিক বলেছে, মেয়ে। চিত্রা, তুমি বিশ্রাম করো, মাম আছে তো আমার পাশে।
-তোমার ওষুধ গুলো?
-ওষুধ, বাপি?
চিত্রাঙ্গদা আস্তে করে বললেন
-তোর বাপির বুকে ব্যথা হয়েছিলো বিকালে, ডাক্তার দেখিয়েই নিয়ে এসেছি। ওষুধ দিয়েছে, অনেক টেস্টও দিয়েছে...
-দেখেছো! আগে বলবে তো। বাপি, কিছু খেয়ে নাও দেখি, তারপর ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে, আর একদম জাগা না।
রঞ্জিত মৃত্তিকার হাত ধরলেন।
-একদম আমার মায়ের মতো করে বললি যে, মা।
মৃত্তিকা হাসলো।
-মা-ও তাই বলে আমায়। মা-কে কোনকিছুতে মানা করলে।
মৃত্তিকার কাছে রঞ্জিতকে রেখে চিত্রাঙ্গদা বিশ্রাম আর নিতে পারেননি। ঋষভের কাছে যেতে হবে বলে মনে হয়েছিলো। ছেলেটা বড্ড একলা এইমুহুর্তে, ওর কাছে যাওয়া উচিৎ। ঋষভের ঘরে নক করে ঢুকে দেখলেন ঋষভ একা নেই, অর্ধেন্দুও আছেন ওর পাশে বসে। চিত্রাঙ্গদাকে দেখে বললেন
-ডিনারের ব্যবস্থা কিছু হয়েছে? ছেলেটা দুপুর থেকে কিছু খায়নি।
-থাক্ বাপি, খিদে নেই।
ঋষভ চোখ মুছলো।
-তা বললে তো হবে না বাপি। তুই না খেলে তোর মা খাবে না। আর তোর মা না খেলে আমিও খাব না। রঞ্জিতবাবুও খাবেন না। ভারী সমস্যা হবে সেটা, তাই না।
ঋষভ অর্ধেন্দুর দিকে তাকালো।
-আমিই তো তোমাদের সবার জীবনের সমস্যা। আমার ভুল, আমার লোভ, আমার পাপের জন্যই... আজ তুমি কাঁদছ, মা কাঁদছে, বাবা গুমরাচ্ছে। যা আমার কোনদিন ছিলোই না সেই মরীলকার দিকে আজীবন ছুটে গিয়ে আজ নিঃস্ব হয়ে গেলাম। প্রেস, মিডিয়া – সবাই ফোন করছে, টেক্সট করছে, হাসছে আমার ব্যর্থতায়। কী জবাব দেবো বলো তো?
অর্ধেন্দু ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন।
-আমি একটা আইডিয়া দেবো?
-বলো?
-ট্যুইট করিস তো তুই!
-হুম, ট্যুইটার। তোমারও তো আছে দেখেছি।
-হ্যাঁ, এক কাজ কর। ভালো করে একটা শুভেচ্ছা বার্তা লিখে আনিশাকে ট্যাগ করে পোস্ট করে দে।
চিত্রাঙ্গদা অবাক হলেন –কী সব বলছো! এর মধ্যে এসব-
ঋষভ মা’কে থামালো –বাপি ঠিকই বলছে মা। বাপি অনেক বিচক্ষণ, এই কথাটা আমার মাথাতেই আসা উচিৎ ছিলো। এই এক ট্যুইটেই সব বিবাদ থেমে যাবে। বাপি, তুমি একটু ড্রাফট করে দেবে?
-আমার সেকেলে ইংরেজি, বাপি... তোদের এই আধুনিক জগতে মানায় কি?
-খুব মানায়। ঐ আধুনিক জগতে কেউ সাহিত্য একাদেমি পায়নি তোমার মতো।
চিত্রাঙ্গদা ছেলের পাশে বসলেন। অর্ধেন্দু টাইপ করছিলেন
-মনখারাপ করিস না...
-সান্ত্বনা দিও না, মা।
-দিচ্ছি না। শান্ত হতে বলছি। তোর সামনে জীবন পড়ে আছে।
ঋষভ চোখ মুছলো। সবকিছু স্পষ্ট করে নিতে হবে, এখনি। পাষাণভার বইবে না ও আর।
-আজ বিদিশার সাথে একটা অরফ্যানেজে গিয়েছিলাম, যেখানে তুমি আর বাবাও আগে গিয়েছিলে, আমার আর বিদিশার সন্তানকে খুঁজতে।
অর্ধেন্দু চিত্রাঙ্গদার দিকে তাকালনে। চিত্রাঙ্গদা বললেন
-তুই অ্যাবর্ট করতে বলেছিলি ওকে? কেন?
ঋষভ মায়ের দিকে তাকালো
-কারণ আমার বিশ্বাস হয়নি ও প্রেগন্যান্ট। ও কোন রিপোর্ট দেখায়নি, আমি রিপোর্ট দেখতে চেয়েছিলাম তাও... ওর মুখের কথায় বিশ্বাস হয়নি আমার। ভেবেছিলাম আমার প্রত্যাখ্যানের জন্য এমন করছে। শর্ট অফ ট্রিক।
-এখন বিশ্বাস করছিস যে?
-এখন ওকে সামনাসামনি দেখছি। খারাপ লাগছে আমার। অসহায় লাগছে। আমার জন্য – ওর এই দুর্দশা। এদিকে আমার সন্তান থেকেও নাগালের বাইরে। তাই গিয়েছিলাম অরফ্যানেজে, যদি ওকে খুঁজে পেতে পারি – বিদিশা শান্তি পাবে। আমি আনিশাকেও কনভিন্স করে নেবো এই ব্যাপারে – এটাও ভেবেই রেখেছিলাম। সেই সুযোগই দিলো না।
-আনিশার ছেলে ছিলো, জানতিস্?
ঋষভ ঘাড় নাড়লো
-নাহ, ঘুণাক্ষরেও বলেনি। না আনিশা না কাকু কাকিমা, জাস্ট ইউজ করেছে আমাকে, সিঁড়ি হিসাবে। হয়তো অনীতের সাথে বরাবরই সম্পর্ক ছিলো তলায় তলায়। এখন তো সবই সম্ভব মনে হচ্ছে। এত বড় ধোঁকা দিলো – ভাবা যায় না। বাট শি উইল হ্যাভ টু পে ফর দিস। ওর ব্যবসা আমি তছনছ করে দেবো মা।
অর্ধেন্দু তাকালেন
-এটা করে কী পাবি?
-প্রতিশোধ। শান্তি। আর কী চাই!
-এই করতে গিয়ে নিজের জীবনের আনন্দটা হারিয়ে যাবে যে।
-তাহলে কি করতে বলছো! হেরে যেতে?
অর্ধেন্দু ঋষভের পিঠে হাত রাখলেন
-নাহ, উজ্জ্বল হতে। ফরগেট অ্যান্ড ফরগিভ।
-ওসব তোমার নভেলে মানায়, বাপি।
অর্ধেন্দু চিত্রাঙ্গদার দিকে তাকালেন।
-বাস্তবেও মানায়। উদাহরণ তো তোর চোখের সামনেই আছে। খুঁজে নে একবার। দেখ এবার – ঠিক আছে ট্যুইটটা?
ঋষভ মোবাইলে দেখলো। চিত্রাঙ্গদা অর্ধেন্দুর কথার ইঙ্গিত বুঝে মুখ নীচু করলেন।
-একদম। প্রো ট্যুইট বাপি। দারুণ লিখেছো। কোটটা অসাধারণ।
-হোপ দ্যাট উই শ্যাল রিমেইন ফ্রেন্ডস ফর এভার – এটা ঠিক আছে?
-একদম, ব্যবসায়িক ট্যুইট।
-আমি আর লাভ ক্ষতি শিখতে পারলাম কই? তোকে একটা সাজেশন দেবো জীবন নিয়ে!
-বলো। ইউ আর মাই বেস্ট ফ্রেন্ড বাপি। কলেজ লাইফে যতবার হড়কেছি, তুমিই সামলেছ। এবারটাও সামলাও।
-থিংক অফ বিদিশা, তোকে ভালোবাসা, তুই-ও কখনো পছন্দ করতিস। তোর মা-ও খুশি হবে এতে, আর যাকে খুঁজছিস তাকে খুঁজে পেতেও...
ঋষভ হেসে ফেললো
-কী যে বলো, দিশা বিবাহিত, সৌমিক নাকি কি যেন নাম ওর হাজব্যান্ডের, তাকে ভালোবাসে ও।
চিত্রাঙ্গদা কথা বললেন এবার।
-বিদিশা কিন্তু সৌমিকের সন্তানের মা হতে পারেনি, তোর সন্তানের হয়েছে।
অর্ধেন্দু ছেলের পিঠে হাত রাখলেন।
-আমরা কিচ্ছু চাপিয়ে দিচ্ছি না বাপি। তুই শুধু ভেবে দেখ। বিদিশা রাজি থাকলে আমরা সবাই মিলে না হয় - তোদের হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে খুঁজবো বা তার মতো আরো কয়েকজন যাতে আসে তার ব্যবস্থা করবো। জীবন তো এভাবেই এগোয়, না?
ঋষভ কিছু বললো না, সৌমিককে ঠকানো হবে এটা। অন্যায় হবে। অথচ অনীতও ঋষভের সাথে একই অন্যায় করেছে। ভালোবাসতে গেলে, ভালো থাকতে গেলে ন্যায় অন্যায় হয়তো ভাবলে চলে না। দিশা কি রাজি হবে? ওকে একবার বলে দেখবে ঋষভ। অবশ্যই বলবে।
তাছাড়া সৌমিক অনীতের খুব ক্লোজ। এতে অনীতও হার্ট হবে বেশ কিছুটাই। ভাববে এটা নিয়ে ঋষভ, অবশ্যই ভাববে। ভালোবাসার জন্য যত না, তার চেয়ে বেশি আঘাত করার জন্য। অনীতকে, আনিশাকেও।
৩৯
বাইরে বৃষ্টি পড়ছিলো। ছেলেকে স্কুলে ড্রপ করে ফিরছিলো অনীত। স্কুল গেটেও প্রেস মিডিয়ার ধাক্কা সইতে হয়েছে ওকে। সারা স্কুল রটে গেছে অনীশ আনিশা গুপ্তার ছেলে। অনীত আনিশা গুপ্তার হাজব্যান্ড। কখন স্কুলে আসবে অনীত ছেলে নিয়ে হাজার হাজার ক্যামেরা অপেক্ষা করছিলো। আনিশা আসবে ভেবেছিলো হয়তো। ছেলেকে কোনক্রমে এসব নাটকের থেকে বাঁচিয়ে স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছে অনীত। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম-কে বলেও এসেছে অনীশের সাথে কোন মিডিয়া যেন কথা না বলতে পারে। প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে সবার অলক্ষে মাদারের লিয়ার্জোতে অনীশের বার্থ সার্টিফিকেটের কপিও সংগোপনে দিয়ে এসেছে অনীত। ওর ফাইলে এবার থেকে এটাই থাকবে – কথা দিয়েছে ম্যাডাম। বাইরে বেরিয়ে এসে ঠান্ডা মাথায় অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে অনীতকে। তার মধ্যে বেশ কয়েকটাই বিলো দ্যা বেল্ট ছিলো। যেমন “আপনাদের সম্পর্কটা কি এই আটবছর তলায় তলায় ছিলোই?”, “ঋষভ রায় তো আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড, ওনাকে কিছু বলবেন?” “এরপর কি মুম্বাইয়ে গিয়ে আনিশাস-এ কাজ করবেন?”, এহেন প্রশ্ন শুনেও ঠান্ডামাথায় জবাব দিয়ে এসেছে, অনীত। দালাল মিডিয়ার সহ্য হচ্ছে না একটা গ্র্যান্ড ওয়েডিং কভারেজ মিস হয়ে যাওয়া। সাধে এদের দু’পয়সার বলে না লোকজন। ব্যক্তিগত জীবনেও কী ভয়ানক উৎসাহ, পারলে বেডরুমে ডুকে পড়ে, লুজার।
ফ্ল্যাটে ফিরে আনিশাকে এসব বলতে যাবে, আনিশা বললো
-ঋষভ ট্যুইট করেছে।
-তাই? ব্লেম করে?
-নাহ, উল্টোটা। শুভেচ্ছা জানিয়ে।
-বাহ, দারুণ খবর। কথা বলে নিও একবার, তাহলে।
-ক’দিন যাক। স্কুলের সামনে খুব বিরক্ত করলো না মিডিয়া?
-ভীষণ, খিস্তি মেরে দিইনি এই ভাগ্যভালো।
আনিশা হাসলো।
-বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এগুলো তো এখন অভ্যাস করতে হবে, মশাই।
-করছি তো। প্রথম প্রথম অস্বস্তি হবে, কিন্তু পারবো।
-জানি। তুমি সব পারো, আমার বরমশাই।
অনীত চোখ মারলো।
-সেটা আনিশা গুপ্তার থেকে বেশি ভালো কে আর জানবে?
-অসভ্য!
আনিশা অনীতের বুকে কিল মারলো একটা।
-কোন অসভ্যতামি করিনি তো। আস্ত বিয়ের রাত গেলো তাও করিনি।
-ভিজে গেছো তুমি। চেঞ্জ করে নাও।
-চেঞ্জ পরে করবো। আগে...
-আগে চা খেয়ে নাও, চা হয়ে গেছে।
আনিশা চোখ মেরে চলে গেলো কিচেনে। অনীতের মনে হল পুরনোদিনগুলো আবার ফিরে এসেছে। আটবছরে কিচ্ছু হারায়নি, সব রংগুলো দারুণভাবে মিলে রংমিলান্তি তৈরি করেছে।
৪০
টেস্টগুলো সবকটা করতে সারাদিন লেগে গেলো। রঞ্জিত বেশ ক্লান্ত ছিলেন। চিত্রাঙ্গদাও। মৃত্তিকা সাথে এসেছিলো, ও সামনের সিটে বসেছিলো। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছিলো। চিত্রাঙ্গদা বললেন
-রিপোর্ট কবে দেবে মাম?
-পরশু নেব, একবারে সব।
রঞ্জিত হাসলেন।
-মানে আরো দু’দিন ঘরবন্দী।
-এতো বেরোবার ছটফটানি কিসের তোমার শুনি?
চিত্রাঙ্গদা কথা বলতে বাধ্য হলনে
-বেরিয়ে আর যাব কোথায়, চিত্রা? যা স্ক্যান্ডেল চলছে চারিদিকে, আমার এত বছরের রেপুটেশন, মান-সম্মান সব...
-বাপি, ওসব থাক না, যা হবার হয়ে গেছে। কেউ না থাকলে তো তাকে জোর করে আটকে রাখা যায় না। দাদাভাই কী করে বুঝবে, যে তলায় তলায় এত-
-সেই, সে তো আমারই ছেলে, চলে যাওয়া আর আটকাবে কী করে?
চিত্রাঙ্গদা আহত হলেন। আহত চোখে রঞ্জিতের দিকে তাকালেন। রঞ্জিতের হাত ধরলেন
-তবে চলে যাওয়া মানুষকে ফিরিয়েও আনা যায় এটা বাবুসোনা শিখলে খুশিই হবো। আমার থেকে অন্তত এটুকু শিখুক।
মৃত্তিকা অবাক চোখে তাকালো
-কাকে ফেরাবে? আনিশা গুপ্তাকে? সে তো নিজেই ছেড়ে গেছে-
-নাহ, ওকে না। আরো একজন আছে।
-বিদিশার কথা বলছো?
চিত্রাঙ্গদা অবাক হলেন
-তুমিই না বলতে যে বিদিশার থেকে বাবুসোনার দূরে থাকায় ভালো।
-বলতাম, তখন পরিস্থিত অন্যছিলো। এখন অন্য – হাতের পাঁচ ফেলতে নেই।
-স্ট্রেঞ্জ।
-কেন?
-অর্ধেন্দুও কাল তাই বললো ঋষভকে।
-স্ট্রেঞ্জ কেন সেটা?
-তোমাদের দুজনের ফারাক এতোটাই যে একইরকম ভাবো ভাবতেই পারি না।
-একইরকমই তো ভাবি, একই মেয়েকে ভেবেছি – দেখছো না?
-তাও, দুজনের সিন্ধান্তও এক খাতে বইবে?
-চিত্রা – দুজনেই পুরুষ, আর দুজনেই পিতা, একরকম হওয়াটা খুব স্বাভাবিক।
-সেই। কিন্তু বিদিশা রাজি হবে কিনা সেটাও তো প্রশ্ন।
মৃত্তিকা বললো
-দিশাদিভাই-কে তুমি বললে রাজি হবে মা – বলো না।
-তোর দিশাদিভাইয়ের কাছে আমার যে অপরাধের শেষ নেই, মাম। তাছাড়া ও বিবাহিত। সংসারী। নিজের ছেলের সুখের জন্য কীভাবে ওকে বলি?
রঞ্জিত মোবাইলটা হাতে নিয়েছিলেন। এসব কথা ভালো লাগছিলো না আর। ফেসবুক করেন না। ইনস্টায় আছেন। কী মনে হল ইনস্টায় ঢুকে আনিশার প্রফাইলে গেলেন। অনীত আর আনিশার বিয়ের ছবিগুলোই দেখলেন খুঁটিয়ে। বাচ্চাটাকেও দেখলেন, প্রাণবন্ত। মা-বাবার কোলে দারুণ মায়াময় করে তুলেছে ছবিগুলোকে। রেজিস্ট্রির ছবিগুলো আর বাচ্চাটাকে নিয়ে ছবিগুলো সম্ভবত একদিনের নয়, ছবিগুলো তুলেছে আবার সৌমিক। মানে বিদিশার হাজব্যান্ড। ক্যাজুয়ালি সৌমিকের প্রফাইলে একবার গেলেন রঞ্জিত। ওর ডিপি বিদিশার সাথে। অনীতের ছেলেকে কোলে নিয়ে। সৌমিকও প্রচুর ছবি পোস্ট করেছে অনীত আর আনিশার বিয়ের। আর দেখবেন না ভেবে বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিলেন – হঠাৎই একটা ছবিতে চোখ আটকে গেলো। ইনি এখানে কি করছেন? মাদার যোহানা? অনীতের বিয়েতে উনি কেন? পরিচিত কি অনীতের? হঠাৎই দুইয়ে দুইয়ে চার করে ফেললেন রঞ্জিত। মানে রেজিস্টার খাতাটা উবে যায়নি, উধাও হয়নি, সযত্নে সরিয়েছেন মাদার, নিজের হাতে। খুব পরিচিত কারোর জন্য। পরিচিত কেউটা যে কে সেটা রঞ্জিতের বুঝতে বাকি নেই। আনিশার গর্ভধারণ ও সন্তানের জন্ম নিয়ে ওর মা-বাবাই সঠিক জানেন না। ভীষণ তোতলাচ্ছিলেন মিডিয়ায়, চিত্রাঙ্গদাই বলেছেন ওনাকে। সন্তানটি কোনমতেই আনিশার নয়, এটা রঞ্জিতের দৃঢ় বিশ্বাস। অবশ্য এটা নিয়ে খুঁচিয়ে লাভও হবে না। আনিশা রেজিস্ট্রি আর মিডিয়া কভারেজের দিনের মধ্যে গ্যাপ সাধে রাখেনি, প্রয়োজনীয় সব কাগজ করে ফেলেছে। বার্থ সার্টিফিকেট, নার্সিংহোমের ডিসচার্জ – সবই দেখিয়ে দেবে ওরা। শেষে জেনেটিক টেস্ট – কিন্তু সে খেলায় নামতে গেলে ঋষভকে এক্সপোজ করতে হবে, আরো বদনামের একশেষ হবে। এমনিতেই বেইজ্জত কম হননি। তার থেকে যা জানলেন নিজের মধ্যেই রাখবেন রঞ্জিত, আজীবন। বাচ্চাটা ভালো আছে। অনীত তার পিতা হয়েছে, প্রকৃত অর্থেই। আনিশা তার জন্য এতো সম্পদ এতো প্রাচুর্য ছেড়েছে, ঋষভ আর বিদিশার তুলনায় ওরা অনেক বেশি যোগ্য মা-বাবা হিসেবে। এখন কেবল ঋষভকে সামলাবেন রঞ্জিত, বিদিশাকে বোঝাবেন, চার হাত এক করবেন ওদের। এমন ফুটফুটে বাচ্চা তাদের রায় পরিবারেও আসবে, অচিরেই। বিদিশা ক্যারি করতে না পারলেও স্যারোগেসি আছে, সমস্যা নেই। বিদিশার প্রতি করা অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত হবে এতে। চিত্রাও দারুণ খুশি হবেন।
-এত কী ভাবছো?
চিত্রাঙ্গদা প্রশ্ন করলেন।
-ভাবছি অনীত আর আনিশার সাথে একবার দেখা করে আসবো, ক’দিন যাক।
-কী বলছো!
-ঠিকই বলছি। ব্যবসায়িক দিক থেকে বলছি। আনিশাস্কে হারাতে পারি না আমরা, আনিশা-কে হারালেও।
-বাবুসোনা-কে কী জবাব দেবে?
-ব্যবসায়ীরা যেমন দেয়, দিয়ে দেবো। তুমি বরং ভাবো কীভাবে বিদিশাকে রাজি করাবে।
-আমি বলবো ওকে। বাকিটা ওদের সিদ্ধান্ত।
-ওদের উপর আর কিছু ছাড়া যাবে না চিত্রা। দেখলে তো ছেড়ে কী ভুলটাই না হলো!
-শান্ত হও। ডাক্তারবাবু কী বললেন শোনোনি? স্ট্রেস ভালো না তোমার জন্য?
রঞ্জিত চুপ করে গেলেন। কিছুক্ষণ দুজনের মাঝে নীরবতার পাঁচিল থাকলো। রঞ্জিতই বললেন তারপর।
-আমাকে যে কথাটা দিয়েছিলে, রাখবে তো!
চিত্রাঙ্গদা রঞ্জিতের হাত ধরলেন।
-রাখবো। একটু থিতোতে দাও সব।
-বেশ, অপেক্ষা করবো, বেশি দেরি করিও না কিন্তু।
-করাবো না। বাবুসোনার ব্যাপারটা ঠিক করিয়ে নিই আগে...
-আজ থেকেই লেগে পড়ো। সময় নিও না, সময় বড্ড কম।
-আবার নেগেটিভ চিন্তা!
রঞ্জিত ম্লান হাসলেন। একটাবার আনিশার ওখানে যেতে হবে, শীঘ্রই। রায় পরিবারের বীজ আর চারাগাছ হয়েছে ওখানে। একবার তাকে ছুঁয়ে দেখতে চান রঞ্জিত। একটাবার, সবার অলক্ষে। ভারত সেরা বাঙালী ব্যবসায়ী একটু তো আবেগ রাখতেই পারেন, তাই না? নিজের চিন্তায় নিজেই অবাক হলেন রঞ্জিত। ভালোবাসার তালিকায় আর একটা নাম বাড়লো তবে। কিন্তু সংগোপনে থাকুক সে, রঞ্জিত আটকাবেন না। আরও বছর কুড়ি বাঁচতে চান রঞ্জিত, তার বেশি না। তার প্রতিষ্ঠিত হওয়াটাও দেখে যেতে পারবেন তবে। স্নেহ সত্যি অতি বিষম বস্তু। আগে প্রবাদে শুনেছেন, এখন বিশ্বাসও করেন রঞ্জিত রায়।
অনীত-আনিশা, ঋষভ-বিদিশা ক্যানভাসের উপর এলোমেলো রঙের মতো ছড়িয়ে ছিল যেন এতদিন। এইকদিনে হয়তো ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই রংগুলো ঠিক মিলে গেছে। একে অপরের সাথে, স্বস্থানে। নিদির্ষ্ট মাত্রায়, অন্যায় গুলো ন্যায় হয়েছে। জটগুলোও খুলে গেছে, প্রকৃত রংমিলান্তি একেই বলে হয়তো। রঞ্জিত ভাবলেন, রংমিলান্তির ফলটিকে একবার ছুঁয়ে দেখতে চান। জীবনের একটা খেদ কমবে তাহলে, চিত্রার কাঁধে হাত রাখলেন রঞ্জিত। বাঁচতে হবে, আরো কয়েকটা বছর, বাঁচতেই হবে।