বিজ্ঞান ও ঈশ্বরবাদ
শুভ্রা ভট্টাচার্য
আজকাল অনেককেই আক্ষেপের সহিত বলতে শুনি যে বর্তমান সময়ে বিজ্ঞানের প্রসার ঘটলেও মানুষের মনের ধর্মবিশ্বাস, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস এগুলো দূর হয় না কেন! এ ব্যাপারে আমি কিছু ব্যক্তিগত ভাবনা আছে। এটা ঠিক যে গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে এই শতাব্দী অবধি বিজ্ঞানের প্রসার ঘটেছে জেট গতিতে৷ তার সুফল কুফল দুই আমরা চারিদিকে দেখতেই পাই। কিন্তু এখানেও একটা কথা আছে, সেটা হল আদপে বিজ্ঞানের প্রসার ঘটেছে কি! আমরা সত্যি কি বিজ্ঞান মনস্ক হয়েছি! না,ঘটে নি, ঘটেছে টেকনোলজির অগ্রগতি। এবার আপনি বলবেন "দুটো তো একই ব্যাপার হল, পার্থক্য কি?" কিন্তু পার্থক্য আছে।
টেকনোলজির উন্নতি বলতে বিজ্ঞানের অ্যাপ্লিকেশনের উন্নতি বোঝায়। অর্থাৎ কারিগরি জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে যন্ত্রসভ্যতার উন্নতি ঘটানো। আরো গভীরে ভাবলে দেখবো আসলে কিন্তু সেটাই হয়েছে। আমরা যন্ত্রনির্ভর সভ্যতায় পরিণত হয়েছি। স্যুইচ, বোতাম, টাচ স্ক্রিনে আঙুল বুলিয়ে টেক স্যাভি হয়েছি এবং ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যার প্রয়োগ করে সফটওয়্যার বা হার্ডওয়্যার বানাতে শিখেছি। কিন্তু বিজ্ঞানচেতনা আসে নি মনে। প্রযুক্তিকে নিজের আপন জ্ঞান বানিয়ে নিয়েছি কিন্তু থিওরিটিক্যাল নলেজে যাইনি। আর এই প্রযুক্তির অত্যধিক বাড়বাড়নন্তর ফলে আমরা ভীষণ রকম প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছি আর আর আমাদের গভীর চিন্তার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে। টেকনোলজি আমাদের রোবট বানিয়েছে। আমরা জানি কোন কোডটার পরে কোন কোডটা এক্সিকিউট করতে হয়, কোন স্যুইচের সাথে কোন তার জুড়তে হয় এবং এ সবকিছুই মেকানিকালি করে যাই প্রসেস ফ্লো হিসেবে। আইআইটির প্রিপারেশন থেকে টেসলার নতুন মডেল লঞ্চ - পুরো ব্যাপারটাই কিন্তু একটা প্রসেস ফ্লো। এখানে যুক্তিবোধ, বিজ্ঞান চেতনার কোনো জায়গায়ই নেই। এমনকি পিএইচডি, পোস্ট ডকের রিসার্চ পর্যন্ত প্রায় অনেক ক্ষেত্রেই টেকনোলজি নির্ভর একটা প্রসেস ফ্লো। ফলে মননশীলতার যা ক্ষতি হওয়ার তাই হয়েছে। স্বাধীন চিন্তাভাবনার পরিধি কমেছে। মানবিক অনুভূতি স্বাধীন চিন্তার জায়গা না পেয়ে খুব সহজে ম্যানিপুলেটেড হচ্ছে।
ঈশ্বর হল এক ধরনের অদৃশ্য বিশ্বাস, সেই বিশ্বাস যে "so called god" হতে হবে তার কোনো মানে নেই। আপনি আপনার বিশ্বাসে অনেক কিছুই করে ফেলতে পারেন! সেই জন্য কেই নাস্তিক নয়। নাস্তিক বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই। আমরা যে পুজো অর্চনা করি, এসব হাওয়ায় ভাসমান এক ধরনের মানসিক শক্তি আমাদের, আর কিছুই নই। অযথা এটাকে নিয়ে এত কদর্য ব্যবসা, মানুষ মারামারি কাটাকাটি হয়। আমরা যা পারিনা তা ওই ঈশ্বর নামের একজনের ওপর দিয়ে চালিয়ে দিই।
এবার আপনি বলতে পারেন, "ঈশ্বর সাধনা করে তো আমরা একটা শক্তি পাই!" ঠিক কথা, আচার বিচার, বিধি মেনে মনকে সংযত ও শক্ত করা যায়। সেটা আপনি ঈশ্বর ছাড়া আত্মজাগরণনের মাধ্যমে নিজে থেকেও আনতে পারেন। কিন্তু এত সংযম খুব কম মানুষেরই আছে, বড়ো কঠিন এই সংযম। কিন্তু যারা পারেন তারাই মহান। তাই হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজা রামমোহন রায় মূর্তি পুজোয় বিশ্বাস করতেন না।
তবে এই ঈশ্বরকে নিয়ে যে সামাজিক পুজো পার্বণ অনুষ্ঠান করে মানুষ আনন্দ পায়, সেটা বাধা না দেওয়ায় ভালো, সুস্থ রুচিতে মানসিক আনন্দের জন্য এই ধরনের মিলন উৎসব খুব দরকার। এছাড়া সবাই অতটা মানসিক ভাবে শক্ত নয়, যদি এই সব করে মানসিক শক্তি পায় তো পাক না, ক্ষতি কি? তবে এটাকে কেন্দ্র করে মানুষ মারামারি, ভন্ডামি, কুসংস্কার, উপোস তাপস করে থাকেন, এগুলো কিন্তু জাস্ট এক প্রকার মানসিক রোগ!
অন্তত যে মানে না তারও ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়াটাও তো অবশ্যই মানসিক রোগ!
Science is god .. god is science.. ঈশ্বর একটা শক্তি কনসেপ্ট - That means nature... আসল বিষয় সত্য অনুসন্ধান। আর সেই সত্যকে জানার জন্য অর্থাৎ প্রকৃত ভগবানকে জানার জন্য ধর্মপুস্তক নয়,জানতে হবে প্রকৃতিকে, পড়তে হবে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিজ্ঞান,গনিত আর জীবন বিজ্ঞান। এই বৃহৎ জ্ঞানের কোন শেষ নেই। প্রকৃতি ও তৎ বিষয়ক পুস্তক আরাধনা করতে হবে। তবেই আসল জ্ঞান ও শক্তি প্রাপ্তি ঘটবে জীবনে।
একসময় সমাজের তথাকথিত উচ্চস্তরের চতুর মানুষ তারাও পুজো আচ্ছার আসল কারণ জানত না , কিন্তু তারা চালাক ও সমাজের চালক ছিল । কিভাবে অধিকাংশ অশিক্ষিত মূর্খ মানুষকে মাথায় টুপি পড়িয়ে অপ্রাকৃত ঘটনার সঙ্গে দেবদেবীর যোগ ঘটিয়েছে , সেই সবের কিছু মনগড়া ব্যাখ্যা করেছিল এবং সেটাই ছিল তখনকার দেবতার উৎপত্তির অবাস্তব ব্যাখ্যা।
কিন্তু প্রাণ প্রকৃতি সৃষ্টির আদি থেকে একটু গভীরে ভাবলে বা ইতিহাস পড়লে দেখা যাবে, দেবতা মানুষের সৃষ্টি করেনি, মানুষই দেবতার সৃষ্টি করেছে। মানুষের সৃষ্টি বিবর্তনবাদের ( evolution) ফসল।(M.Nesturkh এর Origin of Man বইটাতে যা বিস্তারিত বলা আছে।)। আর দেবতা মনুষ্যসৃষ্ট বলেই দেবতার কোনও বিবর্তন নেই।
নিঃশ্বাস ও প্রশ্বাসের এই বহির্মুখী গতিকে সুকৌশলযুক্ত যােগ কর্মের দ্বারা অন্তর্মুখী করে আমরা আবার আমাদের মুল সত্ত্বায় ফিরে যেতে পারি, স্থিরত্ব লাভ করতে পারি এবং অনাদি অনন্ত সৃষ্টির সাথে একত্রীভূত হয়ে যেতে পারি। প্রাণই সর্বশক্তি সমন্বিতা মহাশক্তি, প্রাণই লীলায়িত হয়ে সমস্ত পদার্থমাত্রকে বিকশিত করে তুলছে। এই প্রাণের উপাসনই প্রকৃতভাবে ঈশ্বরােপাসনা। এই প্রাণ ধর্মকে স্বীকার করে আত্মবিজ্ঞানের অনুশীলন যদি সমগ্র বিশ্বে সার্বিকভাবে গৃহীত হয় তাহলে ভিন্নভিন্ন ধর্মমত সমূহ থেকে উপজাত দীর্ঘস্থায়ী কুফলগুলি যথা ধর্মীয় উন্মত্তা, প্রলোভন বা বলপ্রয়ােগে ধর্মান্তরিতকরণ, রক্ষণশীল মনোবৃত্তি, সাম্প্রদায়িকতা, উপদলীয় সংঘাত প্রভৃতি যা কিছু বিশ্বব্যাপী আমাদের অশান্তি বা দুঃখের মূল কারণ সেগুলির অবলুপ্তি ঘটবে। তখন বিশ্বজনীন শান্তি, সম্প্রীতি ও আত্মিক প্রেম-সমন্বয় সহজ ও স্বাভাবিকভাবেই প্রতিষ্ঠিত হবে।।
- প্রাবন্ধিক বিশিষ্ট শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী