বি.এ বাংলা অনার্স
সম্ভাব্য প্রশ্নোত্তর
2nd Semester
Unit–3, WBSU
১। ভাষা ও উপভাষার সম্পর্ক সবিস্তারে আলোচনা করা হলো :
- আর্য ও উপভাষার সম্পর্ক:
উপভাষা মূলত কথ্য ভাষা রূপেই ব্যবহৃত হয়। বলাবাহুল্য ভাষা ও সম্পর্কটি আপেক্ষিক। একই ভাষাভাষী এলাকার অন্তর্গত একাধিক অঞ্চলের ভাষার আঞ্চলিক রূপের মধ্যে যতদিন পর্যন্ত পারস্পরিক বােধগম্যতা থাকে ততদিন পর্যন্ত তাকে উপভাষা হিসেবে। চিহ্নিত করা যায়। আর যখন এই আঞ্চলিক রূপগুলি ধ্বনিগত, শব্দগত ও বাগবিধির দিক থেকে পৃথক হতে হতে পারস্পরিক বােধগম্যতার সীমা চূড়ান্তভাবে ছাড়িয়ে যায় তখন সে হয়ে ওঠে স্বতন্ত্র একটি ভাষা।
যাইহােক, ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সব কটি উপভাষার দুটি সম্ভাব্য রূপকথ্য ও লেখ্য। সেদিক বিচার করে বলা যায় বাংলা কথ্য উপভাষা পাঁচটি এবং লেখ্য উপভাষা দুটি—পদ্য ও গদ্য। বাংলা লেখ্য গদ্যের আবার দুটি রূপ—সাধু ও চলিত। প্রসঙ্গত বলা যায়—যেহেতু লেখ্য উপভাষার রূপটি সমাজের সর্বস্তরে মান্যতা পায় তাই কোনাে ভাষার পরিচয় দিতে গেলে শুধু তার লেখ্য রূপটি উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু মনে রাখা দরকার লেখ্য ভাবও একটি উপভাষা। আসলে একটি ভাষা গড়ে ওঠে কথ্য ও লেখ্য উপভাষার উপর ।
ভাষা ও উপভাষার সম্পর্ক আলােচনা থেকে কয়েকটি প্রধান পার্থক্য উল্লেখ করা হলো —
(১) ভাষা একটি বৃহৎ অঞ্চলে প্রচলিত, উপভাষা অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র অঞ্চলে প্রচলিত।
(২) ভাষার একটি সার্বজনীন আদর্শ থাকে (standard). উপভাষা আঞ্চলিক কথ্যভাষা
(৩) সাহিত্যে, শিক্ষা, বেতার ও সংবাদপত্রে আদর্শ ভাষা ব্যবহার করা হয়। উপভাষা ব্যত লোকসাহিত্যে ব্যবহৃত হয় তাবলিক লােকজীবনকে জীবন্ত করে তােলার জন্য। একসময় ম্যাক্সমুলার বলেছিলেন -- "The real and natural life of language is its dialect বক্তব্যটির বাস্তব মূল্য অস্বীকার করা যায় না। বস্তুত আজকের গবেষকরা অনুভব করেছে উপভাষাগুলির মধ্যেই ভাষার স্বাভাবিক জীবন নিহিত। বাংলা ভাষাভাষী বৃহৎ অঞ্চলে যে আঞ্চলিক রূপভেদ থাকবে তা স্বাভাবিক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে সাম্প্রতিককালে আধুনিক কথা-সাহিত্যে উপভাষা ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যায়।
- (খ) উপভাষা ও তার শ্রেণিবিভাগ :
- নানা ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার সূত্রে আধুনিক বাংলাভাষায় প্রধানত পাঁচটি উপভাষা (dialect) লক্ষ করা যায়—(১) রাঢ়ী (২) বঙ্গলি (৩) বরেন্দ্রী (৪) ঝাড়খণ্ডী (৫) কামরূপী বা রাজবংশী।
১. রাঢ়ী উপভাষা :
প্রধানত মধ্য-পশ্চিমবঙ্গ অর্থাৎ বীরভূম, বর্ধমান, পূর্ব বাঁকুড়া, কলকতা, ২৪-পরগনা (উত্তর ও দক্ষিণ) নদিয়া, হাওড়া, হুগলি, উত্তর-পূর্ব মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ—এই ভৌগােলিক পরিবেশে বসবাসকারী জনসমষ্টি যে-উপভাষার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করে তাকে বলা হয় রাঢ়ী উপভাষা। এই রাঢ়ী উপভাষা হল উপভাষাগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান। ভাষাতাত্ত্বিকেরা সাধারণ বিচারে রাঢ়ী উপভাষাকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করেছেন— পূর্বরাঢ়ী ও পশ্চিম রাঢ়ী, পূর্বরাঢ়ী-উপভাষার ভৌগােলিক এলাকা বা অঞ্চল হল কলকাতা, ২৪-পরগনা (উত্তর ও দক্ষিণ), নদিয়া, হাওড়া, হুগলি উত্তর-পূর্ব মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ এবং পশ্চিমরাঢ়ী উপভার এলাকা বা অচল হল বীরভূম, বর্ধমান ও পূর্ব বাঁকুড়া। তবে ভাষাতাত্ত্বিক সূক্ষ্মবিচারে রাঢ়ী ভাষাকে চারভাগে ভাগ করা যায়— -পূর্ব-মধ্য (East central), পশ্চিমমধ্য (West-central), উত্তর-মধ্য (North-central) এবং দক্ষিণ-মধ্য (South-central)।
- রাঢ়ী উপভাষার নিদর্শন :
সাধুভাষা : “একজন ব্যক্তির দুইটি পুত্র ছিল। তন্মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্র পিতাকে বলিল / কহিল, ‘পিতঃ আপনার সম্পত্তির মধ্যে আমার প্রাপ্য অংশ আমাকে দিউন। তাহাতে তাহাদিগের / তাহাদের পিতা নিজ সম্পত্তি তাহাদিগের / তাহাদের মধ্যে বিভাগ করিয়া দিলেন।” [মূলত কোলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ভাষা]
• চলিত ভাষা : “একজন লােকের দুটি ছেলে ছিল। তাদের মধ্যে ছােটটি বাবাকে বললে, 'বাবা, আপনার বিষয়ের মধ্যে যে-অংশ আমি পাবাে, তা আমাকে দিন। তাতে তাদের বাবা নিজের বিষয়-আশয় তাদের মধ্য ভাগ করে / বেঁটে দিলেন।”
- রাঢ়ী-উপভাষার বৈশিষ্ট্য :
- ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্য :
এই ভাষার ধ্বনিগত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রধান কয়েকটি উল্লেখ করা হল।
(১) অভিশ্রুতি ও স্বরসঙ্গতিজনিত স্বরধ্বনির পরিবর্তন এই উপভাষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
অভিশ্রুতি : যেখানে পূর্ববাংলায় বাঙালি উপভাষার অপিনিহিতির প্রয়ােগ বেশি সেখানে এই ভাষায় অভিশ্রুরি ব্যবহার বেশি। অভিশ্রুতি হল অপিনিহিতির পরবর্তী স্তর।
যেমন : করিয়া > অপিনিহিতি—কইরা (কর্যা > করে) > অভিশ্রুতি করে। তেমনি–মেইরে > মেরে, ধইরে > ধরে, বইল্যা > বলে।
স্বরসঙ্গতি : আধুনিক বাংলা চলিত-ভাষা রাঢ়ী-উপভাযার কাছে অনেকাংশে ঋণী। বলাবাহুল্য স্বরসঙ্গতিজনিত স্বরধ্বনির পরিবর্তন আধুনিক বাংলার চলিত রীতিতে ব্যাপক ব্যবহৃত যা রাঢ়ীভাষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
যেমন—দেশি দিশি, বিলাতি > বিলিতি, মুলা > মুলাে, মিছা >
(২) এই উপভাষায় ‘অ’ কারের ‘ও 'কার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। যেমন—অতিশয় > ওতিশয়, মধু > মধু, গেল > গ্যালাে।
(৩) এই উপভাষায় শব্দমধ্যস্থিত নাসিক্যব্যঞ্জন লুপ্ত হয়ে পূর্ববর্তী স্বরে নাসিক্যভবন ঘটেছে অর্থাৎ অনুনাসিকতা সংরক্ষিত হয়েছে।
যেমন বধু > বঁধু, চন্দ্র > চাঁদ, তবে স্বতােনাসিক্যভবনের প্রবণতা অনেক বেশি। যথা—উট > উট, চা > চা, পুস্তক > পুথি > পুঁথি, হইছে > হইছে।
(৪) কোথাও কোথাও ন’ ও ‘ল’ ধ্বনির বিপর্যয় দেখা যায়। লাল > নাল, লুচি > নুচি, গুলাে > গুনাে, লয় > নয়।
যথা লেবু > নেবু,
• রূপগত বৈশিষ্ট্যও এই উপভাষার রূপগত নানা বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রধান কয়েকটি উল্লেখ করা হল।
(১) সাধারণত সকর্মক ক্রিয়ার দুটি কর্ম থাকে—মুখ্য কর্ম, গৌণ কর্ম। এই উপভাষায় গৌণ কর্মে ‘কে’ বিভক্তি এবং মুখ্য কর্মে শূন্য’ বিভক্তির প্রয়ােগ দেখা যায়। যথা : আমি রমেনকে (গৌণ) বই (মুখ্য) দিলাম। বর্তমানে সম্প্রদান কারক উঠে গেছে কিন্তু যখন প্রচলিত ছিল তখন ওই কারকেও ‘কে’-বিভক্তির প্রয়ােগ দেখা গেছে। যথা : দরিদ্রকে ভিক্ষা দাও।
(২) অধিকরণ কারকে ‘এ’ ও ‘তে’ বিভক্তির ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। যথাঃ সে ঘরে বসেছে। ঘরেতে মানুষ এল।
(৩) সামান্য অতীতে প্রথম পুরুষের অকর্মক ক্রিয়াপদে ‘ল’ এবং সকর্মক ক্রিয়াপদে ‘লে’ ব্যবহার লক্ষ করা যায়। যথা : সে মাঠে গেল। রবি আমাকে বই দিলে। তবে সম্প্রতি বাহালি উপভাষার প্রভাবে এ-পার্থক্য প্রায় ঘুচে গেছে। তাই বর্তমানে সে আমাকে বই দিল’ ব্যবহার করতে দেখা যায়। সামান্য অতীত কালের উত্তম পুরুষের ক্রিয়া-বিভক্তি প্রধানত লুন। তবে পশ্চিম রাঢ়ীতে—‘লুন’, ‘লাম’, ‘লু, নু’ ব্যবহার করতে দেখা যায়। বথা কাজটি করলুম / করলাম। মাঠে গেনু, গান করলু। সাধারণ বর্তমানের উত্তম পুরুষের ব্রিয়া-বিভক্তি 'ই' যথা—আমি কাজ করি (কর + ইতে প্রত্যয়যুক্ত অসমাপিকা ক্রিয়াপদের সঙ্গে আছ’ ধাতু যুক্ত করে তার সঙ্গে কাল ও পুরুসারে ক্রিয়া-বিভক্তি যুক্ত করে ঘটমান বর্তমান ও ঘটমান অতীতরূপ গঠন করা হয়।
যথাঃ করিতে + আ + ই > করিতেছি। (সাধু), করছি (চলিত)। করিতে + আছ + ইলাম > করিতেছিলাম (সাধু), করছিলাম (চলিত)। করিতে + আছ + ইলু (লেমু) > করিতে ছিলুম (সাধু), করছিলুম (চলিত)।
২. বঙ্গালি উপভাষা :
প্রধানত পূর্ববঙ্গ ও দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা, যশাের, নােয়াখালি, চট্টগ্রাম—এই ভৌগােলিক পরিবেশে বসবাসকারীদের জনসমষ্টি যে-উপভাষার মাধ্যমে নিজেদের ভাব বিনিময় করে তাকে বলা হয় বলি উপভাষা।
- বঙ্গালি উপভাষার নিদর্শন :
“একজনের দুইডী ছাওয়াল আছিলাে। তাগাে মৈন্দে ছােটডী তার বাপেরে কৈলাে, বাবা, আমার বাগে যে বিডিব্যাসাদ পরে তা আমারে দেও। তাতে তিনি তান বিষয়-সম্পত্তি তাগাে মৈদ্দে বাইটা দিল্যান।” মূলত ঢাকা, মানিকগঞ্জ অঞ্চলের ভাষা]
“ঔগগােয়া মাইয্যের দুয়া পােয়া আছিল। তার মৈদ্ধে ছােড়ুয়া তার ব-রে কইল, বাজি অওনর সম্পত্তির মৈদ্ধে যেই অংশ আঁই পাইয়ম্, হৈইই আঁরে দেত্ত।তখন তারার বাবা তারার মৈদ্ধে নিজের সম্পত্তি ভাগ করি দিল।”
- বঙ্গালি উপভাষার বৈশিষ্ট্য :
বাংলা উপভাষাগুলির মধ্যে একদিকে রাঢ়ী উপভাষা ও অপরদিকে বঙ্গলি উপভাষার বিশেষ গুরুত্ব আছে। এই উপভাষার ধ্বনিগত ও রূপগত নানা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে প্রধান প্রধান কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হল।
- ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্য:
(১) সাধারণভাবে ব্যঞ্জনের পূর্বে হ’ বা ‘উ’ ধ্বনিকে উচ্চারণ করার প্রবণতাকে বলা হয় অপিনিহিতি। এই উপভাযায় অপিনিহিরি স্বরধ্বনি বক্ষিত হয়েছে। যথাঃ আজি > আইজ, কালি > কাইল, থামিয়া > থাইম্যা।
এছাড়াও য-ফলাযুক্ত ব্যঞ্জন ও যুক্ত ব্যঞ্জনের (জ্ঞ, ক্ষ) তাগে অপিনিহিত্তির মতাে ইকারের আগম হয়। যথা ঃ বাক্য > বাইক (ক্য), সত্য > সই (ত্য), কাব্য > কাই (ব্য), যজ্ঞ > যইa (জ্ঞ), রাক্ষস > রাইখস্ (স) ইত্যাদি।
(২) ‘এ’ কার প্রায়ই ‘অ্যা’ কারে এবং ‘ও-কার উ’ কারে পরিণত হয়। যথা : দেশ > দ্যাশ, কেন > ক্যান, দিলেন > দিল্যান, কেবল > ক্যাবল, কোন্ > কুন্, কোপ > কুপ, লােক > লুক। ঠ > ড তে রূপান্তরিত হয়— —দুইটি > দুইডি, মিঠা > মিডা।
(৩) তাড়নজাত ধ্বনি—ড ঢ > কম্পনজাত ধ্বনি র’ তে রূপান্তরিত হয়। যথাঃ বাড়ি > বারি, বড় > বর, দৃঢ় > দৃর, তাড়াতাড়ি > তারাতারি (সাধারণত ঢাকা, বাখরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের ভাষা)
(৪) শ ষ স > হ-তে রূপান্তরিত হয়। যথা : সে > হে, সকল > হগল / হল, শুনিয়া > হুইন্যা, সােনা > হােনা।
- রূপগত বৈশিষ্ট্য :
(১) কর্তায় ‘এ’ বিভক্তি (রামে গিছে / গেছে, মায়ে ডাকে), গৌণ কর্মে ‘রে’ বিভক্তি (আমারে দেও, তােমারে কইসি), অধিকরণে—ত বিভক্তি ও সম্বন্ধে ‘গাে’ বিভক্তির প্রয়ােগ দেখা যায়। যথা : হে বাড়িত নাই (সে বাড়িতে নাই), শহরত আই (শহরে আসিয়া), আমাগাে বারি (আমাদের বাড়ি)।
(২) ভবিষ্যৎ কালের অর্থে নিত্যবৃত্ত অতীতের প্রয়ােগযথা আমি যাইতাম না (আমি যাব না), আবার কোথাও সামান্য অতীত্রে প্রয়ােগযথা ঃ আমি খেলুম (আমি খেলিব)। আসলে ভবিষ্যৎ অর্থে উত্তম পুরুষের ক্রিয়াপদে—উম্ বিভক্তি, অবশ্য মু’ ভিডিও হয়—যথাঃ করমু, যামু / যাইমু।
(৩) ঘটমান বর্তমান অর্থে সামান্য বর্তমানের প্রয়ােগ দেখা যায়। যথা—মায়ে ডাকে (না ডাকিতেছে / ডাকছে)।
(৪) অসমাপিকা ক্রিয়ার সাহায্যে গঠিত যৌগিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে ক্রিয়া সম্পন্নকালের মূল ক্রিয়াটি পরে বসে। যথা : রাম গ্যাসে গিয়া (রাম চলে গেছে।)।
৩. বরেন্দ্ৰি উপভাষা :
নানা ভাষাতাত্ত্বিক আলােচনার সূত্রে বলা যায়—প্রধানত উত্তরবঙ্গ অর্থাৎ মালদহ, দক্ষিণ দিনাজপুর, রাজশাহি, পাবনা—এই ভৌগােলিক পরিবেশে বসবাসকারী জনসমষ্টি যে উপভাষার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করে তাকে বলা হয় বরেন্দ্রি উপভাষা।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পশ্চিমবঙ্গের উপভাষা রাঢ়ি ও উত্তরবঙ্গের উপভাষা বৱেদ্রি এক সময়ে একই উপভাষার অন্তর্গত ছিল। কালক্রমে একদিকে পূর্ববঙ্গের উপভাষা বাঙালি অপরদিকে বিহারের উপভাষা বিহারি প্রভাবে বরেন্দ্রি রাঢ়ি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে বরেন্দ্রি একটি স্বতন্ত্র উপভাষা হিসেবে গড়ে ওঠায় তার মধ্যে কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দেখা দিলেও সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বরেন্দ্রী ও রাঢ়ীর মধ্যে খুবই কম পার্থক্য বিদ্যমান।
▪︎বরেন্দ্ৰি উপভাষার নিদর্শন:
“য়্যাক ঝােন্ মানুষের দু'টা ব্যাটা আছলো। তার ঘাের বিচে ছােট্রা আপনার বাবা কহলে, বাব, ধন করির যে হিস্যা হানি পানু সে হামা দে’। তাৎ তাই তার ঘােরকে মালমাত্তা সব বাটা দিলে।” [প্রধানত মালদহ অঞলের কথ্য ভাষা]
- বরেন্দ্ৰি উপভাষার বৈশিষ্ট্য :
এই উপভাযায় এ পর্যন্ত নানা ভাষাতাত্ত্বিক আলােচনা সূত্র ধরে নানা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ধ্বনিগত ও রূপগত বৈশিষ্ট্যের খোঁজ পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে প্রধান প্রধান কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হল।
- ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্য :
(১) বরেন্দ্রী উপভাষার স্বরধ্বনি রাড়ির মতাে অনেকটাই অপরিবর্তিত এবং অনুনাসিকতাও বজায় থাকে। এ > এ্যা হয়ে যায়, যথা—এক > এ্যাক, দেন > দ্যান, দিলেন > দিল্যান, অনুনাসিকতা বজায় থাকে। যথা—তাই (তিনি), বাঁটা (বাটিয়া)। ইত্যাদি।
(২) চলিত ভাষায় রাঢ়ির মতাে ড ঢ ধ্বনি দুটি রক্ষিত, যথা—আঢ়ি, আঢ়িয়া ইত্যাদি।
(৩) চ বর্গের উচ্চারণ প্রায়ই রক্ষিত, যথা—ছাওয়াল /ছৈল (ছেলে)। তবে কখনাে কখনাে ‘জ’ ধ্বনি ইংরেজি (Z)-এর মতাে অর্থাৎ ঝ’-ধ্বনির মতাে উচ্চারিত হয়। যথা— জন > ঝন ইত্যাদি।
(৪) পদের আদিতে অ’ স্থানে র’ আবার র’থানে অ’ উচ্চারণের প্রবণতা। যথা আমি > রাম, রাস্তা > তাস্তা, রামকান্ত > আমকান্ত। ফলে উত্তরবঙ্গের উচ্চারণে ‘আমের রস’ হয়ে যায় রামের রস, ইন্দুর > র্যানদুর ইত্যাদি।
- রূপগত বৈশিষ্ট্য :
(১) শব্দ ও ধাতুরূপে বরেন্দ্রি মােটামুটি রাঢ়ির মতােই। অতীত কালের ক্রিয়াপদের প্রথম পুরুষের ‘ল’ উত্তম পুরুষে রাঢ়ি বাঙালি সুলভ ‘লাম’ বিভক্তি, ভবিষ্যৎ কালের উত্তম পুরুষে বাঙালি সুলভ ম, মু বিভক্তি প্রয়ােগ দেখা যায়। যথা—খেল, খেলাম, যামু / যাইমু, পামু | পাইমু ইত্যাদি।
(২) পুরাঘটিত বর্তমান কালের ক্রিয়াপদের অন্তিম ব্যঞ্জনে দ্বিত্ব হয়। যথা—আইচ্চে, যাইচ্চে ইত্যাদি।
(৩) অধিকরণ কারকে কখনাে কখনাে কামরূপীসুলভ ‘ত বিভক্তির প্রয়ােগ দেখা যায়। যথা—তাহাৎ | তাৎ (তাহাতে), খরৎ (খরেতে)।
উল্লেখ্য যে, এই 'ত' বিভক্তি ‘অ’ লুপ্ত করে ‘ৎ'-এর মতাে উচ্চারণ করার প্রবণতা আছে। (s) গৌণ কর্মে ক’ বিভক্তির প্রয়ােগ হয়, তবে ক’-এর ‘আ’ লুপ্ত করে উচ্চারণ করার হণতা রয়েছে, যথা—‘হামা দ্যান’ (আমাকে দিন)।
৪. ঝাড়খণ্ডী উপভাষা :
প্রধানত দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তবগ ও বিহারের কিছু অংশ অর্থাৎ মানভূম, সিংভূম, ধলভূম, দক্ষিণ-পশ্চিম বাঁকুড়া, দক্ষিণ-পশ্চিম মেদিনীপুর—এই ভৌগােলিক পরিবেশে বসবাসকারী জনসমষ্টির যে ভাষার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করে তাকে বলা হয় ঝাড়খণ্ডী উপভাষা।
প্রত্যক্রমে উল্লেখ্য যে, এই উপভাষার ঝাড়খণ্ডি নামকরণ করেছেন ভাষাতাত্ত্বিক ভ. সুকুমার সেন। তিনি মূলত মেদিনীপুব্বে পশ্চিম প্রান্তের ধলভূম ও মানভূমের কথ্যভাষাকে ভিত্তি করে এই নামকরণ করেন। আবার কেউ কেউ একে সীমান্ত রাঢ়ি’ও বলতে চেয়েছেন, যাইহোক, ঝাড়খণ্ডির ভাষা যে মােটামুটি রাঢ়ির মতাে এতে কোনাে সন্দেহ নেই। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে ওড়িয়ার সঙ্গেও এর সাধ লক্ষ করা যায়।
ঝাড়খণ্ডী উপভাষার নিদর্শন:
“এক লােকের দু'টা বেটা ছিল। তাদের মাঝে ছুটু বেটা তার বাপকে বশ্লেক, বাপ্ হে, আমাদের দৌলরে যা হিক্সা আমি পাব, তা আমাকে দাও।' এতে তাদের বাপ আপন দৌলত মধ্যে বাখরা করে দিলেক।” [প্রধানত মানভূম অঞ্চলের কথ্যভাষা]
- ঝাড়খণ্ড উপভাষার বৈশিষ্ট্য :
বাড়তি উপভাষার ধ্বনিগত ও রূপগত নানা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে প্রধান ধন কয়েকটি উল্লেখ করা হল।
- ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্যঃ
(১) বখণ্ডি উপভার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল অনুনাসিক স্বরধ্বনির প্রাচুর্য্য। যথা—উট (উ), ইতি (হাতি), সাপ (সাপ), চা (চা) হহঁচে (হইচে / হচ্ছে)। একটু লক্ষ করলে বের বর-হতেনাসিক্যভবনের ঝোকই প্রবল।
(২) প্রায়শই > ল হয় এবং ন > ল হয়, যথা—লাতিপুঁতিরা (নাতিপুতিরা), লহে (নহে),লিব (নিব) ইত্যাদি।
কালি > কাইল (অপিনিহিতি) > কাইল (ঝাড়খণ্ডি) করিয়া > কইরা (অপিনিহিতি) > কইরা (ঝাড়খণ্ডি)
(৩) এক বৃন্ধভাবে বিচার করলে দেখা যায় ঝাড়খণ্ডি উপভাষারও অপিনিহিতির প্রভৰ আছে। তবে অপিনিহিতির স্বরধ্বনি প্রলম্বিত, কিন্তু ঝাড়খণ্ডির স্বরধ্বনি ক্ষীণ। যথা—সন্ধ্যা > সাইজ (অপিনিহিতি) > সাইজ
(৪) শব্দের আদিতে ‘ও'-কে অ’ উচ্চারণের প্রবণতা। যথা—বকা (বােকা), ছকরা (ছােকরা), রগা (রােগ), লক (লােক) ইত্যাদি।
- রূপগত বৈশিষ্ট্য :
(১) নামধাতুর বহুল প্রয়ােগ ঝাড়খণ্ডি উপভাষার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। যথা—‘পুকুরের জলটা গাধাচ্ছে’, ‘আজ রাতকে শীত ভারি জাড়াবে’, ‘জলটা বাসছে’ (গন্ধ করছে), হির ঘরে চর সাঁদাইছিল’ (সিধিয়ে ছিল)।
(২) ক্রিয়াপদে সার্থিক—ক’ প্রত্যয়ের ব্যবহার লক্ষ করা যায়, যথা—বলবেক, পুছবেক, যাবেক, ‘সে যাবেক নাই’ ইত্যাদি।
(৩) যৌগিক ক্রিয়াপদে আছি’ ধাতুর বদলে বট’ ধাতুর ব্যবহার কোথাও কোথাও লক্ষ করা যায়। যথা—তুমহার মিছা কথা বটে, করি বটে’, ‘ মিছা কথা বটে’, হামাদের (আমাদের) ভাষা বাগলা (বাংলা) বটে। এক্ষেত্রে বিশেষ লক্ষণীয় যে ট’ কে ‘ঠ উচ্চারণ করার প্রবণতা অর্থাৎ ‘ট’-এর মহাপ্রাণতা ঘটে। ওরা এই মহাপ্রাণতার প্রবণতায় দূর > ধূর, পতাকা > ফতাকা বলে।
(৪) উত্তম পুরুষের সর্বনামের একবচনে—“মুই (আমি), বহুবচনে—হামরা’ (আমরা); মধ্যম পুরুষের একবচনে—তুই’ (তুমি), বচনে—“তুহারা / তােহারা’ (তােমরা) ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। যথা—মুই যাবা নি’ (আমি যাব না), তুই যাবু’? (তুমি যাবে ?)।
৫. কামরূপী উপভাষা
প্রধানত উত্তর-পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ জলপাইগুড়ি, রংপুর, কুচবিহার, উত্তর দিনাজপুর কাছাড়, শ্রীহট্ট, ত্রিপুরা—এই ভৌগােলিক পরিবেশে বসবাসকারী জনসমষ্টি যে উপভাষার মাধ্যমে নিজেদের ভাব বিনিময় করে তাকে বলা হয় কামরূপী উপভাষা।”
কামরূপী উপভাষার নিদর্শন:
“একজন মাসির দুই- -কোনা বেটা আছিল, তার মদ্ধে ছােটোদের উয়ার বাপােক্ কই, বা, সম্পত্তির যে হিস্যা মুই পাই, তা মােক্ দেন। তাতে তায় তার মাল-মাত্তা দোনাে ব্যাটা বাটিয়া-চিরিয়া দিল্।” [মূলত কুচবিহার অঞ্চলের কথ্যভাষা]
[প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই কামরূপী উপভাষা কোনাে-কোনাে বিষয়ে উত্তরবঙ্গের, আবার কয়েকটি বিষয়ে পূর্ববঙ্গের উপভাষার কাছাকাছি। এই সূত্র ধরে কেউ কেউ বলেছেন কামরূপীর সঙ্গে বরেন্দ্রির নিকট সম্বন্ধ আছে। আবার কেউ বলেছে বাঙালির সঙ্গে সাধর্ম বেশি। তবে একথা ঠিক কার সঙ্গে কামরূপী উপভাষার নিকট সান্নিধ্য তা এখনও গবেষণার বিষয়। যেহেতু বরেন্দ্ৰি হল উত্তরবঙ্গের ভাষা, ফলে কামরূপীর সঙ্গে এর ভৌগােলিক নৈকট্য আছে। সেদিক থেকে প্রাথমিক স্তরে বরেন্দ্রির সঙ্গে অনেক সাদৃশ্য ছিল। আবার বঙালি উপভাষা হল পূর্ব-দক্ষিণবঙ্গের উপভাষা। আর কামরূপী হল উত্তর-পূর্ববঙ্গের উপভাষা। কালক্রমে কামরূপী ভৌগােলিক পরিবেশের মানুষ নানাসূত্রে পূর্ব-দক্ষিণবঙ্গের মানুষের সাথে ভাব-ভাষা বিনিময়ের সুযােগ পায়। এইভাব বিনিময়ের সূত্রে অবশ্যই দ্রুত পরিবর্তনের সুযােগ এসেছে। হয়ত এইজন্যই বরেন্দ্র অপেক্ষা বাঙালির ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্য অনেক বেশি কামরূপীর মধ্যে লক্ষিত হয়। সুতরাং কামরূপী উপভাষা কার কত নিকট সান্নিধ্য সে বিচারে না গিয়ে বরেন্দ্র ও বাঙালির মাঝমাঝি উপভাষা বলা শ্রেয়।]
- কামরূপী উপভাষার বৈশিষ্ট্য :
- ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্যঃ
(১) এই উপভাষায় কখনাে কখনাে ল ন হয়, আবার ন > ল হয় যথা—লাঙল > নাউল, লাউ ১ নাউ, জননী > লনী, মান > সিনান > সিলান ইত্যাদি।
(২) শব্দের আদিতে র > অ হয়, এবং আদ্য ব্যঞ্জনে মহাপ্রাণতা দেখা যায়। যথা— রাজা > আজা, রাতি > আতি, রাগ > আগ, বেশ > ভেশ, জন > ঝন, বাসা > ভাসা ইত্যাদি।
(৩) বালির মতাে কামরূণীতে ড ঢ >র হয়, যথাবড় > বর, শাড়ি > শারি, আষাঢ় > আশার ইত্যাদি।
(৪) ও' কখনাে কখনাে 'উ' ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয় যথা—তােমার > তুমার, কোন্ > , তবে এই প্রবণতা সর্বত্র দেখা যায় না— কুচবিহার, গােয়ালপাড়া অঞ্চলে কোন্ উচ্চারণই প্রচলিত।
- রূপগত বৈশিষ্ট্য :
(১) মুখ্য ও গৌণ কর্মের বিভক্তি হল ক’ যথা বাবাকে > বাপক, আমাকে > হালক, কে লালু (আমাকে ভুলালি)।
(২) অধিকরণে ত' বিভক্তির প্রয়ােগ। যথা—ঘরে > ঘর পশ্চাতে > পাছ।
(৩) সামান্য অতীতের উত্তম পুরুষে নু', মধ্যম পুরুযে—‘উ' এবং প্রথম পুরুষে—“ইল’ বিভক্তি প্রয়ােগ যথা— —“মুই সেবা কল্প’ (আমি সেবা করলাম), তুই সেবা করলু' (তুমি সেবা করলে), মদন কহিল’ (মদন বলল)।
(৪) সর্বনামের উত্তর পুরুযে 'মুই / হাম’ (আমি), ‘মা’ (আমার) এবং মধ্যম পুরুষের নাম তুই’ (তুমি) “তাে’ (তােমার)।
- পদ্য ও গদ্য বাংলা উপভাষার পার্থক্য :
পদ্য ও গদ্যের মধ্যে পার্থক্য অবশ্যই আছে। মনের ভাবনা কল্পনা অনুভূতি রঞ্জিত হয়ে যথাযথ শব্দসম্ভারে বাস্তব সুষমামণ্ডিত চিত্ৰাত্মক ও ছন্দোময় রূপ হল কবিতা বা পদ্য, ফলে রূপের পদ-বিন্যাস, শব্দ-প্রয়ােগ, ক্রিয়ার ব্যবহার গদ্যরূপের মতাে নয়। কেননা গদ্য হল মানুষের ভাবনা-চিন্তার সুনিয়ন্ত্রিত, সুনির্বাচিত বুদ্ধিনিষ্ঠ প্রকাশ। মণ্ডকে বলছে]
[কালকেতু বুলান মন্ড কে বলেছে"]
পদ্যরূপ :
“আমার নগরে বৈস -- যত ইচ্ছা চাষ চষ তিনসন বাহি (বই) দিয় কর।
হাল পীছে একতঙ্ক|-- করিহ কারে শঙ্কা পাটায় নিসান মাের ধর ॥
নাএি দিহ বাউড়ি -- বয়্যা বস্যা দিহ কড়ি
ডিহিদার নাহি দিব দেশে।
সেলামি বাঁশগাড়ি নানা -- নানা বাবে যত কড়ি
নাহি নিব গুজরাট বাসে ॥”
(চণ্ডীমঙ্গল—মুকুন্দরাম চক্রবর্তী)
গদ্যরূপঃ
আমার নারে বাস করে যত ইচ্ছা চাষ কর। তিন সন অন্তর কর দিও, আর হাল প্রতি এক টাকা করে দিও। কাউকে ভয় করবে না। সময়মতাে পাট্টার সাহায্যে আমার সঙ্কেত ধ্বনি বুঝবে। অগ্রিন কোনো খাজনা দিতে হবে না, রয়ে বসে দেবে। দেশে গ্রামগুলির স্বত্বাধিকার কাউকে দিচ্ছি না। বাঁশগাড়ি সেলামি হিসেবে দেবে। নানা দফায় প্রাপ্য টাকা দেবে, গুজরাটে বাস করার জন্য কোনাে টাকা নেব না।
[শব্দার্থ ও বাউড়ি ও অগ্রিম খাজনা, নিসান ও সঙ্কেত ধ্বনি, বাহি : অরে, ব্যবধান, পীছে : প্রতি, বাবে : দফায়, ডিহিদার ও কয়েকটি গ্রামের স্বত্বাধিকারী]
ত্রিপদী ছন্দে লেখা উদ্ধৃত কবিতাংশটির ভাষা বৈশিষ্ট্যের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায় এর মধ্যে রাঢ়ী ও বলি উপভাষা বৈশিষ্ট্যের প্রবণতা রয়েছে। যেমনবসি > বইস / বৈস, রহিয়া > রয়্যা, বসিয়া > বৈস্যা। আবার—অ / র-এর ‘হ’ উচ্চারণ প্রবণতা যেমন— দিয় > দিহ, নাই > নাহি, করিয় > করিহ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, গদ্যরূপটি রাঢ়ি উপভাষা ও কিছুটা বঙ্গলি উপভাষা থেকে গড়ে ওঠা আদর্শ লেখ্য গদ্য। স্বতন্ত্র উপভাষায় আমরা কথা বলি কিন্তু আদর্শ গদ্য ভাষায় আমরা লিখি।
২ . প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার বৈশিষ্ট্য ও উদাহরণ লেখো ।
প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা স্তরের বৈশিষ্ট্যগুলিকে সংক্ষেপে উপস্থাপন করা যেতে পারে—
- ১. এই স্তরে হ্রস্ব-দীর্ঘ প্লুত ভেদে প্রতিটি স্বরবর্ণ, স্পর্শ-উষ্ম-অন্তঃস্থ ইত্যাদি সকল ব্যঞ্জনবর্ণ, তিন প্রকার শিষ্ ধ্বনি এবং অনুনাসিক মিলিয়ে বর্ণমালা ছিল। একাধিক ব্যঞ্জনের যুক্ত ব্যবহার যথেচ্ছ পরিমাণে দেখা যায়। যেমন – প্রোজ্জ্বল ইত্যাদি।
- ২. স্বর – ব্যঞ্জন ও বিসর্গ সন্ধির বিচিত্র ও জটিল প্রয়োগ বৈদিক এবং সংস্কৃত ভাষার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বৈদিক ভাষায় স্বর ধ্বনিগুলির উপর স্বর-এর বিশেষ তাৎপর্য ছিল।
- ৩. সংস্কৃতের শব্দরূপের বিপুল বৈচিত্র্য অন্যতম লক্ষ্যণীয় বিষয়। ছয় কারক, সাতটি বিভক্তি, তিন লিঙ্গ এবং তিন বচনভেদে এক-একটি শব্দ থেকে অসংখ্য প্রত্যয়ান্বিত রূপ পাওয়া যায়।
- ৪. প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার ধাতুরূপেও অজস্র বৈচিত্র্য রয়েছে।
এই যুগে ভারতীয় আর্যভাষার মূল নির্দশন হিসাবে বেদ-কে উল্লেখ করা হয়ে থাকে।প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বেদ বলতে বেদের সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ্—এই চারটি অংশকেই বুঝতে হবে।শুধু তাই নয়, পরবর্তীকালীন সূত্রসাহিত্যও এই অংশের অন্তর্ভুক্ত।এছাড়াও ইতিহাস, পুরাণ ও রামায়ণ মহাভারতের ভাষাও এই স্তরের অন্তর্ভুক্ত ।
- প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার বিস্তার কাল :
এই প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার আনুমানিক বিস্তৃতিকাল হিসাবে ১৫০০-১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ সময়কে ধরা হয়ে থাকে।
জয়দেব বাবু আপনার এই সাহিত্য চেতনা ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সমস্ত রকম বিষয় ভিত্তিক আলোচনা গুলি বিশেষত পড়াশুনা বিভাগের সত্যি খুবই চিত্তাকর্ষক ।
উত্তরমুছুন