প্রবন্ধ
ভাষা আমারমতিয়ার রহমান
ভাষা তো মাটির মতো।কুমোরের চাকায় পড়লেই তা প্রাণ পায়। কথা বলে। প্রথম ভাষা শিক্ষক তো আমাদের মা।কুমোর হাত দিয়ে বানায় আর মা মুখ দিয়ে বলান।তাই তো মায়ের ভাষা আমার গর্ব আমার অহংকার আমার মাতৃভাষা। কবির কথায়,মাতৃ দুগ্ধ সম মাতৃভাষা। আমি বাঙালী। আমার ভাষা বাংলা। আমি বাংলায় কথা বলি। বাংলাই গান গাই। বাংলায় হাসি। বাংলায় কাঁদি। বঙ্গ নারীর অঙ্গ শোভায় আমার প্রাণ জুড়ায়।বাঙালী বধুতেই আমার সঙ্গ সুখ।তা বলে আমি পরভাষা বিদ্বেষী বা অসহিষ্ণু ও ন ই। আমি কেদারা, পেয়ালা,পিরিচ, বেতার কেন্দ্র, দূরদর্শন,দূরাভাষের বদলে চেয়ার,কাপ,ডিস,রেডিও স্টেশন, টেলিভিশন, টেলিফোন বলতেই বেশি অভ্যসত। ভাষার বেড়া কোন কিছুকেই থামিয়ে দিতে পারে না। বাংলা ভাষাকে হৃদয়ে লালন করে চোখের মণির মতো ভালোবেসে কাজু আজুমা শান্তিনিকেতন বাসী।আর ওই দূর দ্বীপবাসিনী শ্বেতাঙ্গিনী যুবতী গেরুয়া আলখাল্লা পরিহিতা বাউলের সাথে ঘর বেঁধে দুজনে সুজনে গাইছেন," লাল পাহাড়ির দ্যাশে যা রাঙ্গামাটির দ্যাশে যা ইখ্যানটোতে তুকে এক্কেবারে ই মানাইছেনাই রে " আর শান্তিনিকেতন হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া শ্যামবাটি ক্যানেল ধারে শনিবারের খোয়াই বনের অন্যহাটে যে বিদেশী রমনী মুখের পোট্রেট এঁকে মাত্র বিশ ত্রিশ টাকা পান তার বাঙালি সংস্কৃতি প্রেম বাংলাকে ভালোবেসে এখানেই বসত গড়া। আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে।
আমার বন্ধুর বউ হেনা। স্কুল শিক্ষিকা। তাদের একমাত্র সন্তান শিরীন। একটি নাম করা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। কী সুন্দর নিটোল শব্দ উচ্চারণ। শীত কালীন সফরে নানু বাড়ি বেড়াতে গেছে। শীত সকালে পাড়া তুতো দুই নানি কথা বলছেন নিজেদের মধ্যে।নুচি,কদু,ডিঙলা,আনডা বিরান,বয়জা উসা,কাখৈ,সুকটি সানা,মাকাই সিঝা,বাসি ভাত,মার পানি,আমানি,গুলহতি রাঁধা,বিহ্যান ব্যালা,আমচুর শুখা কথা গুলো শুনতে শুনতে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।আর হা হয়ে থাকে। একটুও বুঝতে পারে না। মুশকিল আসান মা হাসতে হাসতে বলেন, ওটা নানিদের ভাষা।
ভাষার মাস এলেই মনে পড়ে সেদিনের কথা। ওপার বাংলার ঢাকা মহানগরী থেকে এসেছিলেন এক ঝাঁক নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠচক্রের সদস্যরা। তাদের ইচ্ছে মুর্শিদাবাদ হাজার দুয়ারী ভ্রমণ। আমাদের ভাড়া গাড়ির চালক উচ্চ স্বরে হিন্দি গান বাজিয়েই চলেছে। গাড়ির ভেতরে হিন্দি গান শুনে হঠাৎ করেই ধমকে উঠলেন নাহার আহমেদ। এই বন্ধ করো তোমার ওই গান। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ভূপেন হাজারিকা, মান্না দে আছে? ডরাইভার আমতা আমতা করে বলল,না ম্যাম।ফের ধমক।ম্যাম! ক্যান ম্যাম।আপা বলতে পারো না? তোমাদের এ বাঙালীদের ওই এক দোষ বাংলা ভাষাটাকে নিজের ভাষা রূপে মনে করতে পারো না। তোমাদের এতো সম্পদ তবু পরধনে মত্ত। সেদিন পথ চলতে চলতে কোন গান বাজে নি। উপস্থিত নন্দিনীরাই খালি গলায় আসর মাতিয়ে গেলেন।
যে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা রক্ষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করলেন সালাম,জাববার, রফিক জব্বার, বরকত প্রমুখেরা।যাদের জন্য ই আমরা পেয়েছি অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি। আমরা বাঙালীরা যোগাযোগের ঠিকানা ইংরেজি ভাষার ব্যবহার করি। সেলিব্রিটিরা অটোগ্রাফ দেন ইংরেজি তে। আপনার সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়িয়ে আভিজাত্যের অহংকার অনুভব করি। উৎসব অনুষ্ঠানে আলু পোস্ত ,ডাল,ভাত, চাটনি তুলে দিয়ে চিলি চিকেন গ্রেভি মাটন বিরিয়ানি, ফ্রায়েড রাইস,আইস ক্রিম। সুদৃশ্য প্যাকেট। আহা। কী আনন্দ। সেদিন ঝাঁ চকচকে দোকানে ঝকঝকে সুন্দর প্যাকেট কিনে খুলে মুখে দিতেই মেয়ের সে কী কান্না।মকাই ভাজা।মকাই ভাজা। বলে কিনা পপ কর্ন।ব্যাটার ছেলে গেঁয়ো বাঙালি পেয়ে ঠকাইছে রে।আর সোকেশ সাজিয়ে রাখা মালপোয়া আরে ওতো দাদির হাতের পাকুয়ান।
কিন্তু আমাদের বাঙালীদের ঠকাননি ইউনেস্কো। পরিশ্রমের মর্যাদা দিয়েছেন তাঁরা। কানাডায় প্রবাসী বাঙালি রফিক আর তাঁর বন্ধু সালাম মাতৃভাষার জন্য যা করলেন তা আরও একটি ইতিহাস। ঐতিহ্য। বিশ্বের বিস্ময়।
২১ শে ফেব্রুয়ারী কে ' আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারী জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আন্নানকে একখানি চিঠি লেখেন।সে সময় তাঁর তথ্য বিভাগে কর্মরত প্রধান আধিকারিক হাসান ফেরদৌসের নজরে আসে। তাঁর সফল উদ্যোগ ও উপদেশেই তৈরি হয় " এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাঙগুয়েজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড" নামের একটি সংগঠন। অনেক লড়াই ও অনেক সঙগরাম করে ১৯৯৯ সালের ১৭ ই নভেম্বর ইউনেস্কোর সভায় প্রস্তাব টি উত্থাপিত হয় এবং ১৮৮ টি দেশের সমর্থনে ২১ শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পায়। বিশ্ব বাঙালি পেল আর ও একটি উজ্জ্বল দিন।২০০০ সাল থেকে আমরা সম্মানের সঙ্গে ২১ শে' র প্রভাত ফেরীতে আমার প্রিয় পছন্দের ভাষাতেই কণ্ঠ মেলাই," আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলিতে পারি" । কী অপূর্ব সুন্দর সুর। কথা গুলো ও অসাধারণ।' আমরি বাংলা ভাষা।' মেটে কি মনের আশা।আহা। আপনারা চুপ কেন? আপনারাও আমার সাথে গলা মেলান আজকের এই পূণ্য প্রভাতে," আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী- - - - -,"
তথ্যসূত্র:১ নন্দিনী সাহিত্য পত্রিকা: ঢাকা, বাংলাদেশ। সম্পাদনা: সুলতানা রিজিয়া।২ বীরভূম প্রান্তিক সাহিত্য পত্রিকা:মুরারই, বীরভূম। সম্পাদনা: সুনীল সাগর দত্ত।দুটিই বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ ভাষা দিবস সংখ্যা রূপে।