চেতনার মহাকালো মাঝে
মৈত্রেয়ী সরকার
( ১)
চরাচরের কোনো স্তরেই আমার স্থুল সত্তার অস্তিত্ব টের পাই না আজকাল আমি। নির্বাক দর্শক হয়ে থাকার মধ্যে একটা নিরন্তর ধ্যানস্থ হওয়ার সুখ পাওয়া যায়। এই চলমান পৃথিবী তার সমস্ত সুখ দুঃখ-হাসি-কান্না-মান-অভিমান-স্বার্থপরতা-হিংসা নিয়ে ঠিক সাপ লুডোর ছকের মতো নেচে-নেচে খেলে বেড়ায় আমার চোখের সামনে। আমি ঠিক বিরাট পর্দার সামনে দর্শকের স্থির দশার মতো চুপ করে বসে থাকি। আউটসাইডার হওয়ার নেশা চেপে ধ'রে। আমার পুরনো বাড়ির দোতলার ব্যালকনিটার সামনে চুপটি করে বসে ছেলেবেলায় অকাজের দিনে আমি যেভাবে রোজ-রোজ সারা পাড়ার ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুমতে যাওয়া সমস্ত কাজকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখতাম ঠিক তেমনই মনে হয় হৃদয়ের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নিরন্তর চরাচরকে খেলে যেতে দেখছি। চলমান ছবিগুলো খেলে যায়, নেচে যায়, দৌঁড়ে যায়, স্থিরও হয়।। আমারো ক্যাথারসিস হয়, ডায়ানোসাসের ভর পড়ে, পিউরিফিকেশন হতে থাকে রোজ-রোজ। বোবা-কালা-কানার প্রকৃত সুখকে গোল্লাছুটের মতো ছুঁয়ে ফেলছি মাঝে-মাঝে ! আগে আমার প্রবল নার্সিসিজম ছিলো আর আজকাল আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে বড়ো অচেনা লাগে ! এই যে মোটা গড়নের শ্যামলা রঙের কোকড়া চুলের মেয়েটা, যার চুল থেকে পায়ের নখ্ পর্যন্ত এককালে ঘঁষে মেজে-মেজে সুন্দর করে তুলতাম, সে কি আদতেই আমি ? নাকি যাকে দেখি রোজ-রোজ সে একটা জামার মতো শুধুই আমার আবরণ মাত্র ! আসল আমি কে ? যে আমাকে আয়নায় দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে সে, নাকি অন্য কেউ ! মাথার ভিতর অদ্ভুত এক উথাল-পাতাল হয় ! গুলিয়ে উঠতে থাকে সমস্ত চিন্তা স্মৃতি আর সত্তা! আচ্ছা আমি কি নিরন্তর নিজেকে খুঁজতে-খুঁজতে পাগল হয়ে যাচ্ছি ! এক একটা লেখা আমায় নিংড়ে নিচ্ছে সত্যের কাছাকাছি, অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি ব্যতীত সৎ লেখার জন্ম হয় না, এই যে প্রতিদিন চেতনার স্তরে-স্তরে অলৌকিক সব চিন্তার স্রোত খেলে যায় চকিতে বিদ্যুৎ শিখার মতো তার কিয়দাংশও লেখায় ধরা যায় না ! হে মস্তিষ্ক, হে চেতনা তোমায় শতকোটি প্রনাম। নশ্বরতার স্তর বেয়ে বেয়ে পঞ্চভূত থেকে শক্তি হয়ে যাওয়ার আগে শুধুই লিখে যেতে চাই এনার্জির এই বিচিত্র সৃষ্টি ক্ষমতাকে।
অঙ্কন : ইন্দ্রানী |
[ ২]
তোমার বৃত্তের ভেতর আমার কোনো অস্তিত্ব নেই, যেমনি ভাবে এই মহাবিশ্বের কোনো বৃত্তই আমার চেতনাকে বেঁধে নিতে পারে নি, ঠিক তেমনিই। তবে সচেতন ভাবেই আমার এই যে নেই হয়ে যাওয়াটাই জানো সবচেয়ে বেশি শূন্যতার আঁধার তৈরি করে । এই যে বিরাট মায়াবী কৃষ্ণগহ্বরের শূন্য চিহ্নটির ভেতর সেই যে আশৈশব থেকে ঘোরা শুরু করেছি তা লক্ষ্যমূখী হ'তে-হ'তে কখন যে লক্ষ্যশূন্য হয়ে গেলো বুঝতেই পারিনি। শুধু কাল পরম্পরায় এই বিশাল কুজ্ঝটিকাময় কালো মায়ার টানে শুধুই ঘুরে চলেছি। এই মহাবিশ্বের কালো করালময়ী কালিকা শূন্যতা আর কালো শক্তি আমায় অস্থির করে রাখে । নিরন্তর তেজের খেলায় গড়ে ভেঙে অন্ধকারের মাঝেই বিষাদপ্রতিমা করে তোলে । অভীষ্ট শূন্য বাঁকবিহীন এই সরল যাত্রাপথে নিতান্তই অবসাদে বৈচিত্র্যহীন ভাবে হেঁটে চলা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই, চেতনার দাসের আনুগত্য ছাড়া আমার আর কোনো কাজ নেই । একটা বৃহৎ মান্টিভার্সের বৃত্তের ভেতর ব্রহ্মাণ্ডের বৃত্ত, কৃষ্ণগহ্বরের চারপাশে আকাশ গঙ্গার বৃত্ত, সৌরবৃত্ত পার করে পৃথিবীর বৃত্ত, তারপর এ বৃত্ত সে বৃত্ত পার করে ওই অনু থেকে স্ট্রিং থিওরি ভেদ করে যে শক্তির বৃত্ত এভাবেই শূন্যতায় ভরা লক্ষ কোটি বৃত্ত কেবলই আমায় গ্রাস করে আছে । এই যে এতো স্বপ্ন ছিলো দু'চোখে, এই যে এতো প্রেম ছিলো আত্মায়, এই যে এতো প্রতিষ্ঠা, সামাজিক মর্যাদার তাগিদ ছিলো বুকে সবই তো বৃত্তের খেলায় খেলেছি জীবনভোর মুঠো মুঠো করে, সিনেমার শেষ দৃশ্যে এসে ক্যাথারসিসের আনন্দে তা মিথ্যে বালির মতো ঝুরঝুর করে মুঠো ছেড়ে ঝরে পড়েছে হাজার বালির সৈকতে। বাজিকর যখন ইন্দ্রজাল ছিড়ে দেয় তখন কি বা প্রাপ্তি থাকে তার খেরোর খাতায় ? ক্লান্ত বিষন্ন অবসাদের মালায় দর্শক তাকে ফেলে দিয়ে বলে " সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়, তফাৎ যাও, তফাৎ যাও"। মায়া কাটা একটা বাজিকরের খেলা, আমি সমস্ত সূত্রধরের সূত্র কেটে দেওয়ার ছুরিতে শাণ দিচ্ছি । এই যে জীবন মৃত্যুর চক্র,
" অথ চৈনং নিত্যজাতং নিত্যং বা মন্যসে মৃতম্
তথাপি ত্বং মহাবাহো নৈনং শোচিতুমর্হসি।" ২৬/ ২/ শ্রীমদ্ভগবদগীতা,শ্রীল প্রভুপাদ অনুবাদ।
( হে মহাবাহো! আর যদি তুমি মনে কর যে, আত্মার বারবার জন্ম হয় এবং মৃত্যু হয়, তা হলেও তোমার শোক করার কোনো কারণ নেই।)
এই যে বৃত্ত থেকে অন্য বৃত্তে ক্রমাগত লাফিয়ে-লাফিয়ে চলা, এর থেকে আমায় মুক্তি দিতে পারো তুমিই, যে তুমি আমায় নির্বাসিত করেছো তোমার নদীর অতল গভীরান্ত থেকে, তুমি আমায় একটা অতি বৃদ্ধ নক্ষত্রের শেষ বিষ্ফোরণের মতো করে টুকরো-টুকরো করে ভেঙে ছড়িয়ে দিয়েছো মহাবিশ্বের ক্রমাগত বেড়ে ওঠার স্রোতে, আমি অসহায়ের মতো কেবল অনন্ত শূন্যের টানে ভেসে যাচ্ছি ক্রমাগত নিজের থেকে নিজেই দূরে সরতে-সরতে । রঙিন আলোর নেবুলার মতো আমার উজ্জ্বল দিক দেখে-দেখে পৃথিবীর চোখ ধাঁধিয়ে যায়, তারপর পড়ে থাকে সময়ের টানে আমার অসহায়ের মতো শুধুই অনন্ত শূন্যের দিকে ভেসে চলার ইতিকথা । এই শূন্যতার বৃত্তের বন্দীদশা থেকে আমার কোনো মুক্তির পথ মহাবিশ্বের জানা নেই।
নিরন্তর কালোর মাঝে এই যে আমার ক্রমাগত ভেসে চলা, সেখানে কোথায় তোমার ঘরবাড়ি,কোথায় তোমার গানের খেয়া,কোথায় তোমার ফুলে ভরা চারাগাছ ! এই যে অনন্ত ব্যাপ্ত কালো কনা আর কালো শক্তিরা তোমার ফোটন প্রতিচ্ছবিকে গ্রাস করে রেখেছে, আমার সাধ্য কি সেই মহাকালোর মাঝে তোমায় উজ্জ্বল করি ! আমি শুধু ধীর গতিতে আসা তোমার গন্ধকে অনুভব করি, কানের শ্রবণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক নীচু স্বরের তোমার শব্দরা আমায় ছুঁয়ে চলে যায়! আমি শুধুই অন্ধত্ব স্বীকার করে মহাকালের মাঝে অজ্ঞ সেজে থাকি। দিকবিদিকের সূত্রকে না বুঝেই নিরন্তর ঘুরে যাই কৃষ্ণগহবরের টানে।অতল-বিতল-তলাতল-রসাতল-পাতাল জুড়ে খুঁজে বেড়াই তোমার ঠিকানা । একটা আকাশগঙ্গা পার করে নতুন আকাশগঙ্গায় তোমার ইশারা পাই । সপ্তর্ষী মন্ডলের এক বিন্দুর দিকে সামান্য ছুটে গেলেই কয়েক কোটির গ্যালাক্সি আবার এসে পড়ে সম্মুখে, আমি কাকে ভেদ করে কোন দিকে ছুটে যাবো ? যেদিকে তাকাই সেদিকেই অনন্ত সীমানাহীন এক ব্রহ্মলোক, এই মহাসমুদ্রে আমি কোথায় খুঁজে পাবো তোমার একবিন্দু ঠিকানা ? বলো কোথায় খুঁজে পাবো ? আমি মহাকালোর ক্ষিদে নিয়ে শুধুই খুঁজে বেড়াই।
[৩]
ধুসর সভ্যতার বুক চিরে চিরে বাঁশির শব্দ আসে কানে।কাচা হলুদ রঙের অমলতাস গাছটার নীচে বসে এক নবীন বাঁশিওয়ালা রোজ রোজ বাঁশি বাজায়।আমি ওর বাঁশির সুরের সাথে হারিয়ে যাই । অনেকটা মায়া ছড়িয়ে ও বাঁশি বিক্রি করে। ওর মায়ার অক্ষর আমি পড়তে পারি না । আচ্ছা, কাল যদি আমি হটাৎ মরে যাই বাঁশি শুনতে-শুনতে, তুমি কি কোনোদিন জানতে পারবে আমার বুকেও একনদী সুর ছিলো, আমার চোখেও এক ঝর্ণা কান্না ছিলো, আমার মনে ও এক পাহাড় অভিমান ছিল !যে বাঁশি থেকে প্রতিমুহুর্তে বিষাদের সুর তুলে গেছি তার সরগম লিখে রাখিনি কোনো খাতায় । একবুক কৃষ্ণকনার তরঙ্গরা প্রতিমুহূর্তে ছুটে যায় তোমার দিকে, জানি না তোমার চেতনার তরঙ্গে তা কখনো ভাষা হয়ে ওঠে কিনা ! আমি আর কোনো ভৌত কণায় আস্থা ও বিশ্বাস রাখি না । যা অদৃশ্য, কালো, প্রতিবিম্বহীন সেই আপাতদৃষ্টিতে শূন্যতায় আমার অনন্ত আস্থা । যদি অখন্ড কর্মব্যস্ত সময়ের মধ্যেও সামান্য কোনো খন্ড অবসরে তোমাকে সামান্য হুতাশন দগ্ধ করে জেনো আমার অবসাদের কালো কণারা কিম্বা কালো শক্তিরা ছুঁয়ে ফেলেছে তোমায় ! ওরা অবাধ, ওরা তীব্র, ওরা প্রবল পরাক্রমশালী অদৃশ্য, ওরা আরো আরো গতিময়,ফোটন কণার থেকেও তীব্র গতিতে যদি ভেদ করে ফেলে তোমার চর্ম হাড় মেদ মজ্জা মাংশ অথবা আত্মা ! হ্যাঁ, সুপ্তিকালীন তোমার আত্মাকে ও ছুঁয়ে দিতে চাইবে ! জড়িয়ে নিতে পারবে আগম পারের মনের মানুষকে । আমার স্থির বিশ্বাস ওরাই পারবে।
(৪)
এই যে বস্তুত তোমার আর আমার ভেতর অখন্ড দুরত্ব আর অনন্ত শূন্যতা, একে আমি কোনো অর্থেই শূন্য মানি না । ব্ল্যাক ম্যাটারের আর শক্তির জালে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে আছি আমরা দু'জন, আমাদের জাগতিক কোনো সূত্রধরের প্রয়োজন নেই, কিম্বা জাগতিক কোনো প্রতিবিম্বিত রশ্মি বা সামাজিক নিয়মের । প্যারালালি আমরা থেকেছি থাকবো অথবা থাকছি আমাদের কালো গ্রহের সংসারে । সেখানে আমরা সীমাহীন আদি ও অকৃত্রিম । আমাদের বেঁধে বেঁধে বয়ে যায় অতীতের কালে সময়ের ঢেউ । সেখানে আমরা একসাথে তাণ্ডব নাচি,ভৈরব গাই আর নিরন্তর মিলনে অর্ধ নারীশ্বর হয়ে পড়ে থাকি দূর কোনো ধূসর লাল আকাশগঙ্গার কূলে ।এই যে আমি তোমার দিকে আমার চিন্তার তরঙ্গগুলো ছুঁড়ে দিলাম আর আমার কোনো জাগতিক তরঙ্গের দরকার নেই, মস্তিষ্কের সহস্র পদ্মকে আদেশ দিয়ে দেখেছি ওর নব্বই ভাগ সুপ্ত ঘরে এখনো বহু অচেনা তরঙ্গের দূত ভাষা নিয়ে যেতে প্রস্তুত।শব্দব্রহ্ম দিয়ে চেতনার চিন্তার কথাগুলোকে না ভরেই ভাসিয়ে দিই অভিকর্ষের মতো ব্রহ্মান্ডব্যাপী তরঙ্গজালে।
আমি ক্রমাগত নিজেকে ছাপিয়ে বড়ো হয়ে উঠছি । আমার ছায়া নিরন্তর প্রসারিত হচ্ছে ঠিক ব্রহ্মান্ডের অবিরাম ছড়িয়ে পড়ার মতো করে । এই দূরত্ব আর বিচ্ছেদ গতি মাপার কোনো একক আমার জানা নেই, তোমার জানা থাকলে জানিও কখনো কোনো কৃষ্ণ কালোর সময়হীন অবসরে । আরো জায়গা জুড়ে কালোর গহ্বরে আমার বিষাদরা শিকড় গড়বে আমাকে ধ্বংশ করতে করতেই । এই অনন্ত প্রসারণ ছাড়া আমার আর কোনো পন্থা নেই।আমি ঘুরতেই থাকবো নিরন্তর তোমার কক্ষপথে। কৃষ্ণগহবরের কালো পথের গ্রাসে আমার ধ্বংসের পর আবার শ্বেতগহ্বরের পথ ধরে আমার নতুন সৃষ্টি হবে, এভাবেই চুরাশি ব্রহ্মাণ্ডের মতোই আমাদের নতুন নতুন জন্ম মৃত্যু এসে যায়, চলে যায়।
একটা অখন্ড অবসাদ আমায় বিশুদ্ধভাবে পোড়াতে পোড়াতে উজ্জ্বল ধাতব করে তোলে।এই যে নিরন্তর মহাশূন্যে আমি ধেয়ে বেড়াই, নিজেরই স্বভাবদোষে ক্রমাগত সকলের আবডালে রাখি আত্মাকে, একাকী ভ্রমিয়া বেড়াই এক নক্ষত্রলোক থেকে আরেক নক্ষত্রলোকে, খুঁজে বেড়াই অনন্ত শয্যায় ঘুমন্ত তুমি কে ! সেকি প্রকৃতই তুমি নাকি আমার আশৈশব লালিত ব্যথা।ক্ষুরদৃপ্ত ছুরিকা দিয়ে হাত কেটে-কেটে যেভাবে ব্যথাদের জাগিয়ে তুলে আনন্দের গান গাইতে শিখেছি, যেভাবে একটা আপাত নিরীহ অথচ বিস্ময়কর বিচিত্র অনুভূতির মৃত্যু আমায় প্রতিনিয়ত অনন্ত আনন্দ দেওয়ার জন্য লালায়িত করে সেভাবেই তোমাকে নক্ষত্রলোকে রোজ খুঁজে বেড়াই নতুন নতুন করে। এই নিরন্তর খুঁজে বেড়ানোর আকাঙখার চক্রে শুধুই জন্ম মৃত্যুর মাঝে গোল গোল করে ঘুরে বেড়াই ভুতুড়ে ক্ণার মতো । একবার শুধু তোমায় ছুঁয়ে দিতে পারলেই এই চক্রকে ভেদ করে তোমার মাঝে অনন্ত বিলীন হতে পারি।আর সেই তৃষ্ণায় আমার বিষাদ কালো ক্ণারা নিরন্তর ছুটছে তোমার অভিমুখে, যদি একবার ছুঁয়ে দিতে পারি তোমায় ! যদি একটিবার অন্তত ছুঁয়ে দিতে পারি তোমায়––––
একটিবার অন্তত ।