• মলয় রায়চৌধুরীর কাব্যনাট্য
ভরসন্ধ্যা
মলয় রায়চৌধুরী
বুড়োবুড়ি ( কোরাস ) ।।
যুবকেরা ( কোরাস ) ।।
যুবতীরা ( কোরাস ) ।।
আত্তিলা ।।
সাঙ্গপাঙ্গদল ।।
কদমগাছ ( পুরুষকণ্ঠে কোরাস ) ।।
আত্তিলা ।।
বুড়োরা ( কোরাস ) ।।
আত্তিলা ।।
ক্যালিগুলা ।।
জাগুয়ারজোড়া ( পুরুষকণ্ঠে ) ।।
ক্যালিগুলা ।।
জাগুয়ারজোড়া ( নারীকণ্ঠে ) ।।
কদমগাছ ( পুরুষকণ্ঠে কোরাস ) ।।
বুড়িরা ( কোরাস ) ।।
ক্যালিগুলা ।।
পলপট ।।
নাচতে-নাচতে শিস দিয়ে হাফ-ল্যাংটো
মেয়েদের কোমর জড়িয়ে অন্তর্ধান
করলেন ক্যালিগুলা । কদমের গাছ
হাততালি দিলেন এবার জোরে-জোরে ।
গলায় খুলির মালা পরে কয়েকটা
হাড়গিলে মানুষকে হাতকড়া বেঁধে
প্রবেশ করল পলপট, জলপাই
রঙের পোশাকে । সামরিক বাজনার
জগঝম্প হইচই ওঠে চারিদিকে
[ একটি কদমগাছ ছেয়ে আছে ফুলে ;
গাছটির চারিপাশে উবু হয়ে বসে
উনত্রিশজন বুড়োবুড়ি আর জনা
ছয় যুবক-যুবতী । সকলেই তারা
ওপরে তাকিয়ে আছে কদমগাছের
পানে ; বোঝা যায় তারা অপেক্ষা করছে
গাছটির অন্ধকার থেকে একজন
অতিমানুষের আগমন । লোকগুলো
এসেছে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এ-আশায়
কদম গাছটি নাকি সেই গল্পতরু
যার গন্ধে লুকিয়ে আছেন অবতার–
নেমে আসবেন মর্ত্যে নেতৃত্ব দেবেন ।
লোকগুলোদের দেশে নেতা নেই বলে
কদম গাছের কাছে ভিক্ষা চাইছেন
যাতে একজন অতি-আধুনিক কেউ
মানুষের মঙ্গলের জন্যে আবির্ভূত
হন । অথচ গাছটি নিরুত্তর আজো । ]
কবে থেকে বসে আছি হাপিত্তেশ করে
কদমের গাছ ওগো দাওনা পাঠিয়ে
কোনো লোক, যাকে কাঁধে তুলে আমাদের
মসনদে বসাবো সকলের ভালোর
জন্য। উচিত মানুষ নেই কবে থেকে ।
অন্য জগৎ চাইছি, ভিন্ন ইতিহাস ।
বদল মানে কি স্রেফ নাচের আঙ্গিক ?
পাড়াতুতো নেতা-নেতি দেশটাকে ছিঁড়ে
সোনাদানা রাখছে বিদেশে নিয়ে গিয়ে ;
নয়তো নিজেরা নিজেদের ছিঁড়েফেড়ে
নাচন-কোদন করে জুয়া খেলছেন ।
কারো মুখ যেন লাল বাঁদরের পাছা
আবার কারোর ঘাড়ে শুয়োরের মাথা
কেউ ঝোলে ডালে ল্যাজ ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে
অনেকের জন্ম তো গুয়েরই আঁতুড়ে
পথই নজরে আসছে না আমাদের
কীভাবে পাল্টাবো এই বেজন্মাগুলোকে
যেনাদের কথা থেকে মানেরা লোপাট !
খুবই খারাপ যাচ্ছে দিনকাল ; শান্তি
নেই, কোনো দিশা-নির্দেশটুকুও নেই
লেগে আছে খুনোখুনি ধর্ষণ ডাকাতি
রাহাজানি বোমাবাজি কিশোরী পাচার
আর এই সবেতেই যারা দায়ি তারা
দখল করেছে মসনদ কোষাগার
আমাদের সার্কাসে আছে চক্রী ভাঁড়েরা,
বড়ই অভাব এক সৎ মানুষের ।
ভয়ে কেউ স্বপ্ন দেখতেও চাইছে না
সব ডানা রয়ে গেছে ডিমের ভেতরে
বাধ্য হয়ে বাছাই করতে হচ্ছে ভাঁড় ;
উপায় না খুঁজে পেয়ে জঙ্গলে ঢুকেছে
রেগে গিয়ে অনেকেই ধরেছে বন্দুক ।
বানচোতে বানচোতে ভরে গেছে দেশ ।
আমরা আরও গন্দা গাল দিতে চাই ;
মনে হয় মাসিকের কানি গুঁজে দিই
ধরে ধরে ওগুলোর মুখের ভেতরে ।
তাই চাই একজন বিশুদ্ধ মানুষ ।
এই সব লুচ্চা-লাফাঙ্গায় ছেয়ে থাকা
বৈভবী বাছাই থেকে মুক্ত হতে চাই ।
কদমগাছ ( নারীকন্ঠে কোরাস ) ।।
রয়েছে আমার স্টকে পাঁচ মহাজন
একে একে গুণাগুণ শোনো ওনাদের
তারপর ভেবেচিন্তে নির্ণয় নেবার
পালা তোমাদের ; নিয়ে যেও যাকে চাও ।
অনেকেই সৎ নয় কেউ কেউ চোর
সকলেই কচু নয় কেউ কেউ ওল
অনেকেই স্নব নয় কেউ কেউ খুনি
সকলেই সাপ নয় কেউ কেউ ব্যাঙ
অনেকেই বোকা নয় কেউ কেউ ছুঁচো
সমস্যা হল যে তারা সবাই মানুষ ।
[ হাততালি বাজালেন কদমের গাছ ।
খচ্চর খুরের ধ্বনি শোনা যায়, কেউ
আসছে মিউলে চেপে এইদিক পানে ।
ভিড়ের ভেতরে এসে ঘোড়া থেকে নেমে
তাকায় সবার দিকে ; বেঁটে-ঘোড়া বাঁধে
কদম গাছেতে । লোকটির খালি গায়ে
চামড়ার শায়া, হাতে বর্শা পিঠে তীর
একটা শুয়োর মরা কাঁধের ওপর ;
তার আগমনে দুর্গন্ধ ছড়ায় এত
সকলেই বাধ্য হয় নাক চাপা দিতে ।
লোকটি নিজের পরিচয় নিজে দেয় ;
একই পোশাকে ঢোকে সাঙ্গপাঙ্গদল । ]
আমি হুন আৎতিলা, দেবতার হাতে
গড়া, শান্তি-শৃঙ্খলার ভয়াল মানুষ
দেখছ আমাকে ? বহু দেশ জয় করে
সেখানের লোকেদের কবজায় আনা
কঠিন ছিল না । ছুটিয়েছি সেনাদের
তাদের ওপর দিয়ে থেঁতলে গুঁড়িয়ে
জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে । মেয়েদের
তুলে এনে বিলিয়েছি সেনাদের মাঝে ।
রা কাড়েনি কেউ । ইতিহাস দেখে নাও ।
যে যেমন আছে তেমন থাকায় রপ্ত
হয়েছে সবাই রোম থেকে দানিয়ুব
থেকে বালটিক সমুদ্রের নোনাঢেউ–
আসেনিকো আমার মতন বারোয়ারি ।
সোনাদানা কিছুই আমরা নিয়ে গিয়ে
রাখিনি বিদেশি ব্যাঙ্কে অথবা বাড়িতে ;
বাড়ি-ফাড়ি নেই আমাদের, যেথা ইচ্ছা
সেখানেই ডেরা বাঁধি, আর সে-জায়গা
হয়ে ওঠে আমাদের থাকার স্বদেশ ।
নিষ্ঠুর হিংস্রতা ছাড়া আনন্দ ঘটে না:
হৃদয়ী নায়কমাত্রে ঘোর ইডিয়ট
কেননা পাবলিক হল নির্মিত প্রাণী ।
আত্তিলা মাস্তান জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ
পাবলিক মানেই তো ভেড়াদের পাল
জন্মসিদ্ধ অধিকার কান্নাকাটি করা ।
আত্তিলার খচ্চর ( নারীকন্ঠে ) ।।
চলুন সম্রাট এটা হাঘরের গ্রাম
ঘাসও তো দেখতে পাচ্ছি না কোনোখানে
উঁহু, পুং ঘোড়াদের দেশ এটা নয়
এখানে বুকনিই পায় বক্তাকে খুঁজে
বর্তমান এলে লোকে অতীতকে খায়
স্মৃতির জোচ্চুরি নিয়ে সমাজটা চলে
ভাবছে ম্যাজিক হবে হাপিত্তেশ করে ।
সত্য বলছে আত্তিলা, কিন্তু মনে রেখো
উনি আর ওনার লোকেরা কাঁচা মাংস
খেতে ভালোবাসে । স্নান করবার প্রথা
এমনকী গরমেও ছোঁচাবার প্রথা
ওনার রাজত্বে নেই । জলের অভাব
আছে তোমাদের দেশে ; তার সমাধান
এতে হবে । খাবার সুরাহা হবে । বিয়ে
দিতে হবেনাকো মেয়েদের । পোশাকের
খরচ বাঁচবে । জনসংখ্যা কমে যাবে ।
এনার শিরায় বয় কংসের পুঁজ ।
পারছ বুঝতে তো আমার খচ্চরও
তোমাদের চেয়ে কত জ্ঞানী ও বিদ্বান !
উঁহু চলবে না ; অমন জোকারচাঁদ
আছে আমাদের ভূঁয়ে প্রদেশে-প্রদেশে ;
তাদের সামনে খোকা তুমি চুনোপুঁটি ।
তারাও ধর্ষণ রাহাজানি লুটপাট
করতে ওস্তাদ বলে আমরা বিরক্ত ;
তাছাড়া সবাই ওরা সংবিধান মেনে
তাবৎ জোকারি করে দিব্বি পার পায়
রাসকেলে ঘুষখোরে ডান-বাম নেই
ঘাপলার অন্ত নেই, কোটি-কোটি টাকা
নামিদামিদের পেনটিং সোনাদানা
সুইজারল্যাণ্ডে ভল্টে লুকিয়ে রেখেছে ।
ফুসলিয়ে মেয়েদের বাজারে চালান করে ।
তুমি চাপো ঘোড়ার ওপরে । তারা চাপে
দেঁতো হেসে সরকারি মোটরগাড়িতে
এই যা তফাত, তাছাড়া সবই এক
প্রতিদ্বন্দ্বী খচ্চরে-গুণ্ডায় দেশ ছয়লাপ ।
ওরা সব আমারই দত্তক সন্তান ;
আনন্দ পেলাম শুনে করে খাচ্ছে ওরা ।
যাই, আরো গণতন্ত্রে আছে আমন্ত্রণ ।
[ ঘোড়ার পিঠেতে চেপে উধাও হলেন
মাতিতে থুতুর দলা ফেলে আৎতিলা ।
সাঙ্গপাঙ্গদল তাঁর পেছন-পেছন
তামাকের পিচ কদমের গাছে ফেলে ।
হাততালি বাজালেন কদমের গাছ ;
বেজে ওঠে পাঙ্ক রক শীৎকারসহ ।
আবির্ভূত হল রোমের সম্রাট বুড়ো
ক্যালিগুলা নাচতে-নাচতে শিস দিয়ে
সঙ্গে তাঁর বুকখোলা যুবতীর দল
আর দুটি চেনে-বাঁধা কালো জাগুয়ার । ]
কী বলছিল আত্তিলা ব্যাটা নরাধম ?
আমার রাজত্বে গিয়ে জেনে নিতে পারো
সেখানে আমার মূর্তি হারকিউলিস
অ্যাপোলো মার্কুরি রূপে পুজো করে লোকে ।
সবাইকে চোখ বুজে দেখি, এমনকী
আমার ঘোড়াকে রাজদূত মর্যাদায়
প্রোমোট করেছি । ভাইবোন ভেদাভেদ
নেই বলে নিজের বোনের সঙ্গে শুতে
কোনো বাধা নেই । অজাচার অনাচার
আইনসঙ্গত কেননা যে আইনই
আমি । টুসকি বাজালে গলা কাটা যায়,
জেলে দিই আমার কার্টুন যদি আঁকে ।
তা এমন শান্তিস্বস্তি কেউ পারবে না
দিতে তোমাদের । আমি মহা-ধুরন্ধর ।
পাবলিক ব্যাপারটা স্রেফ জুয়াচুরি ।
পাবলিক ব্যাপারটা স্রেফ পাঁয়তাড়া ;
জীবের জগত মুছে ফেলবার ট্রিক
অপরাধহীন কোনো রাজনীতি নেই
আবিষ্কার করতে শেখাও মহাভয়
বাঁচবে কী করে প্রাণী কুবলে না খেলে !
কদমগাছ ( নারীকণ্ঠে কোরাস ) ।।
সত্য বলছেন উনি কিন্তু মনে রেখো
ক্যালিগুলা মগজবিহীন কালজয়ী ;
ওনার রাজত্বে যদি অশান্তির খোঁজ
করো, তা তোমরা পাবেনাকো । একেবারে
যাকে বলে শ্মশানের শান্তি সারাক্ষণ
অলিখিত সংবিধান ওনার জিভেতে
যে জিভ চোবানো থাকে যোনিতে মাদকে ;
অন্যের বউকে এনে ধর্ষণ করার
বিশ্ব রেকর্ড রয়েছে এই শাসকের ;
ওর হাঁ-এ বক্রাসুরী বাঁকা দাঁত আছে ।
কারেক্ট বলেছে কদমের গাছ । আমি
যা বলি তা সংবিধান । তাই সমস্যাই
নেই কোনো আমার রাজত্বে । যোনি-লিঙ্গে
বসিয়েছি সারভিস ট্যাক্স । ইতিহাস
লেখকরা ওব্দি জানে না আমার গল্প
এত রকমের চর দরবারে আছে ;
দলের কাজের লোক তারা ফি-প্রহর
কেননা আমিই দল আমি সংবিধান
বানাই যখন ইচ্ছা কিংবা পালটাই ;
তোমাদের মতো জাতিপ্রথা-মার্কা নয় ।
মিডিয়া আমার থুতু চেটে মজা পায়
ভয়ে নাগরিকগুলো টুঁশব্দ করে না ।
এই তো দেখতে পাচ্ছ কত যুবতীরা
আমার নেশায় থাকে পুরো দিলখুশ ।
পাবলিক জিনিসটা চরসের ধোঁয়া ।
আমরা এদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান
এদের নিয়তি হল হাপিত্তেশে মরা ।
সঙ্গে নিয়ে যেতে পারো তোমরা ওনাকে
অন্য কোনো প্রতিযোগী নেতা থাকবে না
ছিঁচকে চামচা-নেতা দেবে দে-চম্পট ।
কনেদের জন্যে বর খুঁজতে হবে না ।
না মা, অমন নেতার কোনো প্রয়োজন
নেই । আমরা অতিষ্ঠ তেএঁটে পাগলে,
মা-বোনের সঙ্গে শোয় এইসব নেতা
পেয়ে । খুনি ধর্ষক ডাকাত দাঙ্গাবাজ
ওরাই তো মসনদে বসে কলকাঠি
নাড়ে, দু-চারটে প্রদেশে । পাথর-মূর্তি
নিজের ও চোদ্দপুরুষের মোড়ে-পার্কে
পাঁচতলা বাড়ির সমান কাটাউট
বসিয়ে তারাও অন্ন ধ্বংস করে যাচ্ছে ;
শ্বশুর ধর্ষণ করে ছেলের বউকে
পুলিশ ধর্ষণ করে লকাপে ঢুকিয়ে
যার ফলে হারামি বিয়োয় ফি-বছর ।
সেসব হারামি একজন আরেকের
পোঁদে বাঁশ কোরে, কুকুর-কুরি ঢঙে
ঘেউ-ঘেউ চিৎকারে সমাবেশ করে
কখনো রাস্তার মোড়ে গেটে ময়দানে ।
আমরা তো শান্তি চাই, দুইবেলা পেট
ভরে খেয়ে-পরে আরাম শৃঙ্খলা চাই ।
ওরা সব আমারই জারজ সন্তান ;
আনন্দ পেলাম শুনে করে খাচ্ছে ওরা ।
চলি, আরো গণতন্ত্রে বহু কাজ আছে ।
[ নাচতে-নাচতে শিস দিয়ে হাফ-ল্যাংটো
মেয়েদের কোমর জড়িয়ে অন্তর্ধান
করলেন ক্যালিগুলা । কদমের গাছ
হাততালি দিলেন এবার জোরে-জোরে ।
গলায় খুলির মালা পরে কয়েকটা
হাড়গিলে মানুষকে হাতকড়া বেঁধে
প্রবেশ করল পলপট, জলপাই
রঙের পোশাকে । সামরিক বাজনার
জগঝম্প হইচই ওঠে চারিদিকে । ]
দেখলুম ক্যালিগুলা উন্মাদ কাঁহিকা
গেল ওইদিকে কোনো মাগির ধান্দায় ;
তা তোমরা খুঁজছ এমন একজন
যে কিনা শৃঙ্খলা শান্তি সুখ এনে দেবে ।