ধা রা বা হি ক উ প ন্যা স
বাউল রাজা
প্রদীপ গুপ্ত
দ্বিতীয় খন্ড ( ত্রয়োবিংশ পর্ব )
আমি এ জীবনে নানান জুটির নানা ধরণের অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে একে অন্যকে আদর করতে দেখেছি -- সে চলচ্চিত্রই হোক অথবা বাস্তব জীবনে। কিন্তু এতো সুন্দর একটা অপার্থিব অন্তরঙ্গতার দৃশ্য আমি আমার সারা জীবনেও দেখিনি। আনন্দ - দুঃখ, হাসি - কান্নার দোলায় দুলতে থাকা দুটো মূর্তি আমার চোখের সামনে প্রকট হয়ে উঠলো। আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম, এক অনির্বচনীয় ঐশ্বরিক প্রেমের যুগলমূর্তির ছবি। আমি বাউলদিদির চোখের তারায় আমার কৃষ্ণরূপ দেখে হয়তো আহ্লাদিত হয়েছিলাম। আমার সেই আহ্লাদের অনুভূতিকে ম্লান করে দেওয়ার জন্যই কিনা জানি না, আমি এই মুহূর্তে যে যুগলমূর্তি দেখছি সেই মূর্তির দুই চরিত্রের যে একজন রাধা আর অন্যজন অবশ্যই কৃষ্ণ, এ বিষয়ে কোনোরকম সন্দেহের অবকাশ নেই। অবশেষে ওরা যখন ফের নিজরূপে ফিরে এলেন, তখন বারান্দায় ধোঁয়া ছড়ানো লম্ফটার কম্পমানতা আর নেই, তার শিখা স্থির। সেই স্থির শিখায় আমি এমন এক পরিপূর্ণ খুশীর হাসি দেখতে পেলাম ওদের মুখমন্ডলে, যে সেই খুশী যে এই পৃথিবীর বুক থেকে আহরিত নয়, সেটার সাক্ষী যে থেকেছে সে ছাড়া অন্য কারও অনুধাবন করা অসম্ভব।
-- " তুমি তো জানো পদীপবাবু, কিষ্ণকে আমি যকন জয়দেবের মেলায় খুঁজে পেলাম, আমি তকন পূন্ন যুবক আর সে মাটির সাতে কতা বলচে। সে গটনার বচর দুয়েক আগে আমার আচ্ছয় দেওয়া বাবা দেহ রেকেচেন। যাওয়ার আগে তিনি আমাকে একটা কতাই বলে গেচিলেন, -- যেহেতু আমি তোমাকে দীক্কা দেইনি, তাই তুমি অন্যান্য দীক্কিতদের মতো বিবাহ কত্তে পারবে না, তুমি কণ্টিবদলও করবে না, তোমাকে অয়তো সিন্দুদান কত্তে অবে। "
কানাইদা কন্ঠিবদল নিয়ে কথা বলতে আমার মনে পড়লো, আমি বাউলদিদিকে ওদের বিবাহ সম্পর্কিত লোকাচারের বিষয়ে জানতে চেয়ে কন্ঠিবদল সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলাম। কৃষ্ণভামা তখন নিজের অপারগতার কথা জানিয়েছিলো। কানাইদা সেই দায়বদ্ধতা থেকেই নিশ্চয়ই এ প্রসঙ্গকে উপস্থাপিত করছেন।
--" বাউল সমাজে বিয়ের অনেক আচারবিদি আচে গো, ফুল, চন্দন, তুলসী আর গঙ্গাজল দে সাদুগুরু দু'হাত এক কইরে দেন। সাদুগুরু পাত্তপাত্তির গলায় মালা পইরে দিয়ে চন্দনের টিপ পইরে দেন দু'জনাকে। ব্যাস, অয়ে গেলো বিয়ে, যাদের বিয়েতে সাদুগুরু তাকতে পারে না, তারা কোনও মেলায় বা মোচ্চবে কন্টিবদল কইরে নেন। আসলে এই রীতি অলোগে বোষ্টোম বোষ্টুমিদের তেকে এয়েচে। বাউলদের রীতিনীতি অনেকটাই বোষ্টোমদের তেকে নেওয়া। এরা তো ওদেরই অংশ চিলো গো। "
সত্যি বলতে কি, বাউল গোষ্ঠী সম্পর্কে আমার কোনোরকম কিছুই জানা নেই। এদের মনমাতানো গান, রঙচঙে পোষাক, একতারা আর খমকের মতো সুরেলা বাদ্যযন্ত্রই আমাদের এদের দিকে টেনে আনে। কিন্তু এদের সমাজ, এদের রীতিনীতি, আচার অনুষ্ঠান এসব সম্পর্কে আমরা ক’জনই বা কতোটুকু জানি?
--" আমার পালকপিতা লিচ্চয় জানতেন যে, আমি কিষ্ণা কে কুইড়ে পাবো। একন কেন জানি না মনে লয় তিনিই বুজি সব ব্যবস্তা কইরে রেকে গেচিলেন। নইলে আমাকে সিন্দুদানের পরামশ্য দে যাপেন কেন? "
--" সিন্ধুদান বিষয়টা কী গো কানাইদা? "
--" দ্যাকো, বিবায়িত মানুষের কাচে মনের সাতে ঘর বাঁদে শরীল। মন মনের সাতে, মনের ওপর যতই নিভভর করুক না কেন, শরীলেরও একটা পাধান্য তেকেই যায়। তবে অবশ্যি পকিত বাউল যিনি, তিনি তো তার আপন দেহেই নারী পুরুষের সহাবস্তান করাতে জানেন। সেক্কেত্তে শরীল তার কাচে মুক্য বিষয় না ওলেও, ইচ্চের আদার। সবসুময়তেই যে সুক্ক কামবাবে যাপন করবেন সে তো নাও ওতে পারে, যকন স্তুল কামবাবে তিনি কাবু, তকন তো সেই শরীলই তার কাচে মুক্ক ওয়ে দাঁড়াবে। "
উফ কি অসম্ভব বিশ্লেষণ! যেন কথা বলছেন না, এই মূহুর্তে তিনি যেন একজন শিল্পী, কথা দিয়ে ছবি আঁকছেন।
---" কিন্তু সিন্দুদান তোমাকে সে অদিকার দেয় নি গো, শরীলকে নে কোনোরকম চাওয়া পাওয়া সেকেনে শুদু অন্যায় না গো, অধম্য। যকনই তোমার মনে তোমার গহণ করা বাউলনির শরীলকে কামবাবে স্পশ্য করবে, তকনই তুমি বাউল দম্মো তেকে পতিত ওলে।
তিনি লিচ্চয় জানতেন গো, যে কিষ্ণাকেই আমার সাদনার আদার কইরে গইড়ে তুইলতে অপে। আমার মেয়ের বয়সী, আমার নিজির আতে বড়ো কইরে তোলা মেয়েটিকে আমার সাদনসঙ্গিনী কইরে নিতি অপে, এটা তার অগোচরে চিলো না গো পদীপদাদা, এ জন্যই তিনি আমার ওপর বিদিনিষেদ দে গেচেন। খপরদার, নিজের কন্যাকে সাদনসঙ্গিনী কইরে নিতি পারো, কিন্তুক শরীলের ওপর নজর দিতি পারবা না। "
কৃষ্ণভামার দিকে নজর পড়লো। দেখলাম একজন অপাপবিদ্ধা অনূঢ়া বিবাহিতা কন্যা, তার অমাবস্যার মতো আলুলায়িত কেশরাশির আড়ালে মুখ ঢেকে মাটির দিকে মুখ করে বসে আছে। হঠাৎ যেন মনে হলো, সেই কন্যার লজ্জাশীলা দুটো চোখ আমার চোখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে আঁতিপাঁতি করে কিছু খুঁজছে। এখনও সেই দৃষ্টির কথা মনে হলেই মনে হয় -- সেদিন সেই বাউলনি কি খুঁজে ফিরছিলো -- আশ্রয়?
( চলবে )