সমাধি
অয়ন্তী সাহা
***
এই কবন্ধের মধ্যে আমার শ্বাসরোধ হয়ে যাচ্ছে। শুকনো পাতায় একটা খসখস শব্দ হচ্ছে। কেউ যেন আস্তে আস্তে এই সমাধির দিকেই এগিয়ে আসছে।" কে ইনি ?" স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে না। এটা তো আমার বাবা। ওঁনার হাতে একগুচ্ছ গোলাপ আর একটা চিঠি। উনি এখানে!!! অবন্তীকা চরম আশ্চর্যিত হয়। কিন্তু ওঁনার মুখমন্ডল এত শুষ্ক আর বিবর্ণ কেন ? দেখে মনে হচ্ছে, বহুদিন ধরে কিছু খাবার খাননি। শরীরটা আছে কিন্তু প্রান নেই। উনি শুষ্ক গলায় বলছেন, "আমি তোর বাবা ছিলাম না হয়তো কিন্তু তোকে আমি নিজের মেয়ের মতোই ভালোবেসেছি।অপরাধটা আমি কী করেছিলাম যে তুই আমায় এত বড়ো শাস্তি দিলি ? "কন্ঠস্বর ভেঙে আসছে রফিকবাবুর। তিনি আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারলেন না। তিনি বললেন, "আমি তোকে আজ তোর জীবনের সবচেয়ে বড়ো সত্যিটা বলতে যাচ্ছি। তুই আমাদের সন্তান না। আমি অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। সেদিন আকাশ মেঘে ঢেকে আসছিলো, আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছিলাম। তখন দেখলাম, নর্দমার পাশে একটা শিশু কাঁদছিলো। আমি তাকে কোলে নিতেই সে আমার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকালো আমি আর তাকে ফেলে আসতে পারিনি। সেই শিশুটি আর কেউ না তুই ছিলিস"। এই বলে উনি আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারলেন না হৃদয় বিদারক শব্দে আর্তনাদ করতে শুরু করলেন। হঠাৎই অবন্তিকার ঘুম ভাঙতেই তার বাবা বললেন,"শুভ জন্মদিনের অনেক অনেক ভালোবাসা"। বাবার হাতের একগুচ্ছ গোলাপ দেখলো সে। রুদ্ধশ্বাসে অবন্তীকা তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করলো," বাবা বলোনা আমি তোমারই মেয়ে"। রফিকবাবুর হাসিমুখ যেন মূহুর্তে বিবর্ণ হয়ে গেল। অবন্তীকা মনে মনে খুব দুঃখ পেল। সে বুঝতে পারলো তার বাবার নিরবতাই প্রমাণ করছে কথাটা সত্যি। রাগে, দুঃখে আর অভিমানের ঘনায়মান মেঘকে মনের মধ্যে পুঞ্জীভূত রাখতে না পেরে সে তার প্রিয় গাড়িটিকে নিয়ে বাড়ি থেকে চলে গেল। ফুটপাতের বাচ্চাদের অবস্থা সে এটা বুঝতে পারল যে, যদি তার জীবনে রফিকবাবু পিতারূপে এবং সাবিনা বেগমকে মারূপে না আসতেন তাহলে তার স্থান হতো কোনো অনাথ আশ্রমে। এমনকি নিজেদের সুখের কথা না ভেবে তারা তো তাকে কোনো কষ্টের আঁচ তার গায়ে লাগতে দেয়নি। তাদের আজ সে নিজে তার বাবা-মাকে কষ্ট দিচ্ছে এটা কী উচিত??? এই ভাবতে ভাবতে সে অব্যক্ত কথাগুলো মুখে না বলে তার মা-বাবার উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লিখলো। চিঠিটা হাতে রেখে গাড়িটি চালিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছতে গিয়ে ঘটে গেল সেই দুর্ঘটনাটা। অন্যদিক থেকে আসা একটা লরি ধাক্কা দিল অবন্তিকার গাড়িটাকে। রক্তাক্ত চিঠিটা উদ্ধার হলেও রফিকবাবু সারাজীবনের মতো হারিয়ে ফেললো অবন্তিকাকে।