কবি প্রদীপ গুপ্ত |
কবি প্রদীপ গুপ্ত
কবি প্রদীপ গুপ্তের ছিন্নমূল উদ্বাস্তু পরিবারে জন্ম। ওপার বাংলার ঢাকা লাগোয়া বিক্রমপুরের টঙ্গী পিতৃপুরুষের বাসভূমি। পিতা একজন আদর্শবাদী শিক্ষক, স্বাধীনতা আন্দোলনে দীর্ঘ বারো বছর কারান্তরালে ছিলেন। ছিলেন ঢাকা কমিউনিস্ট পার্টির একজন সর্বক্ষণের কর্মী।
বাবার হাত ধরেই বাল্যকাল থেকে জীবনকে দেখেছেন কবি। পরিচিত হয়েছেন গ্রাম ও শহরের প্রান্তিক ও নিরন্ন মানুষজনের সাথে। ঘুরে বেড়িয়েছেন পশ্চিমবাংলার কোণায় কোণায়। ঝাড়খণ্ড, বিহার উড়িষ্যায়।
মানুষকে ঘরে বসে আবিষ্কার করতে হয় নি। মানুষের সাথে থেকে লক্ষ্য করেছেন তাদের রোজনামচা।
তাই প্রেমে ও প্রতিজ্ঞায় তার লেখাগুলো হয়ে উঠেছে বাস্তব জীবনের আখ্যান। পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ, তিনটি গল্প সংকলন ও দুটি উপন্যাসে তাই ঘুরেফিরে এসেছে জীবনের কথা। বর্তমানে তিনি বিখ্যাত 'যুগ সাগ্নিক' পত্রিকার সাধারণ সম্পাদক ।
কবি প্রদীপ গুপ্তের সাম্প্রতিক কালের কিছু কবিতা প্রকাশ করা হল :
জন্মদিনের ভাবনারা
***
রূপোলী স্মৃতি আর সোনালি স্বপ্ন
এ দুয়ের মধ্যে যে টলমলে সাঁকো
সেটা বেয়ে চলে যায় জীবন।
সোনালি আর রূপোলী রঙের মিশেলে
বুঝি প্যালেটের বুক কালো হয়ে যায়।
এতো অন্ধকারের আয়োজন কেন?
চারিপাশে!
তাহলে বুঝি স্বপ্নেরা বাসা বাঁধেনি
পাকা ফসলের ক্ষেতে!
অথবা
গোলায় তোলে নি সে পৌষের ধান - চাষি।
কিন্তু যে কৃষক সারাগায়ে কাদা মেখে
বীজ পুঁতেছিলো! ভেবেছিলো পুঁতেছিলো!
সারা মুখে মেখেছিলো হাসি।
দ্যাখো – কতগুলো স্বেত ডানা উড়ে যায় -
অন্ধকার আর অন্ধকার থাকে না।
মহাজন এসে সাঁকোটা নাড়ায়।
শব্দ জন্ম
***
একটা ভলকানো শরীর
উচাটন মন
ভেজা চুল
তিনদিক খোলা ব্যালকনি
আর বৃষ্টি।
এটা নিয়েই একটা দিব্যি কবিতা হতে পারতো।
মনে মনে দিন তিনেক ধরে
বেশ গুছিয়ে এনেছিলাম
লেখাটা।
বাদ সাধলো একটা চড়ুইপাখি।
সর্বাঙ্গ ভেজা,
পাখিটা।
" তুমি যেটাকে পদ্ম বলে ভেবেছিলে
সেটা আসলে পদ্ম নয়
শাপলার ফুল।"
কী সর্বনাশ।
ও কী করে জানলো যে আমি এরপরের লাইনটাই
শুরু করতে চাইছিলাম,
ব্যালকনির সামনের জলাটায়
একা একা ভিজে চলেছে
একটা কিশোরীপদ্ম।
তার অর্ধস্ফুট কমলকলি থেকে
সবে তিনটে নৌকোর মতো
পাঁপড়িতে ধরে রেখেছে…
কাঁধের থেকে চড়ুইটাকে হাতের তালুতে নিয়ে
পরম যত্নে ওর পালকগুলিকে
শুকিয়ে তুলতে শুরু করলাম।
আমার আর কবিতা লেখা হলো না।
মানুষটা...
***
তোমার এক একটি আঁখি পল্লব
এক একটা ছোট গল্পের প্রচ্ছদ
এক ফোঁটা অশ্রু বিন্দু
লিখে যায় উপন্যাস
তোমার ঠোঁটের তিরতির কাঁপনে
লেখা হয় পৃথিবীর দীর্ঘতম কবিতা।
ঝিঝি পোকার একটানা পাখা ঘষার আওয়াজে
আমার ঘুম পায়।
আমি বুঝতে পারি,
এই শব্দ আসলে আমার কলম ভাঙার আর্তনাদ।
স্যালাইনের বোতল, অক্সিমাস্ক, আর একটা বিপবিপ আওয়াজ
একটা খাতা নিয়ে এগিয়ে আসে
শেষের পাতায়
অনেক হিজিবিজির পর
একটা লম্বা লাইন টানা।
লাইনের পর দুটো সংখ্যা
একটা স্টেথোস্কোপ বুকের ওপর চেপে ধরে
কে একজন এসে বলে গেলো
এই সংখ্যাদুটোর যোগফল
ভালোবাসা,
ঘৃণা, রাগ, অভিমান এসবের হিসেব চলছে।
তোমার ভ্রুপল্লব, অশ্রু, আর ঠোঁটের কাঁপনের দিকে
হুমড়ি খেয়ে তাকিয়ে আছে সবাই।
সম্পূর্ণ যোগফলটা যে কী হবে!
মানুষটা কিন্তু আসলে...
!
!
!
এসো একটা ঝড় তুলে যাই
***
আর কতো অসহায় শিশু নিহত হলে
মানুষ সত্যিকারের মানবিক হবে!
আর কতো মানুষ অনাহারে মারা গেলে
গমের ক্ষেত জুড়ে হেসে উঠবে সোনালী সূর্যের আভা?
আর কতোবার বন্দুকের নল ধোঁয়া ছড়ালে
যুদ্ধ শেষে নেমে আসবে শান্তির বারিধারা!
আর কতো মায়ের ক্রন্দন শেষে হে পৃথিবী
সন্তানহারা জননীর কোল ভরে উঠবে স্বপ্নের খুশীতে?
আর কতো বসন্ত পুষ্পহীন কাটালে
সাফল্যে ভরবে এক পুষ্পরেণু ভরা মানবজীবন!
আর কতো মহাসাগর পাড়ি দিলে পাখি
বাঁধতে পারবে সোহাগি নীড় বালুকাবেলায়?
আর কত যুগ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকলে
সমুদ্র এসে ধুয়ে দেবে তোমার পায়ের পাতা!
এসব প্রশ্নের উত্তর জানে অদৃশ্য বিভেদের কাটাতার
সবটাই জানে তোমরা যাকে নির্মল আলো বলে জানো!
এসো, একটা ঝড় তুলে যাই। শেষ ঝড়।
যাওয়ার আগে এসো কোমড় বেঁধে তৈরি হই।
একটা তুমুল ঝড় তুলে যাই এসো
একটা তুমুল ঝড়।
ভ্যাক্সিন
***
তোমার কি কখনো খিদে পায়… সুরঞ্জনা!
না, সুগন্ধের খিদে নয়, নয় অন্য কোনো
প্রিয় ভালোবাসার অনুভবের অফুরন্ত অভাববোধ !
আমি তোমাকে প্রিয় মিলনের খিদের কথাও
জিজ্ঞাসা করিনি।
নিতান্তই বেঁচে থাকার জন্য যে জাগতিক অনল,
সেই জঠরের জ্বালাময়ী খিদে?
খালি পেটে ঢকঢক করে জল পান করেছো কখনও!
হায়রে, ওরা যে জলও পায়নি
এমন ভাবেও কেটেছে কতদিন!
পৃথিবীর সবচাইতে ঘৃণ্য ভাইরাসের নাম ক্ষুধা --
আর সবচাইতে প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিনের নাম -- খাবার।
বিরিয়ানির মহার্ঘ গন্ধের দরকার নেই,
দরকার নেই কাবাবের গনগনে লাল মাংসল টুকরোর।
একমুঠো বজরা বা উইলোর দানাও যে কতোটাই
মহার্ঘ হতে পারে!
কঁকিয়ে উঠলে কেন?
দিনে প্রায় আট হাজার আবালবৃদ্ধবনিতা
মাটির আঁধারের অথবা লেলিহান আগুনের খাদ্য হয় রোজ।
এ পৃথিবীর কোনো দায় নেই ওদের বাঁচানোর,
দিনে আট হলে বছরে কত হয় যেন?
উনত্রিশ লক্ষ সহ নাগরিক।
অভুক্ত, হাড়পাঁজরা বের করে নিজেকে
শকুনের খাদ্য করে তোলে।
আমরাও কি শকুন হয়ে যাচ্ছি --- ক্রমশ ক্রমশ!
এসো, একটাদিন অন্তত করোনাকে দূরে ফেলে রেখে
গরম ভাতের ভ্যাক্সিনের কথা ভাবি!
আহা--রে না বলে
এসো না আহারের গল্প করি আগুনখেকোদের সাথে।
মুক্ত করো ভয়
***
তার চাইতে এসো ফুলের কথা বলি।
এতো রঙ দেখিনি কোথাও।
রামধনুতেও শুধু পরিষ্কার সাত রঙ ছাড়া
কোনও মেলানো মেশানো রঙ নেই
কিন্তু এই যে বাগান ভরে থাকা ফুল
ওরা যে কীভাবে মিশিয়ে নেয় রঙ!
হলুদে সবুজে, লালে আর বেগুনি রঙের সাথে
কোন প্যাস্টেলে মিশিয়ে নেয় রঙ
আমি অবাক হয়ে দেখে যাই শুধু
ইচ্ছে হয় প্রজাপতি হই।
ওদের রেণুর থেকে রঙ মেখে নিয়ে
ফের উড়ে যাই অন্য বাগানে।
তার চাইতে এসো পাখীর কথা বলি।
এতো সুর শুনিনি কখনও।
কোথায় যে খুঁজে পায় ওরা এতো সুর!
কতো রাগ, কতো যে রাগিনি বাসা বেঁধে আছে
ওদের গলায়!
কখন যে গলা সাধে ওরা!
বসে পড়ে এখানে সেখানে, ঘন পাতার বুকে বসে
শুরু করে দেয় আনন্দ আসর!
সাথে বাঁশি লাগেনা, লাগেনা,তানপুরায় তানের বিস্তার,
সারেঙ্গী বা তবলার ঠেকা!
আপন মনে ছড়িয়ে দেয় সুর - উদারা মুদারা তারায়।
তার চাইতে না হয় এসো নদীর কথা বলি
এতো আনন্দ যে কোত্থেকে খুঁজে পায় সে
সারাটাদিন পায়ে নূপুর বেঁধে নেচে নেচে চলা।
আনন্দে উপচে উঠে ভাসিয়ে দেয় কুল।
বুক ভরে ভরিয়ে তোলে সুর -- ভাটিয়ালির।
ছলাৎ ছলাৎ করে গেয়ে চলে গান -- অবিরাম!
চলো, আনন্দে বাঁচতে শিখি।
দু'বেলা মরার আগে না মরে
এসো লড়তে শিখি।
ভালোবাসার মন্ত্রে।
তুলি – কলম
***
চোখে চশমা পরেও, কিছু গর্ভ পাতের ছবি আঁকবো বলে
অন্ধকার বিছানার গর্ভ হাতড়ে চশমা খুঁজে চলি।
পেটের থেকে একটা শকুন উড়ে গিয়ে
ক্ষয়া ক্ষয়া চাঁদ হয়ে যায় ক্রমশ
বেসিনের বুক পেট ভরে ওঠে
অন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসা
বদহজমি খাদ্যে।
আর কফে।
ঘোর ধরা
মাথার ভেতরে
একটা দোতারার সুরে
কে যেন গেয়ে উঠতে চায়
ট্রেনের বগিতে গাওয়া অন্ধ সংগীত।
ক্রমাগত উথলে ওঠা বমির দমকের মাঝে
ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের ডানার শনশন শব্দের গভীরে
আমি বুঝতে পারি আমার কলম তুলি হয়ে ওঠেনি এখনো।
আসা যাওয়া
***
নিজের থেকে বেরিয়ে যেতেই হবে একদিন
এই নিত্যদিনের সংসার থেকেও জানি।
তবে রিক্তহাতে যাবো না কিছুতেই।
ডালিভরে চয়ন করেছি যে শিউলির ফুল
অথবা টগর,
কাঞ্চন, অপরাজিতা
শ্বেতপদ্ম কলি
সেসব নিয়ে যাবো।
ভেবেছিলাম বুঝি থরে থরে নিবেদন করেছি নৈবেদ্য
দেবতার পায়ে,
আজ বুঝি, যে দেবতা অন্তরতম নন
তাঁর কোনো অধিকার ছিলো না
নিবেদিত প্রেমকে গ্রহন করার।
আর অন্তরের দেবতা -- সে তো আমিই!
লাল শালুতে মুড়ে
সে শালগ্রামশিলাও নিয়ে যাবো সাথে।
তবু,
সব কিছু কি আর নিয়ে যাওয়া যায়!
ভালোবাসাগুলো পাথর হয়ে থেকে যায় অনন্তকাল।
বেঁধে রাখে বুঝি!
হয়তোবা ফিরিয়ে আনে ফের।
ভালোবেসে।
বহুকিছু, বহুকিছু জানি।
ভাবি বুঝি -- জানি,
আসলে --
জীবনকেই বা কতটুকু জেনেছি বলো!
আমার আমিকেই বা!
খোঁজ
***
সেই মানুষটার খোঁজে আছি
যে মানুষটা খোলা বাজারে মাংস বিক্রি করতো।
সেই মানুষটার খোঁজে আছি
যে মানুষটা চাররাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে মাংস কাটতো।
প্রথম মানুষটাকে লোকে কষাই বলে জানে
আর দ্বিতীয় মানুষটাকে রাজনীতিবিদ।
সেই মানুষটার খোঁজে আছি
যে মানুষটা সারাগায়ে রক্ত মেখে ঘরে এসে বলতো
– বৌ ভাত দে।
সেই মানুষটার খোঁজে আছি
যে মানুষটা গায়ের রক্ত ধুয়ে মাইকে দাঁড়িয়ে বলতো
– আমাকে ভোট দে
প্রথম মানুষটাকে লোকে কষাই বলে জানে
আর দ্বিতীয় মানুষটাকে নেতা।
সেই মানুষটার খোঁজে আছি
যে মানুষটার পেটে বড় খিদে
আর সেই খিদের জ্বালায় গায়ে ছিটকে আসে জান্তব রক্ত।
সেই মানুষটার খোঁজে আছি
যে মানুষটার মনে বড় খিদে
আর সেই খিদের জ্বালায় গায়ে ছিটকে আসে… রক্ত।
প্রথম মানুষটাকে লোকে কষাই বলে জানে
আর দ্বিতীয় মানুষটাকে ---" মানুষ "!
মহাজীবনের গান
***
বুনো ঘোড়াকে পোষ মানাতে শিখিয়েছে জীবন।
অন্ধকার ঢেউয়ের মাথায় ফসফরাসের মতো
জ্বলতে জ্বলতে নাচতে শিখিয়েছে জীবন।
পাথরে পাথরে ঘষে আগুন জ্বালতে শিখিয়েছে জীবন।
জীবনকে ভালোবাসতেও সেই শিখিয়েছে।
বুনো বাঘের মুখের ভেতর
তুমি হাত ঢুকিয়ে দিয়েছো অবলীলায়।
লাফ দিয়েছো অগ্নিবলয়ের ভেতর অনায়াসে।
একের পর এক আশ্চর্যের জন্ম দিয়েছো তুমি।
মঙ্গলগ্রহকে এনে বসিয়েছো ড্রয়িংরুমে।
চাঁদের চরকার সুতোয় বুনেছো সভ্যতার বিজয়কেতন।
তোমাকে চোখ রাঙিয়ে কেউ জিততে পারেনি।
পারেনি কারণ তোমার ভালোবাসার কাছে
মৃত্যু এসে মাথা নত করেছে বারংবার।
এক যুগ থেকে যুগান্তরে বপন করেছো
ভালোবাসার বীজ।
এ মহামারি আর যাই হোক প্রেমের বাহক নয়।
যে প্রেমের বার্তা বয়ে নিয়ে চলে জীবন সারাটা জীবন জুড়ে।
কবির প্রকাশিত গ্রন্থ সমূহ :
সংখ্যা. | কাব্যগ্রন্থ | গল্প সংকলন | উপন্যাস |
---|---|---|---|
১. | আমি কি যাবো না বলেছি ( ২০১৭, ২য় সংস্করণ ২০১৮) | নুলিয়া ও অন্যান্য ( ২০১৬, ২য় সংস্করণ ২০১৮) | বাউল রাজা ( ২০১৯, ২০১৯ এই দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে) |
২. | যদি অনুমতি দাও ( ২০১৮, ২য় সংস্করণ ২০১৮ ) | যত্তসব পাগলের কথা ( ২০১৭, ৩য় সংস্করণ ২০১৯) | |
৩. | গহীন গহন ( ২০১৮) | শীতের সকাল ও পরকীয়া প্রেম ( ২০১৮) | |
৪. | তুমি ও বৃক্ষজীবন ( ২০১৯) | ||
৫. | এই তো জীবন কালীদা ( ২০২০) |
Tags:
আজকের কবি