কবি নির্মাল্য বিশ্বাস
কবি নির্মাল্য বিশ্বাসের জন্ম কলকাতার বাগবাজারে। ১৯৯৬ সালে ইসক্রা পত্রিকায় ছোটগল্প লিখে সাহিত্য জগতে পদার্পণ। লেখকের প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ 'মন দরিয়ার মাঝি' ও 'ঋতুবদল' এবং প্রকাশিত উপন্যাস 'উপহার', 'দুইমুখ', 'ডায়েরির শেষ পাতা'। লেখক বর্তমানে 'রেওয়া' পত্রিকার সম্পাদনার কাজে যুক্ত আছেন ।
কবি নির্মাল্য বিশ্বাসের একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশ করা হল :
বধূ কোন আলো লাগলো চোখে
***
অতঃপর মেঘ আসে সুনামির বার্তা নিয়ে। সমুদ্রের বুকে উইঢিপির মতো মাথা উঁচিয়ে থাকা যে দ্বীপজোড়া নোনাবালি মেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল, তারাও নারকেলপাতার ছাউনি সরিয়ে প্রেমের জবাকুসুম আলো মাখে। এ আলোয় তাপ নেই, উত্তাপ নেই, শুধু দু-চোখ ভরা স্নিগ্ধতার প্রশান্তি। নিস্তরঙ্গ সমুদ্রে তখন ঢেউয়ের প্লাবন। এ সমুদ্রে নাব্যতা কম। তাই জাহাজ ভেড়ে না কখনও।
দ্বীপান্তরের নির্বাসন ছাড়া এ দ্বীপে আলোরও প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবু কোনো এক হালভাঙা নাবিক পথভোলা পথিকের বেশে এ দ্বীপে পা ছোঁয়ালে পশ্চিমের আকাশ উল্টে দেয় বৃষ্টির পেয়ালা। মেঘের আড়াল থেকে কেউ ছুঁড়ে দেয় বিদ্যুতের শক্তিশেল। জাহাজডুবির পর ছইয়ের ভিতর যে মন দু-হাত বাড়িয়ে ধরতে চেয়েছে আলোর ঠিকানা, সেও তখন দিকভ্রষ্ট নাবিক। পশ্চিমি ঝঞ্ঝা তাকে নিয়ে গেছে মৃত্যুর কারাগারে। এ কী নিয়তির দুর্লঙ্ঘ খেলা৷ নৌকার ভাঙা পাটাতন এলোমোলো ঢেউয়ে দ্বীপের নাগাল এড়িয়ে ভাসছে ডুবছে। জোছনাখচিত চাঁদোয়া দেখছে নৌকাডুবির শোকে একজোড়া দ্বীপ কীভাবে ডুবে যাচ্ছে সমুদ্রের গভীরে, আরো গভীরে। আকাশ আর সমুদ্র বেদনার নীল রঙে মিলেমিশে ঘননীল হয়ে উঠছে।
রাখীবন্ধন
***
বৃষ্টি ভেজা আনন্দমুখর দিনে,
চেয়ে আছে বোন খোলা জানলায়।
দাদার আসবার কথা ছিল আজ,
মন কাঁদে তারই অপেক্ষায়।
দাদা গিয়েছে যুদ্ধে,
নেই তার মনে কোন ভয়;
ফিরবে কী ঘরে ছেলে?
মা'র মনে বড় সংশয়!
বোন বেঁধেছিল রাখী পরম যত্নে
পরাক্রান্ত দাদার হাতে।
মনে স্থির বিশ্বাস- এ রাখী বাঁচাবে
জীবনের ঘাত- প্রতিঘাতে।
তবু শ্রাবণ নেমেছে বোনের
শান্ত দীঘির মত চোখে,
মরণ কী নিয়ে গেছে তবে
কোন এক অমর্ত্যলোকে?
অবশেষে বীরদর্পে এল দাদা,
মুখে তার বিজয়ীর হাসি;
বোনের চিবুক ধরে বলে-
'তোকে বড্ড ভালবাসি'।
সোহাগিনী বোন, বৃষ্টি ভেজা মন
অশ্রুসজল তার আঁখি;
দাদা বলল- 'কাঁদবি পরে,
আগে তো পরা রাখী।'
স্বাধীনতা আর একটি স্ট্যাচু
***
পিঠে তিয়াত্তরটা চাবুক পড়েছিল ছেলেটার।
ব্রিটিশদের অস্ত্রাগার লুঠ করে ধরা পড়েছিল
কোন এক স্বদেশীর বিশ্বাসঘাতকতায়।
অত্যাচারী ব্রিটিশ ক্রুর হাস্যে প্রশ্ন করেছিল- 'কী নাম?'
নির্বিকার চিত্তে ছেলেটি বলেছিল- 'সূর্য'।
ক্রুদ্ধ ব্রিটিশের তর্জন- 'বাবার নাম কী?'
স্মিত হাস্যে ছেলেটির জবাব- 'স্বদেশ'।
আরো এক রণহুঙ্কারে সাম্রাজ্যবাদী আস্ফালন- 'মায়ের নাম কী?'
শান্ত, স্থিতধী সূর্য রুদ্র তেজে বলেছিল- 'ভারতমাতা।'
সপাটে আছড়ে পড়া চাবুক মিশ্রিত প্রশ্ন-
'কারা কারা ছিল সঙ্গে?'
অকুতোভয় সূর্যের তেজদীপ্ত উক্তি- 'সমগ্র ভারতবাসী।'
সেদিনের ছেলেটা স্ট্যাচু হয়ে গেছে তেমাথার মোড়ে;
স্থির, নির্বাক প্রস্তরমূর্তি।
চারপাশে বেড়ে ওঠা আকাশছোঁয়া অট্টালিকা
এখন আড়াল করে দেয় সূর্যের আলো।
কেউ জানতেও পারে না পিঠে তিয়াত্তরটা চাবুক খেয়েছিল ছেলেটা।
অযত্নে, অবহেলায় একটু একটু করে ভাঙতে থাকে সূর্য।
প্রতিটা স্বাধীনতা দিবস আসে আর
সূর্যের শরীর থেকে খসে পড়ে একটা একটা পাথর।
ম্লান, মৌনমুখে সূর্য চেয়ে থাকে অস্তাচলের প্রতীক্ষায়।
ব্রিটিশদের অস্ত্রাগার লুঠ করে
দেশের বিজয়পতাকা তুলেছিল যে সূর্য
সেই স্বাধীন দেশে নির্বাক, চলৎশক্তি রহিত হয়ে সে
মানবতার লুটতরাজ দেখে প্রতিদিন।
তিয়াত্তরটা চাবুক পিঠে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সূর্য
ফুল মালায় সুসজ্জিত হয়ে
পালন করে তিয়াত্তরতম স্বাধীনতা দিবস।
স্বপ্নলীনা
***
স্বপ্নের সাথে আমার আবাল্যের সাহচর্য,
ওকে দেখতে দেখতে কখন যে
চোখের পাতায় প্রেম নেমেছিল
সেটা আজো অজানা।
তবু যত ছুঁতে চাই
ও ততো সরে যায় দূরে।
আড়মোড়া চোখে ছেয়ে থাকে
স্বপ্ন ভাঙার যাতনা।
একদিন দেখি স্বপ্নের কোলে মাথা রেখে
নিঃশ্বাস থেমে গেছে।
স্বপ্ন ডাকছে,আমি এসেছি
চোখ মেলো স্বপ্নলীনা !
অর্কর কবিতা
***
অর্কর চাওয়া উপহারটা এখনো
দেওয়া হয়েনি।
মানুষটা কবিতা চেয়ে বলেছিল
আমার সেরাটা যেন দিই।
উত্তরে বলেছিলাম, ওটা এখনো
লেখা হয়নি।
যেদিন তোমার কাছে যাব,সেদিন পুড়তে পুড়তে নিজেই কবিতা হয়ে যাব।
আজ অর্ক চলে গেছে, যেখানে গেলে মানুষ ফেরে না কখনো।
আমি লিখতে বসেছি আমার সেরা কবিতা।
পথ
***
স্তব্ধ রেখেছি দু'কান
পথের বাঁকে
হারানো অভ্যাস.....
বুকের নীচে নিশ্চুপে বেজে চলা মুঠোফোন।
ভালোবেসে বুঝেছি পথ শুধু
হাঁটার নয়.... পাশাপাশি,
উড়ো ছাতার উচ্ছ্বাস নয়..... মাখামাখি।
টুপটাপ বৃষ্টির যখন
আঙুলে আঙুল ছোঁয় বসন্তবাতাস
পথ যেন কানাগলি।
পথ চিনতে বুঝি
পথ মানে আদর্শ, সংগ্রাম, অন্ধকারে বিদ্যুৎ,
বুঝি বা কোন অপেক্ষার শহীদবেদী।
পথ মানে চলার বাঁক,
সম্পর্কের ভাঙনকাল।
পাশাপাশি চলা পথও ভাঙে
দু'টুকরো হয় শিলাবৃষ্টির মতো।
হঋদয় আর পথ মিলেমিশে যায় দু'দিকে।
পথ এক পথভোলা পথিকের ঘরে ফেরার গল্প
কখনো বা চিরচেনা রিঙটোনের চমক -
' আজ দু'জনার দুটি পথ ওগো
দু'টি দিকে গেছে বেঁকে '।।।
জলছবি
***
'মেঘ তুমি বৃষ্টির কাছে যাও' -
আকাশের কাঁধে মাথা রেখে বলেছিল নীলাঞ্জনা।
আমি তো জন্মান্ধ ছিলাম।
বৃষ্টির বুকে কান পেতে কান্নার শব্দ শুনছি।
সেই শব্দ শুনে ছবি আঁকতে শিখেছি।
একটু একটু করে - ভালবাসার ছবি,
টুপটাপ বৃষ্টির ছবি,
আকাশ আর সেই মেয়েটার ছবি।
সেই ছবিতে দেখেছি বৃষ্টির ফোঁটা জমতে জমতে
নীলাঞ্জনার চোখ দুটো আকাশের মত নীল হয়ে ওঠে।
আর ঝোরো হাওয়ায় আমি সরে সরে যাচ্ছি
দূরে আরো দূরে, বৃষ্টির অভিমুখে।
মুক্তি
***
আকাশকে ভালবেসে যে পাখিটা চলে গেল
সে জানে না তার জন্যও কেউ সাজিয়েছিল
অনন্ত এক মহাকাশ।
বয়স বাড়লে ভালবাসাও ডানা মেলে ওড়ে,
খুঁটে খুঁটে খায় মেঘ বৃষ্টির শস্যদানা।
মেঠো পথে গায় শিকল ভাঙার গান।
শুধু বারান্দায় ঝুলতে থাকা খাঁচাটা
ফিরে আসার প্রতীক্ষায় চেয়ে থাকে।
তারপর ভাঙতে ভাঙতে একদিন
কারোর বুকের খাঁচা হয়ে যায়।
অথ তথাগত কথা
***
যদি ঔরস ভিক্ষা করো
তবে পুণর্জন্ম নাও,
সূর্য দেখার সময় আসেনি এখনো।
গন্ডূষে গন্ডূষে সব বিষ শুষে
যেদিন নীলকন্ঠ হয়ে যাব
গর্ভে এনো অমৃতের সন্তান
মোক্ষ মুক্তির তিথিতে পরমান্ন রেঁধো দেয়াসিনী।
যদি চরণামৃত চাও
উপুড় করে দেব অগ্যস্তের কমন্ডুল।
তীর বিদ্ধ বলাকার ঠোঁটে ঢেলে দিও
আজন্ম তৃষ্ণার সহস্রধারা।
তুমি ঈশ্বর খুঁজছ দেয়াসিনী?
যদি বিশুদ্ধ প্রেম চাও
তবে পেরেক বিদ্ধ করো!
লুম্বিনীর উদ্যানে দেখো
কিভাবে ক্রুসেড সেনার বুটে
পিষে যায় সদ্য ফোটা ঘাস শিশু!
কোপাক ওরা কোপাক
মৌলবাদের লাঙল।
তুমি কোপাইয়ের মাটিতে
ছড়িয়ে দাও বোধিবৃক্ষের পরাগরেণু।
কল্পতরু বনে মহাস্থবির জাতকের অপেক্ষায়
চার প্রহরের বুদ্ধপূর্ণিমা চাঁদ
তুমি কি এখনো ঘুমিয়ে দেয়াসিনী?
যদি সহমরণ চাও
তবে অপেক্ষা করো
মহাপরিনির্বাণের সময় এটা নয়।
তুমি আসবে বলেই
জতুগৃহের বদ্ধ কারাগারে
জেগে আছি আফ্রোদিতি হয়ে।
শীত ঘুম থেকে উঠে এসো
খান্ডবদাহের অগ্নিশলাকা নিয়ে,
দাবানল জ্বালো কলি সভ্যতায়।
বিষামৃতের আগুনে জন্ম নাও গোপা হয়ে
আমি নীল আকাশের তলে মগ্ন হই নির্বিকল্প সমাধিতে।
পরমান্ন নয়, শুধু বিষ দাও দেয়াসিনী!
শতভিষা
***
অবসন্ন ক্রিসমাসের গভীর রাতে
তারাখসা দেখেছে কেউ?
কবি এ রাতে সান্তার কাছে যান।
তার লাল ঝুলিতে ঢেলে দেন
স্বাতী নক্ষত্রের অপার্থিব আলোকবৃষ্টি।
কবির বিষণ্ণ আকাশ থেকে
ঝরে পড়ে বিরামহীন কবিতার মায়াপালক।
সান্তা দু'হাতে কুড়িয়ে নেন ফসলের ঘ্রাণ, বিরহের বাঁশি
আর এক অলৌকিক রাত।
শীতবস্ত্র খুলে নতজানু কবি
সবটুকু বিলিয়ে দেন বৃদ্ধের পাদদেশে।
হিমকুয়াশার রাতে সর্বস্ব খুইয়ে
যেভাবে নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে যায় পাতাঝরা অরণ্য,
সেভাবেই কবির বৃক্ষশরীর থেকে
একে একে খসে পড়ে ঐশ্বর্যের বল্কল।
চারপ্রহরের রাত ফুরোলে সর্বহারা কবি দেখেন
আকাশ জুড়ে সূর্যস্নাতা রমণীর বেশে
পুড়ছে তখনও শতভিষা।