রূপ-টান
— রাজর্ষি বর্ধন
একরাশ উত্তেজনা নিয়ে বান্ধবী তনিমাকে ফোনটা করেই বসল রায়া !আজকেই তো সেই দিন, তাই উত্তেজনা আসাটাই স্বাভাবিক !
“হ্যাঁ রে রায়া বল ?”
“কিরে ? ভুলে মেরে দিস নি তো ! আজকে যাবি বলছিলি !”
“না রে না ! আমার সুন্দরী বান্ধবীর আব্দার কি সহজে ভোলা যায় ! বিশেষ করে ও যখন পার্লারে যাবার বায়না করেছে ! দেখবি, যা টাচ-আপ দেবে, ভোল একেবারে পাল্টে যাবে ! ডট বিকেল পাঁচটায় আমার বাড়িতে চলে আসিস !”
আর পাঁচটা আধুনিকা, চাকুরিরতা গৃহবধূর মতো রায়া আর তনিমার ও রূপ-টানের প্রতি বিশেষ উদ্দীপনা থাকাটাই স্বাভাবিক। তারা মনে করে, শুধু নিজেকে সুন্দর এবং আকর্ষিত করাই নয়, কর্মক্ষেত্রে এবং সমাজে মেয়েদের ব্যাক্তিত্তব স্থাপনেও মেক-আপ বা রূপ-টানের বিশেষ ভুমিকা আছে ! তাই এই দুই বান্ধবী শহরের বিভিন্ন বিউটি-পার্লারে নিয়মিত যাতায়াত করে, এবং নতুন কোন পার্লারের সন্ধান পেলে একে ওপরকে জানিয়ে সেখানে ঢু মেরে আসতেও ভোলে না ! এই যেমন আজকেও চলেছে !
তনিমার বাড়ি থেকে মিনিট পনের দূরে সেই পার্লারটির অবস্থান । রায়া দেখল, সেটি এমন আহামরি কিছু নয়, দক্ষিন কলকাতার ছিমছাম, অভিজাত পাড়ায় কোন বাড়ির একতলায় এমন এক চিলতে পার্লার প্রচুর চোখে পড়ে ! তার আশা ঝুপ করে নিভে যায় ! বান্ধবীকে নিরাশ হতে দেখে তনিমা বলে, “মানছি পার্লারটা দেখতে তেমন আহামরি কিছু নয়, কিন্ত এদের মেক-আপ একদম সেই লেভেলের ! একটা ‘এক্স-ফ্যাক্টার’ আছে ! নইলে এই ছোট্ট পার্লারে এতো ভিড় হয় ! সব জিনিষ বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না !”
আশ্চর্যের বিষয় সেটাই, পার্লারটা যতটা ছিমছাম, তার তুলনায় কাস্টমার বেশি ! সেটাই রায়াকে অবাক করছিল। কিছু একটা ব্যাপার তো রয়েইছে !
প্রায় পৌনে দুঘণ্টা অপেক্ষার পর তাদের সুযোগ এলো ! পার্লারের প্রধান মেক-আপ আর্টিস্ট শ্রেয়সীর সাথে তনিমার আগে থেকে পরিচয় ছিল, এবার রায়ার সাথেও আলাপ হল । আলাপের সময়ই তনিমা বলল, “আপনাদের এখানকার ‘স্পেশালিটি’ পরখ করার জন্যই বান্ধবীকে নিয়ে এলাম ! আমি সিওর, প্রথমবার আমার মতোই ও চমকে যাবে !”
শ্রেয়সী হেসে বলল, “কে রাজিয়া ! ওর তো আজ সকাল থেকেই প্যাকড সিডিউল ছিল ! দেখি এই সিটিংটায় ওকে ‘রাজি’ করানো যায় কিনা !”
তনিমা জবাবে বলল, “তা তো হবেই ! ওর যা ডিমান্ড- সবাই এখন ওকে চায় ! সত্যি, ও আসাতে আপনার পার্লারের ভোল পাল্টে দিয়েছে !”
খানিকক্ষন পরেই পর্দা সরিয়ে একটা অল্পবয়সী, রোগা একটা মেয়ে ঢুকল, যার মুখটা ছিল কালো কাপড়ে ঢাকা, শুধু ঘোলাটে দুটো চোখ ছিল উন্মুক্ত ! শ্রেয়সী হেসে বলল, “এই হল রাজিয়া, আমার পার্লারের “ইউএসপি” ! কেন সেটা একটা সিটিং-এই বুঝতে পারবেন !”
কোন প্রশ্ন না করেই রায়া সিটিঙ্গে বসে গেলো। মেক-আপ করা সময়সাপেক্ষ ব্যপার, রায়ার মেক-আপ হতে এক ঘণ্টার মতো সময় লাগল। এই এক ঘণ্টায় রিজিয়াকে কোন টু শব্দ করতে শুনল না ! মেক-আপ এর পর ায়নায় নিজেকে দেখে রায়ার চোখ ধাধিয়ে গেলো ! নিজেকে সে চিনতেই পারছে না ! সুন্দরী রায়াকে যেন অপ্সরার মতো লাগছে ! কি চমৎকার হাতের কাজ রাজিয়া মেয়েটার, আচ্ছা-আচ্ছা আর্টিস্টকে পেছনে ফেলে দেবে !
মেক-আপ করে রায়া খুশিই ছিল, কিন্তু রাজিয়ার মধ্যে আড়ষ্ট ভাব দেখে ও কেমন অবাক হচ্ছিল ! এতো প্রশংসার পরও মেয়েটার এমন জড়সড় থাকাটা তাকে অস্বস্তিতে ফেলছিল, আর ওর ওই কাপড়ে ঢাকা মুখ দেখে ওর রাগই হচ্ছিল ! সে জানে, রাজিয়া যে সম্প্রদায়ের মেয়ে, সেটারই এক সামাজিক ব্যাধি এই জিনিষ, আজকের দিনে দাড়িয়েও মেয়েদেরকে পর্দার আড়ালে রাখা ! রায়া বিরক্ত হচ্ছিল, সে রাজিয়ার মুখ দেখার ছুতোতেই বলল, “যার হাতের কাজ এতো সুন্দর, না জানি তাকে দেখতেও কতটা সুন্দর হবে !”
কিন্তু অন্যরকম একটা ব্যপার ঘটল। ঘরে সবার মুখ থমথমে হয়ে উঠল ! রাজিয়ার আস্তে আস্তে তার মুখের কাপড়টা সরাল, যা দেখে রায়া চিৎকার করে দু’চোখে ঢাকা দিল ! রাজিয়ার মুখ, মুখ না বলে মাংসের দলা বলা ভালো, তা যে এতো বীভৎস হবে তা ভাবেনি !
ক্রমে সে জানতে পারল, রাজিয়াকে দেখতে সত্যিই সুন্দর ছিল, নিজেকে সে সুন্দর রাখত, নিয়মিত রূপটান করত। কিন্তু তার মুখের শেষ রূপ-টানটা দিয়েছিল তারই প্রেমিক, প্রেমের প্রত্যাখানের “উপহার” স্বরূপ মুখে অ্যাসিড ছুড়ে......